দখিন হাওয়ার দুখী আড্ডা by শাকুর মজিদ
দখিন হাওয়ার আড্ডাটা একটা নতুন রূপ পেল ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের গোড়ার দিকে। হুমায়ূন আহমেদ যখন সিঙ্গাপুর থেকে ফিরেছেন এক দুঃসহ সংবাদ নিয়ে।
খবরটা আমি শুনি চার দিন আগে, সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখে, যেদিন মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের নিষ্ঠুর ডাক্তার তাঁকে এ দুঃসংবাদ শোনালেন। সিঙ্গাপুর থেকে খোকন ভাই (শহীদ হোসেন) এ খবর মাজহারকে প্রথম শোনান। মাজহারের কণ্ঠ থেকে স্বর বেরুচ্ছে না, আমিও কথা বলতে পারছি না। ঢাকার দুই প্রান্তে দুজন কানের কাছে ফোন লাগিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকি। একসময় মাজহার বলল, ‘খবরটা আপাতত কাউকে জানানোর দরকার নাই। খেয়াল রাখবা, মিডিয়া যেন কোনোভাবেই এটা না জানে।’
সে এ খবর আরও কয়েকজনকে জানায় এবং প্রত্যেককে আমার মতোই সাবধান করে দেয়। কিন্তু কেউ কেউ কথা রাখেননি। তাঁদের কাছ থেকে খবর চলে যায়। ১০ সেপ্টেম্বর রাতে তিনি যেদিন ঢাকায় এসে নামেন, তার পরদিনই কাগজে খবর বেরিয়ে যায়। দখিন হাওয়ার বাসায় আগমন শুরু হয় তাঁর স্বজনদের।
এমনিতে আমি কখনোই ডাক না পেলে তাঁর বাসায় যেতাম না। কারণ, প্রতি সন্ধ্যাতেই তিনি আড্ডার জন্য প্রস্তুতও থাকতেন না। কিন্তু এখন নিয়ম-কানুন সব পাল্টে গেছে। ঘরের মধ্যে ঢুকেই দেখি, ঠিক আগে যে রকম লেখা পাঠের আসর বসত, সে রকম একটা আড্ডার পরিবেশ। ড্রয়িংরুমের ফ্লোরের ওপর বিছানো কার্পেটের ওপর বসেছেন হুমায়ূন আহমেদ। দর্শক-শ্রোতারা যথেষ্ট মনমরা একটা ভাব মুখের মধ্যে রেখেছেন, কিন্তু যাঁর জন্য তাঁদের এই আবেগের প্রকাশ, তিনি যথেষ্ট হাসি-খুশির মধ্যে আছেন। তাঁর যেন ফুর্তির শেষ নেই। ক্যানসার ধরা পড়েছে, এ যেন এক অতি আনন্দের সংবাদ।
প্রথমবার আমেরিকার ভিসা পেলে যেমন ফুর্তি ফুর্তি একটা ভাব দেখা যায়, অনেকটা সে রকম। ভিসা কনফার্ম, শুধু টিকিট কাটা হয়নি। ডেট পাওয়া যাচ্ছে না বলে ডিপার্চার ডেট বলা যাচ্ছে না, তবে খুব দেরি হবে না—এমন কিছু।
মাজহারকে বলছেন, ‘তুমি কাল আমার কুলখানির ব্যবস্থা করো। আইটেম রাখবা ভাত, গরুর মাংস ভুনা আর কালাজিরার ডাল। আমার সব বন্ধুকে দাওয়াত দিয়ে দাও। আমি নিজ হাতে তাদের খাওয়াব। মরার পর যদি কোনো ভেজাল-টেজাল হয়, সবাই হয়তো দাওয়াতই পাবে না। আর শোনো, সন্ধ্যায় শোকসভাটাও করে ফেলো। মরার পর কে কী বলবে, আমি তো শুনতে পাব না।’
এর মধ্যে ফোন আসে। তিনি কথা বলেন, এপাশ থেকে, আমরা শুনি।
‘জি আপা, স্লামালেকুম...হ্যাঁ...হ্যাঁ...আমি তো যাচ্ছি, আপনার হাজব্যান্ডের সাথে দেখা হবে ওখানে, আপনার কোনো খবর থাকলে দিবেন, আমি বলে দেব...’—এসব।
কথা হচ্ছিল তাঁর কন্যা নোভার শাশুড়ির সঙ্গে। নোভার শ্বশুর নেই, মারা গেছেন অনেক আগে। তাঁর কথাই বলা হচ্ছিল।
আমরা শুনি। না হেসে পারি না। এ বড় কঠিন হাসি।
মনে পড়ে, বহু বছর আগে তাঁর লেখা দুই চরিত্রের একটা মঞ্চনাটকে [স্বপ্নবিলাস] ক্যানসার আক্রান্ত নায়িকাকে নিয়ে নায়কের কী রকম রসিকতাই না ছিল। দৃশ্যটা ছিল এমন যে একটা রেলস্টেশনের ওয়েটিং রুমে দুটো ছেলেমেয়ের দেখা হয়। তাদের সংলাপ এমন:
ছেলে: আপনার বাবার কী হয়েছে?
মেয়ে: ক্যানসার।
ছেলে: ক্যানসার হলে খামাখা চিকিৎসা করে টাকা নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। একটা বাঁশ দিয়ে ঠাস করে মাথায় বাড়ি দেন। যন্ত্রণা শেষ করে দেন।
মেয়ে: আপনি এসব কী বলছেন!
ছেলে: সত্যি কথা বলছি।
এখন যে লেখাটি তিনি পড়ে শোনাচ্ছেন তার নাম মাইন্ড গেইম। ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার খবর শোনার পরে তাঁর লেখক-সত্তা ঠিক আছে কি না, এটা পরীক্ষা করে দেখার জন্যই ছিল এই লেখা।
লেখা পড়া শেষ। হাততালি পড়ে। হুমায়ূন আহমেদ ভিডিও ক্যামেরায় প্যান করার মতো তাঁর চোখটি ঘোরান। লেফট টু রাইট। সবার মুখের দিকে তাকান। কে কেমন আচরণ করছে, দেখছেন।
এর মধ্যে আলমগীর ভাই খবর দিলেন, পূরবী বসুকে পাওয়া গেছে, স্লোন ক্যাটারিংয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্টের খবর নিচ্ছেন। মাজহার জানাচ্ছে, টিকিট হয়ে গেছে ১৪ তারিখ ভোরের ফ্লাইটে কুয়েত এয়ারওয়েজে। হুমায়ূন আহমেদ আলমগীর ভাইকে বলছেন, ‘পূরবীকে বলেন, ১৫ বা ১৬ তারিখেই যেন অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করে।’ শাওন ইন্টারনেট নিয়ে বসেছে হাসপাতালের কত কাছাকাছি দুই বেডরুমের ফার্নিশড ফ্ল্যাট কত কম ভাড়ায় পাওয়া যায় তার খোঁজখবর নিতে। আয়োজন দেখে মনে হচ্ছে, বেশ কয়েক মাসের জন্য তাঁদের থাকার চিন্তা।
সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত আসার পর এবং ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১১ রাত শেষে নিউইয়র্কের উদ্দেশে যাত্রা করার আগে পর্যন্ত আড্ডার হালচাল ছিল মোটামুটি এ রকমই।
১২ সেপ্টেম্বর ২০১১, আড্ডা বসেছে নিষাদের রুমে। এ রুমে ছয়-সাতজন বসা যায়, এসি আছে। লোকজন কম হলেও এ জায়গাই স্যারের বেশি পছন্দ। আড্ডায় আছেন জুয়েল আইচ, আলমগীর রহমান, মাহফুজুর রহমান খান, মাসুদ আখন্দ, মাজহার আর আমি। সেদিনও স্যারের সেই লেখা আবার পড়ে শোনানো হলো। বিমর্ষ মুখে শাওন পড়ছে। একসময় চ্যানেল আইয়ের অন্যতম পরিচালক ইবনে হাসান খান এলেন। হাসান আমাদের বহু আগে থেকেই পরিচিত। স্যারের খুব প্রিয়ভাজন। হাসান আসতেই শাওন বলল, ‘আমাদের একটা জরুরি মিটিং আছে।’ হাসান-মাজহার আর শাওন চলে গেল বাইরের ঘরে। তারা সম্ভবত স্যারের চিকিৎসার খরচবিষয়ক আলাপ-আলোচনা করবে। এর মধ্যে নতুন খবর নিয়ে ঘরে ঢুকলেন ডা. এজাজ। তিনি একই ধরনের রোগের তিনজন রোগীর কেস হিস্ট্রি দিলেন।
এই ফাঁকে হুমায়ূন আহমেদ নিজে শোনান তাঁর অসুখ ধরা পড়ার কথা। বিষয়টা ছিল এমন যে সিঙ্গাপুরে পায়ের চিকিৎসায় যাবেন শাওনের মা বেগম তহুরা আলী, এমপি। সঙ্গে গেলেন শাওন, হুমায়ূন আহমেদ ও বাচ্চাদের নিয়ে। শাশুড়ির চিকিৎসা চলছে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে। একপর্যায়ে তাঁর নিজেরও শরীরটা পরীক্ষা করানো দরকার মনে করলেন। রক্ত পরীক্ষা ও টিউমার মার্কিং টেস্টে অতি উচ্চ একটা মাত্রা ধরা পড়ল। চৈনিক চিকিৎসকের সঙ্গে তাঁর সংলাপ অনেকটা এ রকম ছিল:
ডাক্তার: আপনার পায়খানা কি ফিতার মতো, না মোটা মোটা?
হুমায়ূন: এটা খেয়াল করিনি।
ডাক্তার: মলের সঙ্গে কি রক্ত যেত?
হুমায়ূন: ভাই, আমি তো নিউজপেপার বিছিয়ে পায়খানা করি না, কী করে বলব?
আসলেই তাঁর রক্ত যেত। তিনি খেয়ালও করেছেন। হুমায়ূন আহমেদ আমল দেননি।
সিঙ্গাপুরের এ ডাক্তার তাঁর টিউমার টেস্টের খারাপ রেজাল্ট পেয়ে আরও কতগুলো পরীক্ষা করতে বলেন। তাঁর একটি হচ্ছে রেকটামের মধ্যে একটি টিউব প্রবেশ করিয়ে কিছু করা। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় এক রুমে।
এ পরীক্ষা করার জন্য এসেছে ‘অত্যন্ত রূপবতী’ এক তরুণী নার্স। সে ভারতীয়। হুমায়ূন আহমেদ কোনো অবস্থায় তাঁকে দিয়ে এ কাজ করতে দেবেন না। বললেন, ‘পুরুষ পাঠাও।’ মেয়েটি একসময় বলল, ‘ইফ আই কল ইউ পাপা, উইল ইউ লেট মি টু ডু সো?’
এ কথা শুনে তাঁর মন ভিজে গেল। তিনি বললেন, ‘ইয়েস, ইউ ক্যান ডু।’
মেয়েটি বলল, ‘পাপা, প্লিজ টার্ন অ্যাবাউট।’
হুমায়ূন আহমেদ পাশ ফিরলেন।
এই পরীক্ষার পরপরই আগের ডাক্তারের কাছে তাঁর রিপোর্ট চলে যায়। তিনি ডাক্তারের কাছে গিয়ে হাজির হন। চৈনিক ডাক্তার অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বরে বলেন, ইট ইজ পজিটিভ দ্যাট ইউ হ্যাভ ক্যানসার। নো ডাউট অ্যাবাউট ইট।
হুমায়ূন আহমেদ বলেন, ডাক্তার আমাকে খবরটা দিল এভাবে যে তোমার আমাশয় হয়েছে, কী আর করা, এমন কিছু।
এসব গল্পই তিনি বলছেন হাসতে হাসতে। এ সময় তাঁর শাশুড়িকে নিয়ে ঘটা আরেকটি ঘটনার কথা বলেন।
তাঁর শাশুড়ি একই হাসপাতালে এ সময় চিকিৎসা নিচ্ছেন এক ভারতীয় বাঙালি চিকিৎসকের কাছে। এ চিকিৎসক বাংলাদেশের লেখক হুমায়ূন আহমেদের কিছু বই পড়ছেন, আরও পড়তে চান। তিনি তাঁর রোগীদের প্রায়ই বলেন, আপনারা দেশে চলে যাচ্ছেন, আবার তো কিছুদিন পরে আসবেন। আসার সময় সম্ভব হলে হুমায়ূন আহমেদের কয়েকটি বই আমার জন্য নিয়ে আসবেন।
প্রায় সবাই বলে, ‘এটা কোনো বিষয়ই না, তিনি আমাদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড, প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসেন। বই নিয়ে আসব।’
‘আরে হুমায়ূন আহমেদ তো আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়...’।
‘এটা কোনো বিষয় হলো? আমার সাথে রেগুলার দেখা হয়, আমি প্রতিটি বইতে আপনার নাম লিখে সাইন করিয়ে নিয়ে আসব।’
কিন্তু কেউই আমাকে বই এনে দেয় না।
বেগম তহুরা আলী ডাক্তারকে বললেন, ‘উনি তো আমার মেয়ের জামাই।’
ডাক্তার ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইলেন।
(লেখকের প্রকাশিতব্য গ্রন্থ ‘হুমায়ূন আহমেদ: এক যে ছিল মুগ্ধকর’ থেকে নেওয়া।)
সে এ খবর আরও কয়েকজনকে জানায় এবং প্রত্যেককে আমার মতোই সাবধান করে দেয়। কিন্তু কেউ কেউ কথা রাখেননি। তাঁদের কাছ থেকে খবর চলে যায়। ১০ সেপ্টেম্বর রাতে তিনি যেদিন ঢাকায় এসে নামেন, তার পরদিনই কাগজে খবর বেরিয়ে যায়। দখিন হাওয়ার বাসায় আগমন শুরু হয় তাঁর স্বজনদের।
এমনিতে আমি কখনোই ডাক না পেলে তাঁর বাসায় যেতাম না। কারণ, প্রতি সন্ধ্যাতেই তিনি আড্ডার জন্য প্রস্তুতও থাকতেন না। কিন্তু এখন নিয়ম-কানুন সব পাল্টে গেছে। ঘরের মধ্যে ঢুকেই দেখি, ঠিক আগে যে রকম লেখা পাঠের আসর বসত, সে রকম একটা আড্ডার পরিবেশ। ড্রয়িংরুমের ফ্লোরের ওপর বিছানো কার্পেটের ওপর বসেছেন হুমায়ূন আহমেদ। দর্শক-শ্রোতারা যথেষ্ট মনমরা একটা ভাব মুখের মধ্যে রেখেছেন, কিন্তু যাঁর জন্য তাঁদের এই আবেগের প্রকাশ, তিনি যথেষ্ট হাসি-খুশির মধ্যে আছেন। তাঁর যেন ফুর্তির শেষ নেই। ক্যানসার ধরা পড়েছে, এ যেন এক অতি আনন্দের সংবাদ।
প্রথমবার আমেরিকার ভিসা পেলে যেমন ফুর্তি ফুর্তি একটা ভাব দেখা যায়, অনেকটা সে রকম। ভিসা কনফার্ম, শুধু টিকিট কাটা হয়নি। ডেট পাওয়া যাচ্ছে না বলে ডিপার্চার ডেট বলা যাচ্ছে না, তবে খুব দেরি হবে না—এমন কিছু।
মাজহারকে বলছেন, ‘তুমি কাল আমার কুলখানির ব্যবস্থা করো। আইটেম রাখবা ভাত, গরুর মাংস ভুনা আর কালাজিরার ডাল। আমার সব বন্ধুকে দাওয়াত দিয়ে দাও। আমি নিজ হাতে তাদের খাওয়াব। মরার পর যদি কোনো ভেজাল-টেজাল হয়, সবাই হয়তো দাওয়াতই পাবে না। আর শোনো, সন্ধ্যায় শোকসভাটাও করে ফেলো। মরার পর কে কী বলবে, আমি তো শুনতে পাব না।’
এর মধ্যে ফোন আসে। তিনি কথা বলেন, এপাশ থেকে, আমরা শুনি।
‘জি আপা, স্লামালেকুম...হ্যাঁ...হ্যাঁ...আমি তো যাচ্ছি, আপনার হাজব্যান্ডের সাথে দেখা হবে ওখানে, আপনার কোনো খবর থাকলে দিবেন, আমি বলে দেব...’—এসব।
কথা হচ্ছিল তাঁর কন্যা নোভার শাশুড়ির সঙ্গে। নোভার শ্বশুর নেই, মারা গেছেন অনেক আগে। তাঁর কথাই বলা হচ্ছিল।
আমরা শুনি। না হেসে পারি না। এ বড় কঠিন হাসি।
মনে পড়ে, বহু বছর আগে তাঁর লেখা দুই চরিত্রের একটা মঞ্চনাটকে [স্বপ্নবিলাস] ক্যানসার আক্রান্ত নায়িকাকে নিয়ে নায়কের কী রকম রসিকতাই না ছিল। দৃশ্যটা ছিল এমন যে একটা রেলস্টেশনের ওয়েটিং রুমে দুটো ছেলেমেয়ের দেখা হয়। তাদের সংলাপ এমন:
ছেলে: আপনার বাবার কী হয়েছে?
মেয়ে: ক্যানসার।
ছেলে: ক্যানসার হলে খামাখা চিকিৎসা করে টাকা নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। একটা বাঁশ দিয়ে ঠাস করে মাথায় বাড়ি দেন। যন্ত্রণা শেষ করে দেন।
মেয়ে: আপনি এসব কী বলছেন!
ছেলে: সত্যি কথা বলছি।
এখন যে লেখাটি তিনি পড়ে শোনাচ্ছেন তার নাম মাইন্ড গেইম। ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার খবর শোনার পরে তাঁর লেখক-সত্তা ঠিক আছে কি না, এটা পরীক্ষা করে দেখার জন্যই ছিল এই লেখা।
লেখা পড়া শেষ। হাততালি পড়ে। হুমায়ূন আহমেদ ভিডিও ক্যামেরায় প্যান করার মতো তাঁর চোখটি ঘোরান। লেফট টু রাইট। সবার মুখের দিকে তাকান। কে কেমন আচরণ করছে, দেখছেন।
এর মধ্যে আলমগীর ভাই খবর দিলেন, পূরবী বসুকে পাওয়া গেছে, স্লোন ক্যাটারিংয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্টের খবর নিচ্ছেন। মাজহার জানাচ্ছে, টিকিট হয়ে গেছে ১৪ তারিখ ভোরের ফ্লাইটে কুয়েত এয়ারওয়েজে। হুমায়ূন আহমেদ আলমগীর ভাইকে বলছেন, ‘পূরবীকে বলেন, ১৫ বা ১৬ তারিখেই যেন অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করে।’ শাওন ইন্টারনেট নিয়ে বসেছে হাসপাতালের কত কাছাকাছি দুই বেডরুমের ফার্নিশড ফ্ল্যাট কত কম ভাড়ায় পাওয়া যায় তার খোঁজখবর নিতে। আয়োজন দেখে মনে হচ্ছে, বেশ কয়েক মাসের জন্য তাঁদের থাকার চিন্তা।
সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত আসার পর এবং ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১১ রাত শেষে নিউইয়র্কের উদ্দেশে যাত্রা করার আগে পর্যন্ত আড্ডার হালচাল ছিল মোটামুটি এ রকমই।
১২ সেপ্টেম্বর ২০১১, আড্ডা বসেছে নিষাদের রুমে। এ রুমে ছয়-সাতজন বসা যায়, এসি আছে। লোকজন কম হলেও এ জায়গাই স্যারের বেশি পছন্দ। আড্ডায় আছেন জুয়েল আইচ, আলমগীর রহমান, মাহফুজুর রহমান খান, মাসুদ আখন্দ, মাজহার আর আমি। সেদিনও স্যারের সেই লেখা আবার পড়ে শোনানো হলো। বিমর্ষ মুখে শাওন পড়ছে। একসময় চ্যানেল আইয়ের অন্যতম পরিচালক ইবনে হাসান খান এলেন। হাসান আমাদের বহু আগে থেকেই পরিচিত। স্যারের খুব প্রিয়ভাজন। হাসান আসতেই শাওন বলল, ‘আমাদের একটা জরুরি মিটিং আছে।’ হাসান-মাজহার আর শাওন চলে গেল বাইরের ঘরে। তারা সম্ভবত স্যারের চিকিৎসার খরচবিষয়ক আলাপ-আলোচনা করবে। এর মধ্যে নতুন খবর নিয়ে ঘরে ঢুকলেন ডা. এজাজ। তিনি একই ধরনের রোগের তিনজন রোগীর কেস হিস্ট্রি দিলেন।
এই ফাঁকে হুমায়ূন আহমেদ নিজে শোনান তাঁর অসুখ ধরা পড়ার কথা। বিষয়টা ছিল এমন যে সিঙ্গাপুরে পায়ের চিকিৎসায় যাবেন শাওনের মা বেগম তহুরা আলী, এমপি। সঙ্গে গেলেন শাওন, হুমায়ূন আহমেদ ও বাচ্চাদের নিয়ে। শাশুড়ির চিকিৎসা চলছে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে। একপর্যায়ে তাঁর নিজেরও শরীরটা পরীক্ষা করানো দরকার মনে করলেন। রক্ত পরীক্ষা ও টিউমার মার্কিং টেস্টে অতি উচ্চ একটা মাত্রা ধরা পড়ল। চৈনিক চিকিৎসকের সঙ্গে তাঁর সংলাপ অনেকটা এ রকম ছিল:
ডাক্তার: আপনার পায়খানা কি ফিতার মতো, না মোটা মোটা?
হুমায়ূন: এটা খেয়াল করিনি।
ডাক্তার: মলের সঙ্গে কি রক্ত যেত?
হুমায়ূন: ভাই, আমি তো নিউজপেপার বিছিয়ে পায়খানা করি না, কী করে বলব?
আসলেই তাঁর রক্ত যেত। তিনি খেয়ালও করেছেন। হুমায়ূন আহমেদ আমল দেননি।
সিঙ্গাপুরের এ ডাক্তার তাঁর টিউমার টেস্টের খারাপ রেজাল্ট পেয়ে আরও কতগুলো পরীক্ষা করতে বলেন। তাঁর একটি হচ্ছে রেকটামের মধ্যে একটি টিউব প্রবেশ করিয়ে কিছু করা। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় এক রুমে।
এ পরীক্ষা করার জন্য এসেছে ‘অত্যন্ত রূপবতী’ এক তরুণী নার্স। সে ভারতীয়। হুমায়ূন আহমেদ কোনো অবস্থায় তাঁকে দিয়ে এ কাজ করতে দেবেন না। বললেন, ‘পুরুষ পাঠাও।’ মেয়েটি একসময় বলল, ‘ইফ আই কল ইউ পাপা, উইল ইউ লেট মি টু ডু সো?’
এ কথা শুনে তাঁর মন ভিজে গেল। তিনি বললেন, ‘ইয়েস, ইউ ক্যান ডু।’
মেয়েটি বলল, ‘পাপা, প্লিজ টার্ন অ্যাবাউট।’
হুমায়ূন আহমেদ পাশ ফিরলেন।
এই পরীক্ষার পরপরই আগের ডাক্তারের কাছে তাঁর রিপোর্ট চলে যায়। তিনি ডাক্তারের কাছে গিয়ে হাজির হন। চৈনিক ডাক্তার অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বরে বলেন, ইট ইজ পজিটিভ দ্যাট ইউ হ্যাভ ক্যানসার। নো ডাউট অ্যাবাউট ইট।
হুমায়ূন আহমেদ বলেন, ডাক্তার আমাকে খবরটা দিল এভাবে যে তোমার আমাশয় হয়েছে, কী আর করা, এমন কিছু।
এসব গল্পই তিনি বলছেন হাসতে হাসতে। এ সময় তাঁর শাশুড়িকে নিয়ে ঘটা আরেকটি ঘটনার কথা বলেন।
তাঁর শাশুড়ি একই হাসপাতালে এ সময় চিকিৎসা নিচ্ছেন এক ভারতীয় বাঙালি চিকিৎসকের কাছে। এ চিকিৎসক বাংলাদেশের লেখক হুমায়ূন আহমেদের কিছু বই পড়ছেন, আরও পড়তে চান। তিনি তাঁর রোগীদের প্রায়ই বলেন, আপনারা দেশে চলে যাচ্ছেন, আবার তো কিছুদিন পরে আসবেন। আসার সময় সম্ভব হলে হুমায়ূন আহমেদের কয়েকটি বই আমার জন্য নিয়ে আসবেন।
প্রায় সবাই বলে, ‘এটা কোনো বিষয়ই না, তিনি আমাদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড, প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসেন। বই নিয়ে আসব।’
‘আরে হুমায়ূন আহমেদ তো আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়...’।
‘এটা কোনো বিষয় হলো? আমার সাথে রেগুলার দেখা হয়, আমি প্রতিটি বইতে আপনার নাম লিখে সাইন করিয়ে নিয়ে আসব।’
কিন্তু কেউই আমাকে বই এনে দেয় না।
বেগম তহুরা আলী ডাক্তারকে বললেন, ‘উনি তো আমার মেয়ের জামাই।’
ডাক্তার ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইলেন।
(লেখকের প্রকাশিতব্য গ্রন্থ ‘হুমায়ূন আহমেদ: এক যে ছিল মুগ্ধকর’ থেকে নেওয়া।)
No comments