আলোর ইশারা-পদ্মা সেতু প্রকল্প এবং আমাদের করণীয় by আইনুন নিশাত
পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে অনেক জল ঘোলা হওয়ার পর আমার কথা একটাই। সরকার যেভাবে নিজস্ব উৎস থেকে প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বলছে, সেটা সম্ভব হলে এই দেশের নাগরিক হিসেবে আমি গর্বই বোধ করব। এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিতে পারেন_ এমন বিশেষজ্ঞের অভাব নেই এ দেশে।
কিন্তু আমাদের ঘাটতি রয়েছে
অর্থে ও প্রযুক্তিতে। প্রযুক্তির বিষয়টি ঠিকাদারের মাথাব্যথা। সরকারের উচিত হবে সম্পূর্ণ অর্থ জোগাড়ের দিকে মনোযোগ দেওয়া। অর্থের সংস্থান হলেই কেবল নির্মাণ কাজের ব্যাপারে অগ্রসর হওয়া
পদ্মা সেতু নিয়ে সমকালের পাতায় কয়েকদিন আগে অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর একটি মূল্যবান নিবন্ধ ছাপা হয়েছে। জামিল স্যার আমার ক্লাসরুম শিক্ষক শুধু নন; তার সঙ্গে পরে বহু প্রকল্পে কাজ করেছি এবং করছি। জটিল কারিগরি জিনিস সহজভাবে ব্যাখ্যা করতে তার জুড়ি পাওয়া দায়। তদুপরি স্যারের মনে রাখার ক্ষমতা এবং বিভিন্ন ঘটনার পরম্পরা বজায় রেখে বর্ণনা করার দক্ষতা অপরিসীম। বলাবাহুল্য, স্যারের ওই লেখাতেও তার ছাপ স্পষ্ট ছিল।
পদ্মা সেতু প্রকল্প সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কাজের ঠিকাদার ও পরামর্শক নির্বাচন প্রক্রিয়া কীভাবে এগোচ্ছিল, অধ্যাপক চৌধুরী তার লেখায় তা গুছিয়ে বলেছেন। ওই নিবন্ধের আলোকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে এসএনসি লাভালিনকে সুপারভিশন কনসালটেন্ট হিসেবে নিযুক্তিতে বিশ্বব্যাংকের কোনো আপত্তি ছিল না। বরং উল্টোটাই ঘটেছিল বলা চলে। বাংলাদেশি মূল্যায়নকারীদের মূল্যায়ন বিশ্বব্যাংক লিখিতভাবে অনুমোদন করেছে এবং সেই প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংকের একজন সাবেক কর্মকর্তাও যুক্ত ছিলেন।
আমি আজকে কলম ধরেছি এসব বিষয়ে আরও কিছু কথা বলার জন্য। বলে রাখা ভালো, বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরামর্শক ও ঠিকাদার নির্বাচনের সময় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর সঙ্গে আমিও জড়িত ছিলাম। একইভাবে পদ্মা সেতু প্রকল্পেরও আমরা কাজ করেছি। যমুনা সেতু প্রকল্পের অভিজ্ঞতার আলোকে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরামর্শক বা ঠিকাদার নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোথায় কোথায় বিশেষ নজর দিতে হবে, সে সম্পর্কে আমাদের পূর্ব ধারণা ও অভিজ্ঞতা কাজে এসেছে।
অনেকেই হয়তো জানেন, পরামর্শক ও ঠিকাদার নির্বাচনের জন্য বিশ্বব্যাংক, এডিবি (এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক) বা আইডিবি (ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক)_ সবারই রয়েছে পৃথক পৃথক নীতিমালা। অর্থাৎ কোনো প্রকল্পে যারা অর্থায়ন করবেন তারাই নির্ধারণ করে দেন যে কোন কোন দেশের পরামর্শক বা ঠিকাদাররা দরপত্র জমা দিতে পারবেন। এরপর আসে দরপত্রে কী কী বিষয়ে নজর দেওয়া হবে এবং কী পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করা হবে, তার নিয়মাবলি। পদ্মা সেতু প্রকল্পের ক্ষেত্রে সেই নিয়মাবলি প্রণয়নের দায়িত্বে ছিল ডিজাইন কনসালটেন্ট বা নকশা প্রণয়নের দায়িত্বে থাকা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। তাদের প্রণীত নিয়ম ও শর্তাবলি প্রথমে বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তারা অনুমোদন করেন এবং এরপর তা দাতা সংস্থার বিশেষজ্ঞের দ্বারা পর্যালোচিত এবং অনুমোদিত হয়। অর্থাৎ বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকার (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি) অনুমোদন পাওয়ার পরই দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
দরপত্রের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে প্রাক-যোগ্যতার ভিত্তিতে কারা দরপত্র দিতে পারবেন, তা নির্ধারণ করা। পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ ও জটিল প্রকল্পে কেবল তাদেরই দরপত্র দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়, যাদের এ ধরনের কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। অর্থাৎ আগ্রহী ঠিকাদার অথবা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান তাদের কাজের অভিজ্ঞতা, আর্থিক সচ্ছলতা, দক্ষ কর্মকর্তার তালিকা ইত্যাদি জমা দেন। সেসবের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের ক্ষেত্রে বড় তিনটি চুক্তি বা কন্ট্রাক্ট করা প্রয়োজন ছিল। প্রথম চুক্তি হচ্ছে মূল সেতুটি নির্মাণ বিষয়ে। এ কাজে ঠিকাদারদের প্রাক-যোগ্যতা নিরূপণের পর নির্বাচিতদের তালিকা বিশ্বব্যাংকের দফতরে রয়েছে। তারা অনুমতি দিলে তবেই মূল দরপত্র আহ্বান করা হতো। তার মানে, মূল দরপত্র এখনও আহ্বান করা হয়নি। কাজেই ঠিকাদার নির্বাচনের বিষয়টি অনেক পরের বিষয়।
দ্বিতীয় চুক্তি বা কন্ট্রাক্ট হচ্ছে নদীশাসন সংক্রান্ত। মূল সেতুর মতো এ কাজটিও অত্যন্ত জটিল এবং এতে দক্ষ ঠিকাদার প্রয়োজন। এ কাজটিরও কেবল প্রাক-দক্ষতা যাচাই কাজ শেষ হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের দফতরে এই কাজের জন্যও প্রাক-দক্ষতা যাচাইয়ের পর মূল্যায়িত ঠিকাদারদের তালিকা জমা দেওয়া আছে। অর্থাৎ এ কাজেও এখন পর্যন্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়নি।
তৃতীয় কন্ট্রাক্টটি হচ্ছে অ্যাপ্রোচ রোড। অর্থাৎ সেতু সংযোগকারী রাস্তার নির্মাণ বিষয়ে। ওই কাজটির অর্থায়ন করবে আইডিবি। কাজেই তাদের নিয়ম মেনে প্রাক-যোগ্যতার কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। ঠিকাদার নির্মাণের কাজও সম্পন্ন হয়েছে। আইডিবির অনুমোদনের জন্য কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে। এ দরপত্র মূল্যায়নে বিশেষ জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
এবার আসি কন্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালটেন্টের বিষয়ে। এ কনসালটেন্টের কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পদ্মা সেতুটি নির্মিত হবে আন্তর্জাতিক নিয়মাবলি মেনে। সংক্ষেপে বলা হয়েছে (ঋওউওঈ) 'ফিডিক' মেনে। এর পুরো নাম হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব কনসালটিং ইজিনিয়ার্স। মূল নামটি ফরাসি। এরা বিশ্বজুড়ে যে কোনো নির্মাণ কাজে শর্তাবলি ও কন্ট্রাক্ট বাস্তবায়নের পদ্ধতি ঠিক করে দেয়। এদের নিয়মের বাইরে কোনো আন্তর্জাতিক কন্ট্রাক্ট পরিচালিত হতে পারে না।
ফিডিকের নিয়ম অনুযায়ী কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালটেন্টের (সিএসসি) তত্ত্বাবধানে কন্ট্রাক্ট সম্পর্কিত সব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ কারণে সিএসসি নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কাজ শুরু হলে এদের সিদ্ধান্ত অর্থায়নকারী সংস্থাগুলো প্রায়ই মেনে নেয় এবং প্রকল্পের মূল মালিক, অর্থাৎ সরকারও মানতে বাধ্য হয়। ঠিকাদারের দাবি যদি সিএসসি অনুমোদন করে, কিন্তু সরকার পক্ষ যদি সেই দাবিকে অযৌক্তিক মনে করে তাহলে সিএসসির সিদ্ধান্তই বলবৎ হবে। পরে সরকার এ বিষয়ে মামলা করতে পারে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের সিএসসি হিসেবে নিযুক্তির জন্য পাঁচটি কোম্পানি তাদের প্রস্তাব জমা দিয়েছিল। ইতিপূর্বে নির্ধারিত নিয়মাবলি মেনে দরপত্রগুলো মূল্যায়িত হয়। এ মূল্যায়ন বিশ্বব্যাংক মেনে নিয়েছিল। পরে নির্বাচিত কনসালন্টিং ফার্মের কোনো কাজে বিশ্বব্যাংক ক্ষুব্ধ হয়েছে এবং তাদের কালো তালিকাভুক্ত করেছে। মোদ্দাকথা, আমি বলতে চাচ্ছি, নির্বাচন পদ্ধতি বা নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে বিশ্বব্যাংকের কোনো আপত্তি ছিল না। যে কারণে এখন জটিলতা দেখা দিয়েছে, তা হলো পরবর্তী সময়ে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা।
এবার আরেকটি বিষয়ের অবতারণা করতে চাই সেটি হচ্ছে, যে কোনো প্রকল্পে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, অংশীদারিত্ব বজায় রাখার প্রচণ্ড তাগিদ আছে বিশ্বজুড়ে। কোনো একটি দেশের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ বা কোনো আন্তর্জাতিক অর্থলগি্নকারক প্রতিষ্ঠানের অর্থ সবার মধ্যে সব পদক্ষেপে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা অর্জনের কথা বলা হচ্ছে। একই সঙ্গে যোগ হচ্ছে যে কোনো কর্মকাণ্ডে প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপ এবং সব স্টেকহোল্ডার বা অংশীদারের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ।
বিশ্বের বিভিন্ন অঙ্গনে কথায় কথায় সুশাসন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও আইনের শাসনের কথা এখন উচ্চারিত হয়। সেই আলোকে, সবাই এখন মানে, যে কোনো দাতা দেশ বা দাতা সংস্থা তাদের সব স্টেকহোল্ডারের কাছে এসব বিষয়ে জবাবদিহি করতে বাধ্য। বিশ্বব্যাংক এবং এডিবিতে সিভিল সোসাইটি প্রতিনিধিরা নিয়মিতভাবে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করে। কাজেই কোনো কারণে কেউ যদি সন্দেহ পোষণ করে যে, এ প্রকল্পে দুর্নীতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তাহলে বিশ্বব্যাংক বিশেষ নজরদারি করতে বাধ্য। বিশ্বব্যাংকের অফিসে পদ্মা সেতুসহ ৫-৬টি বড় প্রকল্পের জন্য একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট রয়েছেন। তার কাজই হচ্ছে এ প্রকল্পগুলো বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করা, যাতে করে কোনো ধরনের অভিযোগ না আসে। আমি যতদূর জানি, পদ্মা সেতুর জমি অধিগ্রহণ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের বিষয়টি তারা খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে এবং সরকারের কাজে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। আমার জানা মতে, বাংলাদেশ সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও তার কাউন্টারপার্ট হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের বিশেষ তদারকির কথা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তার জানা ছিল না। তারপরও দুর্ঘটনা ঘটে গেল।
খবরের কাগজে পড়ছি, সরকার বিকল্প উৎস থেকে অর্থ পাওয়ার চেষ্টা করছে। সরকারের এমন প্রচেষ্টা অস্বাভাবিক নয়। কারণ দেশের লোকজন সেতুটি দ্রুত নির্মিত হওয়া দেখতে চায়। গত নির্বাচনের অঙ্গীকার এবং সামনের নির্বাচনে সাফল্য তুলে ধরার কথাও ভাবতে হচ্ছে সরকারকে। তার ফলেই বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থ জোগাড় করার কথা বলা হচ্ছে।
সত্যি বলতে কি, বিভিন্ন মহলের এ তৎপরতা দেখে আমার ভালো লাগছে। তবে মনে রাখতে হবে, টাকায় কুলাবে না। লাগবে বৈদেশিক মুদ্রা_ ডলার, ইউরো, ইয়েন, পাউন্ড ইত্যাদি। পুরো অর্থের বন্দোবস্ত করে তবেই মাঠে নামতে হবে। দেশে যেভাবে নির্মাণ কাজ হয়_ আমরা দেখি, অর্থের অভাবে ঠিকাদারদের অনেক সময় বসে থাকতে হয়। এটি কোনোভাবেই আন্তর্জাতিক ঠিকাদারদের সঙ্গে চলবে না। ফিডিক আইন অনুযায়ী ঠিকাদার তার রানিং বিল জমা দিলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তা পরিশোধ করতে হবে। কোনো কারণে ঠিকাদারকে কাজ বন্ধ করতে বলা যাবে না। কারণ ঠিকাদার তার যন্ত্রপাতি, লোক-লস্কর মোবিলাইজ করেছেন। সরকারের কারণে কাজের গতি শ্লথ হলে বিপুল পরিমাণ অর্থদণ্ড দিতে হবে।
পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে অনেক জল ঘোলা হওয়ার পর আমার কথা একটাই। সরকার যেভাবে নিজস্ব উৎস থেকে প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বলছে, সেটা সম্ভব হলে এই দেশের নাগরিক হিসেবে আমি গর্বই বোধ করব। এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিতে পারেন_ এমন বিশেষজ্ঞের অভাব নেই এ দেশে। কিন্তু আমাদের ঘাটতি রয়েছে অর্থে ও প্রযুক্তিতে। প্রযুক্তির বিষয়টি ঠিকাদারের মাথাব্যথা। সরকারের উচিত হবে সম্পূর্ণ অর্থ জোগাড়ের দিকে মনোযোগ দেওয়া। অর্থের সংস্থান হলেই কেবল নির্মাণ কাজের ব্যাপারে অগ্রসর হওয়া।
অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত : পরিবেশ বিশেষজ্ঞ; উপাচার্য, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
অর্থে ও প্রযুক্তিতে। প্রযুক্তির বিষয়টি ঠিকাদারের মাথাব্যথা। সরকারের উচিত হবে সম্পূর্ণ অর্থ জোগাড়ের দিকে মনোযোগ দেওয়া। অর্থের সংস্থান হলেই কেবল নির্মাণ কাজের ব্যাপারে অগ্রসর হওয়া
পদ্মা সেতু নিয়ে সমকালের পাতায় কয়েকদিন আগে অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর একটি মূল্যবান নিবন্ধ ছাপা হয়েছে। জামিল স্যার আমার ক্লাসরুম শিক্ষক শুধু নন; তার সঙ্গে পরে বহু প্রকল্পে কাজ করেছি এবং করছি। জটিল কারিগরি জিনিস সহজভাবে ব্যাখ্যা করতে তার জুড়ি পাওয়া দায়। তদুপরি স্যারের মনে রাখার ক্ষমতা এবং বিভিন্ন ঘটনার পরম্পরা বজায় রেখে বর্ণনা করার দক্ষতা অপরিসীম। বলাবাহুল্য, স্যারের ওই লেখাতেও তার ছাপ স্পষ্ট ছিল।
পদ্মা সেতু প্রকল্প সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কাজের ঠিকাদার ও পরামর্শক নির্বাচন প্রক্রিয়া কীভাবে এগোচ্ছিল, অধ্যাপক চৌধুরী তার লেখায় তা গুছিয়ে বলেছেন। ওই নিবন্ধের আলোকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে এসএনসি লাভালিনকে সুপারভিশন কনসালটেন্ট হিসেবে নিযুক্তিতে বিশ্বব্যাংকের কোনো আপত্তি ছিল না। বরং উল্টোটাই ঘটেছিল বলা চলে। বাংলাদেশি মূল্যায়নকারীদের মূল্যায়ন বিশ্বব্যাংক লিখিতভাবে অনুমোদন করেছে এবং সেই প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংকের একজন সাবেক কর্মকর্তাও যুক্ত ছিলেন।
আমি আজকে কলম ধরেছি এসব বিষয়ে আরও কিছু কথা বলার জন্য। বলে রাখা ভালো, বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরামর্শক ও ঠিকাদার নির্বাচনের সময় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর সঙ্গে আমিও জড়িত ছিলাম। একইভাবে পদ্মা সেতু প্রকল্পেরও আমরা কাজ করেছি। যমুনা সেতু প্রকল্পের অভিজ্ঞতার আলোকে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরামর্শক বা ঠিকাদার নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোথায় কোথায় বিশেষ নজর দিতে হবে, সে সম্পর্কে আমাদের পূর্ব ধারণা ও অভিজ্ঞতা কাজে এসেছে।
অনেকেই হয়তো জানেন, পরামর্শক ও ঠিকাদার নির্বাচনের জন্য বিশ্বব্যাংক, এডিবি (এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক) বা আইডিবি (ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক)_ সবারই রয়েছে পৃথক পৃথক নীতিমালা। অর্থাৎ কোনো প্রকল্পে যারা অর্থায়ন করবেন তারাই নির্ধারণ করে দেন যে কোন কোন দেশের পরামর্শক বা ঠিকাদাররা দরপত্র জমা দিতে পারবেন। এরপর আসে দরপত্রে কী কী বিষয়ে নজর দেওয়া হবে এবং কী পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করা হবে, তার নিয়মাবলি। পদ্মা সেতু প্রকল্পের ক্ষেত্রে সেই নিয়মাবলি প্রণয়নের দায়িত্বে ছিল ডিজাইন কনসালটেন্ট বা নকশা প্রণয়নের দায়িত্বে থাকা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। তাদের প্রণীত নিয়ম ও শর্তাবলি প্রথমে বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তারা অনুমোদন করেন এবং এরপর তা দাতা সংস্থার বিশেষজ্ঞের দ্বারা পর্যালোচিত এবং অনুমোদিত হয়। অর্থাৎ বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকার (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি) অনুমোদন পাওয়ার পরই দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
দরপত্রের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে প্রাক-যোগ্যতার ভিত্তিতে কারা দরপত্র দিতে পারবেন, তা নির্ধারণ করা। পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ ও জটিল প্রকল্পে কেবল তাদেরই দরপত্র দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়, যাদের এ ধরনের কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। অর্থাৎ আগ্রহী ঠিকাদার অথবা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান তাদের কাজের অভিজ্ঞতা, আর্থিক সচ্ছলতা, দক্ষ কর্মকর্তার তালিকা ইত্যাদি জমা দেন। সেসবের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের ক্ষেত্রে বড় তিনটি চুক্তি বা কন্ট্রাক্ট করা প্রয়োজন ছিল। প্রথম চুক্তি হচ্ছে মূল সেতুটি নির্মাণ বিষয়ে। এ কাজে ঠিকাদারদের প্রাক-যোগ্যতা নিরূপণের পর নির্বাচিতদের তালিকা বিশ্বব্যাংকের দফতরে রয়েছে। তারা অনুমতি দিলে তবেই মূল দরপত্র আহ্বান করা হতো। তার মানে, মূল দরপত্র এখনও আহ্বান করা হয়নি। কাজেই ঠিকাদার নির্বাচনের বিষয়টি অনেক পরের বিষয়।
দ্বিতীয় চুক্তি বা কন্ট্রাক্ট হচ্ছে নদীশাসন সংক্রান্ত। মূল সেতুর মতো এ কাজটিও অত্যন্ত জটিল এবং এতে দক্ষ ঠিকাদার প্রয়োজন। এ কাজটিরও কেবল প্রাক-দক্ষতা যাচাই কাজ শেষ হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের দফতরে এই কাজের জন্যও প্রাক-দক্ষতা যাচাইয়ের পর মূল্যায়িত ঠিকাদারদের তালিকা জমা দেওয়া আছে। অর্থাৎ এ কাজেও এখন পর্যন্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়নি।
তৃতীয় কন্ট্রাক্টটি হচ্ছে অ্যাপ্রোচ রোড। অর্থাৎ সেতু সংযোগকারী রাস্তার নির্মাণ বিষয়ে। ওই কাজটির অর্থায়ন করবে আইডিবি। কাজেই তাদের নিয়ম মেনে প্রাক-যোগ্যতার কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। ঠিকাদার নির্মাণের কাজও সম্পন্ন হয়েছে। আইডিবির অনুমোদনের জন্য কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে। এ দরপত্র মূল্যায়নে বিশেষ জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
এবার আসি কন্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালটেন্টের বিষয়ে। এ কনসালটেন্টের কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পদ্মা সেতুটি নির্মিত হবে আন্তর্জাতিক নিয়মাবলি মেনে। সংক্ষেপে বলা হয়েছে (ঋওউওঈ) 'ফিডিক' মেনে। এর পুরো নাম হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব কনসালটিং ইজিনিয়ার্স। মূল নামটি ফরাসি। এরা বিশ্বজুড়ে যে কোনো নির্মাণ কাজে শর্তাবলি ও কন্ট্রাক্ট বাস্তবায়নের পদ্ধতি ঠিক করে দেয়। এদের নিয়মের বাইরে কোনো আন্তর্জাতিক কন্ট্রাক্ট পরিচালিত হতে পারে না।
ফিডিকের নিয়ম অনুযায়ী কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালটেন্টের (সিএসসি) তত্ত্বাবধানে কন্ট্রাক্ট সম্পর্কিত সব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ কারণে সিএসসি নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কাজ শুরু হলে এদের সিদ্ধান্ত অর্থায়নকারী সংস্থাগুলো প্রায়ই মেনে নেয় এবং প্রকল্পের মূল মালিক, অর্থাৎ সরকারও মানতে বাধ্য হয়। ঠিকাদারের দাবি যদি সিএসসি অনুমোদন করে, কিন্তু সরকার পক্ষ যদি সেই দাবিকে অযৌক্তিক মনে করে তাহলে সিএসসির সিদ্ধান্তই বলবৎ হবে। পরে সরকার এ বিষয়ে মামলা করতে পারে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের সিএসসি হিসেবে নিযুক্তির জন্য পাঁচটি কোম্পানি তাদের প্রস্তাব জমা দিয়েছিল। ইতিপূর্বে নির্ধারিত নিয়মাবলি মেনে দরপত্রগুলো মূল্যায়িত হয়। এ মূল্যায়ন বিশ্বব্যাংক মেনে নিয়েছিল। পরে নির্বাচিত কনসালন্টিং ফার্মের কোনো কাজে বিশ্বব্যাংক ক্ষুব্ধ হয়েছে এবং তাদের কালো তালিকাভুক্ত করেছে। মোদ্দাকথা, আমি বলতে চাচ্ছি, নির্বাচন পদ্ধতি বা নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে বিশ্বব্যাংকের কোনো আপত্তি ছিল না। যে কারণে এখন জটিলতা দেখা দিয়েছে, তা হলো পরবর্তী সময়ে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা।
এবার আরেকটি বিষয়ের অবতারণা করতে চাই সেটি হচ্ছে, যে কোনো প্রকল্পে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, অংশীদারিত্ব বজায় রাখার প্রচণ্ড তাগিদ আছে বিশ্বজুড়ে। কোনো একটি দেশের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ বা কোনো আন্তর্জাতিক অর্থলগি্নকারক প্রতিষ্ঠানের অর্থ সবার মধ্যে সব পদক্ষেপে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা অর্জনের কথা বলা হচ্ছে। একই সঙ্গে যোগ হচ্ছে যে কোনো কর্মকাণ্ডে প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপ এবং সব স্টেকহোল্ডার বা অংশীদারের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ।
বিশ্বের বিভিন্ন অঙ্গনে কথায় কথায় সুশাসন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও আইনের শাসনের কথা এখন উচ্চারিত হয়। সেই আলোকে, সবাই এখন মানে, যে কোনো দাতা দেশ বা দাতা সংস্থা তাদের সব স্টেকহোল্ডারের কাছে এসব বিষয়ে জবাবদিহি করতে বাধ্য। বিশ্বব্যাংক এবং এডিবিতে সিভিল সোসাইটি প্রতিনিধিরা নিয়মিতভাবে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করে। কাজেই কোনো কারণে কেউ যদি সন্দেহ পোষণ করে যে, এ প্রকল্পে দুর্নীতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তাহলে বিশ্বব্যাংক বিশেষ নজরদারি করতে বাধ্য। বিশ্বব্যাংকের অফিসে পদ্মা সেতুসহ ৫-৬টি বড় প্রকল্পের জন্য একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট রয়েছেন। তার কাজই হচ্ছে এ প্রকল্পগুলো বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করা, যাতে করে কোনো ধরনের অভিযোগ না আসে। আমি যতদূর জানি, পদ্মা সেতুর জমি অধিগ্রহণ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের বিষয়টি তারা খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে এবং সরকারের কাজে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। আমার জানা মতে, বাংলাদেশ সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও তার কাউন্টারপার্ট হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের বিশেষ তদারকির কথা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তার জানা ছিল না। তারপরও দুর্ঘটনা ঘটে গেল।
খবরের কাগজে পড়ছি, সরকার বিকল্প উৎস থেকে অর্থ পাওয়ার চেষ্টা করছে। সরকারের এমন প্রচেষ্টা অস্বাভাবিক নয়। কারণ দেশের লোকজন সেতুটি দ্রুত নির্মিত হওয়া দেখতে চায়। গত নির্বাচনের অঙ্গীকার এবং সামনের নির্বাচনে সাফল্য তুলে ধরার কথাও ভাবতে হচ্ছে সরকারকে। তার ফলেই বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থ জোগাড় করার কথা বলা হচ্ছে।
সত্যি বলতে কি, বিভিন্ন মহলের এ তৎপরতা দেখে আমার ভালো লাগছে। তবে মনে রাখতে হবে, টাকায় কুলাবে না। লাগবে বৈদেশিক মুদ্রা_ ডলার, ইউরো, ইয়েন, পাউন্ড ইত্যাদি। পুরো অর্থের বন্দোবস্ত করে তবেই মাঠে নামতে হবে। দেশে যেভাবে নির্মাণ কাজ হয়_ আমরা দেখি, অর্থের অভাবে ঠিকাদারদের অনেক সময় বসে থাকতে হয়। এটি কোনোভাবেই আন্তর্জাতিক ঠিকাদারদের সঙ্গে চলবে না। ফিডিক আইন অনুযায়ী ঠিকাদার তার রানিং বিল জমা দিলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তা পরিশোধ করতে হবে। কোনো কারণে ঠিকাদারকে কাজ বন্ধ করতে বলা যাবে না। কারণ ঠিকাদার তার যন্ত্রপাতি, লোক-লস্কর মোবিলাইজ করেছেন। সরকারের কারণে কাজের গতি শ্লথ হলে বিপুল পরিমাণ অর্থদণ্ড দিতে হবে।
পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে অনেক জল ঘোলা হওয়ার পর আমার কথা একটাই। সরকার যেভাবে নিজস্ব উৎস থেকে প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বলছে, সেটা সম্ভব হলে এই দেশের নাগরিক হিসেবে আমি গর্বই বোধ করব। এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিতে পারেন_ এমন বিশেষজ্ঞের অভাব নেই এ দেশে। কিন্তু আমাদের ঘাটতি রয়েছে অর্থে ও প্রযুক্তিতে। প্রযুক্তির বিষয়টি ঠিকাদারের মাথাব্যথা। সরকারের উচিত হবে সম্পূর্ণ অর্থ জোগাড়ের দিকে মনোযোগ দেওয়া। অর্থের সংস্থান হলেই কেবল নির্মাণ কাজের ব্যাপারে অগ্রসর হওয়া।
অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত : পরিবেশ বিশেষজ্ঞ; উপাচার্য, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
No comments