বিষমুক্ত খাদ্য চাই by হায়দার আকবর খান রনো
ফরমালিন ও খাদ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক মেশানোর ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে লেখালেখি কম হয়নি। কালের কণ্ঠেই পরপর কয়েক সংখ্যায় প্রথম পাতায় বড় বড় করে লেখা হয়েছে। টেলিভিশনে আলোচিত হয়েছে। লিচুগাছে রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রণের কারণে সেই গাছের লিচু খেয়ে ১২টি বালক মারা যায়। তাদের মধ্যে একটি ছেলে ছিল বাগান মালিকেরও।
এত ঘটনার পরও, এত সর্বনাশের পরও সরকারের টনক নড়ছে বলে মনে হয় না। ব্যবস্থা নিচ্ছি-নেব, আইনগত সুবিধা-অসুবিধা, কোন কর্তৃপক্ষের কাজ ইত্যাদি শুনতে আর ভালো লাগে না। শুধু ভালো লাগালাগির বিষয় নয়। রীতিমতো ক্রোধ ও অসম্ভব উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। আমার বয়স এখন ৭০ বছর। ফরমালিন না খেলেও আমি হয়তো আর খুব বেশি দিন বাঁচব না। খাদ্যে ফরমালিনের চল তো মাত্র সেদিন থেকে শুরু হয়েছে। এতকাল ফরমালিন না খাওয়ায় এত বছর বাঁচতে পেরেছি। কিন্তু আজ যারা শিশু, তরুণ অথবা মাঝবয়সী, তাদের কি স্লো পয়জন করে মেরে ফেলার মহা উদ্যোগে আমরা শামিল হচ্ছি? পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে, ডাক্তার-বিশেষজ্ঞরা বহুবার বলেছেন, ফরমালিন খেলে মানুষ ক্যান্সার, কিডনি রোগসহ আরো অনেক ধরনের মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হবেই। আমরা কি গোটা দেশের মানুষকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলব? এই ভয়ংকর মরণ খেলায় যারা মুনাফার জন্য মেতে আছে, তাদের মৃত্যুদণ্ডের মতো শাস্তি দিয়ে অতিদ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তৎপর হওয়া সরকারের উচিত ছিল। কিন্তু এর সামান্যতম লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। সরকারের পক্ষে এ ধরনের অবহেলা রীতিমতো অপরাধ। এত বড় অপরাধের কোনো ক্ষমা নেই।
আমরা তো বেশি কিছু চাচ্ছি না। আমরা বলছি, বিষমুক্ত খাদ্য চাই। বড় বেশি দাবি হলো? আর এটাই যদি সরকার দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তো সরকারের ক্ষমতায় থাকার কোনো নৈতিক অধিকারই থাকে না।
মুনাফা এবং মুনাফার জন্য যেকোনো ধরনের পাপ কাজ করতে বিরত হয় না বুর্জোয়া শ্রেণী। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্গেই যে অনৈতিকতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, এটা নতুন কোনো কথা নয়। দেড় শ বছর আগে লেখা কার্ল মার্কসের ঐতিহাসিক গ্রন্থ 'ডাস ক্যাপিটাল'-এ পুঁজিবাদী লোভ ও মুনাফার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে উল্লেখ আছে। পুঁজি গ্রন্থের প্রথম খণ্ড থেকে কয়েকটা লাইন উদ্ধৃত করা যাক।
'যথেষ্ট মুনাফা পেলে পুঁজি খুবই তেজি হয়ে ওঠে। ১০ শতাংশ মুনাফা নিশ্চিত জানলে সে যেকোনো জায়গায় নিজেকে নিয়োগ করবে; ২০ শতাংশ নিশ্চিত জানলে নিয়োগের আগ্রহ প্রবলতর রূপে দেখা দেবে; ৫০ শতাংশ সুনিশ্চিত হলে দেখা দেবে স্পর্ধা; আর মুনাফা যদি ১০০ শতাংশে পৌঁছানোর নিশ্চয়তা থাকে, তবে এর জন্য মানবসমাজের সব আইনকে পদদলিত করতে সে রাজি। আর যদি সে বোঝে মুনাফা ৩০০ শতাংশে পৌঁছাবে, তবে এমন কোনো অপরাধ নেই যা করতে সে দ্বিধান্বিত হবে। এমন কোনো ঝুঁকি নেই, যা সে নিতে পারবে না। এমনকি তার ফলে যদি পুঁজি-প্রভুর ফাঁসির ঝুঁকি হয়, তাতেও সে রাজি।'
মাছ, ফল, সবজি, দুধ, সব কিছুতেই ফরমালিন মিশিয়ে দীর্ঘদিন টাটকাভাব রাখার জন্য যে কৌশল, তা যতই অনৈতিক হোক, যতই বিষাক্ত হোক, মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের কাছে তা কোনো বিবেচনার বিষয় নয়। মাছকে তাজা রাখার জন্য আগে বরফ দেওয়া হতো। এটা বহুকাল ধরে চলে আসছে। বরফ দেওয়া কোনো অপরাধ নয়। কিন্তু ৩১ আগস্ট কালের কণ্ঠে একটি খবর পড়ে আমি চমকে গেলাম, আতঙ্কিত হয়ে উঠলাম। যেহেতু বরফের চেয়ে ফরমালিনের দাম কম তাই বরফের বদলে ফরমালিন দেওয়া হচ্ছে। ফরমালিনের কার্যকারিতা বেশি বলে বরফেও কয়েক ফোঁটা ফরমালিন মিশিয়ে দেওয়া হয়। কী সর্বনাশ! নৈতিকতার মান কোথায় নেমেছে!
একটু আগে কার্ল মার্কসের উদ্ধৃতি থেকে জানলাম, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নৈতিকতা বলে কিছু নেই। কার্ল মার্কস না বললেও আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, বুর্জোয়ারা নৈতিকতার ধার ধারে না। বুর্জোয়ার কাছে মুনাফাই একমাত্র আরাধ্য দেবতা। সেই দেবতা যদি বিষ মিশ্রণে মানুষ খুন করে, তবু সেই-ই পুঁজিবাদের দেবতা। পুঁজিবাদের কাছে সাধারণভাবে নৈতিকতা, মনুষ্যত্ব, মানবতা বলে কিছুই নেই, আগেও ছিল না। এর পরও কিছু প্রশ্ন জাগে। পুঁজিবাদী দেশ তো পৃথিবীতে আরো আছে। পুঁজিবাদের স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে দুর্নীতি, অনৈতিকতা, মুনাফার জন্য জঘন্য ধরনের অপরাধ সবই চলে পৃথিবীর সব পুঁজিবাদী দেশে। একমাত্র সমাজতান্ত্রিক সমাজ যখন পৃথিবীতে ছিল, তারাই কেবল শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে পারত, নিশ্চিত করে বলতে পারত এই সমাজে মুনাফা বলে কিছু নেই আর তাই নেই মুনাফার জন্য ভেজাল অথবা অনৈতিক কারবার। যা-ই হোক, পুঁজিবাদী দেশে ভেজাল আর দুর্নীতি থাকলেও একমাত্র বাংলাদেশ বাদে আর কোথাও কি আছে খাদ্যে ফরমালিন মেশানোর ঘটনা? নেই। বেনাপোলের ওপারে বনগায়ে কেউ ফরমালিন খায় না। টেকনাফের সীমান্ত পার হয়ে মিয়ানমারে কেউ ফরমালিন যুক্ত মাছ, ফল খায় না। পাকিস্তানের মতো একটি দুর্বৃত্তের দেশ, যে দেশে গণতন্ত্র সব সময় সংকটের মধ্যে রয়েছে, অস্থিরতা যার নিত্যদিনের বৈশিষ্ট্য, সেই দেশেও খাদ্যে ফরমালিন ব্যবহার হয় না। তালেবানদের আফগানিস্তানে হেরোইনের চাষ ও হেরোইন ব্যবসা চলে। কিন্তু সেখানেও খাবারে কেউ ফরমালিন মেশায় না। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, পুঁজিবাদী ইউরোপ, সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা, উত্তাল লাতিন আমেরিকা, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, দূরপ্রাচ্য, প্রশান্ত মহাসাগরের কোনো দ্বীপ দেশ- কোথাও দেখবেন না খাদ্যে ফরমালিনের চল। আমরা কি নৈতিক দিক দিয়ে সবার চেয়ে নিচে? ছি! ছি! এটা ভাবতেও তো গা শিউরে ওঠে।
অথচ আমাদের দেশে স্বাধীনতা লাভের পর পর অন্তত তিন মাস থানার পুলিশ পর্যন্ত ঘুষ খায়নি। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের দালালদের আক্রমণ ছাড়া কোথাও সাধারণ চুরি-ডাকাতি হয়নি। মানুষের নৈতিক মান কত উন্নত জায়গায় পৌঁছেছিল। হায়! এখন তার এই পরিণতি! এতটাই অধঃপতন।
ফরমালিনের ব্যবহার সম্পর্কে অবশ্য সরকারি কিছু বিধিবিধান আছে। ব্যবহারকারী ও বিক্রয়কারীদের সরকারি অনুমোদন লাগে। কালের কণ্ঠের ২৮ আগস্টের রিপোর্ট থেকে জানলাম, ওসব পেতে তেমন কোনো অসুবিধা নেই। একে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে দালালচক্র ও সিন্ডিকেট। সরকার বা প্রশাসনের ওপরতলার বড়কর্তাদের অংশগ্রহণ, সহযোগিতা বা আশীর্বাদ ছাড়া এমন সিন্ডিকেট গড়ে উঠতে পারে না। রাজস্ব বোর্ডের রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে যে ফরমালিনের আমদানি সাম্প্রতিক সময়ে দ্বিগুণ হয়েছে। কালের কণ্ঠের রিপোর্টই বলছে যে আগোরা, হলমার্ক, স্বপ্ন প্রভৃতি চেইনশপেও মাছ ও ফলে ফরমালিন পাওয়া গেছে। দুধে ফরমালিন আছে। এর মানে শিশুদেরও সুশৃঙ্খলভাবে হত্যা করার সব ব্যবস্থাই তৈরি আছে। এ এক অসম্ভব পরিস্থিতি। এ এক অসহনীয় অবস্থা। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া হবে রাজনৈতিক মতাদর্শ, দল ও শ্রেণী-নির্বিশেষে সব নাগরিকের প্রধান কাজ। সরকারকে সবার ওপরে মানুষকে বিষের হাত থেকে বাঁচানোর দায়িত্ব নিতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন হলে নতুন আইন করতে হবে। ফরমালিন অথবা অন্য কোনো ধরনের রাসায়নিক মিশ্রণের বিরুদ্ধে কঠোরতম শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা রেখে তা কার্যকর করতে হবে। ফরমালিন যারা খাদ্যে মেশাচ্ছে, যারা তা বহন করছে এবং বিক্রি করছে, সবার জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতেই হবে। যারা এ ধরনের বিষ মেশাচ্ছে তাদের মৃত্যুদণ্ড হওয়া বাঞ্ছনীয়। যারা জেনেশুনে তা বহন বা বিক্রি করছে তাদের জন্যও একই শাস্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়। সরাসরি বিষ মেশানোর কাজে যুক্ত না থাকলেও যারা ভালোভাবে পরীক্ষা না করে মাছ, ফল ইত্যাদি বিক্রি করছে তাদের জন্যও শাস্তির বিধান রাখা উচিত। সে ক্ষেত্রে শুধু ফাইন বা সামান্য কয়েক মাস জেল যথেষ্ট নয়। অন্যথায় ফরমালিন দূর করা যাবে না।
শোনা গেছে, আজকাল নাকি কিছু ধুরন্ধর ব্যবসায়ী ফরমালিন মেশানো মাছের ওপর কিছু গুড় জাতীয় জিনিস রাখে, যাতে সেখানে মাছি বসে। এভাবে ক্রেতাদের ধোঁকা দেওয়ার কৌশলও তারা আবিষ্কার করছে। ছি! জাতি হিসেবে আমরা কত নিচে নেমে গেছি।
ফরমালিন বিভিন্ন কাজে লাগে। তাই আমদানি একেবারে নিষিদ্ধ করা যাবে না। এর পরও আমদানি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমদানিকারক ও ক্রেতাদের ওপর নজরদারি রাখতে হবে। বিক্রেতাদের বিক্রয়ের হিসাব (অর্থাৎ কার কাছে, কী কারণে, কত বিক্রয় করা হয়েছে) রাখা এবং নিয়মিত চেক-আপের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এসিড বা আগ্নেয়াস্ত্র মজুদ, বিক্রয় ও ব্যবহারের মতো ফরমালিন বা অনুরূপ রাসায়নিক দ্রব্যের ক্ষেত্রেও কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে।
অবশ্য অসাধু ব্যবসায়ীর সঙ্গে জড়িত রাজনৈতিক দলের ওপরতলার নেতারা বা প্রশাসনের বড় কর্মকর্তারা মুনাফার অংশ নিয়ে যদি ছাড় দেন, তাহলে তো আমরা সাধারণ নাগরিকরা বড় অসহায় বোধ করব। সে ক্ষেত্রে খাদ্যের বিষের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক দল, সরকার ও প্রশাসনের বিষমুক্ত করারও উদ্যোগ নিতে হবে।
খাদ্যে ভেজাল দেওয়া আর বিষ মেশানো হচ্ছে সম্পূর্ণরূপে দুই ভিন্ন জিনিস। যাদব বাবুর পাটিগণিতে দুধে পানি মেশানোর অঙ্ক আছে। এর মানে দুধে পানি মেশানোর বহু পুরাতন প্র্যাকটিস। কিন্তু দুধে ফরমালিন তো অন্য জিনিস। এ তো মানুষ হত্যার মতো অপরাধ।
খাদ্যে ভেজাল সম্পর্কে উনবিংশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের ঘটনা উল্লেখ করে কাল মার্কস তাঁর পুঁজি গ্রন্থে পুঁজিবাদ ও বুর্জোয়াদের নোংরা চেহারা বহু আগেই উন্মোচন করেছিলেন। সেখান থেকে উদ্ধৃত করা যাক। (পুঁজি, প্রথম খণ্ড, দশম অধ্যায়, তৃতীয় পরিচ্ছেদ)
"১৮৬০ সালের ৬ আগস্টের আইনটি- যার উদ্দেশ্য ছিল 'খাদ্য ও পানীয় সামগ্রীতে ভেজাল নিষিদ্ধ করা'। সেই আইনটি কার্যকর হলো না, কারণ এতে স্বাভাবিকভাবে প্রত্যেক স্বাধীন ব্যবসায়ীর জন্য অপরিসীম মমতা দেখানো হয়েছিল, যে ব্যবসায়ীরা ভেজাল দেওয়া পণ্য কেনাবেচা করে 'সৎপথে' দুটো পয়সা করতে বদ্ধপরিকর ছিল।... স্বাধীন ব্যবসা মানে স্বাভাবিকভাবে ভেজাল অথবা...'পরিমার্জিত' জিনিস নিয়ে ব্যবসা।" কার্ল মার্কস খাদ্যে ভেজাল নিয়ে পুঁজিবাদী ভণ্ডামিকে ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় উন্মোচন করেছেন। তবু পাশ্চাত্যের পুঁজিপতিরা ভেজাল পর্যন্ত গেছে এবং এর সঙ্গে প্রশাসনের ও বুর্জোয়া পণ্ডিতদের যোগাযোগ ছিল। কিন্তু মার্কস ভেজাল পর্যন্ত দেখেছেন। খাদ্যে বিষ মেশানোর ঘটনা দেখে যাননি। তিনি আরো দেখে যাননি, এই বিষ মিশ্রণ প্রক্রিয়ায় কিভাবে সিন্ডিকেট ও প্রশাসন জড়িত থাকে। তাহলে তাঁর ভাষার তীক্ষ্নতা কোন উঁচু পর্যায়ে পৌঁছাত তা আমরা কল্পনা করতে পারি না।
সরকারের যদি সামান্যতম নীতিবোধ থাকে, তবে এখনই ফলে, মাছে, দুধে ফরমালিন ও অন্যান্য রাসায়নিক মেশানো বন্ধ করতে হবে। কঠোর আইন করে দু-একজনকে মৃত্যুদণ্ডের মতো শাস্তি দিয়ে মানুষকে বিষ প্রক্রিয়া থেকে বাঁচাতে হবে। আর সবার আগে প্রশাসনের মধ্যেই যদি ভূত ঢুকে থাকে, সেটাকে তাড়াতে হবে। খাদ্যে বিষ ও প্রশাসনে বিষ- দুটো থেকেও আমরা মুক্তি চাই। এখনই সরকারকে সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করে বলতেই হবে, কবে থেকে আমরা ফরমালিন ও বিষমুক্ত খাদ্য খাব।
লেখক : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
No comments