নেহরুর সেকুলারিজম ও বাংলাদেশ by ফাহমিদ উর রহমান
কংগ্রেসের বিখ্যাত নেতা ও ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু ইংরেজি সেকুলারিজম শব্দটা ব্যাখ্যা করতেন বিশেষভাবে। সেকুলারিজম শব্দটার আজকাল বাংলায় তরজমা করা হয় ইহজাগতিকতা বা পার্থিববাদ হিসেবে।
ধর্মনিরপেক্ষতার চেয়ে ইহজাগতিকতা সেকুলারিজমের প্রকৃত অর্থের অনেক কাছাকাছি ও মূলানুগ বলে পণ্ডিতরা মনে করেন। সেকুলারিজম বলতে ঠিক সব ধর্মের সমানাধিকার বুঝায় না, যেটা নেহরু প্রচার করতেন। বুঝায় রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক থাকবে না। প্রকৃতপক্ষে সেকুলারিজমের সঙ্গে ধর্মহীনতার নৈকট্য রয়েছে। কিন্তু নেহরু সেকুলারিজম দিয়ে ঠিক এই ধরনের কোনো নীতি প্রতিষ্ঠার কথা ভাবেননি। আবার সংবিধানে সব ধর্মের সমানাধিকারের কথা বলা হলেও কার্যক্ষেত্রে ভারতে হিন্দু ধর্ম ও ভাবধারাই বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে সেটাই হয়তো কারণ।রাষ্ট্র হিসেবে ভারতকে মোটেই ধর্মনিরপেক্ষ বলা যায় না। কারণ সেখানকার মানুষের মন আজও যথেষ্ট ধর্ম প্রভাবিত। মানুষ ধর্মনিরপেক্ষ না হলে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব নয়। কেবল আইন করে ধর্মনিরপেক্ষতা বা সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি বাস্তবসম্মত নয়। তাই সংবিধান বা আইন দিয়ে কোনো দেশের সামাজিক অবস্থাকে বিশ্লেষণ করতে যাওয়া একটা বড় রকমের ভুল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে বলা হয়েছে, সব মানুষ সমান। কিন্তু সে দেশে কী এখনও সাদা ও কালোর বৈষম্য পুরোপুরি উঠে গেছে অথবা এখনও কী কালো মানুষের সমাজের বিভিন্ন স্তরে সাদাদের ঘৃণা কুড়াতে হয় না? যদিও দেশের অনেক শীর্ষস্থানীয় পদে তারা এখন বসতে শুরু করেছেন। ভারতের সংবিধানেও সব ধর্মের মানুষের সমানাধিকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সেখানে মুসলমান ও হরিজনদের প্রতি যে আচরণ করা হয় তা কতকটা আমেরিকার নিগ্রোদের বঞ্চনার সঙ্গেই তুলনা করা যায়। তা না হলে বাবরী মসজিদ ও গুজরাট হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটতে পারতো না। সংবিধান ও আইনের দিক দিয়ে যা হোক না কেন সমাজ বাস্তবতার দিক দিয়ে ভারতকে একটা ধর্ম-নিরপেক্ষ দেশ বলা যায় না। আইন আর বাস্তব অবস্থার মধ্যে ফারাক অনেক। রাজনীতিবিদ হিসেবে নেহরু এ জিনিসটা কতটুকু বুঝতে পেরেছিলেন জানি না। তবে তিনিও যে সমাজ বাস্তবতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি তা বলাই বাহুল্য। নেহরুর একটা বিখ্যাত বইয়ের নাম হচ্ছে Discovery of India— ভারত আবিষ্কার। তার চিন্তা ভাবনার একটা সুস্পষ্ট রূপ দেখতে পাওয়া যায় এ বইয়ে। তিনি এখানে বলতে চেয়েছেন নানা বৈচিত্র্যের মধ্যেও ভারতজুড়ে একটা ঐক্য কাজ করছে। আর সেই ঐক্যের সূত্রকেই ধরে এক মহাজাতির উত্থান সম্ভব।
তার এ বইটি লেখার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম লীগের পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিকে অযৌক্তিক প্রমাণ করা। তখনকার ভারতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে তিনি এ বই লিখেছিলেন। ভারতের ঐক্যের যেসব কথা তিনি বলেছেন তার অনেক কিছুই ইতিহাসবর্জিত ও কল্পনাশ্রয়ী। কিন্তু বইয়ের ভাষা ঝরঝরে যা মানুষকে আকর্ষণ করে। তাই ইতিহাস না জানা পাঠকের কাছে এ বই একটা প্রভাব ফেলতেই পারে।
বিশাল ভারতের মানুষের মধ্যে ভাষা ও সংস্কৃতিগত ঐক্য যেমন নেই, তেমনি নেই মানবধারাগত (Race) ঐক্য। আর্য-অনার্য-দ্রাবিড়দের মধ্যেও আছে বিরাট ব্যবধান। অথচ এসব ব্যবধানকে চাপা দিয়ে নেহরু শুধু ভারতীয় ঐক্যের গল্প কথা প্রচার করতে চেয়েছেন। আবার নেহরু তার কল্পিত ঐক্যের সূত্র হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন আর্য ভারতের সভ্যতাকেই। অনার্য কিংবা দ্রাবিড় ভারতকে তিনি অকিঞ্চিত্কর মনে করেছেন। প্রায় এক হাজার বছর হলো মুসলমানরা ভারতজুড়ে এক গৌরবোজ্জ্বল সভ্যতা নির্মাণ করেছে। সেই সভ্যতার কথাও নেহরু মন খুলে বলতে চাননি। আসলে নেহরুর ভারত আবিষ্কার বইটা হচ্ছে সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতার বড় নিদর্শন। যে সাম্প্রদায়িকতার তোড়ে একদিন ভারত ভাগ হয়ে গিয়েছিল। ভারতীয় শ্যাসকগোষ্ঠীর মিডিয়া ও প্রচার বিশারদরা অসাম্প্রদায়িক ও উদার নেতা হিসেবে নেহরুর যে ইমেজ গড়ে তুলেছে এ বই তা সমর্থন করে না।
মাওলানা আজাদের বিখ্যাত বই India Wins Freedom কিংবা হাল আমলে প্রকাশিত যশবন্ত সিংয়ের Jinnah বইটি পড়লে দেখা যাবে, নেহরু ধর্মনিরপেক্ষতার কথা মুখে বললেও তার মধ্যে কাজ করেছে এক ব্রাহ্মণ্যবাদী গোঁড়ামি। কার্যক্ষেত্রে তিনি নিরপেক্ষ থাকতে পারেননি বলেই ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে যায়। আর ঘটে যায় বিরাট এক রক্তক্ষয়ী সংঘাত। এ সংঘাতের জন্য জিন্নাহ ও তার মুসলিম লীগের চেয়ে নেহরু নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসই যে বেশি দায়ী এসব কথা আজ উদারমতি ইতিহাসবিদদের গবেষণা থেকেই বেরিয়ে আসছে।
ভারত আবিষ্কার বইটি গভীর অভিনিবেশ সহকারে পড়লে বোঝা যায়, নেহরু আসলে দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে আর্য হিন্দু আধিপত্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছেন। তিনি নিজেও বলেছেন, ভবিষ্যতের পৃথিবী কয়েকটি বড় রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়বে। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভারত। তার মতে, ছোট দেশগুলোর কোনো ভবিষ্যত্ নেই। এরা বড় রাষ্ট্রগুলোর ভেতরে আত্তীকৃত হয়ে যাবে। বড় জোর তারা কিছুটা সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য টিকিয়ে রাখতে পারে। নেহরুর এ আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ডকট্রিন ভারতের শাসকগোষ্ঠীকে আজও তাড়া করে ফিরছে। এ ডকট্রিনের লক্ষ্য হচ্ছে ভারতের আশপাশের ছোটখাটো রাষ্ট্রকে গ্রাস করে নেয়া। অন্ততপক্ষে এদের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিকভাবে অধীন করে রাখা। ভারতীয় উপমহাদেশের যে বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠী তাদের সম্পর্কেও নেহরুর বিবেচনা এর অতিরিক্ত কিছু ছিল না। এ কথা বলাই বাহুল্য, নেহরুর স্বপ্ন দেখা এ আর্য সভ্যতার প্রতিনিধিদের দ্বারা নিগৃহীত না হয়ে বেঁচে থাকার প্রেরণা থেকেই বিশ শতকের চল্লিশের দশকে উপমহাদেশে পাকিস্তান আন্দোলনের উত্পত্তি হয়েছিল। কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে নেহরুকে অনেকে বলেন উদার ও প্রগতিশীল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, নেহরু তার ভারত আবিষ্কার বইয়ে যে আর্য সভ্যতার গুণগান করেছেন তা কিন্তু বিশেষ ধর্মীয় সংস্কৃতির আশ্রয়েই গড়ে উঠেছে। উপমহাদেশের বহু প্রগতিশীল বলে পরিচিত রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের কাছে বেদ উপনিষদভিত্তিক সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদ সাম্প্রদায়িক নয়। লৌকিক সংস্কৃতি মাত্র কিন্তু মুসলিম তাহজীব ও তমদ্দুন এদের কাছে অস্পৃশ্য ও সাম্প্রদায়িক। এরকম চিত্র বাংলাদেশেও আজ বিরল নয়। প্রগতি ও প্রতিক্রিয়াশীলতার এ বিচিত্র ও অভিনব ব্যাখ্যা আমাদের মাঝে মাঝে ধন্ধে ফেলে দেয়।
নেহরু যেভাবে দক্ষিণ এশিয়াব্যাপী আর্য সভ্যতার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কথা ভেবেছিলেন ইতিহাস ঠিক সেভাবে তার পথ করে নেয়নি। তাকে ও তার কংগ্রেসকে পাকিস্তানের দাবি শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে হয়েছিল। তবে নেহরু ভেবেই নিয়েছিলেন রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান বেশি দিন টিকবে না। আবার অখণ্ড ভারত সৃষ্টি হবে। নেহরুর মেয়ে ইন্দিরা গান্ধী তার পিতার রাজনৈতিক আদর্শকেই অনুসরণ করতেন। আর্য সভ্যতার গোঁড়ামি তার মধ্যেও ষোল আনা ছিল। তিনিও চাইতেন যেভাবেই হোক পাকিস্তানকে ভেঙে দিতে এবং ১৯৭১ সালে তিনি আংশিকভাবে সফলও হন। কিন্তু পূর্ব বাংলার মানুষেরা যে নিজেদের স্বাধীনতার বিনিময়ে ভারতের তাঁবেদারি সহ্য করবে না সেকথা ইন্দিরা ও তার নীতি-নির্ধারকদের পক্ষে তখনকার মতো বোঝা সম্ভব হয়নি।
১৯৪৭ সালে ভারতকে কাটা-ছেঁড়া করার যাবতীয় সিদ্ধান্ত হয় শেষ ভাইসরয় মাউন্ট ব্যাটেনের সিমলার বাসভবনে। ওখানে ছিল নেহরুর অবাধ যাতায়াত। মাউন্ট ব্যাটেন পত্নী এডুইনার সঙ্গে নেহরুর সম্পর্ক ছিল অন্যরকম। গবেষকরা আজ বলছেন, ওটা নিছক বন্ধুত্ব নয়, কাজ আদায়ের সম্পর্ক। (দেখুন কলিন্স ও লাপিয়ের কৃত ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট, বরুন সেনগুপ্তের ইন্দিরা একাদশী এবং ফারুক মাহমুদের ইতিহাসের অন্তরালে)।
নাস্তিকতা ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসের দাবিদার হয়েও বর্ণবাদী ব্রাহ্মণ, পুঁজিপতি টাটা-বিড়লা-ডালমিয়াদের পৃষ্ঠপোষক, ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার হয়েও মুসলিমবিদ্বেষী নেহরু ভালোভাবেই জানতেন Exchange is not robbery। কারণ ওই পথেই অতীতে বর্ণহিন্দুরা ‘শক হুন দল পাঠান মোগল’ সবাইকে এক দেহে লীন করার চেষ্টা করেছে।
ভারত বিভাগের রঙ্গমঞ্চে যখন কোটি কোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ে নাড়াচাড়া হচ্ছে তখন পর্দার অন্তরালে চলছে আর্য সভ্যতার উত্তরাধিকারীদের সঙ্গে ক্রুসেডের রক্তবহনকারীদের যৌথ ষড়যন্ত্র কীভাবে উপমহাদেশের মুসলমানদের ষোলআনা সর্বনাশ করা যায়।
সেদিনের উপমহাদেশের মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার দাবির খায়েশ মিটিয়ে দেয়ার জন্য এক প্রতিশোধমূলক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়। মাউন্ট ব্যাটেনের মন্তব্য : যেভাবে পাকিস্তান দেয়া হলো তাতে সিকি শতাব্দীর মধ্যে পূর্ব বঙ্গ আলাদা হয়ে যাবে। ....পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের উপর বিব্রতকর বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। (দেখুন ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট)।
আর উচ্ছ্বসিত নেহরু নিশ্চিত মন্তব্য করেন : কিছু আগেই হোক বা পরেই হোক পূর্ব পাকিস্তানকে ভারতভুক্ত হতেই হবে। (ভাইসরয়ের ৩১ মে, ১৯৪৭ তারিখের স্টাফ মিটিংয়ের কার্যবিবরণী)।
আজ বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল নিয়ে এক ধরনের অসন্তোষ চলছে। র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ অনুযায়ী পূর্ব বাংলা তার প্রাপ্য অংশ পায়নি। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুর্শিদাবাদ, মালদহ, নদীয়া জেলা, দিনাজপুর, যশোর, ২৪ পরগনা, বীরভুমের মুসলিম অধ্যুষিত একাংশ কেটে জোর করে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়। সিলেটকে পাকিস্তানে দেয়া হয় ন্যায় বিচারের জন্য নয় আসামে মুসলমানদের নিশ্চিত সংখ্যালঘু করার লক্ষ্যে। কাশ্মীরকে কুক্ষিগত করার জন্য পাঞ্জাবের মুসলিম অধ্যুষিত গুরুদাসপুর জেলাকে কৌশলগত কারণে ভারতে ঢুকিয়ে দেয়া হয়, কারণ ওই জেলার ভেতর দিয়েই কাশ্মীরের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ রক্ষা করতে হয়। এই গুরুদাসপুরের বদলেই শেষ মুহূর্তে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পূর্ব বাংলার সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়। এটুকুও নেহরু মেনে নিতে চাননি। তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে মাউন্ট ব্যাটেনকে এটি ছিনিয়ে নেয়ার হুমকিও দেন। আর কলকাতা ছাড়া পূর্ববাংলা পাওয়াকে জিন্নাহ বলেছিলেন— Like asking a man to live without his heart. এই কারণেই পাকিস্তানের মানচিত্রকে তার কাছে মনে হয়েছিল ‘পোকায় খাওয়া’। তাই আমাদের দেশে যেসব সেকুলার বুদ্ধিজীবী ইতিহাসের মাথা খেয়ে জিন্নাহকে নিয়ে মনগড়া গালগল্প প্রচার করেন তারা আসলে একভাবে ইতিহাসের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ শুরু করেছেন।
সুতরাং আজ যে বাংলাদেশকে বিভিন্ন মহল থেকে অকার্যকর রাষ্ট্র বানানোর কথা শোনা যায় তা কিন্তু নতুন বিষয় নয়। সেদিনের আর্য সভ্যতার উত্তরাধিকারীরা পূর্ব বাংলার মানুষের বিরুদ্ধে নেয়া রণনীতি থেকে আজও পিছিয়ে আসেনি। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক নানা কৌশলে এ ভূখণ্ডটি অধীন করে রাখাই হচ্ছে তাদের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য। ১৯৪৭ সালে যারা বসু-সোহ্রাওয়ার্দীয় স্বাধীন বাংলা ফর্মুলার বিরোধিতা করেছিলেন নেহরু তাদের অন্যতম। তার কন্যা ইন্দিরা গান্ধী যা কিছু করেছেন তা তিনি করেছিলেন কেবল বাংলাদেশের স্বার্থে নয়, ভারতের স্বার্থের কথাও বিবেচনা করে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের ছিল দুটি রূপ। এ সময় বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মবিকাশের প্রয়োজনে। কিন্তু ভারত এ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল পাকিস্তান ভেঙে দিয়ে এ অঞ্চলে নিজের আধিপত্য স্থায়ী করার লক্ষ্যে। ভারত-বাংলাদেশের বিরোধ তাই নদীর পানি আর সীমানার বিরোধ নয়। এ বিরোধ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিরোধও। বাংলাদেশের মানুষের কাছে ভারতীয় শাসককুলের এ আধিপত্যবাদী চেহারা অতীতের মতোই স্পষ্ট। তাই বাংলাদেশের মানুষের ভেতরে সৃষ্টি হয়েছে ভারত সম্পর্কে এক নেতিবাচক সন্দেহ ও প্রতিরোধী মনোভাব। এ মনোভাবকেই প্রচার করা হয়ে থাকে সাম্প্রদায়িকতা বলে, যাতে ভারতের উদ্দেশ্যকে আড়াল করা যায়।
এই ভারতীয় আধিপত্যকে মজবুত করার জন্য ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশে আমদানি হয় নেহরুর সেকুলারিজম। এই সেকুলারিজমের ধারণা দিয়েই এদেশে শুরু হয় ইসলামবিরোধিতা। আর সেই সঙ্গে শুরু হয় বাংলাদেশের ইতিহাস ও সমাজ জীবনে ইসলামের ভূমিকাকে ছোট করে দেখাবার প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদদের একাংশও অনুরক্ত হয়ে ওঠে নেহরুর এই সেকুলারিজমের প্রতি এবং সেকুলারিজমের আড়ালেই তারা ইসলামের বিরোধিতা শুরু করে। ইসলাম ও মুসলমান সম্পর্কিত সব বিষয়কে ঢালাওভাবে সাম্প্রদায়িক হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা চলে। প্রকারান্তরে বাংলাদেশের এই শ্রেণীর ইসলামবিরোধিতার সঙ্গে ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীর মুসলিম স্বার্থবিরোধী ভূমিকার ভেতরে মৌলিক কোনো তফাত্ নেই। বাঙালি মুসলিম সমাজের এই অংশ অত্যন্ত নির্লজ্জভবে ভারতীয় স্বার্থের পাহারাদার হয়ে উঠেছে।
কেন এই ইসলাম বিরোধিতা তার বিচারও আজ জরুরি। প্রায় এক হাজার বছর হলো ইসলাম এদেশে এসেছে এবং এখানকার জনসমাজে প্রভাব বিস্তার করেছে। ইসলামকে কেন্দ্র করে বাঙালি মুসলমানদের এক নিজস্ব সংস্কৃতিও গড়ে উঠেছে। এই দীর্ঘ সময় ধরে ইসলাম বাঙালি মুসলিম সমাজের সংহতি ও আত্মপরিচয়ের ঐক্য সূত্র হিসেবে কাজ করেছে। মুসলিম দুনিয়ার সঙ্গে এদেশের যোগাযোগ বহুদিনের। এক আন্তর্জাতিক সমাজশক্তি হিসেবে ইসলামের পরিচয়ে বাঙালি মুসলমানের অংশগ্রহণ তাই ঐতিহাসিক বাস্তবতা। বাংলাদেশে আজ যে ইসলামবিরোধিতা চলছে তার পেছনে আছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কালো ছায়া। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সন্ত্রাসবিরোধিতার আড়ালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ইসলামবিরোধী লড়াই চালাচ্ছে তারই অংশ ও কৌশল হিসেবে বাংলাদেশে চলছে ইসলামবিরোধী প্রোপাগাণ্ডা। ইসলামকে মার্কিন নীতিবিশারদরা প্রমাণ করতে চাচ্ছে একটা গোঁড়া, গণতন্ত্রবিরোধী জঙ্গি ধর্ম হিসেবে। আজকের বিশ্ব রাজনীতিতে খ্রিস্টান ইহুদি-ব্রাহ্মণ্যবাদী স্বার্থ একাকার হয়ে গেছে এবং এ তিনশক্তি যৌথভাবে মুসলিম দুনিয়ার ওপর খবরদারি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ কারণে বাংলাদেশের ভারতপ্রেমী অংশ ইসলামবিরোধী প্রচারণায় নেমে পড়েছে। এদের লক্ষ্য বাংলাদেশকে ভারতের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য বলয়ের নিচে নিয়ে আসা। কিন্তু এ কাজে প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছে এদেশের বৃহত্তর জনসমাজের ধর্ম চেতনা ও মূল্যবোধ থেকে উদ্ভূত আবেগ। ইসলামবিরোধী প্রচারণা দিয়ে এদেশের মানুষের সেই আবেগকে দুর্বল করে দেয়ার চেষ্টা চলছে। যাতে বাংলাদেশ তার আত্মপরিচয় নিয়ে দাঁড়াতে না পারে। বাংলাদেশে ইসলামবিরোধিতার এই হচ্ছে আসল কারণ।
কিন্তু এদেশের মানুষের ইতিহাস ও ভাবলোককে অস্বীকার করে নতুন ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নয়। এভাবে নতুন কিছুর উপর থেকে চাপিয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে তৈরি হবে সংঘাত ও সামাজিক বিপর্যয়। এরকম নজির মুসলিম দুনিয়ায় অপ্রতুল নয়। তুরস্ক, মিসর, আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়ায় এরকম চেষ্টা হয়েছে। জোর করে সেকুলারিজম প্রতিষ্ঠার পরিণতি ভালো হয়নি। ওসব দেশগলোতে রক্ষক্ষয়ী সংঘাত ও বিপর্যয়ই সৃষ্টি হয়েছে মাত্র। কিন্তু সাধারণ জনমানসে নিবিড়ভাবে মিশে থাকা ইসলামকে উত্খাত করা যায়নি। তাত্ক্ষণিকভাবে ইসলামকে প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দেয়া সম্ভব হলেও শেষ বিচারে রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি হিসেবে ইসলাম আরও বেশি শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। আমাদের রাজনীতি ও সংস্কৃতির লক্ষ্য হওয়া উচিত সংঘাত কমানো, বাড়িয়ে তোলা নয়।
No comments