আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা by আনিসুজ্জামান
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে আমি ছিলাম পূর্ববঙ্গের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের কনিষ্ঠ ছাত্র। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ার পর ঢাকার সেই অদ্বিতীয় থাকার গৌরবহানি হওয়ায় খানিকটা যে ক্ষুণ্ন হয়েছিলাম, তা স্বীকার করতে হয়।
আমাদের শিক্ষকদেরও অনেকে এখানে যোগ দিয়েছিলেন। তাতেও মনে হয়েছিল, নতুন এই প্রতিষ্ঠান আমাদের সম্পদে ভাগ বসাচ্ছে। আমি প্রথমবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আসি ১৯৫৮ সালে। তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ভবন তৈরি হয়নি—রাজশাহী কলেজকে কেন্দ্র করেই এর বিদ্যাদানের কাজ চলছিল। রাজশাহী কলেজের গ্রন্থাগারটি সমৃদ্ধ ছিল। বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির তখন ভগ্নদশা, তবু এর গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপির সংগ্রহ ছিল ঈর্ষণীয়। এই গ্রন্থাগার দুটির ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি ছিল। রাজশাহী পাবলিক লাইব্রেরিও বেশ ভালো ছিল। বিজ্ঞানশিক্ষার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দ্রুত পরীক্ষাগার স্থাপন করে ফেলছিল। তারপর তো মতিহারে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল ও সুদৃশ্য এলাকা গড়ে উঠল।
যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রদেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। তখন তার সর্বোচ্চ ছাত্রসংখ্যা ছিল কমবেশি আড়াই হাজার। এর মধ্যে আইনের শিক্ষার্থীরা ছিলেন। তাঁরা অনেকে দিনে চাকরি করতেন, সন্ধ্যায় আইন পড়তেন; ‘বেকার আছি’ বলতে ভালো না লাগায় অনেকে আইনের ক্লাসে নাম লিখিয়েছিলেন; অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী রাজনৈতিক কারণে ছাত্রজীবন প্রলম্বিত করার জন্য একই উপায় অবলম্বন করেছিলেন। এখন বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দুই অঙ্ক ছাড়ানোর উপক্রম করেছে। ছাত্রসংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। এতে হয়তো অনেক মেধাবী ছাত্র উচ্চশিক্ষালাভের এবং সেই সঙ্গে জীবনে প্রতিষ্ঠালাভের সুযোগ পেয়েছে, অন্যথায় তারা তা থেকে বঞ্চিত হতো। কিন্তু এত সব বিশ্ববিদ্যালয় সত্যিই প্রয়োজনীয় শিক্ষা-উপকরণ সংগ্রহে ও উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগে সমর্থ হয়েছে কি না, সে প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় সবগুলোই গড়ে উঠেছে ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শে। তবে ছাত্রসংখ্যার বিস্ফোরণে খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই আবাসিক ও শিক্ষাদানকারী চরিত্র প্রায় বিনষ্ট হয়ে গেছে। আবাসিক হলগুলো এখন পরিণত হয়েছে ছাত্রদের মেসে। প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ সেখানে শিথিল, শৃঙ্খলাও বিপর্যস্ত। হলগুলোর নির্বাচিত ছাত্রসংসদ নেই, তাদের ঘিরে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগত এবং শারীরিক ও মানসিক বিকাশের সুযোগ প্রায় তিরোহিত। টিউটোরিয়ালের ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। ছাত্র-শিক্ষকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও দুর্লভ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গড়ে উঠেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচে—কোনো একটি নির্দিষ্ট আদর্শ অনুসরণ করে নয়। এদের অনেকগুলো সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। তবু দিনে দিনে তার সংখ্যা বাড়ছে। কারণ বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিতের চাহিদা যত আছে, উচ্চশিক্ষার চাহিদা আছে তার চেয়ে অনেক বেশি। একই কারণে অনেক ক্ষেত্রে উপযুক্ত উপকরণ ও শিক্ষকের অভাব থাকা সত্ত্বেও প্রায় সোয়া দুই শ কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স পড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে ছাত্রসংখ্যা সাত লাখের বেশি। অনেকে মনে করে, উচ্চশিক্ষালাভ তাদের অধিকার। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রবেশাধিকার আছে কিংবা থাকা উচিত আসলে মেধাবীদের। আর নাগরিকমাত্রেরই আছে প্রাথমিক শিক্ষালাভের অধিকার—সে অধিকারও কিন্তু আমরা সবাইকে দিতে পারিনি।
ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তিলাভের পর আমাদের মতো দেশের সামনে শিক্ষার বিষয়ে দুটি পথ খোলা ছিল। নিজেদের স্বল্প সম্পদ দিয়ে আমরা কি দেশের সব মানুষকে ন্যূনতম শিক্ষাদানের চেষ্টা করব, নাকি সদ্য স্বাধীন দেশ গড়ার জন্য প্রশাসক-আইনজীবী-চিকিৎসক-প্রকৌশলী-শিক্ষক সৃষ্টির লক্ষ্যে উচ্চশিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করব। মালদ্বীপের মতো দেশ প্রথমটি বেছে নিয়েছিল। তারা কেবল স্কুলই স্থাপন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় দূরের কথা, কলেজও প্রতিষ্ঠা করেনি। স্কুলের শিক্ষা শেষ করে যারা আরও পড়তে চেয়েছে, তারা গেছে দক্ষিণ ভারতে বা শ্রীলঙ্কায়। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা গেছে বিলেত-আমেরিকায়। ভারতে বা পাকিস্তানে আমরা ঝুঁকেছিলাম উচ্চশিক্ষার দিকেই। তার ফল একদিকে ভালো হয়েছে হয়তো, অন্যদিকে হয়নি।
সাম্প্রতিককালে আমরা নিম্নশিক্ষার প্রতি অপেক্ষাকৃত বেশি মনোযোগ দিয়েছি। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ মিলে সেখানে সাফল্য এসেছে কম নয়। বিশেষত, এ ক্ষেত্রে মেয়েদের স্থান খুব আশাব্যঞ্জক। এখন আমরা প্রাথমিক
শিক্ষার ব্যাপ্তি বাড়াতে চাইছি—পাঁচ বছর থেকে আট বছরে। এটা জরুরি। তেমনি আমরা প্রাথমিক শিক্ষা আরও বেশিজনের কাছে নিয়ে যেতে চাইছি। সেটাও খুব দরকার। প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তিটা যত সম্প্রসারিত হয়, ততই মঙ্গল। কিন্তু এমন শিক্ষাবিস্তারে সমস্যাও আছে। উপযুক্ত শিক্ষক ও শিক্ষা উপকরণের অভাব তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
আমি একটি সমস্যার কথা বলব, তা হলো ভাষাশিক্ষার বিষয়। আমাদের ভাষাশিক্ষাপ্রণালি ত্রুটিপূর্ণ। তার ওপর, বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা শ্রেণীকক্ষে প্রায়ই আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেন, যা ছাত্রদের প্রমিত বাংলা শেখার অন্তরায় হয়। মাতৃভাষার যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে দ্বিতীয় ভাষা ইংরেজির অবস্থা কী হবে, তা সহজে অনুমেয়। বাংলা ভাষায় ছাত্রদের দুর্বলতা সহজে আমাদের চোখে পড়ে না। ফলে অনেকে অনুযোগ করেন, বাংলা বাংলা করে আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেল—ছেলেমেয়েরা ইংরেজি শিখছে না, তারা বিলেত-আমেরিকায় গিয়ে পড়াশোনা করবে কী করে!
সবাই হয়তো বিলেত-আমেরিকায় যাবে না, কিন্তু দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভালো করে শেখা দরকার। আরও দরকার প্রথম ভাষাটা নির্ভুলভাবে শেখার। ভাষা আত্মপ্রকাশের বাহন। ভাষাজ্ঞান না থাকলে নিজের বিকাশ অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। আমরা ভেবে দেখি না, দেশে ছেলেমেয়েরা বাংলা-ইংরেজি শিখতে হিমশিম খেয়ে যায়; অথচ ফ্রান্সে বা রাশিয়ায় গিয়ে এক বছরে সে-দেশের ভাষা শিখে পিএইচ ডি থিসিস লিখে ফেলে কী করে! এসব ক্ষেত্রে ভাষাশিক্ষার প্রণালি উন্নত—অডিও-ভিসুয়াল সিস্টেম তার সহায়। এখন আমরা স্কুলে স্কুলে কম্পিউটার দেওয়ার চেষ্টা করছি। তেমনি করে স্কুলে স্কুলে যদি শ্রবণ-দর্শনব্যবস্থা চালু করা যায়, তা ভাষাশিক্ষার সহায় হবে।
ভাষাশিক্ষার কথা এতক্ষণ ধরে বললাম, তার কারণ, অনেকেই আমাদের উচ্চশিক্ষার মানের সমালোচনা করে বলে থাকেন, এমএ পাস করা ছেলেমেয়ে ঠিকমতো ইংরেজি লিখতে বা বলতে পারে না। কদাচিৎ বাংলার কথাও হয়তো বলা হয়। আরেকটা সমালোচনা এই যে, অধীত বিষয়ে অনেক সময়েই তাদের অধিকার সন্তোষজনক নয়। শিক্ষার মান নেমে যাচ্ছে—এমন অভিযোগ কিন্তু দেড় শ বছর ধরেই করা হচ্ছে। তবু এসব সমালোচনায় সত্যতা যে নেই, তা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বলেন, কলেজ থেকে ওরা শিখে আসছে না; কলেজের শিক্ষকেরা বলেন, স্কুল থেকে শিখে আসছে না। ভাষা বিষয়ে এটা সত্য। অন্যপক্ষে, মুখস্থ বিদ্যার ওপরে এখনো জোর বেশি। শিক্ষার্থীদের বোঝার পরীক্ষা আমরা নিই না, আমরা নিই তাদের মুখস্থ করার ক্ষমতার পরীক্ষা।
এখানে শিক্ষার মাধ্যমের প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। মাতৃভাষা শিক্ষার বাহন হলে শিক্ষার্থীর বোঝার যে সুবিধা হতো, বিদেশি ভাষার মাধ্যমে পড়াশোনা করলে তা হয় না। একে মাতৃভাষায় পাঠ্যবইপত্র কম—অন্তত উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে—অন্যদিকে ইংরেজি বই পড়ে বাংলায় লিখতে পারার ক্ষমতার অভাব। সুতরাং মুখস্থই ভরসা।
উচ্চশিক্ষার পীঠস্থানে কেবল বিদ্যাদানই চলে না, জ্ঞান সৃষ্টি করা সেখানে অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে আমরা যে অনেক পিছিয়ে আছি, তা স্বীকার না করে উপায় নেই। আমাদের উচ্চশিক্ষাঙ্গনে ছাত্রদের হানাহানি একটা ভয়াবহ ব্যাপার। এটাকে আমি রাজনীতি বলতে রাজি নই, এটা একেবারেই অপরাধমূলক কাজ। তবে সে কাজ যারা করে, তারা রাজনীতিবিদদের প্রশ্রয় পেয়ে থাকে প্রায়ই। তবু এটা রাজনীতি নয়। ছাত্র রাজনীতি রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করবে না, রাজনৈতিক দলকে ঠিক পথে চলতে প্রভাবান্বিত করবে। কিন্তু ছাত্রদের কথা কেবল বলে লাভ কী! আমরা শিক্ষকেরাও যেভাবে দলাদলি করছি, রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করছি, সেটাও কি কম হতাশাব্যঞ্জক। রাজনৈতিক মত ও আদর্শ থাকা এক কথা, আর রাজনৈতিক দলের শর্তহীন লেজুড়বৃত্তি অন্য কথা। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা যখন স্বায়ত্তশাসন দাবি করেছিলাম, তখন আমরা ভাবিনি যে সেই স্বায়ত্তশাসনের অপব্যবহার করে আমরা শিক্ষকদের স্বার্থ দেখব কিংবা সরকারি দল ও বিরোধী দলের মতো পক্ষ গড়ে তুলব এবং সব বিষয়ে দলীয় বিবেচনাকে প্রাধান্য দেব। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে কোনো না কোনো অজুহাতে, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও ক্ষুদ্র স্বার্থের প্রভাব আজ সমগ্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষে ক্ষতিকর হতে চলেছে।
এমন পরিস্থিতিতে জ্ঞান আহরণ ও জ্ঞান সৃষ্টি দুই-ই দুরূহ। এই সংকট আমাদের পার হতে হবে। মেধার মর্যাদা দিতে হবে, ন্যায়বিচার করতে হবে। নইলে আমাদের অতি সাধের স্বায়ত্তশাসন নিতান্তই অর্থহীন হয়ে যাবে।
আজ যারা এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিলাভের সনদ নিয়ে যাচ্ছে, তাদের আমার আন্তরিক অভিনন্দন। তাদের উদ্দেশে আমি দু-একটি কথা বলতে চাই। আজ আমার বক্তব্যে যেসব কথা বলেছি, তারই আলোকে তাদের কাছে আমি দাবি করব, তারা যেন অন্তত একটি ভাষায় হলেও নিজেকে যথাযথভাবে প্রকাশ করতে সমর্থ হয়। আর অধীত জ্ঞান যেন যথাযথ প্রয়োগ করতে পারে। যদি এ ক্ষেত্রে নিজের কোনো অসম্পূর্ণতা থেকে থাকে, তা দূর করার চেষ্টা করতে হবে। জ্ঞানের যেমন শেষ নেই, শেখারও তেমনি শেষ নেই। তাদের কাছে আমার আরও বক্তব্য এই যে, তারা যে আজ শিক্ষাজীবনে সফলতা লাভ করেছে, তার জন্য পরিবারের কাছে, শিক্ষকদের কাছে, দেশের কাছে তাদের ঋণ রয়েছে। পরিবারের প্রতি তারা কর্তব্য করবে, শিক্ষকদের কাছে ঋণ স্বীকার করবে—এই আশা করি। আর আশা করি, জীবনে যেখানেই তারা থাকুক না কেন, দেশকে তারা মনে রাখবে এবং কোনো না কোনো উপায়ে দেশকে কিছু দেওয়ার চেষ্টা করবে।
৯ ডিসেম্বর ২০১২ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অষ্টম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পঠিত
যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রদেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। তখন তার সর্বোচ্চ ছাত্রসংখ্যা ছিল কমবেশি আড়াই হাজার। এর মধ্যে আইনের শিক্ষার্থীরা ছিলেন। তাঁরা অনেকে দিনে চাকরি করতেন, সন্ধ্যায় আইন পড়তেন; ‘বেকার আছি’ বলতে ভালো না লাগায় অনেকে আইনের ক্লাসে নাম লিখিয়েছিলেন; অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী রাজনৈতিক কারণে ছাত্রজীবন প্রলম্বিত করার জন্য একই উপায় অবলম্বন করেছিলেন। এখন বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দুই অঙ্ক ছাড়ানোর উপক্রম করেছে। ছাত্রসংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। এতে হয়তো অনেক মেধাবী ছাত্র উচ্চশিক্ষালাভের এবং সেই সঙ্গে জীবনে প্রতিষ্ঠালাভের সুযোগ পেয়েছে, অন্যথায় তারা তা থেকে বঞ্চিত হতো। কিন্তু এত সব বিশ্ববিদ্যালয় সত্যিই প্রয়োজনীয় শিক্ষা-উপকরণ সংগ্রহে ও উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগে সমর্থ হয়েছে কি না, সে প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় সবগুলোই গড়ে উঠেছে ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শে। তবে ছাত্রসংখ্যার বিস্ফোরণে খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই আবাসিক ও শিক্ষাদানকারী চরিত্র প্রায় বিনষ্ট হয়ে গেছে। আবাসিক হলগুলো এখন পরিণত হয়েছে ছাত্রদের মেসে। প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ সেখানে শিথিল, শৃঙ্খলাও বিপর্যস্ত। হলগুলোর নির্বাচিত ছাত্রসংসদ নেই, তাদের ঘিরে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগত এবং শারীরিক ও মানসিক বিকাশের সুযোগ প্রায় তিরোহিত। টিউটোরিয়ালের ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। ছাত্র-শিক্ষকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও দুর্লভ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গড়ে উঠেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচে—কোনো একটি নির্দিষ্ট আদর্শ অনুসরণ করে নয়। এদের অনেকগুলো সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। তবু দিনে দিনে তার সংখ্যা বাড়ছে। কারণ বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিতের চাহিদা যত আছে, উচ্চশিক্ষার চাহিদা আছে তার চেয়ে অনেক বেশি। একই কারণে অনেক ক্ষেত্রে উপযুক্ত উপকরণ ও শিক্ষকের অভাব থাকা সত্ত্বেও প্রায় সোয়া দুই শ কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স পড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে ছাত্রসংখ্যা সাত লাখের বেশি। অনেকে মনে করে, উচ্চশিক্ষালাভ তাদের অধিকার। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রবেশাধিকার আছে কিংবা থাকা উচিত আসলে মেধাবীদের। আর নাগরিকমাত্রেরই আছে প্রাথমিক শিক্ষালাভের অধিকার—সে অধিকারও কিন্তু আমরা সবাইকে দিতে পারিনি।
ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তিলাভের পর আমাদের মতো দেশের সামনে শিক্ষার বিষয়ে দুটি পথ খোলা ছিল। নিজেদের স্বল্প সম্পদ দিয়ে আমরা কি দেশের সব মানুষকে ন্যূনতম শিক্ষাদানের চেষ্টা করব, নাকি সদ্য স্বাধীন দেশ গড়ার জন্য প্রশাসক-আইনজীবী-চিকিৎসক-প্রকৌশলী-শিক্ষক সৃষ্টির লক্ষ্যে উচ্চশিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করব। মালদ্বীপের মতো দেশ প্রথমটি বেছে নিয়েছিল। তারা কেবল স্কুলই স্থাপন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় দূরের কথা, কলেজও প্রতিষ্ঠা করেনি। স্কুলের শিক্ষা শেষ করে যারা আরও পড়তে চেয়েছে, তারা গেছে দক্ষিণ ভারতে বা শ্রীলঙ্কায়। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা গেছে বিলেত-আমেরিকায়। ভারতে বা পাকিস্তানে আমরা ঝুঁকেছিলাম উচ্চশিক্ষার দিকেই। তার ফল একদিকে ভালো হয়েছে হয়তো, অন্যদিকে হয়নি।
সাম্প্রতিককালে আমরা নিম্নশিক্ষার প্রতি অপেক্ষাকৃত বেশি মনোযোগ দিয়েছি। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ মিলে সেখানে সাফল্য এসেছে কম নয়। বিশেষত, এ ক্ষেত্রে মেয়েদের স্থান খুব আশাব্যঞ্জক। এখন আমরা প্রাথমিক
শিক্ষার ব্যাপ্তি বাড়াতে চাইছি—পাঁচ বছর থেকে আট বছরে। এটা জরুরি। তেমনি আমরা প্রাথমিক শিক্ষা আরও বেশিজনের কাছে নিয়ে যেতে চাইছি। সেটাও খুব দরকার। প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তিটা যত সম্প্রসারিত হয়, ততই মঙ্গল। কিন্তু এমন শিক্ষাবিস্তারে সমস্যাও আছে। উপযুক্ত শিক্ষক ও শিক্ষা উপকরণের অভাব তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
আমি একটি সমস্যার কথা বলব, তা হলো ভাষাশিক্ষার বিষয়। আমাদের ভাষাশিক্ষাপ্রণালি ত্রুটিপূর্ণ। তার ওপর, বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা শ্রেণীকক্ষে প্রায়ই আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেন, যা ছাত্রদের প্রমিত বাংলা শেখার অন্তরায় হয়। মাতৃভাষার যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে দ্বিতীয় ভাষা ইংরেজির অবস্থা কী হবে, তা সহজে অনুমেয়। বাংলা ভাষায় ছাত্রদের দুর্বলতা সহজে আমাদের চোখে পড়ে না। ফলে অনেকে অনুযোগ করেন, বাংলা বাংলা করে আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেল—ছেলেমেয়েরা ইংরেজি শিখছে না, তারা বিলেত-আমেরিকায় গিয়ে পড়াশোনা করবে কী করে!
সবাই হয়তো বিলেত-আমেরিকায় যাবে না, কিন্তু দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভালো করে শেখা দরকার। আরও দরকার প্রথম ভাষাটা নির্ভুলভাবে শেখার। ভাষা আত্মপ্রকাশের বাহন। ভাষাজ্ঞান না থাকলে নিজের বিকাশ অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। আমরা ভেবে দেখি না, দেশে ছেলেমেয়েরা বাংলা-ইংরেজি শিখতে হিমশিম খেয়ে যায়; অথচ ফ্রান্সে বা রাশিয়ায় গিয়ে এক বছরে সে-দেশের ভাষা শিখে পিএইচ ডি থিসিস লিখে ফেলে কী করে! এসব ক্ষেত্রে ভাষাশিক্ষার প্রণালি উন্নত—অডিও-ভিসুয়াল সিস্টেম তার সহায়। এখন আমরা স্কুলে স্কুলে কম্পিউটার দেওয়ার চেষ্টা করছি। তেমনি করে স্কুলে স্কুলে যদি শ্রবণ-দর্শনব্যবস্থা চালু করা যায়, তা ভাষাশিক্ষার সহায় হবে।
ভাষাশিক্ষার কথা এতক্ষণ ধরে বললাম, তার কারণ, অনেকেই আমাদের উচ্চশিক্ষার মানের সমালোচনা করে বলে থাকেন, এমএ পাস করা ছেলেমেয়ে ঠিকমতো ইংরেজি লিখতে বা বলতে পারে না। কদাচিৎ বাংলার কথাও হয়তো বলা হয়। আরেকটা সমালোচনা এই যে, অধীত বিষয়ে অনেক সময়েই তাদের অধিকার সন্তোষজনক নয়। শিক্ষার মান নেমে যাচ্ছে—এমন অভিযোগ কিন্তু দেড় শ বছর ধরেই করা হচ্ছে। তবু এসব সমালোচনায় সত্যতা যে নেই, তা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বলেন, কলেজ থেকে ওরা শিখে আসছে না; কলেজের শিক্ষকেরা বলেন, স্কুল থেকে শিখে আসছে না। ভাষা বিষয়ে এটা সত্য। অন্যপক্ষে, মুখস্থ বিদ্যার ওপরে এখনো জোর বেশি। শিক্ষার্থীদের বোঝার পরীক্ষা আমরা নিই না, আমরা নিই তাদের মুখস্থ করার ক্ষমতার পরীক্ষা।
এখানে শিক্ষার মাধ্যমের প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। মাতৃভাষা শিক্ষার বাহন হলে শিক্ষার্থীর বোঝার যে সুবিধা হতো, বিদেশি ভাষার মাধ্যমে পড়াশোনা করলে তা হয় না। একে মাতৃভাষায় পাঠ্যবইপত্র কম—অন্তত উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে—অন্যদিকে ইংরেজি বই পড়ে বাংলায় লিখতে পারার ক্ষমতার অভাব। সুতরাং মুখস্থই ভরসা।
উচ্চশিক্ষার পীঠস্থানে কেবল বিদ্যাদানই চলে না, জ্ঞান সৃষ্টি করা সেখানে অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে আমরা যে অনেক পিছিয়ে আছি, তা স্বীকার না করে উপায় নেই। আমাদের উচ্চশিক্ষাঙ্গনে ছাত্রদের হানাহানি একটা ভয়াবহ ব্যাপার। এটাকে আমি রাজনীতি বলতে রাজি নই, এটা একেবারেই অপরাধমূলক কাজ। তবে সে কাজ যারা করে, তারা রাজনীতিবিদদের প্রশ্রয় পেয়ে থাকে প্রায়ই। তবু এটা রাজনীতি নয়। ছাত্র রাজনীতি রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করবে না, রাজনৈতিক দলকে ঠিক পথে চলতে প্রভাবান্বিত করবে। কিন্তু ছাত্রদের কথা কেবল বলে লাভ কী! আমরা শিক্ষকেরাও যেভাবে দলাদলি করছি, রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করছি, সেটাও কি কম হতাশাব্যঞ্জক। রাজনৈতিক মত ও আদর্শ থাকা এক কথা, আর রাজনৈতিক দলের শর্তহীন লেজুড়বৃত্তি অন্য কথা। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা যখন স্বায়ত্তশাসন দাবি করেছিলাম, তখন আমরা ভাবিনি যে সেই স্বায়ত্তশাসনের অপব্যবহার করে আমরা শিক্ষকদের স্বার্থ দেখব কিংবা সরকারি দল ও বিরোধী দলের মতো পক্ষ গড়ে তুলব এবং সব বিষয়ে দলীয় বিবেচনাকে প্রাধান্য দেব। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে কোনো না কোনো অজুহাতে, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও ক্ষুদ্র স্বার্থের প্রভাব আজ সমগ্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষে ক্ষতিকর হতে চলেছে।
এমন পরিস্থিতিতে জ্ঞান আহরণ ও জ্ঞান সৃষ্টি দুই-ই দুরূহ। এই সংকট আমাদের পার হতে হবে। মেধার মর্যাদা দিতে হবে, ন্যায়বিচার করতে হবে। নইলে আমাদের অতি সাধের স্বায়ত্তশাসন নিতান্তই অর্থহীন হয়ে যাবে।
আজ যারা এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিলাভের সনদ নিয়ে যাচ্ছে, তাদের আমার আন্তরিক অভিনন্দন। তাদের উদ্দেশে আমি দু-একটি কথা বলতে চাই। আজ আমার বক্তব্যে যেসব কথা বলেছি, তারই আলোকে তাদের কাছে আমি দাবি করব, তারা যেন অন্তত একটি ভাষায় হলেও নিজেকে যথাযথভাবে প্রকাশ করতে সমর্থ হয়। আর অধীত জ্ঞান যেন যথাযথ প্রয়োগ করতে পারে। যদি এ ক্ষেত্রে নিজের কোনো অসম্পূর্ণতা থেকে থাকে, তা দূর করার চেষ্টা করতে হবে। জ্ঞানের যেমন শেষ নেই, শেখারও তেমনি শেষ নেই। তাদের কাছে আমার আরও বক্তব্য এই যে, তারা যে আজ শিক্ষাজীবনে সফলতা লাভ করেছে, তার জন্য পরিবারের কাছে, শিক্ষকদের কাছে, দেশের কাছে তাদের ঋণ রয়েছে। পরিবারের প্রতি তারা কর্তব্য করবে, শিক্ষকদের কাছে ঋণ স্বীকার করবে—এই আশা করি। আর আশা করি, জীবনে যেখানেই তারা থাকুক না কেন, দেশকে তারা মনে রাখবে এবং কোনো না কোনো উপায়ে দেশকে কিছু দেওয়ার চেষ্টা করবে।
৯ ডিসেম্বর ২০১২ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অষ্টম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পঠিত
No comments