অভিমতঃ এ লজ্জা কার? by লাভলী আনোয়ার
এক সময় সারা বাংলার উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা অনেকেই মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কো-এডুকেশনে না দিয়ে ইডেনে ভর্তি করাতেন। সাবজেক্টে ৪৫ শতাংশ নাম্বার লাগত, ভর্তি পরীক্ষা হতো। অতঃপর টিকে গেলে কাটাতেন নির্ভার নিশ্চিত জীবন।
আমিও ছিলাম এমনি নিরুপদ্রব চিন্তাশীল এক অভিভাবকের মেয়ে। আজকে আমি নিজেও অভিভাবক। ভাবছিলাম চারপাশে সময়ের বদান্যতায় আধুনিকতার নামে অসভ্যতার যে হুল্লোড় তাতে মেয়েকে ইডেনে পড়ানোর চেষ্টা করব। কিন্তু ক’দিন আগে আমার দেশসহ কয়েকটি জাতীয় দৈনিক নগ্নতার যে নির্লজ্জ দলিল প্রকাশ করল ইডেনের শিক্ষার পরিবেশ সম্পর্কে, তাতে করে নিজে এক সময় ওই বিদ্যাপীঠে অধ্যয়ন করেছি বলতে লজ্জাবোধ করছি। দেশের একজন সচেতন নাগরিক ও ইডেনের পুরনো শিক্ষার্থী হিসেবে এ অধঃপতিত অবস্থার আশু সমাধান আশা করছি। কারণ, ইডেন আমার কাছে শুধু বিদ্যাপীঠ নয়, বিদ্যামন্দির। বিদ্যাপীঠ থেকে বিদ্যামন্দিরের ব্যবধানটা আশা করি আপনারা বুঝতে পারবেন!আমার যৌবনের স্বর্ণ সময়টা ওখানে কাটিয়েছি। রাষ্ট্রের প্রথম শ্রেণীর একজন নাগরিক হিসেবে আমার স্বপ্ন, সৌন্দর্য, আদর্শ, নৈতিকতার বিদ্যামন্দির যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে ফেরত চাই। বিশ্বাস করতে চাই যে, আমার মেয়েও আগের মতো সুষ্ঠু পরিবেশ পাবে। পাবে ইডেনে পড়ে গর্বিত হওয়ার মতো মানসিকতা।
নারী শিক্ষার সুষ্ঠু বিকাশের ধারায় মহীরুহ আজ পতিত থেকে পতিতালয়! বললে ভুল হবে কি? জাতির অর্ধেক অংশের এই অবক্ষয়ের চিত্র নারী, নারী উন্নয়নের পথে এক বিরাট অন্তরায়। আর এ লজ্জা কর্তব্যবোধসম্পন্ন যুক্তিবাদী মানুষের সবার।
ছাত্রী নামধারী শিক্ষা-বাণিজ্যের অন্তরালে দেহপসারিণীরা বিদ্যায়তনে কেন? এ প্রশ্ন আমিসহ সুস্থ রুচির সবার। ছাত্র রাজনীতির নামে মেয়েদের উপঢৌকন হিসেবে ব্যবহার বন্ধ হবে কবে?
আমার সময়ের ইডেন। ঠিক ৬টায় হলে ঢোকা। সপ্তাহে একদিন ভিজিটিং ডে। লোকাল অভিভাবক ছাড়া যে কেউ যখন-তখন দেখা করতে হলে হল সুপারের অনুমতি লাগত। নির্দিষ্ট পোশাক ছিল, তার বাইরে কেবল বৃহস্পতিবার অন্য পোশাক পরার নিয়ম ছিল। অনার্সের মেয়েদেরও অডিটোরিয়ামে পিটি ক্লাসে অংশ নিতে হতো। অনুপস্থিতির জন্য কর্তৃপক্ষীয় ব্যবস্থা নিতে স্বয়ং প্রিন্সিপাল উপস্থিত থাকতেন। আর শরীরচর্চা শিক্ষকের হাতে থাকত চোখ রাঙানির বেত। সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় ছিল দক্ষ সংগঠিত তত্পরতার ছাপ, সুবিন্যস্ত নিয়ম প্রণালী আর আদর্শ পাঠদানের পরিবেশ। হয়তো এখন তা ভেঙে গেছে।
যৌবনের নারী সুন্দরতম, অন্যতম অনবদ্যতার প্রতীক। এই সুন্দর যদি এভাবে অবক্ষয়ের পথে ধাবিত হয় তাহলে তাদের মধ্য থেকে কোনো মা মেয়ের জন্ম না নিয়ে জন্ম নেবে কেবল পতিতা।
আগের সেই পদ্ধতি চালু হোক। সভ্যতা আর আধুনিকতার মানে ইট-কাঠ বদলে দেয়ালের ওয়েল ফার্নিশিং নয়। ভেতর থেকে, বিশ্বাস থেকে, মহত্বের জন্য, আদর্শের জন্য বদলানো কেবল সৃষ্টি, ধ্বংস নয়। নারীর সুশিক্ষা ভবিষ্যত্ সুনাগরিকের প্রধানতম পূর্বশর্ত। অতএব, এখানে স্খলন হলে জাতির মেরুদণ্ড থাকবে না, কেবল জাতি শব্দটা থাকবে।
তাই আবারও বলছি আগের সেসব মার্জিত ও অতীব প্রয়োজনীয় পদ্ধতি চালু হোক। প্রয়োজনে এ ধরনের ন্যক্কারজনক রাজনীতি বন্ধ হোক, যে রাজনীতি একটি বিশ্ববিদ্যালয় মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে চরম অরাজক নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দেয়। সে রাজনীতি কখনোই কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। রাজনীতি ভবিষ্যত্ সুন্দরের বিনির্মাণের জন্য, আদিম অসভ্য জগতে বন্দির জন্য নয়। অতএব, নারী শিক্ষার পথিকৃত্ ইডেন যেন ফিরে পায় তার অতীত মর্যাদা, হয়ে ওঠে প্রাণময়, এ চেষ্টা যেন আশুভাবে থাকে কর্তৃপক্ষের কাছে—এ আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
লেখক : বেসরকারি কলেজের প্রভাষক
No comments