ক্রসফায়ার আইনসিদ্ধ? নিহতদের তদন্ত রিপোর্ট কই
সম্প্রতি র্যাবের মহাপরিচালক ক্রসফায়ারে মৃত্যুর প্রতিটি ঘটনাকে ‘আইনসিদ্ধ’ বলে মন্তব্য করেছেন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে আইনসিদ্ধ হিসাবে চিহ্নিত করায় তাত্ক্ষণিকভাবে উদ্বেগ ও বিস্ময় প্রকাশ করেছে দেশের সচেতন মহল।
এরই মধ্যে বিশিষ্টজনরা তার এ মন্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন এবং প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করার দাবি জানিয়েছেন। বিচারবহির্ভূত মৃত্যু কী করে আইনি কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত হয়, সে প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে। উল্লেখ্য, ক্রসফায়ারের শুরু থেকেই বিষয়টি বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। একে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে অভিহিত করে আসছিল মানবাধিকার সংগঠনগুলো। আইনি বৈধতা নিয়েও তুমুল বিতর্কের শুরু তখন থেকেই। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল তখন এর বিরোধিতা করলেও সেই পুরনো ঘাটের মাঝি সেজেই বসেছে এবং যথারীতি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে নেতিবাচক সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু এসব সমালোচনাকে এখন পর্যন্ত আমলে আনেনি। বরং এর সপক্ষে নানা ধরনের যুক্তি খাড়া করছে। এতে প্রমাণিত হয়েছে দেশে ক্রমবর্ধমান অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সরকারের নেই। কেননা, কোনো সমাজে যখন বিচার ছাড়াই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হত্যাকাণ্ড ঘটাতে হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই আঁচ করা যায় অপরাধ বেড়েছে এবং আইন ও আইনি প্রক্রিয়ায় তা রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় ক্রসফায়ারকে আইনসিদ্ধ বলা ছাড়া সরকারপক্ষের আর কোনো রাহা নেই। র্যাব মহাপরিচালকের কথা থেকে তা সম্পূর্ণ স্পষ্ট হয়েছে। গত ২৮ মার্চ র্যাবের ষষ্ঠ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ক্রসফায়ারে যেসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, তার প্রতিটিই আইনসিদ্ধ, কোনোটিই আইনবহির্ভূত নয়। প্রতিটি ঘটনার বেলায়ই আইনানুগ তদন্ত হয়েছে বলেও দাবি করেছেন তিনি। তিনি এও বলেছেন, সবকিছু সম্পন্ন হয়েছে আইনের কাঠামোতেই। তার এ মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, আইনের কাঠামো আর প্রচলিত বিচারব্যবস্থা দুটি ভিন্ন বিষয়। বিচারবহির্ভূত হলেও এসব হত্যাকাণ্ড সিদ্ধ।এদিকে দেশের বিশিষ্টজনরা র্যাব মহাপরিচালকের মন্তব্য সম্পর্কে বলেছেন, নিজেদের কাজকে নিজেরা আইনসিদ্ধ বললে তো হবে না। দেশের অন্যান্য মানুষ কী বলছেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তারা বলেছেন, নির্বাচিত সরকারের আমলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলতে পারে না। বিচারিক প্রক্রিয়ার পাশাপাশি বিনাবিচারে হত্যাকাণ্ড গণতান্ত্রিক সমাজে অগ্রহণযোগ্য।
স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, ক্রসফায়ারে মৃত্যুর ঘটনায় দেশের আইনশৃঙ্খলার আদৌ কোনো উন্নতি হয়েছে কিনা। তেমন কোনো আলামত আদতেই দেখা যাচ্ছে না। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খুন-খারাবি বেড়েছে, নৃশংসতা বেড়েছে। র্যাব-পুলিশ যাদের মেরেছে, তাদের পরিবারের পক্ষ থেকেও আপত্তি উঠছে; কয়েকটি ক্রসফায়ার নিয়ে মামলাও হয়েছে। অথচ নিহতের বিরুদ্ধে কোনো ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই। এ থেকে স্বভাবতই মানবাধিকারের প্রশ্নটি উচ্চকিত হয়ে ওঠে। অপরাধী গ্রেফতার হবে, আদালতে তার বিচার হবে, শাস্তি হবে। অপরাধ দমনের জন্য এ ব্যবস্থার কোনো বিকল্প গণতান্ত্রিক সমাজে নেই। র্যাব মহাপরিচালক প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের আগে আইনি তদন্তের যে কথা বলেছেন, তাতে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে বলেও মনে করছেন অনেকে। দেশবাসীর সামনে এই স্বচ্ছতা প্রমাণের জন্য ক্রসফায়ারে নিহতদের সম্পর্কে সব তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা অবশ্য প্রয়োজন। ক্রসফায়ারে মৃত্যুর ঘটনা যদি বৈধই হবে, তাহলে গত ছয় বছরে যে ৬২২ জন মারা গেছে, তাদের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করাও বৈধতার আওতায় পড়ে। আর তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ পেলে স্বাভাবিকভাবেই প্রমাণ হবে ক্রসফায়ার বৈধ, না অবৈধ। কাজেই এসব হত্যাকাণ্ডের বৈধতা দাবির বিষয় নয়, প্রমাণের বিষয়। এজন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করার দাবিও করেছেন অনেকে। কমিটিটি গঠন করতে হবে বিচারপতি এবং মানবাধিকার কর্মীদের নিয়ে। কারণ হত্যাকাণ্ডের বৈধতার প্রশ্নটি প্রচলিত বিচারব্যবস্থা এবং মানবাধিকারের সঙ্গে সম্পর্কিত। গণতান্ত্রিক দেশে বিচারের বাইরে হত্যাকাণ্ড র্যাব মহাপরিচালকের ভাষায় কেন ‘আইনসিদ্ধ’, তা প্রমাণের দায় সরকারকেই নিতে হবে। নইলে এ ধরনের মন্তব্য আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পক্ষে সাফাই গাওয়ার সমতুল্য বলে জনমনে সংশয়ের সৃষ্টি করতেই পারে। সরকার কেন সে সুযোগ দেবে? অথচ দিচ্ছে। গত ২২ মার্চ ঢাকার ধানমন্ডিতে দৃক গ্যালারিতে ক্রসফায়ার সংক্রান্ত একটি ব্যতিক্রমী আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানটি ভণ্ডুল করে দেয়া হয় পুলিশ পাঠিয়ে। এ ধরনের তত্পরতা কোনোক্রমেই কোনো স্বচ্ছতার পরিচায়ক নয়। এ ঘটনার ক’দিন পরই র্যাব মহাপরিচালক ক্রসফায়ার সম্পর্কে যা বললেন, তাতে স্বচ্ছতার ওপর যেন আরেকটি প্রলেপ বসে গেল। কিন্তু একথা এখন আর ব্যাখ্যা করে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ক্রসফায়ারের মতো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কখনও অপরাধ দমনে কার্যকর ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ হতে পারে না। এই বাধা অব্যাহত থাকলে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থাসহ পুরো বিচার ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ বা এনকাউন্টার ইত্যাদি যে কোনো নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার কোনো বিকল্প নেই। গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে জনগণ এটাই প্রত্যাশা করে।
No comments