ছাত্র রাজনীতি-১ by মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান
খবরটি খুব বড় করে কোনো পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, এমনটি চোখে পড়েনি। অনেক সময় যথেষ্ট গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও, বিশেষ কারণে কোনো কোনো পত্রিকা কোনো কোনো খবরকে সহজ-গোচর করে ছাপতে চায় না। ছাপার ক্ষেত্রে আবার খবরের বিশুদ্ধ মূল্যের চেয়ে পত্রিকা বিশেষের দৃষ্টিভঙ্গিই প্রকট এবং বিকট হয়ে ওঠে।
আমি অবশ্য সব পত্রিকা খুঁটিয়ে দেখেছি—এমন দাবি করব না। গত ২৪ মার্চ যশোর বইমেলার একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে যোগদানের উদ্দেশে যাওয়ার পথে যে চারটি দৈনিক পত্রিকা কিনেছিলাম সেগুলোর কথাই বলছি। খবরটি ছিল পতাকা দিবস উপলক্ষে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের বক্তব্য নিয়ে। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠার প্রথম কলামেই খবরটি ছাপা হয়েছে। সাধারণ পাঠকের অভ্যাসমত পত্রিকার প্রথম এবং শেষ পৃষ্ঠা আগে দেখে নেয়ার প্রবণতা আমারও আছে। তেমনভাবেই আমার দেশ পত্রিকায় ছাপা খবরটি চোখে এলো। পাঠকের ওপর পত্রিকার দৃষ্টিভঙ্গি বা অভিমত চাপিয়ে প্রভাবিত করার দুর্মতি ছাড়াই খবরটি ছাপা হয়েছে দেখে ভালো লাগল। ছাত্রজীবনে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল বলেই হয়তো সবার আগে এ খবরটি পড়ে ফেললাম। ছাত্র রাজনীতির বর্তমান ভয়ঙ্কর, বীভত্স এবং দুর্গন্ধময় অবস্থা দেখে সাবেক ছাত্র নেতারা যে বুকভাঙা হাহাকার করেছেন, সে হাহাকার আমার বুকেও আছে। এই ঘোর দুঃসময়ে, সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা তাদের সময়ের ছাত্র রাজনীতির আদর্শের তুলনায় বর্তমান ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের লোভ-লালসা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজিকে তুলে ধরে এমনকি এ কথাও বলেছেন, ‘এক সময় ছাত্রলীগ করেছি, এটা ভেবেই লজ্জা লাগে’। বিবেকের এই তীব্র তাড়নার জন্য তাদের ধন্যবাদ। তবে তাদের লজ্জিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। যে যার সময়ে, ইতিহাসের চলমানতায় যতটুকু বেগ সঞ্চারিত করতে পারেন শুভ আগামীর দিশায় তাতেই তিনি সার্থক। এ আলোচনা সভার অনেকেই আমার সমসাময়িক। তখনকার ছাত্র রাজনীতির আদর্শিক দিকটির গৌরব আমাকে এখনও প্রশান্তি দেয়। আসলেই সে সময়ের ছাত্র রাজনীতিকরা ছিলেন অনেক বেশি মেধাবী ও সচেতন। শুধু দেশীয় রাজনীতি নয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কেও ছিলেন পরিজ্ঞাত। রাজনীতি তাদের কাছে অবৈধভাবে সম্পদ লুটপাট করার হাতিয়ার ছিল না। তখনও ছাত্র রাজনীতিতে দুর্বৃত্তের আবির্ভাব ঘটেছে, কিন্তু তারা কখনোই বড় বড় রাজনৈতিক নেতার প্রশ্রয় পায়নি। কারণ তখনকার প্রধান প্রধান রাজনৈতিক নেতাদের কাছে দেশপ্রেম এবং আদর্শই ছিল বড়। ছাত্রদের মধ্যে তখন দ্বন্দ্ব হতো আদর্শিক, লুটপাটের সংঘাত হতো না। যখনই লুটপাটের প্রশ্ন আসে, তখনই তা আর সমষ্টির স্বার্থে থাকে না, ব্যক্তি স্বার্থ হয়ে ওঠে প্রবল। তখনই দলীয় আদর্শ পদদলিত হয় এবং একই দলের মধ্যে ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে শুরু হয় হানাহানি। সেই চিত্রই আজ দেখতে পাচ্ছি সর্বত্র। সাবেক ছাত্র নেতাদের একজন গভীর ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী কি পারেন না ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করে দিতে?’ তার ক্ষোভ আমি বুঝি, কিন্তু তার বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারি না। এরই মধ্যে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ বা নিষিদ্ধ করা সম্ভব নয়। আমি বলব, উচিতও নয়। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হলে রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি জনপ্রশাসন এবং বিশ্ব পরিস্থিতিতে শিক্ষিত নেতৃত্বের খোঁজ পাওয়া যাবে না ভবিষ্যতে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এখন যেভাবে লুটপাট, দখল, সন্ত্রাস ও মাস্তানি করে নেতৃত্ব করায়ত্ত করছে অধিকাংশ ছাত্রনেতা, তাতে কি ভবিষ্যতে সত্যিকার শিক্ষিত রাষ্ট্রনেতা পাওয়া সম্ভব? না, সম্ভব নয়। কিন্তু ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করেও এ সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে না। আর শুধু ছাত্রলীগ নয়, গোটা ছাত্র রাজনীতির মধ্যেই এ বিষয়ের সংক্রমণ ঘটে গেছে। প্রধান প্রধান ছাত্র সংগঠনগুলোর কোনোটিই এই বিষমুক্ত নয়। তবে এবার ছাত্রলীগের যে চরিত্রের সর্বগ্রাসী ও বিধ্বংসী বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তা দেখেই হয়তো সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের মনে গ্লানিকর ক্ষোভের জন্ম হয়েছে। তারপরও বলব, দেশে ছাত্র রাজনীতি থাকতেই হবে। যে দেশের শিক্ষার হার অতি নিম্ন, সেখানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণরতরা যদি রাজনীতি সচেতন না হন তাহলে মইন উ গংদের মতো ব্যক্তিদের, দেশকে রাজনীতিশূন্য করে লাঠিয়াল দিয়ে দেশ শাসনের সুযোগ করে দেয়া হবে মাত্র। বর্তমান সময়ে যা প্রয়োজন তা হলো, দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। ছাত্রসমাজকে নিজের বা নিজ দলের লেজুড়বৃত্তি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে দেয়া। কথাটা যত সহজে বললাম, বর্তমান সময়ের ক্ষমতালিপ্সাসর্বস্ব রাজনীতিকদের পক্ষে কাজটা করা তত সহজ নয়। সে যোগ্যতা থাকলে সম্পূর্ণ গণভিত্তির ওপর ভর করে একজন নেতা মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেন, আমাদের দুর্ভাগ্য সেই যোগ্যতা অধিকাংশ নেতা-নেত্রীরই নেই। শুধু তাই নয়, সব নেতা-নেত্রীই ক্রমান্বয়ে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন, তাই তাদের জনসংযোগ হয়ে পড়েছে মাধ্যমনিভৃর। সেই মাধ্যম নির্ণয়ের ক্ষেত্রে, নিজের জনসম্পৃক্ততা না থাকার কারণে, প্রকৃতপক্ষে জনমতের প্রতিনিধিত্ব করে এমন ব্যক্তি খুঁজে পান না তারা। বরং জনভীতি সৃষ্টির মাধ্যমে যারা বিকট চেহারায় হুঙ্কার ছাড়তে পারে, তাদের দিকেই চোখ পড়ে নেতাদের। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত বিস্তৃত না হয়ে, কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে ধাবিত ব্যবস্থায় এভাবেই মাস্তান তন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়। এসব স্থানীয় মাস্তানদের হাতে ব্যবহৃত ছাত্র মাস্তানরাই একদিন এসে যায় কেন্দ্রীয় পর্যায়ে।
No comments