পদ্মা সেতু প্রকল্প-আমরাও পারি_ এটা কি প্রমাণ করা যাবে? by সুভাষ সাহা
আমরা এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নই। আমাদের ঝুড়িতে এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণর্তা অর্জন, শিক্ষা বিস্তার, দক্ষ ও শিক্ষিত জনশক্তির দ্রুত প্রসার, রফতানি পণ্যের বহুমুখিতা। দেশে বেশ শক্ত-সামর্থ্য একদল উদ্যোক্তা শ্রেণীর প্রতিষ্ঠা অনেক ক্ষেত্রেই বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার সামর্থ্য জোগাচ্ছে
চলতি বছর পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করার প্রস্তাব অনেকের কাছে অবাস্তব। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুর কাজ ধরা কি সোজা কথা! প্রাক্কলিত ব্যয় প্রায় তিনশ' কোটি ডলার। বিশ্বব্যাংক তাদের ১২০ কোটি ডলারের অর্থায়ন প্রস্তাব বাতিল করে দেওয়ার পর তার অনুসরণে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও প্রকল্প থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ায় সরকারকে এখন বিশাল অঙ্কের দেশি অর্থের জোগান দিয়ে সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তবে জাপান সরকারের সরাসরি অর্থায়ন ব্যবস্থা জাইকা এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক প্রকল্পে জড়িত থাকার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় কিছুটা হলেও কর্তাব্যক্তিরা এই মুহূর্তে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেন।
প্রধানত, নিজস্ব অর্থায়নেই যদি পদ্মা সেতু করতে হয়, তাহলে এর কাজ শুরু করতে আগামী বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত (গণমাধ্যমের সংবাদ অনুযায়ী) আমাদের অপেক্ষা করতে হবে কেন? আর কেনইবা চলতি বছর শুরু করা যাবে না? বাজেটের থোক বরাদ্দ পদ্মা সেতুর কথা মাথায় রেখেই রাখা আছে। দেশীয় অন্যান্য উৎস থেকেও কয়েক হাজার কোটি টাকা জোগাড় করা অসম্ভব নয়। বিদেশে বন্ড ছেড়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলার তোলা সম্ভব। এর ফলে বিশ্বব্যাংক প্রতিশ্রুত এবং পরে বাতিল করা অর্থের (বৈদেশিক মুদ্রায়) কাছাকাছি সংস্থান করা সম্ভব। বাদবাকি বৈদেশিক তহবিলজনিত ঘাটতি সাশ্রয়ী উৎস থেকে সংগ্রহের উদ্যোগ নিলে সেখানেও দেখা যাবে সাহায্যের হাত প্রসারিত হয়েই আছে। আর এই অর্থ একসঙ্গে তুলতে হবে না। কারণ, সেতুটি এক বছরে নির্মাণ সম্পন্ন হবে না। এ জন্য অন্তত তিন-চার বছর সময় লাগবে।
দেশে সারচার্জ আরোপ করে বছরে হাজার কোটি টাকা উত্তোলন কি সম্ভব নয়! তাছাড়া এখন বিশ্বে 'ব্রিক'(ইমাজিং কান্ট্রি :চীন, ভারত, ব্রাজিল, রাশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া নিয়ে গঠিত ফোরাম) দেশগুলো, বিশেষত চীন ও ভারত অনেক কম সুদে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোকে নিজেদের পছন্দসই প্রকল্পে ঋণ ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে। ব্রিক দেশগুলো আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থাগুলোতে ন্যায্য হিস্যা না পেয়ে এখন বিশ্বব্যাকং, আইএমএফের সমান্তরাল বিকল্প লেন্ডিং ব্যবস্থা উদ্ভাবনের চেষ্টা করছে। মজার ব্যাপার হলো, এ প্রস্তাবটিতে চীনের আগ্রহ বেশি থাকলেও উপস্থাপন করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর আগামী বছর ব্রিক নেতাদের শীর্ষ বৈঠকে ব্রিক উন্নয়ন ব্যাংকের খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে। তদুপরি এবার ইউরোপের অর্থনীতিকে বেইল আউট করার জন্য সাড়ে সাত হাজার কোটি ডলার এসব উদীয়মান দেশ দেওয়ার অঙ্গীকার করায় অর্থনৈতিক দাবার ছক উল্টে যাওয়ার উপক্রম। এবার ইউরোপকে তো যুক্তরাষ্ট্র বেইল আউট করেনি। করেছে উদীয়মান দেশগুলো এবং ইউরোপ নিজে। আসলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এখনও মন্দার ধকল পুরোপুরি কাটিয়ে উঠে কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি । তাই তাদের পক্ষে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
আমি উপরের কথাগুলো বললাম বিশ্ব অর্থনৈতিক কূটনীতি ও তহবিল জোগানোর প্রশ্নে বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফের মতো আন্তর্জাতিক পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত অর্থ ব্যবস্থা যে শেষ কথা নয়; সে সম্পর্কে আলোকপাত করার জন্য। সুতরাং চোখ-কান খোলা রাখলে এবং অর্থনৈতিক কূটনীতি বোঝার মতো বিজ্ঞজনদের সমাহার ঘটলে পদ্মা সেতু কেন, আরও উন্নয়নমূলক কাজ হাতে নেওয়াও সম্ভব।
তাছাড়া আমরা তো এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নই। আমাদের ঝুড়িতে এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণর্তা অর্জন, শিক্ষা বিস্তার, দক্ষ ও শিক্ষিত জনশক্তির দ্রুত প্রসার, রফতানি পণ্যের বহুমুখিতা, বিশেষ করে দেশে বেশ শক্ত-সামর্থ্য একদল উদ্যোক্তা শ্রেণীর প্রতিষ্ঠা অনেক ক্ষেত্রেই বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার সামর্থ্য জোগাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা কিছুদিন আগেও বাংলাদেশ উদীয়মান টাইগার হতে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন সভা-সেমিনারের বক্তব্যে উল্লেখ করছিলেন। বাংলাদেশ তো প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদে এতটা ধনী নয় যে, আমরা পায়ের উপর পা দিয়ে নিত্যসুখে বিভোর থাকতে পারব। আসলে আমাদের কর্মোদ্যোগী ও বিরাট সৃজনশীল তরুণ জনশক্তিই আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রসারের যুগে বাংলাদেশকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। অমিত সম্ভাবনাময় এই দেশটি নিজেদের পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে একটি পদ্মা সেতু করতে পারবে না_ সেটা নিছক ভ্রান্ত ধারণা।
তবে যত উপায়ই থাক না কেন, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সঙ্গে আমাদের যেখানে যেখানে স্বার্থের মিল থাকবে, সেখানে সহযোগিতা নিতে হবে। এমনকি উদীয়মান টাইগার হয়ে উঠতে পারলেও পশ্চিমা দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক-সংযোগের সেতু বন্ধ করা যাবে না। কারণ, আমরা সবাই এখন বিশ্বায়িত বিশ্বের বাসিন্দা। সবাই সবার উন্নয়নের পরিপূরক_ এ ধরনের এক বিশ্বের দিকেই আমরা সবাই এগিয়ে চলেছি।
সরকারের তরফে কেউ কেউ বিশ্বব্যাংকের পদ্মা সেতু নিয়ে পদক্ষেপকে বাড়াবাড়ি ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আখ্যায়িত করেছেন। বিশেষ করে এ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাতিলের আগে একেক সময় একেক কথা বলেছেন। তাদের বক্তব্যে অসঙ্গতি সাধারণ মানুষকে পর্যন্ত অবাক করেছে। যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাতিলের কারণ হয়ে থাকে, তাহলে ওই ট্রিক্সটি সরকারের কর্তাব্যক্তিদের বুঝতে এত দেরি হলো কেন? কর্তাব্যক্তিদের অবস্থা দেখে 'পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ' উক্তিটি মনে পড়ে।
বিশ্বব্যাংক তার তহবিল জোগানের প্রধান উৎস যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গুলি হেলনে চলে_ এ কথা তো নতুন করে জানার বিষয় নয়। যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে এই ব্যাংক এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন এমন ব্যক্তিদের লেখা বইয়ের ছত্রে ছত্রে এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। আর যারা উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকার চালান বা এক সময় চালিয়েছেন, তারা তো জানেন; প্রতিনিয়ত এসব দেশকে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ বা পশ্চিমা সরকারগুলোর উপদেশ মেনে ও মন জুগিয়ে চলতে হয়। কীভাবে তাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো, অর্থ সংস্থাগুলো, সংসদ ও কংগ্রেস এবং সরকার উন্নয়নশীল বিশ্বের ব্যাপারে সমন্বয় করে এগোয়_ সেটাও এখন ইন্টারনেটের কল্যাণে অনেকে জানেন।
আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলানো জন পারকিনসের লিখিত বই 'কনফেসন অব এ ইকোনিক হিটম্যান'-এর কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতেই হয়। বইতে পারকিনস দেখিয়েছেন, পশ্চিমা বিশ্ব নিজেদের আধিপত্য তথা নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে কীভাবে আন্তর্জাতিক অর্থ সাহায্যকে ব্যবহার করে। বিরুদ্ধবাদীর কণ্ঠকে কী করে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়, তারও বর্ণনা রয়েছে সেখানে। এটা তারা করে থাকে এবং করবেই। তারা ঋণ নিয়ে রাজনৈতিক ছলচাতুরীর আশ্রয় নিতেই পারে। তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আমার যদি কোমরে জোর থাকে, আর মিলেঝুলে চলার মধ্যেও স্বাধীনভাবে চলার মতো জ্ঞানগম্যি থেকে থাকে, তাহলে শত কারসাজিতেও ভড়কে যাওয়ার কিছু নেই। সময়ের ধারাবাহিকতায় বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সৃষ্ট জটিলতাও এক সময় কেটে যাবে। বরং আমরা যদি আগামী পরিবর্তিত বিশ্বে সত্যিকার অর্থনৈতিক টাইগার হিসেবে আবির্ভূত হতে পারি; তারা পদ্মা সেতু না হোক, ভবিষ্যতের বড় বড় প্রকল্পে অর্থায়ন করতে এগিয়ে আসবেই। আর আমাদের জন্য তো ব্রিক দেশগুলোর সাহায্যের হাত অবধারিতভাবে প্রসারিত থাকবেই। কারণ, তাদের লড়াইটা উন্নয়নশীল বিশ্বের স্বাধীন উন্নয়ন চিন্তাপ্রসূত।
তবে তার জন্য আমাদের রাজনীতিবিদদের সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ধাতস্থ হতে হবে। সরকারি দলের রাজনীতিই শুধু নয়, বিরোধী দলের অতিমাত্রায় নেতিবাচক রাজনীতি অনুসরণের প্রবণতাও ত্যাগ করা উচিত হবে। কথায় বলে_ সময়ের এক ফোঁড় আর অসময়ের দশ ফোঁড়। মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ও মর্যাদা রক্ষার যে চেতনা সঞ্চারিত হয়েছে, সেটাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হলে এবং ধরে রাখতে হলে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজে বিলম্ব করা উচিত হবে না। আসুন না, পদ্মা সেতু নির্মাণ করে দেখাই_ আমরাও পারি।
সুভাষ সাহা :সাংবাদিক
প্রধানত, নিজস্ব অর্থায়নেই যদি পদ্মা সেতু করতে হয়, তাহলে এর কাজ শুরু করতে আগামী বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত (গণমাধ্যমের সংবাদ অনুযায়ী) আমাদের অপেক্ষা করতে হবে কেন? আর কেনইবা চলতি বছর শুরু করা যাবে না? বাজেটের থোক বরাদ্দ পদ্মা সেতুর কথা মাথায় রেখেই রাখা আছে। দেশীয় অন্যান্য উৎস থেকেও কয়েক হাজার কোটি টাকা জোগাড় করা অসম্ভব নয়। বিদেশে বন্ড ছেড়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলার তোলা সম্ভব। এর ফলে বিশ্বব্যাংক প্রতিশ্রুত এবং পরে বাতিল করা অর্থের (বৈদেশিক মুদ্রায়) কাছাকাছি সংস্থান করা সম্ভব। বাদবাকি বৈদেশিক তহবিলজনিত ঘাটতি সাশ্রয়ী উৎস থেকে সংগ্রহের উদ্যোগ নিলে সেখানেও দেখা যাবে সাহায্যের হাত প্রসারিত হয়েই আছে। আর এই অর্থ একসঙ্গে তুলতে হবে না। কারণ, সেতুটি এক বছরে নির্মাণ সম্পন্ন হবে না। এ জন্য অন্তত তিন-চার বছর সময় লাগবে।
দেশে সারচার্জ আরোপ করে বছরে হাজার কোটি টাকা উত্তোলন কি সম্ভব নয়! তাছাড়া এখন বিশ্বে 'ব্রিক'(ইমাজিং কান্ট্রি :চীন, ভারত, ব্রাজিল, রাশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া নিয়ে গঠিত ফোরাম) দেশগুলো, বিশেষত চীন ও ভারত অনেক কম সুদে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোকে নিজেদের পছন্দসই প্রকল্পে ঋণ ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে। ব্রিক দেশগুলো আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থাগুলোতে ন্যায্য হিস্যা না পেয়ে এখন বিশ্বব্যাকং, আইএমএফের সমান্তরাল বিকল্প লেন্ডিং ব্যবস্থা উদ্ভাবনের চেষ্টা করছে। মজার ব্যাপার হলো, এ প্রস্তাবটিতে চীনের আগ্রহ বেশি থাকলেও উপস্থাপন করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর আগামী বছর ব্রিক নেতাদের শীর্ষ বৈঠকে ব্রিক উন্নয়ন ব্যাংকের খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে। তদুপরি এবার ইউরোপের অর্থনীতিকে বেইল আউট করার জন্য সাড়ে সাত হাজার কোটি ডলার এসব উদীয়মান দেশ দেওয়ার অঙ্গীকার করায় অর্থনৈতিক দাবার ছক উল্টে যাওয়ার উপক্রম। এবার ইউরোপকে তো যুক্তরাষ্ট্র বেইল আউট করেনি। করেছে উদীয়মান দেশগুলো এবং ইউরোপ নিজে। আসলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এখনও মন্দার ধকল পুরোপুরি কাটিয়ে উঠে কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি । তাই তাদের পক্ষে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
আমি উপরের কথাগুলো বললাম বিশ্ব অর্থনৈতিক কূটনীতি ও তহবিল জোগানোর প্রশ্নে বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফের মতো আন্তর্জাতিক পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত অর্থ ব্যবস্থা যে শেষ কথা নয়; সে সম্পর্কে আলোকপাত করার জন্য। সুতরাং চোখ-কান খোলা রাখলে এবং অর্থনৈতিক কূটনীতি বোঝার মতো বিজ্ঞজনদের সমাহার ঘটলে পদ্মা সেতু কেন, আরও উন্নয়নমূলক কাজ হাতে নেওয়াও সম্ভব।
তাছাড়া আমরা তো এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নই। আমাদের ঝুড়িতে এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণর্তা অর্জন, শিক্ষা বিস্তার, দক্ষ ও শিক্ষিত জনশক্তির দ্রুত প্রসার, রফতানি পণ্যের বহুমুখিতা, বিশেষ করে দেশে বেশ শক্ত-সামর্থ্য একদল উদ্যোক্তা শ্রেণীর প্রতিষ্ঠা অনেক ক্ষেত্রেই বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার সামর্থ্য জোগাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা কিছুদিন আগেও বাংলাদেশ উদীয়মান টাইগার হতে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন সভা-সেমিনারের বক্তব্যে উল্লেখ করছিলেন। বাংলাদেশ তো প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদে এতটা ধনী নয় যে, আমরা পায়ের উপর পা দিয়ে নিত্যসুখে বিভোর থাকতে পারব। আসলে আমাদের কর্মোদ্যোগী ও বিরাট সৃজনশীল তরুণ জনশক্তিই আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রসারের যুগে বাংলাদেশকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। অমিত সম্ভাবনাময় এই দেশটি নিজেদের পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে একটি পদ্মা সেতু করতে পারবে না_ সেটা নিছক ভ্রান্ত ধারণা।
তবে যত উপায়ই থাক না কেন, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সঙ্গে আমাদের যেখানে যেখানে স্বার্থের মিল থাকবে, সেখানে সহযোগিতা নিতে হবে। এমনকি উদীয়মান টাইগার হয়ে উঠতে পারলেও পশ্চিমা দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক-সংযোগের সেতু বন্ধ করা যাবে না। কারণ, আমরা সবাই এখন বিশ্বায়িত বিশ্বের বাসিন্দা। সবাই সবার উন্নয়নের পরিপূরক_ এ ধরনের এক বিশ্বের দিকেই আমরা সবাই এগিয়ে চলেছি।
সরকারের তরফে কেউ কেউ বিশ্বব্যাংকের পদ্মা সেতু নিয়ে পদক্ষেপকে বাড়াবাড়ি ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আখ্যায়িত করেছেন। বিশেষ করে এ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাতিলের আগে একেক সময় একেক কথা বলেছেন। তাদের বক্তব্যে অসঙ্গতি সাধারণ মানুষকে পর্যন্ত অবাক করেছে। যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাতিলের কারণ হয়ে থাকে, তাহলে ওই ট্রিক্সটি সরকারের কর্তাব্যক্তিদের বুঝতে এত দেরি হলো কেন? কর্তাব্যক্তিদের অবস্থা দেখে 'পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ' উক্তিটি মনে পড়ে।
বিশ্বব্যাংক তার তহবিল জোগানের প্রধান উৎস যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গুলি হেলনে চলে_ এ কথা তো নতুন করে জানার বিষয় নয়। যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে এই ব্যাংক এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন এমন ব্যক্তিদের লেখা বইয়ের ছত্রে ছত্রে এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। আর যারা উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকার চালান বা এক সময় চালিয়েছেন, তারা তো জানেন; প্রতিনিয়ত এসব দেশকে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ বা পশ্চিমা সরকারগুলোর উপদেশ মেনে ও মন জুগিয়ে চলতে হয়। কীভাবে তাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো, অর্থ সংস্থাগুলো, সংসদ ও কংগ্রেস এবং সরকার উন্নয়নশীল বিশ্বের ব্যাপারে সমন্বয় করে এগোয়_ সেটাও এখন ইন্টারনেটের কল্যাণে অনেকে জানেন।
আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলানো জন পারকিনসের লিখিত বই 'কনফেসন অব এ ইকোনিক হিটম্যান'-এর কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতেই হয়। বইতে পারকিনস দেখিয়েছেন, পশ্চিমা বিশ্ব নিজেদের আধিপত্য তথা নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে কীভাবে আন্তর্জাতিক অর্থ সাহায্যকে ব্যবহার করে। বিরুদ্ধবাদীর কণ্ঠকে কী করে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়, তারও বর্ণনা রয়েছে সেখানে। এটা তারা করে থাকে এবং করবেই। তারা ঋণ নিয়ে রাজনৈতিক ছলচাতুরীর আশ্রয় নিতেই পারে। তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আমার যদি কোমরে জোর থাকে, আর মিলেঝুলে চলার মধ্যেও স্বাধীনভাবে চলার মতো জ্ঞানগম্যি থেকে থাকে, তাহলে শত কারসাজিতেও ভড়কে যাওয়ার কিছু নেই। সময়ের ধারাবাহিকতায় বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সৃষ্ট জটিলতাও এক সময় কেটে যাবে। বরং আমরা যদি আগামী পরিবর্তিত বিশ্বে সত্যিকার অর্থনৈতিক টাইগার হিসেবে আবির্ভূত হতে পারি; তারা পদ্মা সেতু না হোক, ভবিষ্যতের বড় বড় প্রকল্পে অর্থায়ন করতে এগিয়ে আসবেই। আর আমাদের জন্য তো ব্রিক দেশগুলোর সাহায্যের হাত অবধারিতভাবে প্রসারিত থাকবেই। কারণ, তাদের লড়াইটা উন্নয়নশীল বিশ্বের স্বাধীন উন্নয়ন চিন্তাপ্রসূত।
তবে তার জন্য আমাদের রাজনীতিবিদদের সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ধাতস্থ হতে হবে। সরকারি দলের রাজনীতিই শুধু নয়, বিরোধী দলের অতিমাত্রায় নেতিবাচক রাজনীতি অনুসরণের প্রবণতাও ত্যাগ করা উচিত হবে। কথায় বলে_ সময়ের এক ফোঁড় আর অসময়ের দশ ফোঁড়। মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ও মর্যাদা রক্ষার যে চেতনা সঞ্চারিত হয়েছে, সেটাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হলে এবং ধরে রাখতে হলে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজে বিলম্ব করা উচিত হবে না। আসুন না, পদ্মা সেতু নির্মাণ করে দেখাই_ আমরাও পারি।
সুভাষ সাহা :সাংবাদিক
No comments