মুক্তিযোদ্ধার বাঁচার লড়াই-দেশমাতৃকার জন্য যাঁরা যুদ্ধে নেমেছিলেন তাঁদের অনেকেই আজ লড়ছেন দুবেলা দুমুঠো খাবারের জন্য। তাঁদের জীবনচিত্র নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন-খেজুরের গুড় বেচে দিন চলে মোখলেছারের by আলমগীর চৌধুরী
সংসারে সারা বছরের খরচ জোগাতে শীত এলেই খুব ভোরে মোটা রশি আর ছ্যান (হাঁসুয়া আকৃতির ধারালো যন্ত্র) হাতে বেরিয়ে পড়েন মুক্তিযোদ্ধা মোখলেছার। মৌসুমভিত্তিক চুক্তিতে নেওয়া খেজুরগাছ থেকে রস আহরণের পর তৈরি করা গুড় বেচে সংসার চালান তিনি। বয়স এখন ষাটের কাছাকাছি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরই খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহের পেশা বেছে নেন তিনি। আর এ জন্য এলাকায় সবাই তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা গ্যাছা মোখলেছার নামে চেনে।
জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার রামশালা বর্ধমানপাড়ায় পরিত্যক্ত সরকারি জায়গায় ছাপরাঘরে স্ত্রী জাহানারা বেগমকে নিয়ে বসবাস করেন। বড় ছেলে জাহিনুর বিয়ে করে আলাদা থাকেন। আর একমাত্র মেয়ে নাজমা পারভীনকে বিয়ে দেওয়ার পর অসুস্থ হয়ে গত বছর মারা গেছেন।
সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধা মোখলেছারের খোঁজ নিতে তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, জাহানারা বাড়ির পাশেই শুকনো জমিতে বসে লেপ সেলাই করছেন। পরিচয় দিতেই উঠে এসে পুকুরপাড়ে নির্মিত বস্তি আকৃতির ঝুপড়ির মতো ঘর দেখিয়ে বলেন, 'ওখানেই আমরা স্বামী-স্ত্রী থাকি।' উলুখাগড়ার বেড়া দিয়ে নির্মাণ করা সীমানা প্রাচীর পেরিয়ে বাড়িতে মাথা নিচু করে ঢুকে দেখা গেল ঘরে কোথাও কোনো আসবাবপত্র নেই। মেঝেতেই তাঁদের শোবার ব্যবস্থা। কাঠের টুলে বসতে দিয়ে নিজে মাটিতে বসেই জাহানারা জানান, স্বামী মুক্তিযোদ্ধা; তাই গরিব হওয়া সত্ত্বেও গ্রামের সবাই তাঁকে সম্মান করে। জাহানারা বলেন, 'শত অভাবের মধ্যেও জীবনে কারো কাছে হাত পাততে দেখিনি আমার স্বামীকে।' ছেলেমেয়েদেরও ওই শিক্ষাই দিয়েছেন। তাই তো ছেলে বিয়ে করে আলাদা হলেও বাবার প্রতি সম্মান দেখাতে তাঁর পেশা ধরেই স্বাবলম্বী হয়েছেন। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা আর শীতের সময় আহরণ করা খেজুরের রস দিয়ে তৈরি করা গুড় বিক্রি করা আয় দিয়েই তাঁদের সংসার চলে। এ ছাড়া সারা বছর তিনি নিজেও হাঁস-মুরগি পালন করে কিছু আয় করেন। মোখলেছারের খোঁজ জানতে চাইলে জাহানারা জানান, ভোররাতে আক্কেলপুর বাজারে গেছেন খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ করতে। মোবাইল ফোনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে কি না, জানতে চাইলে জাহানারা বলেন, 'আমাদের কোনো মোবাইল ফোন নাই।'
অনেক খোঁজাখুঁজির পর আক্কেলপুর সদরের পশ্চিম বাজার আমুট্ট মহল্লায় দেখা মেলে মোখলেছারের। খেজুরের রস আহরণের জন্য মোখলেছার ধারালো ছ্যান দিয়ে গাছ পরিষ্কার করছিলেন। পরিচয় পেয়ে গাছ থেকে নেমে আসেন তিনি। শীতের মধ্যেও ঘামছিলেন। কারণ গাছ পরিষ্কার করতে বেশ শক্তি লাগে। শরীরের ঘাম মুছতে মুছতে মোখলেছার বলেন, 'বয়স হইছে, তাই একটু কাজ করলেই শরীর দুর্বল লাগে। আগের মতো কাজ করতে না পারায় এখন পার্টনার নিছি।'
মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মোখলেছার জানান, গরিবের ঘরে জন্ম নেওয়ায় পড়ালেখার সুযোগ হয়নি। তাই ছোটবেলা থেকেই প্রতিবেশী বিত্তবানদের বাড়িতে দিনমজুরের কাজ করতে হয়েছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ যখন শুরু হয়, মোখলেছার তখন প্রতিবেশী মোসলিম উদ্দিনের বাড়িতে দিনমজুরের কাজ করতেন। তিনি বলেন, চারদিকে যুদ্ধ শুরু হলে একদিন স্থানীয় রাজাকাররা কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিয়ে তাঁদের রামশালা বর্ধমানপাড়া গ্রামে আসে। ওই সময় গ্রাম থেকে গরুসহ বেশ কিছু আসবাবপত্র তারা লুট করে নিয়ে যায়। তাঁর এক চাচিকেও তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। পরে অনেক কাকুতি-মিনতির পর সেই চাচি পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে রেহাই পান। ওই দৃশ্য দেখার পর মোখলেছারের মনে প্রতিরোধের আকাঙ্ক্ষা জাগে। এরপরই তিনি সিদ্ধান্ত নেন যুদ্ধে অংশ নেওয়ার। ওই সময় তাঁদের গ্রামে এক মুচি বাস করতেন। তাঁর সঙ্গেই মোখলেছার পাড়ি জমান ভারতের শিলিগুড়ি ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিতে। সেখানে ২১ দিন প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে এসে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। স্থানীয় ক্যাম্প কমান্ডারের নির্দেশে আক্কেলপুরের কাশিড়া, রায়কালী, গোপীনাথপুর ও বগুড়ার আদমদীঘিতে মোখলেছার নেমে পড়েন যুদ্ধে। তাঁদের কমান্ডার ছিলেন জাফরপুরের আবদুল জলিল এবং ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন আক্কেলপুরের তেমারিয়া গ্রামের তোফাজ্জাল হোসেন।
মোখলেছার বলেন, 'কোনো কিছু পাওয়ার জন্য নয়, শুধু দেশমাতৃকার টানেই যুদ্ধ করেছি। রাজনীতি না বুঝলেও দেশের মাটিতে পাকিস্তানিরা দুঃশাসন চালাবে- এটা মেনে নিতে পারিনি বলেই সে সময় যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু যে আশা নিয়ে দেশ স্বাধীন করলাম, তা আজও পূরণ হয়নি। আজও পরাজিত শক্তি মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে।' তিনি আক্ষেপ করে বলেন, 'সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম স্বাধীন দেশে রাজাকারদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা দেখে।'
জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার রামশালা বর্ধমানপাড়ায় পরিত্যক্ত সরকারি জায়গায় ছাপরাঘরে স্ত্রী জাহানারা বেগমকে নিয়ে বসবাস করেন। বড় ছেলে জাহিনুর বিয়ে করে আলাদা থাকেন। আর একমাত্র মেয়ে নাজমা পারভীনকে বিয়ে দেওয়ার পর অসুস্থ হয়ে গত বছর মারা গেছেন।
সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধা মোখলেছারের খোঁজ নিতে তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, জাহানারা বাড়ির পাশেই শুকনো জমিতে বসে লেপ সেলাই করছেন। পরিচয় দিতেই উঠে এসে পুকুরপাড়ে নির্মিত বস্তি আকৃতির ঝুপড়ির মতো ঘর দেখিয়ে বলেন, 'ওখানেই আমরা স্বামী-স্ত্রী থাকি।' উলুখাগড়ার বেড়া দিয়ে নির্মাণ করা সীমানা প্রাচীর পেরিয়ে বাড়িতে মাথা নিচু করে ঢুকে দেখা গেল ঘরে কোথাও কোনো আসবাবপত্র নেই। মেঝেতেই তাঁদের শোবার ব্যবস্থা। কাঠের টুলে বসতে দিয়ে নিজে মাটিতে বসেই জাহানারা জানান, স্বামী মুক্তিযোদ্ধা; তাই গরিব হওয়া সত্ত্বেও গ্রামের সবাই তাঁকে সম্মান করে। জাহানারা বলেন, 'শত অভাবের মধ্যেও জীবনে কারো কাছে হাত পাততে দেখিনি আমার স্বামীকে।' ছেলেমেয়েদেরও ওই শিক্ষাই দিয়েছেন। তাই তো ছেলে বিয়ে করে আলাদা হলেও বাবার প্রতি সম্মান দেখাতে তাঁর পেশা ধরেই স্বাবলম্বী হয়েছেন। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা আর শীতের সময় আহরণ করা খেজুরের রস দিয়ে তৈরি করা গুড় বিক্রি করা আয় দিয়েই তাঁদের সংসার চলে। এ ছাড়া সারা বছর তিনি নিজেও হাঁস-মুরগি পালন করে কিছু আয় করেন। মোখলেছারের খোঁজ জানতে চাইলে জাহানারা জানান, ভোররাতে আক্কেলপুর বাজারে গেছেন খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ করতে। মোবাইল ফোনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে কি না, জানতে চাইলে জাহানারা বলেন, 'আমাদের কোনো মোবাইল ফোন নাই।'
অনেক খোঁজাখুঁজির পর আক্কেলপুর সদরের পশ্চিম বাজার আমুট্ট মহল্লায় দেখা মেলে মোখলেছারের। খেজুরের রস আহরণের জন্য মোখলেছার ধারালো ছ্যান দিয়ে গাছ পরিষ্কার করছিলেন। পরিচয় পেয়ে গাছ থেকে নেমে আসেন তিনি। শীতের মধ্যেও ঘামছিলেন। কারণ গাছ পরিষ্কার করতে বেশ শক্তি লাগে। শরীরের ঘাম মুছতে মুছতে মোখলেছার বলেন, 'বয়স হইছে, তাই একটু কাজ করলেই শরীর দুর্বল লাগে। আগের মতো কাজ করতে না পারায় এখন পার্টনার নিছি।'
মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মোখলেছার জানান, গরিবের ঘরে জন্ম নেওয়ায় পড়ালেখার সুযোগ হয়নি। তাই ছোটবেলা থেকেই প্রতিবেশী বিত্তবানদের বাড়িতে দিনমজুরের কাজ করতে হয়েছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ যখন শুরু হয়, মোখলেছার তখন প্রতিবেশী মোসলিম উদ্দিনের বাড়িতে দিনমজুরের কাজ করতেন। তিনি বলেন, চারদিকে যুদ্ধ শুরু হলে একদিন স্থানীয় রাজাকাররা কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিয়ে তাঁদের রামশালা বর্ধমানপাড়া গ্রামে আসে। ওই সময় গ্রাম থেকে গরুসহ বেশ কিছু আসবাবপত্র তারা লুট করে নিয়ে যায়। তাঁর এক চাচিকেও তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। পরে অনেক কাকুতি-মিনতির পর সেই চাচি পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে রেহাই পান। ওই দৃশ্য দেখার পর মোখলেছারের মনে প্রতিরোধের আকাঙ্ক্ষা জাগে। এরপরই তিনি সিদ্ধান্ত নেন যুদ্ধে অংশ নেওয়ার। ওই সময় তাঁদের গ্রামে এক মুচি বাস করতেন। তাঁর সঙ্গেই মোখলেছার পাড়ি জমান ভারতের শিলিগুড়ি ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিতে। সেখানে ২১ দিন প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে এসে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। স্থানীয় ক্যাম্প কমান্ডারের নির্দেশে আক্কেলপুরের কাশিড়া, রায়কালী, গোপীনাথপুর ও বগুড়ার আদমদীঘিতে মোখলেছার নেমে পড়েন যুদ্ধে। তাঁদের কমান্ডার ছিলেন জাফরপুরের আবদুল জলিল এবং ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন আক্কেলপুরের তেমারিয়া গ্রামের তোফাজ্জাল হোসেন।
মোখলেছার বলেন, 'কোনো কিছু পাওয়ার জন্য নয়, শুধু দেশমাতৃকার টানেই যুদ্ধ করেছি। রাজনীতি না বুঝলেও দেশের মাটিতে পাকিস্তানিরা দুঃশাসন চালাবে- এটা মেনে নিতে পারিনি বলেই সে সময় যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু যে আশা নিয়ে দেশ স্বাধীন করলাম, তা আজও পূরণ হয়নি। আজও পরাজিত শক্তি মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে।' তিনি আক্ষেপ করে বলেন, 'সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম স্বাধীন দেশে রাজাকারদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা দেখে।'
No comments