ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে ঐক্য জরুরি, বিভেদ নয় by আহমেদ জিয়াউদ্দিন
যুদ্ধাপরাধ বিশেষজ্ঞ ও প্রবাসী আইনজীবী আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপি কথোপকথনকে কেন্দ্র করে যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কিত বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টির চেষ্টা চলে। এ ব্যাপারে অনেকেই ইতিমধ্যে তাদের মতামত জানিয়েছেন।
আইনজীবী আহমেদ জিয়াউদ্দিন এই বিচারিক প্রক্রিয়া কীভাবে প্রশ্নাতীতভাবে অব্যাহত থাকতে পারে সে সম্পর্কে মতামত দিয়েছেন। বিচারপতি নিজামুল হকের সঙ্গে তার কথোপকথনকে কেন্দ্র করে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। বিডিনিউজের সৌজন্যে তার লিখিত নিবন্ধটি নিম্নে ছাপা হলো
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সম্মানিত চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের ব্যক্তিগত স্কাইপি কথোপকথন এবং ই-মেইল হ্যাকিংকে কেন্দ্র করে যে ঘটনাপ্রবাহ তার সঙ্গে বাংলাদেশের অনেকেই ইতিমধ্যে বোধকরি অবগত হয়েছেন। গত কয়েক দিনে ইকোনমিস্টসহ দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম থেকে আমার সঙ্গে এবং আইসিটির বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তা করার জন্য আরও যাদের নাম উঠে এসেছে তাদের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের বিচারাধীন থাকায় এবং এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকায় আমরা সচেতনভাবেই কোনো মন্তব্য দেওয়া থেকে বিরত ছিলাম। এখনও আমরা এই বিচারাধীন বিষয়ের কনটেন্ট নিয়ে কোনো মন্তব্য করব না। কিন্তু গত কয়েক দিনের পত্রপত্রিকায় এবং সংবাদমাধ্যমে কিছু বিভ্রান্তিমূলক কথা আমাদের গোচরে এসেছে। 'আমার দেশ' নামের চিহ্নিত পত্রিকাটি আদালতের সুনির্দিষ্ট আদেশের লঙ্ঘন করে, সব ধরনের শিষ্টাচার ও সভ্যতার নিয়মকানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এই অপরাধের মাধ্যমে গৃহীত তথ্যগুলো অনেক রঙ চড়িয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রচার করতে থাকে। তার সঙ্গে যোগ দেয় অনলাইন পল্গাটফর্মের চিহ্নিত কিছু জামায়াতপন্থি গ্রুপ। এমনই কিছু বিভ্রান্তির ওপর আলোকপাত করতেই আমার আজকের এই লেখাটি।
বিচারপতি নিজামুল হকের সঙ্গে আমার কথিত কথোপকথন এবং ই-মেইল হ্যাকিংয়ের ঘটনাটি আমি প্রথম জানতে পারি 'ইকোনমিস্ট'- এর এক সাংবাদিকের কাছ থেকে, যখন তিনি এ বিষয়ে আমার সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছিলেন। এই কথিত কথোপকথনে আরও যাদের নাম উঠে এসেছে তাদের আরও কয়েকজনের সঙ্গেও যে ইকোনমিস্ট পত্রিকার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে, তাও জানতে পারি। এর পরের ঘটনা সবার জানা। ইকোনমিস্টের সাংবাদিক যখন বিচারপতির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেন, তার পরের দিন অর্থাৎ ৬ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে একটি আদেশ জারি করা হয় ইকোনমিস্ট পত্রিকার বিরুদ্ধে। সেখানে উন্মুক্ত আদালতে ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে বিচারপতি হক স্পষ্টভাবে তার আদেশে উল্লেখ করেন যে, হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে তার ব্যক্তিগত ই-মেইলের নিরাপত্তা বিঘি্নত করা হয়েছে। অবৈধভাবে তার ব্যক্তিগত কথোপকথন রেকর্ডিংয়ের কথাও তিনি সে আদেশে দেশবাসীকে অবগত করেন। তিনি উন্মুক্ত আদালতে এটাও সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেন কেন, কী পরিস্থিতিতে এবং কী প্রয়োজনীয়তা মাথায় রেখে ট্রাইব্যুনাল বিভিন্ন সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের বিষয়ে আমিসহ অন্যদের পরামর্শ ও গবেষণা সহায়তা গ্রহণ করেছেন। আমার সঙ্গে বিচারপতির খোলামেলা আলোচনায় আন্তর্জাতিক মানের বিভিন্ন নিয়ামক, এ জাতীয় বিচারের রায়ের আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত কাঠামো/বিন্যাসসহ ব্যক্তিগত নানা কথাও উঠে আসত মাঝে মধ্যে। আমাদের কথোপকথনে আমি সবসময়ই দেখেছি বিচারপতি হক তার নিরপেক্ষতা, স্বাধীনতা, বিচারের গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি বিষয়ের ব্যাপারে খুবই সচেতন থাকতেন। তাতে তার প্রতি আমার ব্যক্তিগত শ্রদ্ধাবোধ আরও বেড়েছে বৈ কমেনি। আমার সৌভাগ্য যে, বিচারপতি হকের মতো একজন নির্ভীক এবং সৎ মানুষের সাহচর্যে আসতে পেরেছি। এই বিচারটিকে বিশ্বের দরবারে কীভাবে আরও গ্রহণযোগ্য করা যায়, কীভাবে বিচার প্রক্রিয়াকে সব ধরনের চাপের ঊধর্ে্ব রাখা যায়, সে বিষয়ে বিচারপতি হকের সবসময়ই খুব সজাগ দৃষ্টি ছিল।
আজকে এই বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার চক্রটির পক্ষ থেকে করা একটি দাবি আমার চোখে পড়েছে, যা এক কথায় হাস্যকর। বলা হচ্ছে যে, এই মামলার চূড়ান্ত রায় (পড়হারপঃরড়হ ধহফ ংবহঃবহপরহম) নাকি আগেই লেখা হয়ে আছে, আর আমিই নাকি সেটা লিখে দিয়েছি। রায় যদি লেখা হয়ে গিয়েই থাকে তাহলে সে রায় এতদিনে দিয়ে দেওয়া হয়ে যেত নিশ্চয়ই। আর সে রকম কোনো রায়ের কপি যদি থেকেই থাকত, তাহলে ট্রাইব্যুনালের তথাকথিত গোপন দলিলের তথাকথিত 'লিক' (ষবধশ)-কারীরা নিশ্চয়ই বিশ্ববাসীর কাছে তা তুলে ধরত। তারা যেহেতু তুলে ধরতে পারেনি, তাতে এও প্রমাণিত হয় যে, যে চক্রটি দাবি করছে রায় ইতিমধ্যেই লেখা হয়ে গেছে, সেটি কতখানি অসার এবং ভিত্তিহীন!
আমি বিচারকের হয়ে রায় লিখে দেব, এমন হাস্যকর কৃতিত্ব আমি দাবি করি না। যদি সত্যিই লিখে দিতাম, তাহলে নিশ্চয়ই এই কৃতিত্বের ভাগ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করার কোনো কারণ ছিল না। আমি এবং আরও যারা শুরু থেকেই এই বিচার প্রক্রিয়াকে জরুরি সাহায্যটুকু করার চেষ্টা করে এসেছি ট্রাইব্যুনালেরই অনুরোধে_ আমাদের পক্ষ থেকে শুরু থেকেই একটি বিষয় স্পষ্ট করেছিলাম। সেটি হলো, এই সহযোগিতা আমরা করব সম্পূর্ণ ঢ়ৎড় নড়হড় ভিত্তিতে, অর্থাৎ কোনো ধরনের পদ বা সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে নয়। আমরা যারা এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরো প্রক্রিয়াটিকে দেখেছি, তারা জানি কী পরিমাণ কষ্ট এবং ত্যাগের বিনিময়ে এ দেশটি স্বাধীন হয়েছে। সে দেশের মানুষের বহু প্রতীক্ষিত বিচারের প্রক্রিয়ায় যদি সামান্যতম সাহায্যও করতে পেরে থাকি, তবে তাকে আমরা নিজেদের সৌভাগ্য বলেই গণ্য করি।
পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় যেখানেই এ ধরনের অপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেখানেই বিচারকদের গবেষণা এবং ড্রাফটিংসহ অন্যান্য বিষয়ে সাহায্য করার জন্য বিপুলসংখ্যক মানুষকে নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। উদাহরণ হিসেবে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি), রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনাল, যুগোশ্লাভিয়া ট্রাইব্যুনালের নাম উলেল্গখ করা যেতে পারে। আমাদের দেশ গরিব, সাধ্য এবং সামর্থ্য দুটিই অত্যন্ত সীমিত। তাই সরকারের ইচ্ছা থাকলেও, জনগণ এবং নাগরিক সমাজের নানা আকাঙ্ক্ষা ও আশাবাদ থাকলেও বাস্তবতা অনেক সময়ই তাতে বাদ সেধেছে। অথচ আমাদের ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রে আইনটি যেমন নতুন, প্রক্রিয়াটিও তেমনি একেবারেই নতুন, এমনকি বিচারকদের জন্যও। সুতরাং সাহায্য গ্রহণের বাস্তব পরিস্থিতিটুকু সবসময়ই বিদ্যমান ছিল। এ কথাগুলো বিচারপতি হকের আদেশেও স্পষ্ট হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের ওপর ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুদায়িত্বটি ন্যস্ত। ১৯৭১ সালে সংঘটিত সমসাময়িক বিশ্ব ইতিহাসের তুলনাহীন আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার, চার দশকের বিচারহীনতার সংস্কৃতির নিরসন, লাখ লাখ ভিকটিমসহ দেশবাসীর দীর্ঘদিনের বিচারের প্রত্যাশা পূরণ করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা এই গুরুদায়িত্বের অংশ। অন্যদিকে, তৃতীয় বিশ্বের একটি দরিদ্র রাষ্ট্রের নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা মাথায় নিয়ে এই ট্রাইব্যুনালকে কাজ করতে হচ্ছে প্রতিদিন। তেমনই এক পরিস্থিতিতে ট্রাইব্যুনালের পাশে দাঁড়িয়ে যতটুকু সম্ভব অভাব পূরণে এগিয়ে আসা আমাদের সবারই নৈতিক দায়িত্ব ছিল বলে আমি মনে করি। এর ফলে কোনো আইন ভঙ্গ হয়নি, যা এমনকি ইকোনমিস্টও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। ইকোনমিস্টের গত ১২ ডিসেম্বর তারিখের বিশদ প্রতিবেদনের শেষাংশে এসে স্পষ্টই বলা হয়েছেWe do not believe he (Ahmed Ziauddin) has broken any laws and cannot be held responsible for the actions of others.Õ কোনো নৈতিকতার মানদ েরও লঙ্ঘন হয়নি, বরং নৈতিক দায়িত্ব পালিত হয়েছে।
এখন বিচারপতি হকের স্বেচ্ছা পদত্যাগ এবং সংশ্লিষ্ট ঘটনাপ্রবাহের ধুয়া তুলে যারা দাবি করছেন আবার গোড়া থেকে বিচার শুরু করতে হবে, তারা একেবারেই সঠিক বলছেন না। ১৯৭৩ সালের আইনটির ধারা ৬(৬)-তে স্পষ্ট বলা আছে যে, 'যে কোনো কারণে' ট্রাইব্যুনালের কোনো বিচারপতির পরিবর্তন হলেও ট্রাইব্যুনাল পুনরায় সাক্ষীদের সাক্ষ্য গোড়া থেকে শুনতে বাধ্য নন। বরং আইনে বলা রয়েছে, ইতিমধ্যে মামলাগুলো সাক্ষ্যগ্রহণের যে পর্যায়ে রয়েছে ঠিক তার পর থেকেই বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে কোনো ধরনের ছেদ ছাড়াই। এই প্রকাশে সম্প্রতি সমকাল পত্রিকায় আইন কমিশনের মাননীয় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম শাহ আলমের বিশ্লেষণটি আমার কাছে অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত এবং সঠিক মনে হয়েছে।
নানা জনে নানান কথা বলেছেন। এদের মধ্যে কিছু কথা বলেছেন এমন কিছু মানুষ যারা শুরু থেকেই এই বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কাজে সচেষ্ট ছিলেন। তাদের কথার জবাব দেওয়া সময়ের অপচয়মাত্র। কিন্তু আমি খুব দুঃখ নিয়ে লক্ষ্য করছি যে কিছু বিভ্রান্তি বিচারের পক্ষের মানুষদের অনেকের মধ্যেও ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে। ১৫ ডিসেম্বর বিডিনিউজের মতামত-বিশ্লেষণ শাখায় প্রকাশিত শ্রদ্ধাভাজন শাহরিয়ার কবিরের একটি মন্তব্য আমাকে খুবই ব্যথিত করেছে। তিনি লিখেছেন, 'আমি মনে করি, এখানে জিয়াউদ্দিন নামের যে-বিচারক ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলেছেন, তিনি আইন জেনেবুঝে আমাদের ট্রাইব্যুনালকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছেন। এই জিয়াউদ্দিন সাহেব নিজেকে প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের ধারক বলে দাবি করেন। কোন সাহসে তিনি আমাদের বিচারপতির সঙ্গে বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলেন? আমি বলব, এ নিয়ে জোর তদন্ত হওয়া উচিত।'
তিনি আমার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করার প্রয়োজন অনুভব করছি না। কোথা থেকে আমি এমন 'সাহস' পেয়েছি, তিনি তেমন প্রশ্নও করেছেন। আমার বিনীত মতামত, বিষয়টি 'সাহস'-এর নয়, বিষয়টি সদিচ্ছার এবং সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি দায়িত্ববোধের। আমার সে দায়িত্ববোধ বা সাহায্য করার অধিকারের উৎস কী, তা বিচারপতি হকের ৬ ডিসেম্বর দেওয়া আদেশে সুস্পষ্টভাবে উলেল্গখ করা আছে। শাহরিয়ার কবির আরও বলেছেন, এর মাধ্যমে নাকি জামায়াত-শিবির চক্রের হাতে 'একটি সুযোগ তুলে দেওয়া হলো'। অন্য কিছু বাদ দিলেও, শুধু কার এভাবে জড়িয়ে, আমি বা বিচারপতি হক নিশ্চয়ই সেটা করব না। এক অদ্ভুত উটের পিঠে সওয়ার হয়ে যার বাড়িতে চুরি হয়েছে, তাকেই পাল্টা দোষী সাব্যস্ত করার নামান্তর এটি! আমি আরও আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করেছি যে তার এ দীর্ঘ লেখাটির কোথাও তিনি হ্যাকিং অপরাধের নিন্দা জানিয়ে একটি শব্দও লেখেননি!
'ইকোনমিস্ট' পত্রিকার হঠাৎ (!) অবস্থান পাল্টানোর বিষয়ে প্রশ্ন তুলে শাহরিয়ার কবির লিখেছেন, অতীতেও যুদ্ধাপরাধ বিষয় নিয়ে নাকি তারা প্রতিবেদন করেছে, তিনি নিজেও নাকি সে সবে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সে সব প্রতিবেদন নাকি এমন সমালোচনামূলক ছিল না। আমি জানি না তিনি সাম্প্রতিককালে ইকোনমিস্ট পত্রিকাটি নিয়মিত পড়ছেন কি-না। তাদের সাম্প্রতিককালের প্রায় প্রতিটি প্রতিবেদন বাংলাদেশ সরকার এবং যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে সমালোচনামুখর। জামায়াতের যে লবিং প্রতিষ্ঠান ক্যাসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের কথা তিনি তার লেখায় উল্লেখ করেছেন, তার হয়তো জানা নেই ওয়াশিংটনের বহু লবিং ফার্মের কাছেই এখন ইকোনমিস্ট পত্রিকাটিই লবিং উদ্ভূত তথাকথিত সাংবাদিকতার একটি পছন্দের ভেন্যু, যা আমরা অতীতে ব্যারি শুমাখারের বক্তব্যেও জানতে পেরেছি। তবে শাহরিয়ার কবিরের সঙ্গে যদি ইকোনমিস্ট পত্রিকার ভালো যোগাযোগ থেকে থাকে আমি অনুরোধ করব তিনি যেন অবশ্যই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই ই-মেইল হ্যাকিং এবং তথ্য ফাঁসের উৎসের ব্যাপারে খোঁজ নেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটি অনেক বেশি সাহায্যে আসবে মনে করি।
শ্রদ্ধেয় শাহরিয়ার কবির দীর্ঘদিন ধরে এ বিচার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সময় সময় বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে তার উদ্বেগ বা সমালোচনাগুলো বিভিন্ন লেখায় উঠে এসেছে। কিছু সমালোচনা করা হয়ে থাকে একটি প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে, আবার কিছু সমালোচনা হলো 'একজন সুহৃদের সমালোচনা'। শাহরিয়ার কবিরের সমালোচনাগুলো আমি শেষোক্ত ধারার বলেই ধরে নিতে চাই। বিচারকদের একান্ত গোপনীয় বিষয়গুলো অবৈধভাবে যখন কোনো মতলবী মহল সংগ্রহ করে প্রচার করে, সেটা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের জন্যই নিঃসন্দেহে খুব হতাশার বিষয়। বিচারের শেষ পর্যায়ে এসে এমন প্রতিবন্ধকতা তৈরির অপচেষ্টা সবার কাছেই নিশ্চয়ই উদ্বেগের। আমাদের কারও কারও জন্য, যাদের নামধাম উঠে এসেছে ইতিমধ্যে, তাদের জন্য সেটা নিছক হতাশার চাইতেও আরও বেশি কিছু। কারণ, ইতিমধ্যে ব্যক্তিগতভাবে আমাদের কারও কারও কাছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী নির্দিষ্ট একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীদের কাছ থেকে মৃত্যু-হুমকি পাঠানো হয়েছে, অত্যন্ত মানহানিকর প্রচারণাও চলছে পাশাপাশি। এর থেকে আমাদের পরিবারের সদস্যদেরও বাদ দেওয়া হয়নি। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে এবং সামাজিক মিডিয়ায় তাদেরও ছবি তুলে দেওয়া হয়েছে। সে সব বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে আমরা ইতিমধ্যেই অবগত করেছি।
এ কথাগুলো উল্লেখ করলাম কয়েকটি কারণে। মূল কারণটি হলো_ আমরা মনে করি এখানেই এর শেষ নয়। বিচারকের একান্ত ব্যক্তিগত আলাপচারিতা এবং পত্র বিনিময়ের তথ্য যখন বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গেই জড়িত একটি বিশেষ মহলের হস্তগত হয়, তখন তা আমাদের ব্যক্তিগত হতাশা, কিংবা ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং প্রাইভেসির বাইরেও আরও বড় ক্ষতির ইঙ্গিত বহন করে। যেমন_ ১. লিংক করা ফাইল থেকে এটা খুবই স্পষ্ট যে, শুধু বিচারপতি হকের ব্যক্তিগত যোগাযোগের তথ্যাদিই হ্যাকারদের হাতে পড়েনি, তার সঙ্গে অন্য বিচারকদের যোগাযোগের সমস্ত গোপনীয় তথ্যও যে এখন হ্যাকারদের হাতে তার আলামত স্পষ্ট; ২. বিচারকগণ সাক্ষী সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার কাস্টডিয়ান, এক পক্ষের সাক্ষীদের তথ্যাদি তারা অন্য পক্ষের কাছ থেকে গোপন রাখেন। বিচারকের নিজের গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হওয়ার মাধ্যমে সাক্ষীদের সুরক্ষা সংক্রান্ত সকল গোপনীয়তাই এখন হুমকির সম্মুখীন; ৩. শুধু যে বিচারকের কম্পিউটারেই হ্যাকিং বা আড়িপাতা হয়েছে সেটা মনে করলেও ভুল হবে। ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই যে এমনটি অতীতে করা হয়নি বা এখনও করা হচ্ছে না সেটার কোনো নিশ্চয়তা নেই। হঠাৎ করে একের পর এক সাক্ষীরা (যারা ছিলেন অত্যন্ত গোপনীয় সাক্ষী সুরক্ষা-ব্যবস্থার আওতায়) কেন ট্রাইব্যুনালের সামনে সাক্ষ্য দিতে হঠাৎ এত ভীত হয়ে পড়ল বা সাক্ষ্য প্রদানে অসম্মত হলো বা হঠাৎ আসামি পক্ষের হয়ে সাফাই দেওয়া শুরু করল, সে বিষয়গুলোর প্রতিটিরই এখন তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। কারণ, গোপনীয়তা ভঙ্গের এবং আড়িপাতার এই চর্চার মূল যে আসলে কতখানি গভীর এবং কতখানি বিস্তৃত তা জানাটা এই বিচারের স্বার্থেই জরুরি। এখনই সে ষড়যন্ত্রের স্বরূপ উন্মোচন না করতে পারলে আগামীতে আরও বড় ধরনের ষড়যন্ত্রের পথ বিস্তৃত হবে।
২০০৯ থেকে দেশ এবং প্রবাসের একদল নিবেদিত প্রাণ ছেলেমেয়ে মিলে আইসিএসএফ (ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম) নামের একটি নেটওয়ার্ক বা কোয়ালিশন শুরু করে। খুব দ্রুতই বিশ্বের প্রায় ৩৮ শহরের তরুণ প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সংগ্রামী কিছু তরুণ-তরুণীর মধ্যে এ সংগঠনটি ছড়িয়ে পড়ে। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে গড়ে তোলা এই সংগঠনটিতে কোনো তথাকথিত স্তরবিন্যাস নেই। রাজনৈতিক কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতাহীন এ সংগঠনটিতে একে একে জড়ো হয়েছে ১৩টি সংগঠন, যার মধ্যে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নেতৃত্ব দেওয়া সবচেয়ে প্রভাবশালী বাংলা বল্গগগুলোও। ব্যক্তি হিসেবে এসে এখানে যুক্ত হয়েছেন অক্সফোর্ড-কেমব্রিজ-হার্ভার্ডসহ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রখর মেধাবী দেশপ্রেমিক ছেলেমেয়েরা। ছাত্রছাত্রীরা ছাড়াও রয়েছেন দেশ-বিদেশের নামকরা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা, রয়েছেন আইনজীবী, সাংবাদিক এবং নানা পেশাজীবী, রয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারের সদস্যরা। তাদের সবাই সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পর রাতে বাড়ি ফিরে যে সময়টুকু পান তা ব্যয় করেন আইসিএসএফর সামষ্টিক কর্মযজ্ঞে। বাংলাদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস করে এ ছেলেমেয়েদের বুকের ভেতর। এই নেটওয়ার্কের ভেতর কাজের সংস্কৃতিটিই একেবারে আলাদা, যা আমি আমার অভিজ্ঞতায় কখনও আর কোথাও দেখিনি। এরা কেউ নিজের ব্যক্তিগত নাম বা যশের জন্য কাজ করেন না। প্রচলিত ধারার কমিটি, সাব-কমিটি নির্ভর বিবৃতি সেমিনার এবং প্রচারনির্ভর কর্মকা ের বাইরে গিয়ে ওরা নিভৃতে গড়ে তুলেছে একের পর এক আর্কাইভ যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা ও গবেষণায় বর্তমান এবং আগামীর জন্য অমূল্য সম্পদ হতে পারে। এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সব ধরনের অপপ্রচার এবং ষড়যন্ত্র এই নেটওয়ার্কের সদস্যরা মোকাবেলা করে আসছে সবল হাতে। দরকারের সময় এরাই টোবি ক্যাডম্যান, স্টিফেন যার্প, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, বা গ্রেগ হার্টলিদের নানা বিভ্রান্তিমূলক বিবৃতি এবং রিপোর্টগুলোর সমুচিত জবাব দিয়ে এসেছে। যে কারণে আসামিপক্ষের বিদেশি আইনজীবী এবং লবিস্টদের বিষোদ্গারের শিকারও হতে হয়েছে আইসিএসএফর সদস্যদের বহুবার। নীরবে-নিভৃতে এ সংগঠনটি বিচারের পক্ষে যে কী পরিমাণ প্রয়োজনীয় কাজ করেছে তা তাদের ওয়েবসাইটটি ভিজিট করলেই যে কোনো সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট হবে।
গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তার ভয়াবহ লঙ্ঘন হয়েছে এখানে, সেটা যেন আমরা ভুলে না যাই। পরিতাপের বিষয় হলো, ই-মেইল এবং স্কাইপি কথোপকথনগুলো ফাঁস হওয়ার পর প্রথম প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত ছিল পুরো বিষয়ের যথাযথ তদন্ত, কারণ অন্যসব অপরাধের মতো সাইবার অপরাধের আলামতও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায়। এ অবস্থায় এটি নিশ্চিত যে, একটি সংঘবদ্ধ চক্র সবিস্তার পরিকল্পনার পর এ আক্রমণে হাত দেয়। আমি এবং বিচারক হক এ আক্রমণের ভুক্তভোগী। শুধু আমরা নই, হয়তো আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তাও এ ধরনের আক্রমণের শিকার হয়ে থাকতে পারেন, যা উপরেই উল্লেখ করেছি। কিছুটা দেরিতে হলেও এ বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ এসেছে ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে। এ উদ্যোগকে আমরা আন্তরিক সাধুবাদ জানাই।
প্রাসঙ্গিক ডিজিটাল তথ্যগুলো যথাযথ প্রবাসী বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ইতিমধ্যেই যাচাই করানো হয়েছে এবং আমাদের প্রাপ্ত সমুদয় তথ্য খুব সুস্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয়, ই-মেইল হ্যাকিং বা অডিও-রেকর্ডিং আসলে কোথা থেকে হয়েছে। এ বিষয়ে ঘটনার শুরু থেকেই যারা এমনকি আমার দেশ বা ইকোনমিস্ট পত্রিকায় প্রকাশের আগে থেকেই বিভিন্ন ইন্টারনেট প্লাটফর্মে কথিত আলোচনার অংশবিশেষ নিয়ে মন্তব্য করেছে বা প্রকাশ করার হুমকি দিয়েছে, আমাদের কাছে সেসবেরও তথ্যপ্রমাণ এবং তালিকা রয়েছে। আমরা মনে করি সেসব বিশ্লেষণ করলে কারা এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট একটি ধারণা পাওয়া যাবে। আমরা আমাদের প্রাপ্ত সব তথ্য এবং বিশ্লেষণ তদন্তকারী সংস্থার হাতে তুলে দিচ্ছি। আশা করি, দ্রুতই এ বিষয়ে সবাই একটি সুস্পষ্ট ধারণা পাবেন।
এ প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয়ে আমি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। দু'জন মানুষের আলোচনার রেকর্ডকে নানাভাবে বিকৃত করা যায়। কোনো আলোচনাকে নিজের সুবিধার্থে পরিপ্রেক্ষিত বহির্ভূতভাবে উদ্ধৃত করে, কথার অংশবিশেষকে আগুপিছু জোড়া লাগিয়ে, কিছুু প্রয়োজনীয় অংশকে সুপরিকল্পতভাবে বাদ দিয়ে ইচ্ছেমতো সাজিয়ে উপস্থাপন করা যায়। আইসিএসএফর তদন্তে অডিও ফাইলগুলোর ওপর কারিগরি সম্পাদনা বা কাটাছেঁড়া করার সুস্পষ্ট আলামত খুঁজে পাওয়া গেছে। আর প্রকাশিত তথাকথিত ই-মেইলগুলোর ক্ষেত্রে সে কথা তো আরও বেশি প্রযোজ্য। কারণ, আগুপিছছুু আলোচনার বা পরিপ্রেক্ষিত সম্বন্ধে কিছু না উল্লেখ করে মাঝখান থেকে বিচ্ছিন্নভাবে একটি ই-মেইলের স্ক্রিনশট তুলে ধরা হলে তা তো বিভ্রান্তি তৈরি করবেই। এ কারণে বিশ্বব্যাপী সর্বত্র এভাবে অবৈধভাবে যখন কিছু সংগৃহীত হয় এবং তা অসম্পূর্ণভাবে প্রচারের জন্য তুলে ধরা হয় তার নির্ভর যোগ্যতার ব্যাপারে বিশেষ সন্দেহ পোষণ করেন সবাই। এ জাতীয় তৎপরতাকে উন্নত বিশ্ব এবং বাংলাদেশেও গুরুতর অপরাধ হিসেবেই গণ্য করা হয়। এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত পত্রিকাগুলোকে চরম মূল্য দিতে হয়, যেমনটি আমরা দেখেছি ব্রিটেনের 'নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড'-এর ক্ষেত্রে। সাম্প্রতিক 'লেভিসন তদন্তের' পর এ বিষয়ে সংশয়ের আর কোনো অবকাশই নেই।
আমি বা আমরা কোনো আইন ভঙ্গ করিনি, কোনো অন্যায় করিনি। বরং প্রয়োজনে আমাদের সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে এ বিচার প্রক্রিয়াকে যতভাবে সম্ভব সহায়তা দানের চেষ্টাই করে গেছি এবং যাব। এ সময়ে সবার কাছে আমার একটি বিনীত অনুরোধ থাকবে। এ বিচারের দিকে পুরো দেশ এবং নতুন প্রজন্ম অনেক আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে। আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম, ১৯৭১ সালের ভিকটিম এবং তাদের পরিবারও তাকিয়ে আছেন। আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের প্রগতির শিবিরে যদি কোনো বিভেদ বা ব্যক্তিগত মনোমালিন্য থেকেও থাকে তা যেন আজকের এই নতুন প্রজন্মের আশাটিকে পদদলিত না করে; আমরা যেন তাদের কাছে নিজেদের বিভেদ দিয়ে নিজেদের আর ছোট না করি। এ বিচারটি শুরু করতে এমনিতেই ৪১ বছর দেরি হয়ে গেছে, সেটি আমাদের প্রজন্মেরই ব্যর্থতা, আমরা যেন সেটা ভুলে না যাই।
ডিসেম্বর ১৯, ২০১২
আহমেদ জিয়াউদ্দিন : আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সম্মানিত চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের ব্যক্তিগত স্কাইপি কথোপকথন এবং ই-মেইল হ্যাকিংকে কেন্দ্র করে যে ঘটনাপ্রবাহ তার সঙ্গে বাংলাদেশের অনেকেই ইতিমধ্যে বোধকরি অবগত হয়েছেন। গত কয়েক দিনে ইকোনমিস্টসহ দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম থেকে আমার সঙ্গে এবং আইসিটির বিচার প্রক্রিয়াকে সহায়তা করার জন্য আরও যাদের নাম উঠে এসেছে তাদের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের বিচারাধীন থাকায় এবং এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকায় আমরা সচেতনভাবেই কোনো মন্তব্য দেওয়া থেকে বিরত ছিলাম। এখনও আমরা এই বিচারাধীন বিষয়ের কনটেন্ট নিয়ে কোনো মন্তব্য করব না। কিন্তু গত কয়েক দিনের পত্রপত্রিকায় এবং সংবাদমাধ্যমে কিছু বিভ্রান্তিমূলক কথা আমাদের গোচরে এসেছে। 'আমার দেশ' নামের চিহ্নিত পত্রিকাটি আদালতের সুনির্দিষ্ট আদেশের লঙ্ঘন করে, সব ধরনের শিষ্টাচার ও সভ্যতার নিয়মকানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এই অপরাধের মাধ্যমে গৃহীত তথ্যগুলো অনেক রঙ চড়িয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রচার করতে থাকে। তার সঙ্গে যোগ দেয় অনলাইন পল্গাটফর্মের চিহ্নিত কিছু জামায়াতপন্থি গ্রুপ। এমনই কিছু বিভ্রান্তির ওপর আলোকপাত করতেই আমার আজকের এই লেখাটি।
বিচারপতি নিজামুল হকের সঙ্গে আমার কথিত কথোপকথন এবং ই-মেইল হ্যাকিংয়ের ঘটনাটি আমি প্রথম জানতে পারি 'ইকোনমিস্ট'- এর এক সাংবাদিকের কাছ থেকে, যখন তিনি এ বিষয়ে আমার সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছিলেন। এই কথিত কথোপকথনে আরও যাদের নাম উঠে এসেছে তাদের আরও কয়েকজনের সঙ্গেও যে ইকোনমিস্ট পত্রিকার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে, তাও জানতে পারি। এর পরের ঘটনা সবার জানা। ইকোনমিস্টের সাংবাদিক যখন বিচারপতির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেন, তার পরের দিন অর্থাৎ ৬ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে একটি আদেশ জারি করা হয় ইকোনমিস্ট পত্রিকার বিরুদ্ধে। সেখানে উন্মুক্ত আদালতে ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে বিচারপতি হক স্পষ্টভাবে তার আদেশে উল্লেখ করেন যে, হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে তার ব্যক্তিগত ই-মেইলের নিরাপত্তা বিঘি্নত করা হয়েছে। অবৈধভাবে তার ব্যক্তিগত কথোপকথন রেকর্ডিংয়ের কথাও তিনি সে আদেশে দেশবাসীকে অবগত করেন। তিনি উন্মুক্ত আদালতে এটাও সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেন কেন, কী পরিস্থিতিতে এবং কী প্রয়োজনীয়তা মাথায় রেখে ট্রাইব্যুনাল বিভিন্ন সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের বিষয়ে আমিসহ অন্যদের পরামর্শ ও গবেষণা সহায়তা গ্রহণ করেছেন। আমার সঙ্গে বিচারপতির খোলামেলা আলোচনায় আন্তর্জাতিক মানের বিভিন্ন নিয়ামক, এ জাতীয় বিচারের রায়ের আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত কাঠামো/বিন্যাসসহ ব্যক্তিগত নানা কথাও উঠে আসত মাঝে মধ্যে। আমাদের কথোপকথনে আমি সবসময়ই দেখেছি বিচারপতি হক তার নিরপেক্ষতা, স্বাধীনতা, বিচারের গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি বিষয়ের ব্যাপারে খুবই সচেতন থাকতেন। তাতে তার প্রতি আমার ব্যক্তিগত শ্রদ্ধাবোধ আরও বেড়েছে বৈ কমেনি। আমার সৌভাগ্য যে, বিচারপতি হকের মতো একজন নির্ভীক এবং সৎ মানুষের সাহচর্যে আসতে পেরেছি। এই বিচারটিকে বিশ্বের দরবারে কীভাবে আরও গ্রহণযোগ্য করা যায়, কীভাবে বিচার প্রক্রিয়াকে সব ধরনের চাপের ঊধর্ে্ব রাখা যায়, সে বিষয়ে বিচারপতি হকের সবসময়ই খুব সজাগ দৃষ্টি ছিল।
আজকে এই বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার চক্রটির পক্ষ থেকে করা একটি দাবি আমার চোখে পড়েছে, যা এক কথায় হাস্যকর। বলা হচ্ছে যে, এই মামলার চূড়ান্ত রায় (পড়হারপঃরড়হ ধহফ ংবহঃবহপরহম) নাকি আগেই লেখা হয়ে আছে, আর আমিই নাকি সেটা লিখে দিয়েছি। রায় যদি লেখা হয়ে গিয়েই থাকে তাহলে সে রায় এতদিনে দিয়ে দেওয়া হয়ে যেত নিশ্চয়ই। আর সে রকম কোনো রায়ের কপি যদি থেকেই থাকত, তাহলে ট্রাইব্যুনালের তথাকথিত গোপন দলিলের তথাকথিত 'লিক' (ষবধশ)-কারীরা নিশ্চয়ই বিশ্ববাসীর কাছে তা তুলে ধরত। তারা যেহেতু তুলে ধরতে পারেনি, তাতে এও প্রমাণিত হয় যে, যে চক্রটি দাবি করছে রায় ইতিমধ্যেই লেখা হয়ে গেছে, সেটি কতখানি অসার এবং ভিত্তিহীন!
আমি বিচারকের হয়ে রায় লিখে দেব, এমন হাস্যকর কৃতিত্ব আমি দাবি করি না। যদি সত্যিই লিখে দিতাম, তাহলে নিশ্চয়ই এই কৃতিত্বের ভাগ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করার কোনো কারণ ছিল না। আমি এবং আরও যারা শুরু থেকেই এই বিচার প্রক্রিয়াকে জরুরি সাহায্যটুকু করার চেষ্টা করে এসেছি ট্রাইব্যুনালেরই অনুরোধে_ আমাদের পক্ষ থেকে শুরু থেকেই একটি বিষয় স্পষ্ট করেছিলাম। সেটি হলো, এই সহযোগিতা আমরা করব সম্পূর্ণ ঢ়ৎড় নড়হড় ভিত্তিতে, অর্থাৎ কোনো ধরনের পদ বা সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে নয়। আমরা যারা এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরো প্রক্রিয়াটিকে দেখেছি, তারা জানি কী পরিমাণ কষ্ট এবং ত্যাগের বিনিময়ে এ দেশটি স্বাধীন হয়েছে। সে দেশের মানুষের বহু প্রতীক্ষিত বিচারের প্রক্রিয়ায় যদি সামান্যতম সাহায্যও করতে পেরে থাকি, তবে তাকে আমরা নিজেদের সৌভাগ্য বলেই গণ্য করি।
পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় যেখানেই এ ধরনের অপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেখানেই বিচারকদের গবেষণা এবং ড্রাফটিংসহ অন্যান্য বিষয়ে সাহায্য করার জন্য বিপুলসংখ্যক মানুষকে নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। উদাহরণ হিসেবে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি), রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনাল, যুগোশ্লাভিয়া ট্রাইব্যুনালের নাম উলেল্গখ করা যেতে পারে। আমাদের দেশ গরিব, সাধ্য এবং সামর্থ্য দুটিই অত্যন্ত সীমিত। তাই সরকারের ইচ্ছা থাকলেও, জনগণ এবং নাগরিক সমাজের নানা আকাঙ্ক্ষা ও আশাবাদ থাকলেও বাস্তবতা অনেক সময়ই তাতে বাদ সেধেছে। অথচ আমাদের ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রে আইনটি যেমন নতুন, প্রক্রিয়াটিও তেমনি একেবারেই নতুন, এমনকি বিচারকদের জন্যও। সুতরাং সাহায্য গ্রহণের বাস্তব পরিস্থিতিটুকু সবসময়ই বিদ্যমান ছিল। এ কথাগুলো বিচারপতি হকের আদেশেও স্পষ্ট হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের ওপর ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুদায়িত্বটি ন্যস্ত। ১৯৭১ সালে সংঘটিত সমসাময়িক বিশ্ব ইতিহাসের তুলনাহীন আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার, চার দশকের বিচারহীনতার সংস্কৃতির নিরসন, লাখ লাখ ভিকটিমসহ দেশবাসীর দীর্ঘদিনের বিচারের প্রত্যাশা পূরণ করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা এই গুরুদায়িত্বের অংশ। অন্যদিকে, তৃতীয় বিশ্বের একটি দরিদ্র রাষ্ট্রের নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা মাথায় নিয়ে এই ট্রাইব্যুনালকে কাজ করতে হচ্ছে প্রতিদিন। তেমনই এক পরিস্থিতিতে ট্রাইব্যুনালের পাশে দাঁড়িয়ে যতটুকু সম্ভব অভাব পূরণে এগিয়ে আসা আমাদের সবারই নৈতিক দায়িত্ব ছিল বলে আমি মনে করি। এর ফলে কোনো আইন ভঙ্গ হয়নি, যা এমনকি ইকোনমিস্টও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। ইকোনমিস্টের গত ১২ ডিসেম্বর তারিখের বিশদ প্রতিবেদনের শেষাংশে এসে স্পষ্টই বলা হয়েছেWe do not believe he (Ahmed Ziauddin) has broken any laws and cannot be held responsible for the actions of others.Õ কোনো নৈতিকতার মানদ েরও লঙ্ঘন হয়নি, বরং নৈতিক দায়িত্ব পালিত হয়েছে।
এখন বিচারপতি হকের স্বেচ্ছা পদত্যাগ এবং সংশ্লিষ্ট ঘটনাপ্রবাহের ধুয়া তুলে যারা দাবি করছেন আবার গোড়া থেকে বিচার শুরু করতে হবে, তারা একেবারেই সঠিক বলছেন না। ১৯৭৩ সালের আইনটির ধারা ৬(৬)-তে স্পষ্ট বলা আছে যে, 'যে কোনো কারণে' ট্রাইব্যুনালের কোনো বিচারপতির পরিবর্তন হলেও ট্রাইব্যুনাল পুনরায় সাক্ষীদের সাক্ষ্য গোড়া থেকে শুনতে বাধ্য নন। বরং আইনে বলা রয়েছে, ইতিমধ্যে মামলাগুলো সাক্ষ্যগ্রহণের যে পর্যায়ে রয়েছে ঠিক তার পর থেকেই বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে কোনো ধরনের ছেদ ছাড়াই। এই প্রকাশে সম্প্রতি সমকাল পত্রিকায় আইন কমিশনের মাননীয় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম শাহ আলমের বিশ্লেষণটি আমার কাছে অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত এবং সঠিক মনে হয়েছে।
নানা জনে নানান কথা বলেছেন। এদের মধ্যে কিছু কথা বলেছেন এমন কিছু মানুষ যারা শুরু থেকেই এই বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কাজে সচেষ্ট ছিলেন। তাদের কথার জবাব দেওয়া সময়ের অপচয়মাত্র। কিন্তু আমি খুব দুঃখ নিয়ে লক্ষ্য করছি যে কিছু বিভ্রান্তি বিচারের পক্ষের মানুষদের অনেকের মধ্যেও ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে। ১৫ ডিসেম্বর বিডিনিউজের মতামত-বিশ্লেষণ শাখায় প্রকাশিত শ্রদ্ধাভাজন শাহরিয়ার কবিরের একটি মন্তব্য আমাকে খুবই ব্যথিত করেছে। তিনি লিখেছেন, 'আমি মনে করি, এখানে জিয়াউদ্দিন নামের যে-বিচারক ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলেছেন, তিনি আইন জেনেবুঝে আমাদের ট্রাইব্যুনালকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছেন। এই জিয়াউদ্দিন সাহেব নিজেকে প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের ধারক বলে দাবি করেন। কোন সাহসে তিনি আমাদের বিচারপতির সঙ্গে বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলেন? আমি বলব, এ নিয়ে জোর তদন্ত হওয়া উচিত।'
তিনি আমার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করার প্রয়োজন অনুভব করছি না। কোথা থেকে আমি এমন 'সাহস' পেয়েছি, তিনি তেমন প্রশ্নও করেছেন। আমার বিনীত মতামত, বিষয়টি 'সাহস'-এর নয়, বিষয়টি সদিচ্ছার এবং সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি দায়িত্ববোধের। আমার সে দায়িত্ববোধ বা সাহায্য করার অধিকারের উৎস কী, তা বিচারপতি হকের ৬ ডিসেম্বর দেওয়া আদেশে সুস্পষ্টভাবে উলেল্গখ করা আছে। শাহরিয়ার কবির আরও বলেছেন, এর মাধ্যমে নাকি জামায়াত-শিবির চক্রের হাতে 'একটি সুযোগ তুলে দেওয়া হলো'। অন্য কিছু বাদ দিলেও, শুধু কার এভাবে জড়িয়ে, আমি বা বিচারপতি হক নিশ্চয়ই সেটা করব না। এক অদ্ভুত উটের পিঠে সওয়ার হয়ে যার বাড়িতে চুরি হয়েছে, তাকেই পাল্টা দোষী সাব্যস্ত করার নামান্তর এটি! আমি আরও আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করেছি যে তার এ দীর্ঘ লেখাটির কোথাও তিনি হ্যাকিং অপরাধের নিন্দা জানিয়ে একটি শব্দও লেখেননি!
'ইকোনমিস্ট' পত্রিকার হঠাৎ (!) অবস্থান পাল্টানোর বিষয়ে প্রশ্ন তুলে শাহরিয়ার কবির লিখেছেন, অতীতেও যুদ্ধাপরাধ বিষয় নিয়ে নাকি তারা প্রতিবেদন করেছে, তিনি নিজেও নাকি সে সবে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সে সব প্রতিবেদন নাকি এমন সমালোচনামূলক ছিল না। আমি জানি না তিনি সাম্প্রতিককালে ইকোনমিস্ট পত্রিকাটি নিয়মিত পড়ছেন কি-না। তাদের সাম্প্রতিককালের প্রায় প্রতিটি প্রতিবেদন বাংলাদেশ সরকার এবং যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে সমালোচনামুখর। জামায়াতের যে লবিং প্রতিষ্ঠান ক্যাসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের কথা তিনি তার লেখায় উল্লেখ করেছেন, তার হয়তো জানা নেই ওয়াশিংটনের বহু লবিং ফার্মের কাছেই এখন ইকোনমিস্ট পত্রিকাটিই লবিং উদ্ভূত তথাকথিত সাংবাদিকতার একটি পছন্দের ভেন্যু, যা আমরা অতীতে ব্যারি শুমাখারের বক্তব্যেও জানতে পেরেছি। তবে শাহরিয়ার কবিরের সঙ্গে যদি ইকোনমিস্ট পত্রিকার ভালো যোগাযোগ থেকে থাকে আমি অনুরোধ করব তিনি যেন অবশ্যই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই ই-মেইল হ্যাকিং এবং তথ্য ফাঁসের উৎসের ব্যাপারে খোঁজ নেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটি অনেক বেশি সাহায্যে আসবে মনে করি।
শ্রদ্ধেয় শাহরিয়ার কবির দীর্ঘদিন ধরে এ বিচার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সময় সময় বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে তার উদ্বেগ বা সমালোচনাগুলো বিভিন্ন লেখায় উঠে এসেছে। কিছু সমালোচনা করা হয়ে থাকে একটি প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে, আবার কিছু সমালোচনা হলো 'একজন সুহৃদের সমালোচনা'। শাহরিয়ার কবিরের সমালোচনাগুলো আমি শেষোক্ত ধারার বলেই ধরে নিতে চাই। বিচারকদের একান্ত গোপনীয় বিষয়গুলো অবৈধভাবে যখন কোনো মতলবী মহল সংগ্রহ করে প্রচার করে, সেটা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের জন্যই নিঃসন্দেহে খুব হতাশার বিষয়। বিচারের শেষ পর্যায়ে এসে এমন প্রতিবন্ধকতা তৈরির অপচেষ্টা সবার কাছেই নিশ্চয়ই উদ্বেগের। আমাদের কারও কারও জন্য, যাদের নামধাম উঠে এসেছে ইতিমধ্যে, তাদের জন্য সেটা নিছক হতাশার চাইতেও আরও বেশি কিছু। কারণ, ইতিমধ্যে ব্যক্তিগতভাবে আমাদের কারও কারও কাছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী নির্দিষ্ট একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীদের কাছ থেকে মৃত্যু-হুমকি পাঠানো হয়েছে, অত্যন্ত মানহানিকর প্রচারণাও চলছে পাশাপাশি। এর থেকে আমাদের পরিবারের সদস্যদেরও বাদ দেওয়া হয়নি। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে এবং সামাজিক মিডিয়ায় তাদেরও ছবি তুলে দেওয়া হয়েছে। সে সব বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে আমরা ইতিমধ্যেই অবগত করেছি।
এ কথাগুলো উল্লেখ করলাম কয়েকটি কারণে। মূল কারণটি হলো_ আমরা মনে করি এখানেই এর শেষ নয়। বিচারকের একান্ত ব্যক্তিগত আলাপচারিতা এবং পত্র বিনিময়ের তথ্য যখন বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গেই জড়িত একটি বিশেষ মহলের হস্তগত হয়, তখন তা আমাদের ব্যক্তিগত হতাশা, কিংবা ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং প্রাইভেসির বাইরেও আরও বড় ক্ষতির ইঙ্গিত বহন করে। যেমন_ ১. লিংক করা ফাইল থেকে এটা খুবই স্পষ্ট যে, শুধু বিচারপতি হকের ব্যক্তিগত যোগাযোগের তথ্যাদিই হ্যাকারদের হাতে পড়েনি, তার সঙ্গে অন্য বিচারকদের যোগাযোগের সমস্ত গোপনীয় তথ্যও যে এখন হ্যাকারদের হাতে তার আলামত স্পষ্ট; ২. বিচারকগণ সাক্ষী সুরক্ষা এবং নিরাপত্তার কাস্টডিয়ান, এক পক্ষের সাক্ষীদের তথ্যাদি তারা অন্য পক্ষের কাছ থেকে গোপন রাখেন। বিচারকের নিজের গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হওয়ার মাধ্যমে সাক্ষীদের সুরক্ষা সংক্রান্ত সকল গোপনীয়তাই এখন হুমকির সম্মুখীন; ৩. শুধু যে বিচারকের কম্পিউটারেই হ্যাকিং বা আড়িপাতা হয়েছে সেটা মনে করলেও ভুল হবে। ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই যে এমনটি অতীতে করা হয়নি বা এখনও করা হচ্ছে না সেটার কোনো নিশ্চয়তা নেই। হঠাৎ করে একের পর এক সাক্ষীরা (যারা ছিলেন অত্যন্ত গোপনীয় সাক্ষী সুরক্ষা-ব্যবস্থার আওতায়) কেন ট্রাইব্যুনালের সামনে সাক্ষ্য দিতে হঠাৎ এত ভীত হয়ে পড়ল বা সাক্ষ্য প্রদানে অসম্মত হলো বা হঠাৎ আসামি পক্ষের হয়ে সাফাই দেওয়া শুরু করল, সে বিষয়গুলোর প্রতিটিরই এখন তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। কারণ, গোপনীয়তা ভঙ্গের এবং আড়িপাতার এই চর্চার মূল যে আসলে কতখানি গভীর এবং কতখানি বিস্তৃত তা জানাটা এই বিচারের স্বার্থেই জরুরি। এখনই সে ষড়যন্ত্রের স্বরূপ উন্মোচন না করতে পারলে আগামীতে আরও বড় ধরনের ষড়যন্ত্রের পথ বিস্তৃত হবে।
২০০৯ থেকে দেশ এবং প্রবাসের একদল নিবেদিত প্রাণ ছেলেমেয়ে মিলে আইসিএসএফ (ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম) নামের একটি নেটওয়ার্ক বা কোয়ালিশন শুরু করে। খুব দ্রুতই বিশ্বের প্রায় ৩৮ শহরের তরুণ প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সংগ্রামী কিছু তরুণ-তরুণীর মধ্যে এ সংগঠনটি ছড়িয়ে পড়ে। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে গড়ে তোলা এই সংগঠনটিতে কোনো তথাকথিত স্তরবিন্যাস নেই। রাজনৈতিক কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতাহীন এ সংগঠনটিতে একে একে জড়ো হয়েছে ১৩টি সংগঠন, যার মধ্যে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নেতৃত্ব দেওয়া সবচেয়ে প্রভাবশালী বাংলা বল্গগগুলোও। ব্যক্তি হিসেবে এসে এখানে যুক্ত হয়েছেন অক্সফোর্ড-কেমব্রিজ-হার্ভার্ডসহ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রখর মেধাবী দেশপ্রেমিক ছেলেমেয়েরা। ছাত্রছাত্রীরা ছাড়াও রয়েছেন দেশ-বিদেশের নামকরা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা, রয়েছেন আইনজীবী, সাংবাদিক এবং নানা পেশাজীবী, রয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারের সদস্যরা। তাদের সবাই সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পর রাতে বাড়ি ফিরে যে সময়টুকু পান তা ব্যয় করেন আইসিএসএফর সামষ্টিক কর্মযজ্ঞে। বাংলাদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস করে এ ছেলেমেয়েদের বুকের ভেতর। এই নেটওয়ার্কের ভেতর কাজের সংস্কৃতিটিই একেবারে আলাদা, যা আমি আমার অভিজ্ঞতায় কখনও আর কোথাও দেখিনি। এরা কেউ নিজের ব্যক্তিগত নাম বা যশের জন্য কাজ করেন না। প্রচলিত ধারার কমিটি, সাব-কমিটি নির্ভর বিবৃতি সেমিনার এবং প্রচারনির্ভর কর্মকা ের বাইরে গিয়ে ওরা নিভৃতে গড়ে তুলেছে একের পর এক আর্কাইভ যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা ও গবেষণায় বর্তমান এবং আগামীর জন্য অমূল্য সম্পদ হতে পারে। এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সব ধরনের অপপ্রচার এবং ষড়যন্ত্র এই নেটওয়ার্কের সদস্যরা মোকাবেলা করে আসছে সবল হাতে। দরকারের সময় এরাই টোবি ক্যাডম্যান, স্টিফেন যার্প, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, বা গ্রেগ হার্টলিদের নানা বিভ্রান্তিমূলক বিবৃতি এবং রিপোর্টগুলোর সমুচিত জবাব দিয়ে এসেছে। যে কারণে আসামিপক্ষের বিদেশি আইনজীবী এবং লবিস্টদের বিষোদ্গারের শিকারও হতে হয়েছে আইসিএসএফর সদস্যদের বহুবার। নীরবে-নিভৃতে এ সংগঠনটি বিচারের পক্ষে যে কী পরিমাণ প্রয়োজনীয় কাজ করেছে তা তাদের ওয়েবসাইটটি ভিজিট করলেই যে কোনো সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট হবে।
গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তার ভয়াবহ লঙ্ঘন হয়েছে এখানে, সেটা যেন আমরা ভুলে না যাই। পরিতাপের বিষয় হলো, ই-মেইল এবং স্কাইপি কথোপকথনগুলো ফাঁস হওয়ার পর প্রথম প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত ছিল পুরো বিষয়ের যথাযথ তদন্ত, কারণ অন্যসব অপরাধের মতো সাইবার অপরাধের আলামতও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায়। এ অবস্থায় এটি নিশ্চিত যে, একটি সংঘবদ্ধ চক্র সবিস্তার পরিকল্পনার পর এ আক্রমণে হাত দেয়। আমি এবং বিচারক হক এ আক্রমণের ভুক্তভোগী। শুধু আমরা নই, হয়তো আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তাও এ ধরনের আক্রমণের শিকার হয়ে থাকতে পারেন, যা উপরেই উল্লেখ করেছি। কিছুটা দেরিতে হলেও এ বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ এসেছে ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে। এ উদ্যোগকে আমরা আন্তরিক সাধুবাদ জানাই।
প্রাসঙ্গিক ডিজিটাল তথ্যগুলো যথাযথ প্রবাসী বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ইতিমধ্যেই যাচাই করানো হয়েছে এবং আমাদের প্রাপ্ত সমুদয় তথ্য খুব সুস্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয়, ই-মেইল হ্যাকিং বা অডিও-রেকর্ডিং আসলে কোথা থেকে হয়েছে। এ বিষয়ে ঘটনার শুরু থেকেই যারা এমনকি আমার দেশ বা ইকোনমিস্ট পত্রিকায় প্রকাশের আগে থেকেই বিভিন্ন ইন্টারনেট প্লাটফর্মে কথিত আলোচনার অংশবিশেষ নিয়ে মন্তব্য করেছে বা প্রকাশ করার হুমকি দিয়েছে, আমাদের কাছে সেসবেরও তথ্যপ্রমাণ এবং তালিকা রয়েছে। আমরা মনে করি সেসব বিশ্লেষণ করলে কারা এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট একটি ধারণা পাওয়া যাবে। আমরা আমাদের প্রাপ্ত সব তথ্য এবং বিশ্লেষণ তদন্তকারী সংস্থার হাতে তুলে দিচ্ছি। আশা করি, দ্রুতই এ বিষয়ে সবাই একটি সুস্পষ্ট ধারণা পাবেন।
এ প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয়ে আমি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। দু'জন মানুষের আলোচনার রেকর্ডকে নানাভাবে বিকৃত করা যায়। কোনো আলোচনাকে নিজের সুবিধার্থে পরিপ্রেক্ষিত বহির্ভূতভাবে উদ্ধৃত করে, কথার অংশবিশেষকে আগুপিছু জোড়া লাগিয়ে, কিছুু প্রয়োজনীয় অংশকে সুপরিকল্পতভাবে বাদ দিয়ে ইচ্ছেমতো সাজিয়ে উপস্থাপন করা যায়। আইসিএসএফর তদন্তে অডিও ফাইলগুলোর ওপর কারিগরি সম্পাদনা বা কাটাছেঁড়া করার সুস্পষ্ট আলামত খুঁজে পাওয়া গেছে। আর প্রকাশিত তথাকথিত ই-মেইলগুলোর ক্ষেত্রে সে কথা তো আরও বেশি প্রযোজ্য। কারণ, আগুপিছছুু আলোচনার বা পরিপ্রেক্ষিত সম্বন্ধে কিছু না উল্লেখ করে মাঝখান থেকে বিচ্ছিন্নভাবে একটি ই-মেইলের স্ক্রিনশট তুলে ধরা হলে তা তো বিভ্রান্তি তৈরি করবেই। এ কারণে বিশ্বব্যাপী সর্বত্র এভাবে অবৈধভাবে যখন কিছু সংগৃহীত হয় এবং তা অসম্পূর্ণভাবে প্রচারের জন্য তুলে ধরা হয় তার নির্ভর যোগ্যতার ব্যাপারে বিশেষ সন্দেহ পোষণ করেন সবাই। এ জাতীয় তৎপরতাকে উন্নত বিশ্ব এবং বাংলাদেশেও গুরুতর অপরাধ হিসেবেই গণ্য করা হয়। এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত পত্রিকাগুলোকে চরম মূল্য দিতে হয়, যেমনটি আমরা দেখেছি ব্রিটেনের 'নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড'-এর ক্ষেত্রে। সাম্প্রতিক 'লেভিসন তদন্তের' পর এ বিষয়ে সংশয়ের আর কোনো অবকাশই নেই।
আমি বা আমরা কোনো আইন ভঙ্গ করিনি, কোনো অন্যায় করিনি। বরং প্রয়োজনে আমাদের সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে এ বিচার প্রক্রিয়াকে যতভাবে সম্ভব সহায়তা দানের চেষ্টাই করে গেছি এবং যাব। এ সময়ে সবার কাছে আমার একটি বিনীত অনুরোধ থাকবে। এ বিচারের দিকে পুরো দেশ এবং নতুন প্রজন্ম অনেক আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে। আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম, ১৯৭১ সালের ভিকটিম এবং তাদের পরিবারও তাকিয়ে আছেন। আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের প্রগতির শিবিরে যদি কোনো বিভেদ বা ব্যক্তিগত মনোমালিন্য থেকেও থাকে তা যেন আজকের এই নতুন প্রজন্মের আশাটিকে পদদলিত না করে; আমরা যেন তাদের কাছে নিজেদের বিভেদ দিয়ে নিজেদের আর ছোট না করি। এ বিচারটি শুরু করতে এমনিতেই ৪১ বছর দেরি হয়ে গেছে, সেটি আমাদের প্রজন্মেরই ব্যর্থতা, আমরা যেন সেটা ভুলে না যাই।
ডিসেম্বর ১৯, ২০১২
আহমেদ জিয়াউদ্দিন : আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ
No comments