রুশ-মার্কিন পারমাণবিক অস্ত্র হ্রাসকরণ চুক্তি by এবনে গোলাম সামাদ
২৬ মার্চ, ২০১০ রুশ-মার্কিন চুক্তি সমঝোতা হয়েছে। সমঝোতা হয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র হ্রাসের। উভয় পক্ষ রাজি হয়েছে তারা পারমাণবিক অস্ত্র বহনকারী ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা হ্রাস করবে। এই হ্রাসের পরিমাণ হবে বর্তমানে তাদের প্রত্যেকের হাতে যে সংখ্যক পারমাণবিক অস্ত্র আছে তার প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ।
অর্থাত্ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া উভয়ই যেন চাচ্ছে তাদের ওপর ক্ষেপণাস্ত্রের সাহায্যে হামলার সম্ভাবনা কমাতে। রাশিয়ার হাতে পারমাণবিক অস্ত্র থাকার অর্থই হবে না তার দ্বারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আক্রান্ত হওয়া। একইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র থাকার অর্থ দাঁড়াবে না তার দ্বারা রাশিয়া আক্রান্ত হওয়া। কারণ, উভয় পক্ষই সম্মত হয়েছে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা কমাতে। খবরে প্রকাশ, পৃথিবীতে এখন যে পরিমাণ পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে তার শতকরা ৯০ ভাগের অধিকারী হলো রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিলিতভাবে। আর মাত্র শতকরা ১০ ভাগ আছে অন্যান্য রাষ্ট্রের হাতে। অর্থাত্ রাশিয়া এবং আমেরিকা পৃথিবীকে ঠেলে দিতে পারে প্রলয়ঙ্করী যুদ্ধের মধ্যে, যদি তারা সেটা চায়। সেই সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। তবে বর্তমানে চুক্তি হচ্ছে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কতকটা আপসরফার মনোভাব নিয়ে। তারা চাচ্ছে না একে অপরের দ্বারা আক্রান্ত হতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি সহ্য করতে হয়েছিল প্রধানত রাশিয়াকে। তার অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে যে বিপুল পরিমাণ পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার গড়ে তুলতে পেরেছে, তার সম্পর্কে জেনে বিস্মিত হতে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় তার হাতে পারমাণবিক অস্ত্র কম নেই, বরং সংখ্যার দিক থেকে আছে কিছু বেশি। রাশিয়া এখনও বলতে গেলে বিশ্বের প্রধান পারমাণবিক অস্ত্রধর দেশ। রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই চাচ্ছে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশ যাদের পারমাণবিক অস্ত্র নেই, তারা যেন পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হতে না পারে। এদিক থেকে মার্কিন মনোভাব হয়ে উঠেছে একই রকম। বর্তমান চুক্তি হতে পারছে এই মনোভাবের ঐক্যের কারণে। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য দেশ, রুশ-মার্কিন প্রচেষ্টার ফলে পারমাণবিক অস্ত্র না বানিয়ে চুপ করে থাকবে এমন মনে হচ্ছে না। উত্তর কোরিয়া এরই মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র বানিয়ে ফেলেছে। ভারত-পাকিস্তানের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র আছে। পারমাণবিক অস্ত্র আছে চীন, ইসরাইল, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের হাতে। খবরে প্রকাশ, আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত প্রয়োজনে বছরে কম করে ২০০ পরমাণু বোমা বানাতে সক্ষম। তাই বলতে হয়, রুশ-মার্কিন চুক্তির ফলে বিশ্ব ঠিক এড়াতে পারছে না পারমাণবিক অস্ত্রের ধ্বংসকারিতার ঝুঁকি। যদিও প্রচার করা হচ্ছে, রুশ-মার্কিন প্রীতি পৃথিবীতে আনতে চাচ্ছে শান্তির পরিবেশ। কিন্তু বাস্তবে তা হতে যাচ্ছে রুশ-মার্কিন স্বার্থে একটা বিশেষ সমঝোতা।মার্কিন সমরবিদরা বলছেন পুরনো ধাঁচের ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করে নতুন ধাঁচের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের কথা। যা সংখ্যায় কম হলেও হবে আগের তুলনায় অনেক কার্যকরী। সম্ভবত রাশিয়াও নিতে যাচ্ছে একই রকম উদ্যোগ। কারণ এই উভয় রাষ্ট্রই বিপুল অর্থ ব্যয় করছে সমরাস্ত্র নির্মাণ গবেষণায়। বর্তমান চুক্তিটি অবশ্য সহজে হতে যাচ্ছে না। এর জন্য রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে আলোচনা করেছে এক বছরের ওপর। চুক্তিটির খসড়া লিখতে সময় লেগেছে তিন মাস। এর ভাষা যা সব ক্ষেত্রে যথেষ্ট স্বচ্ছ নয়। রুশ প্রেসিডেন্ট মেদভেদেভ বলেছেন, বর্তমান চুক্তির ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার স্বার্থের মধ্যে আসতে যাচ্ছে একটা সাম্যস্থিতি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেছেন, এই চুক্তির ফলে বিশ্বে শান্তির সম্ভাবনা বাড়ল। আর কমল পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তারের সম্ভাবনা। বর্তমান চুক্তিটি উভয় পক্ষের আইন সভায় পাস হওয়ার পর ১০ বছরের জন্য কার্যকর থাকবে। যদি না এর মধ্যে আরও কোনো উন্নতমানের চুক্তি সম্পাদিত হয়। ১৯৯১ সালে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে হতে পেরেছিল Strategic Arms Reduction Treaty (START)। সেটা ১৯৯১ সালের কথা। তারপর হতে পারল বর্তমান চুক্তি। উভয় পক্ষই বলছে, এর ফলে হতে পারল আস্থার ঘাটতি কম। আর পৃথিবীর মানুষও সাধারণভাবে পেতে পারছে স্বস্তি। কিন্তু শোনা যাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটররা এ ধরনের চুক্তির ঘোরবিরোধী। তারা সিনেটে বিরোধিতা করলে চুক্তিটি বাস্তবায়িত হতে পারবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদি লবি খুবই প্রবল। ইহুদি লবি চাচ্ছে ইরানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হামলা করুক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকার খবরে প্রকাশ, ভারত মহাসাগরের দ্বীপ দিয়াগো গার্সিয়াতে যে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি আছে সেখানে চলছে ইরান আক্রমণের প্রস্তুতি। রাশিয়াকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে সম্ভবত নিষ্ক্রিয় রাখতে। ইরান-মার্কিন যুদ্ধ বাধলে রাশিয়া নেবে না ইরানের পক্ষ। আমরা জানি না ঠিক কী হতে যাচ্ছে। তবে ইরান আমাদের বহুদিনের আপন দেশ। তার ওপর সম্ভাব্য হামলার কথা জেনে আমরা হচ্ছি চিন্তিত। তাই রুশ-মার্কিন চুক্তিটিকে আমরা সহজভাবে নিতে পারছি না। মনে হচ্ছে এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকছে আনুষঙ্গিক আরও অনেক ঘটনা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কথায় কথায় আন্তর্জাতিক আইনের কথা বলে। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেই সে করেছে ইরাক আক্রমণ। আমরা জানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ফেলেছিল পারমাণবিক বোমা। পারমাণবিক বোমা ব্যবহারে তার কোনো বিবেকের দংশন নেই। জাপান যদি ইউরোপের দেশ হতো তাহলে হয়তো তার ওপর পরমাণু বোমা পড়ত না। ইরান আক্রান্ত হলে তার ওপর পারমাণবিক অস্ত্রের হামলা হবে কিনা আমরা বলতে পারি না। যাই হোক, রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্টের মধ্যে অনেক টানাপড়েনের পর একটা চুক্তি হয়ে গেল। এ থেকে একটা কথা প্রমাণিত হতে যাচ্ছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে সামরিক দিক থেকে খাটো করে দেখতে পারছে না। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়েছে, কিন্তু রাশিয়া আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে একটা উল্লেখযোগ্য সামরিক শক্তি হিসেবে। যেটাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারছে না অস্বীকার করতে। বিশ্বের সামরিক ভারকেন্দ্র এখন হয়ে আছে দ্বিধাবিভক্ত। এখন ঠাণ্ডা লড়াইয়ের যুগ শেষ হয়েছে, কিন্তু মস্কোর সামরিক সামর্থ্য ক্ষয়প্রাপ্ত হয়নি।
বরং শোনা যাচ্ছে, সে এরইমধ্যে আবিষ্কার করেছে এমন এক গ্যাস যা প্রয়োগ করলে শত্রুপক্ষের প্রবল ঘুম পেতে থাকবে। তারা সমর্থ হবে না যুদ্ধ করার। আমরা সমর বিশারদ নই। তবে এতটুকু উপলব্ধি করতে অসুবিধা হচ্ছে না যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছা করলেই সারা বিশ্বকে জয় করতে সক্ষম হবে না। তার সামরিক শক্তির সীমাবদ্ধতা থাকছে।
No comments