মুক্তিযুদ্ধ পদযাত্রা
বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি আদায় ও গণহত্যা বন্ধে জনমত তৈরির উদ্দেশ্যে ৩৮ জনের একটি দল ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’ করেছিল। এত দিন যা ছিল অজানা, বিস্মৃতপ্রায়।
বিজয়ের মাসে মুক্তিযুদ্ধের সেই গৌরবগাথা জানাচ্ছেন শামীম আমিনুর রহমান
সময়টা ২০০৯ সালের ২২ আগস্ট। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার শাহবাজপুর উচ্চবিদ্যালয়। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ভ্রাম্যমাণ জাদুঘরের প্রদর্শনী চলছে। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য দিলীপ নাগও প্রদর্শনী দেখছিলেন। তিনি আবেগান্বিত হয়ে প্রদর্শনী সমন্বয়কারী রণজিৎ কুমারকে বললেন, মুক্তিযুদ্ধে তিনিও জড়িয়ে পড়েছিলেন। জানালেন একাত্তরের প্রায় অজানা এক পদযাত্রার কথা। দিলীপ নাগ বললেন, একাত্তরে বিশ্ববিবেক জাগরণ পদযাত্রাতে তিনিও অংশগ্রহণ করেছিলেন। রণজিৎ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সদস্যসচিব মফিদুল হককে ফোনে বিষয়টি জানালেন। তিনি দিলীপ নাগের সঙ্গে আলাপ করে তথ্য সংগ্রহের নির্দেশনা দিলেন। আমরা জানলাম বিস্মৃতপ্রায় এক অজানা বিশ্ববিবেক জাগরণ পদযাত্রার কথা।
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ড শুরু হওয়ার পর থেকে এ দেশের অগণিত অসহায় আশ্রয়হীন মানুষ ভারতে পালিয়ে যেতে থাকল। সীমান্ত অতিক্রম করে লাখ লাখ শরণার্থী উপচে পড়ল ভারতের নানা জায়গায়। যা ভারত সরকারকে এক কঠিন অবস্থার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
এমনই এক বিপর্যয়ের সময় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য পালিয়ে আসা অসংখ্য মানুষের মধ্যে যশোরের মোহাম্মদ আবদুল খালেক, দুলালচন্দ্র দত্ত, খুলনার আক্রামুল ইসলামসহ এই পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারী সবাই ভারতে হাজির হলেন। সীমান্ত এলাকায় যেসব শরণার্থী আসতে থাকে তাদের সেবা ও সাহায্যার্থে গড়ে ওঠে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, নাম ‘ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোর’। তার বেইজ ডাইরেক্টর হয়ে কাজ করছিলেন যশোরেরমোখলেছুর রহমান। তিনি আবদুল খালেকের বাড়ি যশোরে জেনে তাঁকে এই সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করার অনুরোধ করলেন। খালেকের মতো দুলালচন্দ্র দত্তসহ অনেকেই সেখানে শরণার্থীদের নানা ধরণের সেবায় এগিয়ে এসেছিলেন। এর মধ্যে একদিন মোহাম্মদ আবদুল খালেকসহ কয়েকজনকে ডেকে পাঠানো হলো দপ্তরে। সেখানে গিয়ে তাঁরা দেখলেন ‘অখিল ভারত শান্তি সেনামন্ডল’ নামে একটি সংস্থার প্রধান জয়প্রকাশ নারায়ণ, অক্সফাম ও বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারের দুজন প্রতিনিধি তাঁদের সঙ্গে কথা বলবেন। তাঁরা প্রস্তাব দিলেন বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে একটি পদযাত্রার আয়োজন করা যায় কি না। কলকাতায় মোহাম্মদ আবদুল খালেকের নেতৃত্বে ভলান্টারি সার্ভিস কোরের আরও কয়েকজন সদস্য এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন যে, যেহেতু ভারতের সাহায্য ছাড়া তাঁরা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাস্তব কোনো প্রতিরোধ গড়তে পারবেন না, তাই তাঁদের উচিত হবে এই পদযাত্রার মাধ্যমে ভারতীয় নাগরিকদের কাছে বাংলাদেশের ভেতরে যে ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞ চলছে তা তুলে ধরা। ঠিক হলো পদযাত্রার মাধ্যমে কলকাতা থেকে দিল্লিতে পৌঁছানো, ভারতীয় সরকারের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায় এবং সেখানে অবস্থানরত বিভিন্ন দূতাবাসে স্মারকলিপি ও বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা তুলে ধরে বাংলাদেশে যে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চলছে তা বন্ধ করতে চাপ প্রয়োগ করা। ৩৮ জনকে নিয়ে দলটি গড়ে উঠল। এঁরা ১৪ অক্টোবর কলকাতা থেকে ট্রেনযোগে মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে উপস্থিত হলো। সেখানে বিখ্যাত পলাশী অবস্থিত, যার মাটি ছুঁয়ে শপথ নিলেন ৩৪ জন মুক্তিপাগল বাঙালি। পরবর্তী সময়ে আরও চারজন আগরতলা থেকে এই দলে যুক্ত হলেন। তাঁদের পদযাত্রা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। বহরমপুরের একটি স্কুলে তাঁরা রাত্রিযাপন করেন। পরের দিন দেখা গেল হাজার হাজার মানুষ সেখানে জড়ো হয়েছে। এঁদের মধ্যে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন, কংগ্রেস নেত্রী আভা মাইতি ও অখিল ভারত শান্তি সেনামন্ডলের সাধারণ সম্পাদক নারায়ণ দেশাইসহ অনেকে। কেউ কেউ হাত কেটে রক্ত দিয়ে এই অভিযাত্রার বীরদের কপালে রক্ততিলক পরিয়ে দিল। শুরু হলো যাত্রা, পথের মাঝে যেখানেই একটি বাজার পেয়েছিল, সেখানেই এই দলটি সভা করে সেখানকার জনগণকে জানিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশে চলা পাকিস্তানিদের গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের কথা। মতবিনিময় করে সেই জড়ো হওয়া জনগণকে জানানো হতো এই যাত্রার উদ্দেশ্য, তাদের বোঝানো হতো কেন তারা দেশের জন্য যুদ্ধ করছে এবং এই যুদ্ধে ভারতীয় জনগণের সমর্থন তাদের দরকার। চলার পথে সেই সব সাধারণ মানুষ হয়েছিল সমব্যথী, টাকা, খাবার এমনকি তাদের গায়ের চাদর দিয়ে এই মুক্তিপাগল দলটিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল পথের ধারের সাধারণ সব মানুষ। এভাবে প্রতিদিন এই দলটি পায়ে হেঁটে ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে লাগল।
এই দলটি পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে যাওয়ার আগে একটি সভায় খুলনার আক্রামুল ইসলাম সিকদার বক্তৃতা করেছিলেন।
এরপর বিহারে গিয়ে এই দলটি একটি ভিন্ন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিল। বিহারের জনগণ তাদের নানা প্রশ্ন করতে শুরু করল। কেন বাঙালিরা পাকিস্তান ভাঙছে কিংবা মুসলমানদের ভূমি নষ্ট করছে। তারা মনে করত ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তান ভাঙছেন। বিহারের এই জনগণকে বোঝানো হলো যে বাংলাদেশের মানুষ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় করতে গিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিহিংসার কবলে পড়েছে। তাই বাঙালিদের স্বাধীনতাযুদ্ধ ছাড়া আর কোনো পথই খোলা নেই। তাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দী করা হয়েছে। টিক্কা খান হুমকি দিয়েছেন ‘পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ নয়, শুধু মাটি চাই।’ বিহার প্রদেশের শেষ প্রান্ত যখন এই দলটি অতিক্রম করছিল, তেমনি এক মুহূর্তে ৬ ডিসেম্বর তারা পথেই জানতে পারে যে ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। দলের উপনেতা খুলনার আক্রামুল ইসলামের ভাষায় সম্ভবত জায়গাটির নাম ‘কুদরা’। সেখানে আমরা পৌঁছুলে দেখি একজন উত্তেজিত বৃদ্ধ দুজন লোকের সহায়তা নিয়ে আমাদের যাত্রাপথে এগিয়ে আসছেন। আমি পদযাত্রার অগ্রভাগে ছিলাম। সেই বৃদ্ধ লোকটি আমাকে বললেন, ‘বেটা, তোমাদের দেশকে ভারত স্বীকৃতি দিয়েছে।’ তাঁর কথা শুনেই আমার মনে কী ঘটল জানি না, আমি উঁচুতে লাফ দিয়ে চিৎকার করে বললাম—জয় বাংলা, জয় বাংলা। এর পরও দলটি তাদের পদযাত্রা অব্যাহত রাখে। উল্লেখ্য, এই দলটির সঙ্গে অখিল ভারত শান্তি সেনামন্ডলের একজন প্রতিনিধি তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক থেকে তাদের গাইড হিসেবে পথ দেখাতেন, এই গাইড স্থানীয় জনগণের কাছে দোভাষীর মতো এই দলের বিভিন্ন বক্তব্য তুলে ধরতেন।
এরপর উত্তর প্রদেশের বিখ্যাত কানপুরে দলটি পৌঁছাল। আবদুল খালেক বললেন, ‘সেখানে আমাদের বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। বড় সমাবেশে আমাদের জাতীয় পতাকা উড়িয়ে আমরা গেয়েছিলাম—আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।’ এরপর দলটি এগিয়ে যেতে থাকে লক্ষ্নৌর দিকে। পথে ১৬ ডিসেম্বর দলটি রেডিও ও লোকজনের কাছে জানতে পারল বাংলাদেশের বিজয় লাভের কথা। লক্ষ্নৌ পৌঁছানোর পর তাদের দেওয়া হলো উষ্ণ সংবর্ধনা। প্রশাসন থেকে এই ৩৮ জন মুক্তিসেনাকে দেওয়া হয়েছিল ‘গার্ড অব অনার’। বিজয়ের পর কী হলো তা-ই শোনা যাক এই দলের প্রধান আবদুল খালেকের কথায়। ‘লক্ষ্নৌ যাওয়ার পর যত দূর মনে পড়ে দিনটি ছিল ১৮ ডিসেম্বর। সেখানে লক্ষ্নৌবাসীও বিজয় উৎসব করছে। আমাদের বিজয় আনন্দ ও পদযাত্রা আর ওদের বিজয় উৎসব একসঙ্গে মিশে গিয়ে একাকার হয়ে গেল। আমরা বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে পুরো শহর প্রদক্ষিণ করেছিলাম। মিছিল শেষে আমরা সেখানকার গণ্যমান্য ব্যক্তি ও অখিল ভারত শান্তি সেনা মন্ডলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সভা করি। তাঁরা আমাদের কাছে জানতে চাইলেন যে আমরা কি এখন আমাদের স্বাধীন দেশে ফিরে যেতে চাই, নাকি আমাদের শেষ গন্তব্য দিল্লিতে যেতে চাই, যা ছিল আমাদের এই যাত্রার একটি লক্ষ্য। তখন আমরা বললাম, আমাদের উদ্দেশ্য ছিল ভারতের কাছ থেকে আমাদের দেশের স্বীকৃতি আদায় এবং আমাদের দেশে গণহত্যা বন্ধ করার জন্য জনমত তৈরি। দেশ স্বাধীন হওয়ায় দুটোই আমরা পেয়েছি, তাই দিল্লি যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমরা দেশে ফিরে যেতে চাই, এরপর আমরা ট্রেনে করে লক্ষ্মৌ থেকে বাংলাদেশের সীমান্তে পৌঁছে যাই এবং বাংলাদেশে প্রবেশ করি।
দেশে ফিরে আসার পর সেই ৩৮ জন সম্পর্কে কোনো খবর আর কেউ রাখেনি। দীর্ঘদিন পর হঠাৎ করেই শাহবাজপুর উচ্চবিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের ভ্রাম্যমাণ জাদুঘরে একজন দর্শক প্রদর্শনীর সমন্বয়কারীকে বললেন, তিনি বিশ্ববিবেক জাগরণ পদযাত্রা ১৯৭১-এর একজন সদস্য, নাম তাঁর দিলীপ নাগ। তিনি শোনান বিস্মৃত সেই পদযাত্রার কথা। ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয় বিজয়ের আর এক গৌরবগাথা, যা আমাদের অজানাই ছিল। এরপর খুঁজে ফেরা হয় সেই ৩৮ জন মুক্তিসেনাকে, একে একে ৩৬ জন সম্পর্কে খোঁজ পাওয়া যায়, যার চারজন স্বাধীনতার পরপর ভারতে চলে গেছেন। কিন্তু অনেক খোঁজার পরও হদিস পাওয়া যায়নি পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশীর আবু বকর এবং মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার কুলচরির ক্ষিতিশচন্দ্র মণ্ডলকে। অনেক চেষ্টার পরও আজ অবধি তাঁদের সম্পর্কে কেউ কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
সময়টা ২০০৯ সালের ২২ আগস্ট। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার শাহবাজপুর উচ্চবিদ্যালয়। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ভ্রাম্যমাণ জাদুঘরের প্রদর্শনী চলছে। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য দিলীপ নাগও প্রদর্শনী দেখছিলেন। তিনি আবেগান্বিত হয়ে প্রদর্শনী সমন্বয়কারী রণজিৎ কুমারকে বললেন, মুক্তিযুদ্ধে তিনিও জড়িয়ে পড়েছিলেন। জানালেন একাত্তরের প্রায় অজানা এক পদযাত্রার কথা। দিলীপ নাগ বললেন, একাত্তরে বিশ্ববিবেক জাগরণ পদযাত্রাতে তিনিও অংশগ্রহণ করেছিলেন। রণজিৎ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সদস্যসচিব মফিদুল হককে ফোনে বিষয়টি জানালেন। তিনি দিলীপ নাগের সঙ্গে আলাপ করে তথ্য সংগ্রহের নির্দেশনা দিলেন। আমরা জানলাম বিস্মৃতপ্রায় এক অজানা বিশ্ববিবেক জাগরণ পদযাত্রার কথা।
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ড শুরু হওয়ার পর থেকে এ দেশের অগণিত অসহায় আশ্রয়হীন মানুষ ভারতে পালিয়ে যেতে থাকল। সীমান্ত অতিক্রম করে লাখ লাখ শরণার্থী উপচে পড়ল ভারতের নানা জায়গায়। যা ভারত সরকারকে এক কঠিন অবস্থার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
এমনই এক বিপর্যয়ের সময় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য পালিয়ে আসা অসংখ্য মানুষের মধ্যে যশোরের মোহাম্মদ আবদুল খালেক, দুলালচন্দ্র দত্ত, খুলনার আক্রামুল ইসলামসহ এই পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারী সবাই ভারতে হাজির হলেন। সীমান্ত এলাকায় যেসব শরণার্থী আসতে থাকে তাদের সেবা ও সাহায্যার্থে গড়ে ওঠে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, নাম ‘ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোর’। তার বেইজ ডাইরেক্টর হয়ে কাজ করছিলেন যশোরেরমোখলেছুর রহমান। তিনি আবদুল খালেকের বাড়ি যশোরে জেনে তাঁকে এই সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করার অনুরোধ করলেন। খালেকের মতো দুলালচন্দ্র দত্তসহ অনেকেই সেখানে শরণার্থীদের নানা ধরণের সেবায় এগিয়ে এসেছিলেন। এর মধ্যে একদিন মোহাম্মদ আবদুল খালেকসহ কয়েকজনকে ডেকে পাঠানো হলো দপ্তরে। সেখানে গিয়ে তাঁরা দেখলেন ‘অখিল ভারত শান্তি সেনামন্ডল’ নামে একটি সংস্থার প্রধান জয়প্রকাশ নারায়ণ, অক্সফাম ও বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারের দুজন প্রতিনিধি তাঁদের সঙ্গে কথা বলবেন। তাঁরা প্রস্তাব দিলেন বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে একটি পদযাত্রার আয়োজন করা যায় কি না। কলকাতায় মোহাম্মদ আবদুল খালেকের নেতৃত্বে ভলান্টারি সার্ভিস কোরের আরও কয়েকজন সদস্য এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন যে, যেহেতু ভারতের সাহায্য ছাড়া তাঁরা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাস্তব কোনো প্রতিরোধ গড়তে পারবেন না, তাই তাঁদের উচিত হবে এই পদযাত্রার মাধ্যমে ভারতীয় নাগরিকদের কাছে বাংলাদেশের ভেতরে যে ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞ চলছে তা তুলে ধরা। ঠিক হলো পদযাত্রার মাধ্যমে কলকাতা থেকে দিল্লিতে পৌঁছানো, ভারতীয় সরকারের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায় এবং সেখানে অবস্থানরত বিভিন্ন দূতাবাসে স্মারকলিপি ও বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা তুলে ধরে বাংলাদেশে যে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চলছে তা বন্ধ করতে চাপ প্রয়োগ করা। ৩৮ জনকে নিয়ে দলটি গড়ে উঠল। এঁরা ১৪ অক্টোবর কলকাতা থেকে ট্রেনযোগে মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে উপস্থিত হলো। সেখানে বিখ্যাত পলাশী অবস্থিত, যার মাটি ছুঁয়ে শপথ নিলেন ৩৪ জন মুক্তিপাগল বাঙালি। পরবর্তী সময়ে আরও চারজন আগরতলা থেকে এই দলে যুক্ত হলেন। তাঁদের পদযাত্রা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। বহরমপুরের একটি স্কুলে তাঁরা রাত্রিযাপন করেন। পরের দিন দেখা গেল হাজার হাজার মানুষ সেখানে জড়ো হয়েছে। এঁদের মধ্যে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন, কংগ্রেস নেত্রী আভা মাইতি ও অখিল ভারত শান্তি সেনামন্ডলের সাধারণ সম্পাদক নারায়ণ দেশাইসহ অনেকে। কেউ কেউ হাত কেটে রক্ত দিয়ে এই অভিযাত্রার বীরদের কপালে রক্ততিলক পরিয়ে দিল। শুরু হলো যাত্রা, পথের মাঝে যেখানেই একটি বাজার পেয়েছিল, সেখানেই এই দলটি সভা করে সেখানকার জনগণকে জানিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশে চলা পাকিস্তানিদের গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের কথা। মতবিনিময় করে সেই জড়ো হওয়া জনগণকে জানানো হতো এই যাত্রার উদ্দেশ্য, তাদের বোঝানো হতো কেন তারা দেশের জন্য যুদ্ধ করছে এবং এই যুদ্ধে ভারতীয় জনগণের সমর্থন তাদের দরকার। চলার পথে সেই সব সাধারণ মানুষ হয়েছিল সমব্যথী, টাকা, খাবার এমনকি তাদের গায়ের চাদর দিয়ে এই মুক্তিপাগল দলটিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল পথের ধারের সাধারণ সব মানুষ। এভাবে প্রতিদিন এই দলটি পায়ে হেঁটে ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে লাগল।
এই দলটি পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে যাওয়ার আগে একটি সভায় খুলনার আক্রামুল ইসলাম সিকদার বক্তৃতা করেছিলেন।
এরপর বিহারে গিয়ে এই দলটি একটি ভিন্ন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিল। বিহারের জনগণ তাদের নানা প্রশ্ন করতে শুরু করল। কেন বাঙালিরা পাকিস্তান ভাঙছে কিংবা মুসলমানদের ভূমি নষ্ট করছে। তারা মনে করত ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তান ভাঙছেন। বিহারের এই জনগণকে বোঝানো হলো যে বাংলাদেশের মানুষ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় করতে গিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিহিংসার কবলে পড়েছে। তাই বাঙালিদের স্বাধীনতাযুদ্ধ ছাড়া আর কোনো পথই খোলা নেই। তাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দী করা হয়েছে। টিক্কা খান হুমকি দিয়েছেন ‘পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ নয়, শুধু মাটি চাই।’ বিহার প্রদেশের শেষ প্রান্ত যখন এই দলটি অতিক্রম করছিল, তেমনি এক মুহূর্তে ৬ ডিসেম্বর তারা পথেই জানতে পারে যে ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। দলের উপনেতা খুলনার আক্রামুল ইসলামের ভাষায় সম্ভবত জায়গাটির নাম ‘কুদরা’। সেখানে আমরা পৌঁছুলে দেখি একজন উত্তেজিত বৃদ্ধ দুজন লোকের সহায়তা নিয়ে আমাদের যাত্রাপথে এগিয়ে আসছেন। আমি পদযাত্রার অগ্রভাগে ছিলাম। সেই বৃদ্ধ লোকটি আমাকে বললেন, ‘বেটা, তোমাদের দেশকে ভারত স্বীকৃতি দিয়েছে।’ তাঁর কথা শুনেই আমার মনে কী ঘটল জানি না, আমি উঁচুতে লাফ দিয়ে চিৎকার করে বললাম—জয় বাংলা, জয় বাংলা। এর পরও দলটি তাদের পদযাত্রা অব্যাহত রাখে। উল্লেখ্য, এই দলটির সঙ্গে অখিল ভারত শান্তি সেনামন্ডলের একজন প্রতিনিধি তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক থেকে তাদের গাইড হিসেবে পথ দেখাতেন, এই গাইড স্থানীয় জনগণের কাছে দোভাষীর মতো এই দলের বিভিন্ন বক্তব্য তুলে ধরতেন।
এরপর উত্তর প্রদেশের বিখ্যাত কানপুরে দলটি পৌঁছাল। আবদুল খালেক বললেন, ‘সেখানে আমাদের বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। বড় সমাবেশে আমাদের জাতীয় পতাকা উড়িয়ে আমরা গেয়েছিলাম—আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।’ এরপর দলটি এগিয়ে যেতে থাকে লক্ষ্নৌর দিকে। পথে ১৬ ডিসেম্বর দলটি রেডিও ও লোকজনের কাছে জানতে পারল বাংলাদেশের বিজয় লাভের কথা। লক্ষ্নৌ পৌঁছানোর পর তাদের দেওয়া হলো উষ্ণ সংবর্ধনা। প্রশাসন থেকে এই ৩৮ জন মুক্তিসেনাকে দেওয়া হয়েছিল ‘গার্ড অব অনার’। বিজয়ের পর কী হলো তা-ই শোনা যাক এই দলের প্রধান আবদুল খালেকের কথায়। ‘লক্ষ্নৌ যাওয়ার পর যত দূর মনে পড়ে দিনটি ছিল ১৮ ডিসেম্বর। সেখানে লক্ষ্নৌবাসীও বিজয় উৎসব করছে। আমাদের বিজয় আনন্দ ও পদযাত্রা আর ওদের বিজয় উৎসব একসঙ্গে মিশে গিয়ে একাকার হয়ে গেল। আমরা বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে পুরো শহর প্রদক্ষিণ করেছিলাম। মিছিল শেষে আমরা সেখানকার গণ্যমান্য ব্যক্তি ও অখিল ভারত শান্তি সেনা মন্ডলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সভা করি। তাঁরা আমাদের কাছে জানতে চাইলেন যে আমরা কি এখন আমাদের স্বাধীন দেশে ফিরে যেতে চাই, নাকি আমাদের শেষ গন্তব্য দিল্লিতে যেতে চাই, যা ছিল আমাদের এই যাত্রার একটি লক্ষ্য। তখন আমরা বললাম, আমাদের উদ্দেশ্য ছিল ভারতের কাছ থেকে আমাদের দেশের স্বীকৃতি আদায় এবং আমাদের দেশে গণহত্যা বন্ধ করার জন্য জনমত তৈরি। দেশ স্বাধীন হওয়ায় দুটোই আমরা পেয়েছি, তাই দিল্লি যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমরা দেশে ফিরে যেতে চাই, এরপর আমরা ট্রেনে করে লক্ষ্মৌ থেকে বাংলাদেশের সীমান্তে পৌঁছে যাই এবং বাংলাদেশে প্রবেশ করি।
দেশে ফিরে আসার পর সেই ৩৮ জন সম্পর্কে কোনো খবর আর কেউ রাখেনি। দীর্ঘদিন পর হঠাৎ করেই শাহবাজপুর উচ্চবিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের ভ্রাম্যমাণ জাদুঘরে একজন দর্শক প্রদর্শনীর সমন্বয়কারীকে বললেন, তিনি বিশ্ববিবেক জাগরণ পদযাত্রা ১৯৭১-এর একজন সদস্য, নাম তাঁর দিলীপ নাগ। তিনি শোনান বিস্মৃত সেই পদযাত্রার কথা। ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয় বিজয়ের আর এক গৌরবগাথা, যা আমাদের অজানাই ছিল। এরপর খুঁজে ফেরা হয় সেই ৩৮ জন মুক্তিসেনাকে, একে একে ৩৬ জন সম্পর্কে খোঁজ পাওয়া যায়, যার চারজন স্বাধীনতার পরপর ভারতে চলে গেছেন। কিন্তু অনেক খোঁজার পরও হদিস পাওয়া যায়নি পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশীর আবু বকর এবং মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার কুলচরির ক্ষিতিশচন্দ্র মণ্ডলকে। অনেক চেষ্টার পরও আজ অবধি তাঁদের সম্পর্কে কেউ কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
No comments