ইটভাটার রসদ-বৃক্ষ ও পাহাড় গ্রাসের শেষ কোথায়?
ইমারত তৈরির জন্য ইট অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য ইট উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তা কেউ অস্বীকার করেন না। কিন্তু ইট উৎপাদন করতে গিয়ে পরিবেশ ও প্রকৃতির সমূহ ক্ষতিকেও নির্বিবাদে মেনে নেওয়ার কোনো উপায় নেই।
উন্নত দেশগুলো বহু আগে থেকে ইট উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক উপাদানের যথেচ্ছ ব্যবহারের লাগাম টেনে ধরেছে। মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ অপচয় করে যাতে ইট উৎপাদন করা না হয় সে জন্য যথাবিহিত নিয়ম চালু করেছে তারা। বিশেষত, ইট পোড়ানোর কাজে কাঠ ব্যবহারের পরিবর্তে ইলেকট্রনিক চুলি্লর ব্যবহার বহু আগে থেকেই শুরু হয়েছে। মাটি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সচেতনতা এসেছে। পাহাড় কেটে বা কৃষিজমির মূল্যবান মাটি ব্যবহার করে ইট উৎপাদিত হবে সে কথা অনেক দেশেই ভাবা যায় না। অনেক দেশই ঘরবাড়ি ও ইমারত তৈরিতে ইটের ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছে। ছোট ঘরবাড়ি সাধারণত পরিবেশবান্ধব উপাদানেই তৈরি হয়। আর বড় অট্টালিকা ও ইমারতের ক্ষেত্রে ইস্পাত, রূপান্তরিত লৌহ, স্টিল ব্যবহারের রীতি জনপ্রিয় হয়েছে। ভূমিকম্পসহ নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে এ উপাদানের ব্যবহার এখন প্রত্যাশিত শুধু নয়, অপরিহার্যও বটে। কিন্তু আমাদের দেশে ইটই এখনও ইমারত, অট্টালিকা, ঘরবাড়ি নির্মাণের প্রধান উপাদান। ফলে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ ইট প্রয়োজন হয়। কিন্তু ইট উৎপাদনের জন্য ভাটা কোথায় তৈরি হবে, ইটভাটাগুলো কোথাকার মাটি ব্যবহার করবে, ইট পোড়ানোর জন্য কোন জ্বালানি ব্যবহার করবে সে সম্পর্কে স্পষ্ট নীতিমালার দেখা মেলে না। কিছু নিয়ম-নীতি থাকলেও সেগুলো অনুসরণ করার বালাই কারও মধ্যে দেখা যায় না। ইট পোড়ানোর জন্য কাঠের বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার বলতে গেলে দেশে চালুই করা যায়নি। ফলে ইটভাটার গ্রাসে চলে যাচ্ছে বহুল পরিমাণ মূল্যবান বৃক্ষসম্পদ। নির্বিবাদে গাছ কাটার ফলে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কোনো অঞ্চলে ইটভাটা গড়ে উঠলে সে অঞ্চলটি দ্রুত মরুতে পরিণত হচ্ছে। ইটভাটা মানেই যেন বৃক্ষহীন, শস্যহীন বিরান প্রান্তর। কৃষিজমির মাটি কেটে ইটভাটার গ্রাস জোগানোর কারণে কৃষিজমিগুলো উর্বরতা হারাচ্ছে। বছরের পর বছর জমিগুলো শস্যহীন থাকছে। দেশের অর্থনীতির জন্য সুদূরপ্রসারী ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে ইটভাটাগুলো। শুধু কৃষিজমিই নয়, ইটভাটাগুলোর জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে পাহাড়ের মূল্যবান মাটি। চট্টগ্রাম অঞ্চলে একের পর এক পাহাড় কেটে ইটভাটায় ব্যবহার করা হচ্ছে বলে খবর মিলেছে। পাহাড় কাটার ফলে একদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিনাশ ঘটছে, অন্যদিকে প্রাকৃতিক সম্পদ ও প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষতি হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, প্রাকৃতিক ভারসাম্যের ক্ষেত্রে বড় ধরনের হেরফের ঘটছে। অঞ্চলগুলো পাহাড়ধসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকির মধ্যে চলে যাচ্ছে। অবিলম্বে ইটভাটাসহ অন্যান্য কর্মকাণ্ডে পাহাড়ের মাটি ব্যবহার বন্ধ করা দরকার। অথচ দায়িত্বরত কর্মকর্তারা সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করছেন না। অভিযোগ, উৎকোচের বিনিময়ে তাদের চুপ করে দেওয়া হয়েছে। এ অভিযোগ সত্য হলে, সেটি খুবই দুঃখজনক। আমরা আশা করব, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো দ্রুত সতর্ক হবে। পাহাড় কাটার যে মচ্ছব চলছে তা বন্ধ করার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেবে। দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃক্ষ নিধনের যে প্রক্রিয়া চলছে তা বন্ধ করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। এ জন্য বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পরিবেশ রক্ষার দায়িত্বও আমাদের পালন করে যেতে হবে।
No comments