ধর্ম- মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

মানুষের নাগরিক জীবনের মৌলিক অধিকারের প্রাথমিক বিষয় তার বেঁচে থাকার অধিকার। আর অপরকে বাঁচতে দেওয়া হলো নাগরিক কর্তব্যের মধ্যে অন্যতম, এটিই মানবাধিকারের মূলকথা।
সর্বজনীন মানবাধিকারের ধর্ম ইসলাম বিশ্বজনীন শান্তি, সম্প্রীতি ও মানবজাতির জন্য কল্যাণকামী একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ‘ইসলাম’ অর্থ মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে তাঁর নির্দেশ মান্য করার মাধ্যমে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা অর্জন। তাই পৃথিবীতে সত্য-ন্যায়ের মাধ্যমে সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানুষের নিরাপত্তা বজায় রাখা ইসলামের দৃষ্টিতে অপরিহার্য কর্তব্য এবং ইমানি দায়িত্ব। সুতরাং মানবসমাজে কোনো রকম অশান্তি সৃষ্টি, নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, হানাহানি, উগ্রতা, বর্বরতা ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ইসলামে নিষিদ্ধ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘আর তোমরা পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের পর এতে বিপর্যয় সৃষ্টি কোরো না।’ (সূরা আল-আ’রাফ, আয়াত: ৫৬)
ইসলাম মানবাধিকার লঙ্ঘনকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে; অন্যায়ভাবে হত্যাকাণ্ড, রক্তপাত ও অরাজকতা প্রত্যাখ্যান করেছে; সৎ ও ভালো কাজে সহযোগিতার নির্দেশ দিয়েছে, পাপ ও নির্যাতনমূলক কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেছে। শান্তি, সম্প্রীতি, সহাবস্থানের চেতনা এবং অর্থনৈতিক দর্শন ও অপরাধ দমন কৌশল ইসলামকে দিয়েছে সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা। কিন্তু শান্তির ধারক-বাহক জনগণের বিরুদ্ধে সর্বদাই অশান্তিকামী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী স্বার্থপর লোকেরা খড়্গহস্ত থাকে। এদের সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা (ইসলামের শত্রুরা) দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায়, আর আল্লাহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করেন না।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ৬৪)
সমাজে ইসলামের ন্যায়বিচারের মাধ্যমে বিশ্বমানবতার শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা হয়। সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সংঘাতমুক্ত পৃথিবীর প্রয়োজনে ইসলামের শান্তিপ্রিয় ও কল্যাণধর্মী আদর্শের বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। মানুষের সামগ্রিক জীবনের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ ও পূর্ণ নিরাপত্তা বিধানে ইসলাম এক অনন্য কালজয়ী আদর্শ। ইসলামে চরমপন্থা, জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদের কোনো স্থান নেই। ইসলামের যুদ্ধনীতি প্রতিরক্ষামূলক, আক্রমণাত্মক নয়; এমনকি প্রতিশোধমূলকও নয়। নবী করিম (সা.) কখনো একজন মানুষকে গুপ্তহত্যা করেননি। নানা অত্যাচার ও নির্যাতন সহ্য করেও কখনো বাড়াবাড়ি, কঠোরতা বা গোঁড়ামির পরিচয় দেননি, বরং দিন প্রচারের ক্ষেত্রে চরমপন্থা অবলম্বন করার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে ইসলামের সুমহান আদর্শ সমরনীতি ঘোষণা করেছেন, ‘তোমরা কখনো আগে অস্ত্র উত্তোলন কোরো না বা অস্ত্রের ভয়ভীতিও প্রদর্শন কোরো না।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুসলমান সেই ব্যক্তি, যার হাত ও মুখ থেকে অপর মুসলমান নিরাপদ।’ (বোখারি ও মুসলিম)
ইসলাম অন্যায়ভাবে মানবসন্তানকে হত্যা করা কঠোর ভাষায় নিষিদ্ধ করেছে। নিরপরাধ ব্যক্তিদের হত্যা করা ইসলামের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যাকে সবচেয়ে বড় গুনাহ বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তার পরিণাম সম্পর্কে সুস্পষ্ট ভাষায় পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘নরহত্যা বা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে হত্যা করল; আর কেউ কারও প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে প্রাণে রক্ষা করল।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত-৩২) মানুষের জীবনের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা তথা মানবাধিকার নিশ্চিত করতে পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হয়েছে, ‘আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন, যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তোমরা তাকে হত্যা কোরো না।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত-৩৩)
সমাজে বিশৃঙ্খলা, হানাহানি ও সন্ত্রাস দমনে শান্তির ধর্ম ইসলাম কঠোর দিকনির্দেশনা দিয়েছে এবং সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধে কঠিন শাস্তি আরোপ করেছে। ইসলামের আলোকে যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচলিত আইনে হত্যাকারী সন্ত্রাসীদের উপযুক্ত বিচার করা হয়, তাহলে আর কেউ সন্ত্রাস ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে সাহস পাবে না। পবিত্র কোরআনে নরহত্যাকে মহা অপরাধ সাব্যস্ত করে ইচ্ছাকৃতভাবে একজন মুসলমান আরেকজন মুসলমানকে হত্যাকাণ্ডের ন্যায় মানবাধিকার লঙ্ঘন করার শাস্তির কঠোর বিধান সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘কোনো মুমিনের জন্য সমীচীন নয় যে, সে অন্য মুমিনকে হত্যা করবে, অবশ্য ভুলবশত করে ফেললে অন্য কথা।...আর কেউ স্বেচ্ছায় কোনো মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম, সেখানে সে চিরকাল অবস্থান করবে। আর আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন ও তাকে অভিশপ্ত করেছেন এবং তার জন্য ভীষণ শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত ৯২-৯৩)
বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন পর্যায়ে সভ্য সমাজে যেভাবে নিরাপত্তাহীনতা, ফেতনা-ফাসাদ ও সন্ত্রাসবাদ চলছে, সর্বস্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে, এতে যেমন জননিরাপত্তাসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়, তেমনি সামাজিক কর্মকাণ্ডে দারুণভাবে ব্যাঘাত ঘটছে। যেসব বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী বিভিন্ন স্থানে নানা পর্যায়ে সন্ত্রাস, বোমাবাজি, গুপ্তঘাতকতা ও প্রকাশ্য দিবালোকে নরহত্যা, অপহরণ, হামলাসহ ইসলামবিরোধী মানবতাবিবর্জিত ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে, বাস্তবিকই তারা ইসলামের মর্মবাণীর সঙ্গে সম্পর্কহীনই বটে। এসব ফেতনা-ফাসাদ প্রতিরোধে কথা ও কলমের জিহাদ অব্যাহত রাখতে হবে। কেননা, সমাজে ফেতনা-ফাসাদ, মানবিক বিপর্যয়, নিরাপত্তাহীনতা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করাকে হত্যার চেয়েও জঘন্যতম অপরাধ সাব্যস্ত করা হয়েছে। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে যে, ‘দুনিয়া ধ্বংস করে দেওয়ার চেয়েও আল্লাহর কাছে ঘৃণিত কাজ হলো মানুষ হত্যা করা।’ (তিরমিজি)
মানবাধিকার মানুষের জন্মগত মৌলিক অধিকার। এসব অধিকার ছাড়া কোনো মানুষ আত্মমর্যাদা ও নিরাপত্তা সহকারে জীবন ধারণ করতে পারে না। আইনের শাসনের মূল বক্তব্য মানবাধিকারের গ্যারান্টি। যে সমাজে মানবাধিকারের অস্তিত্ব নেই, সে সমাজে আইনের শাসন নেই। মানুষের জানমালের নিরাপত্তাই যদি বিঘ্নিত হয়, তবে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে মানুষ এ পৃথিবীতে কীভাবে একত্রে শান্তিতে সহাবস্থান করবে? জীবনের ওপার থেকে তো মৃতকে ফিরিয়ে আনা যায় না। কিন্তু নির্মম হত্যাকাণ্ড, জিঘাংসা, অমানবিকতা, বর্বরতা, হিংস্রতার বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ব্যক্ত করা যায়, জোরালো প্রতিবাদ করা যায়, জনপ্রতিরোধ ও গণসচেতনতা গড়ে তোলা যায় এবং জীবিত মানুষের সেটাই অবশ্যকর্তব্য। ব্যর্থ হলে, শান্তিপ্রিয় যেকোনো মানুষের ওপরই জিঘাংসার হিংস্র কালো থাবা নেমে আসবে। তাই জননিরাপত্তার স্বার্থে ও সবার কল্যাণার্থে দলমত-নির্বিশেষে বিশ্বমানবতার ঐক্য ও পরমতসহিষ্ণুতার কোনো বিকল্প নেই।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.