লালদীঘি ময়দানের জনসমুদ্রে খালেদা জিয়াঃ ব্যর্থ সরকারের প্রতি হুশিয়ারি
আওয়ামী মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের ১৫ মাসের মাথায় বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া এই প্রথম সরকারের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন। সোমবার চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানের জনসমুদ্রে তিনি সরকারকে চুক্তিবাজ, মামলাবাজ, দখলবাজ, দুর্নীতিবাজ আখ্যা দেন।
এক ঘণ্টারও বেশি সময় বক্তৃতায় তিনি সরকারের দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত না হওয়া, বিএনপিসহ বিরোধী নেতাকর্মীদের নির্যাতন, ইতিহাস বিকৃতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও ভারতের সঙ্গে দেশবিরোধী চুক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণের উদাত্ত আহ্বান জানান। অসাংবিধানিক জরুরি সরকারের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ২০০৮ সালের ৭ নভেম্বর জনসভার পর গত ২৯ মার্চ আবারও বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকেই তিনি বিভাগীয় পর্যায়ে জনসভার মধ্য দিয়ে মাঠে নামার ঘোষণা দেন।জিয়াউর রহমানই যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন লালদীঘির লাখো কণ্ঠে তার সমর্থন মিললেও সরকার এটা মানতে নারাজ বলেই বিমানবন্দর থেকে শুরু করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা থেকে জিয়ার নাম মুছে ফেলা হচ্ছে উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, আসলে আওয়ামী লীগ জিয়াকে ভয় পায়। কিন্তু কোনোভাবেই কোটি মানুষের মন থেকে জিয়াকে মুছে ফেলা যাবে না। শেখ মুজিবকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করা হলেও তার কোনো দলিল বা প্রমাণ নেই। খালেদা জিয়া দেশ গঠনে শেখ মুজিবের অবদান শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বলেন, তার পরিবার এবং আওয়ামী লীগ ইতিহাস বিকৃত করে তার প্রতি অসম্মান করছে। সরকারকে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী আখ্যায়িত করে তার প্রমাণ হিসেবে ভাষণে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন ১৯৮৬ সালে এ চট্টগ্রামের জনসভায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এরশাদের সঙ্গে নির্বাচনে যাবে না বলার পর নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ জাতীয় বেঈমান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। একইভাবে বিগত নির্বাচনে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতিও তারা ক্ষমতায় গিয়ে ভুলে গেছে। ১০ টাকায় চাল, বিনামূল্যে সার, ঘরে ঘরে চাকরি দিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। দেশজুড়ে অব্যাহত দুর্নীতি, সন্ত্রাস, হামলা-মামলার পাশাপাশি মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষা করতে ব্যর্থতার উল্লেখ করে ছাত্রলীগসহ সরকারি নির্যাতনের বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন খালেদা জিয়া। সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলে এমন অবস্থার সৃষ্টি করেছে, মানুষ এখন মোমবাতি, লাকড়ির চুলা আর হাতপাখা ব্যবহারে বাধ্য হচ্ছেন। এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে দেশ ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে। চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য বিএনপি জোট সরকার আমলে সহনীয় থাকলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও বর্তমান সরকারের আমলে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। দীর্ঘ বক্তৃতায় খালেদা জিয়া আরও বলেন, এক-এগারোর ষড়যন্ত্রকারীদের ক্ষমতাগ্রহণ ছিল সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ৫৮(খ) ধারা ভঙ্গ করেই বন্দুকের জোরে ফখরুদ্দীনকে ক্ষমতায় বসিয়ে মাইনাস-টু ফর্মুলা কার্যকর করা তিনি প্রতিহত করেন। এজন্য তাকে ও তার সন্তানদের অকথ্য নির্যাতন সইতে হয়েছে। অথচ সেই ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে জোগসাজশ করে ক্ষমতায় এসেছে বলেই বর্তমান সরকার সংবিধান লঙ্ঘনের কোনো বিচার করছে না। বিএনপির বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের জবাবে খালেদা জিয়া ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে নতুন করে ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ বৃদ্ধির কথা বলেন। আরও ৯টি প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য অর্থ সংস্থান করা হয়েছিল, যার মধ্যে ৮টির টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ হলেও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। পরবর্তী বা বর্তমান সরকার এগুলো শেষ করলে ২৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ পাওয়া যেত। জঘন্য মিথ্যাচারের আরেক উদাহরণ দৈনিক ১০টা খুনের ঘটনার পরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো থাকার কথা। খালেদা জিয়া বলিষ্ঠ কণ্ঠে চট্টগ্রাম বন্দর, টিপাইমুখ, করিডোর নিয়ে ভারতের সঙ্গে চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করে জনগণকে নিয়ে সব দেশবিরোধী চুক্তির বাস্তবায়ন প্রতিরোধ করার ঘোষণা দেন।
ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাস, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, লোডশেডিং, গ্যাস, পানি সঙ্কটে জর্জরিত আম-জনতার মনের কথাই ধ্বনিত হয়েছে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কণ্ঠে। সরকার পক্ষের ভয়ভীতি, বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে লাখো মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি এবং মুহুর্মুহু গগনবিদারী স্লোগান থেকেও যদি ক্ষমতাসীনদের বোধোদয় না হয় তাহলে পরিস্থিতি বদলে যেতে বাধ্য এটা জোর দিয়ে বলা যায়। পর্যায়ক্রমে দেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহরে সমাবেশের পর খালেদা জিয়ার মুখে ব্যর্থ সরকারের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলনের ডাক শুনতেই এখন দেশবাসী কান পেতে আছে।
No comments