পশ্চিমবঙ্গ-মিয়োন বিস্কুট জুড়োন চা by অমিত বসু

রাজনীতিকরা প্রচারের ঝড় তোলার চেষ্টা করলেও প্রাণিকুল শিউরে ওঠে। সাইক্লোনের শুরুটা হয় মোটরসাইকেল বাহিনীর প্রাকোপে। তারা যখন বিভিন্ন এলাকায় দাপিয়ে বেড়ায়, নিরীহ সমাজ সংকুচিত হয়। নেতা বা নেত্রীরা পিঠ চাপড়ালে তাদের দাপট বাড়ে। এলাকা দখলের উল্লাসে প্লাবন ডেকে আনে।


তখন মানুষ কিন্তু মিইয়ে যায়। ঘরে বসে প্রমাদ গোনে। ঘোড়া ছুটিয়ে বর্গি আসার সঙ্গে বাইক বাহিনীর তফাত করতে পারে না। মানুষের এই ভয়কে যারা রাজনৈতিক জয় মনে করে, তাদের বাতাসের ক্যারেক্টার সম্পর্কে কোনো আইডিয়া নেই বলে ফুঁ দিয়ে ফোলানো বেলুনের আকারে চিরন্তন রূপ খোঁজে


বিস্কুট কৌটোয় রাখা ভালো। বাতাসে মিয়োবে না। কোয়ালিটি অটুট থাকবে। গরম চা ঠোঁটে তুলতে বিলম্ব হলে চাপা দেওয়া উচিত। চট করে ঠাণ্ডা হবে না। মিয়োন বিস্কুট আর জুড়োন চা অসহ্য। হাওয়া রুখলে এটা হয় না। বিষয়টি রাজনীতিকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যারা মনে করেন, সমীরণে স্ফীত হবার সুখই আলাদা, ফুলো ফুলো ভাবটায় লোকের মন ভোলাতে মজা; তারা ভুলে যান, হাওয়ায় ফুলোন বস্তু অস্থায়ী। চুপসোয় খুব তাড়াতাড়ি। গ্রহের মধ্যে নেপচুনে বাতাসের শাসন সব থেকে বেশি। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ধারণা, অতিরিক্ত পবন প্রবাহে সেখানে প্রাণের উদ্ভব সম্ভব হচ্ছে না। অঙ্কুর মাথা তুলতে চাইলে হাওয়াই তাকে ভূমিতে মিশিয়ে দিচ্ছে। পৃথিবীতে সে বিপদ নেই বলেই এত প্রাণ। সুঘ্রাণও কম নয়। সেই জন্যই অত্যন্ত ক্লিষ্ট মানুষও বাঁচার চেষ্টা করতে ছাড়ে না। এখানে বাতাসের সামঞ্জস্য জীবন স্বাভাবিকভাবে বহমান। যখন ভয়ঙ্কর ঝড়ে মৃত্যুর দামামা বাজে, ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে। না পেলে প্রাণ-প্রদীপ নিভে যায়।
রাজনীতিকরা প্রচারের ঝড় তোলার চেষ্টা করলেও প্রাণিকুল শিউরে ওঠে। বিপন্নতায় ম্লান হয়। সাইক্লোনের শুরুটা হয় মোটরসাইকেল বাহিনীর প্রাকোপে। তারা যখন বিভিন্ন এলাকায় দাপিয়ে বেড়ায়, নিরীহ সমাজ সংকুচিত হয়। নেতা বা নেত্রীরা পিঠ চাপড়ালে তাদের দাপট বাড়ে। এলাকা দখলের উল্লাসে প্লাবন ডেকে আনে। তখন মানুষ কিন্তু মিইয়ে যায়। ঘরে বসে প্রমাদ গোনে। ঘোড়া ছুটিয়ে বর্গি আসার সঙ্গে বাইক বাহিনীর তফাত করতে পারে না। মানুষের এই ভয়কে যারা রাজনৈতিক জয় মনে করে, তাদের বাতাসের ক্যারেক্টার সম্পর্কে কোনো আইডিয়া নেই বলে ফুঁ দিয়ে ফোলানো বেলুনের আকারে চিরন্তন রূপ খোঁজে।
এসব কথা বলা মানে মোটরসাইকেল ইন্ডাস্ট্রির বিরোধিতা করে নয়। এই নামটি বর্তমানে যথেষ্ট জনপ্রিয়। কম খরচে দ্রুত গন্তব্যে পেঁৗছনোর পক্ষে যথেষ্ট উপযোগী। যে যুবক হাঁ করে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকে, তার চেয়ে ধুলো উড়িয়ে উড়ে যাওয়া মোটরসাইকেল আরোহীর দিকে মেয়েদের নজর অনেক বেশি। সপ্তপদীতে উত্তম কুমার সুচিত্রা সেনকে মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে যেভাবে আঁকাবাঁকা রাস্তায় উধাও হয়েছিলেন, তার তুলনায় এখনকার নায়ক-নায়িকাদের বিলাসবহুল গাড়িতে রোমান্টিক জার্নি অনেক নিরেশ। তাছাড়া হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের পাগল করা গানটির বা বিকল্প কোথায়? উত্তম কুমার গানে গানে যখন বলেছেন, 'এই পথ যদি না শেষ হয়, কেমন হতো তুমি বলতো।' সেই দায়িত্ব উত্তমের কাঁধে চাপিয়ে সুচিত্রা বলছেন, 'না-না তুমিই বলো।' এ দৃশ্য দেখলে আনাড়ি লোকও রোমান্টিক বলতে বাধ্য।
আজকেও প্রেমিকাকে নিয়ে প্রেমিক যখন মোটরসাইকেলে উদ্দামতায় উদ্ভাসিত হয়, ভালই তো লাগে। পিজা ডেলিভারি বয়ের কাস্টমারের ঘরে পিজা পেঁৗছে দেবার বাহন এটাই। কুরিয়ার সার্ভিসের ভরসাও এই দু'চাকার যানটি। রানারের মতো দু'পায়ে দৌড়ানোর দিন শেষ। ছুটতে হবে বাতাসের আগে। নিজের পায়ে দাঁড়ানো বা এগোনোর দরকার নেই। মোটরসাইকেল আছে না।
বিজ্ঞান-প্রযুক্তির লক্ষ্যই হচ্ছে কাজে গতি আনা। মোটরসাইকেল সেটা করছে। অসুবিধে কোথায়! ঝঞ্ঝাট অন্য জায়গায়। কাজ আর যুদ্ধকে কি এক করা যায়! নৌকা আর নৌবাহিনী কি এক? বিমান বললে যা বোঝায়, বিমানবাহিনী কী তাই? মোটরসাইকেলের সঙ্গে মোটর বাইক বাহিনীকেও মেলান যায় না। বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধের ওতপ্রোত সম্পর্ক। তার গর্জন সুজনের কাছে অশনি সংকেত। তাদের যাতায়াতে শান্তির পাঁচিল ভাঙে। শঙ্কার ছায়া ছড়ায়।
ঘরে ঘরে গিয়ে ঘরোয়া সম্পর্ক পাতানো। সবার সুখ-দুঃখের সঙ্গী হওয়াটা যদি রাজনৈতিক কর্মীদের প্রধান কাজ মনে করা হয়, তাহলে মানতেই হবে মোটারসাইকেল তার পরিপন্থী। দ্বিচক্রযানে যুদ্ধের আহ্বান। ভালোবেসে যখন মানুষকে জয় করা যায় না, তখন ভয় দেখিয়ে বশ করার প্রবণতা। ইভিএম মেশিনে আপন আপন দলের সপক্ষে ভোটের তুফান তোলা। শিশি থেকে ঘি বের করতে সোজা আঙুলের জায়গায় বাঁকা আঙুলের দরকার কী। একটু গরম করে নিলেই তো গলে বেরিয়ে আসবে। সহযোগিতা, সহমর্মিতার উষ্ণতায় ভোটাররাও তরল বস্তুর মতো সহজলভ্য। সরল কাজটা জটিল হচ্ছে হঠকারিতায়। ভোট হাইজ্যাক করতে চাপের কৌশল। আবেগের নয়। অনিবার্য কারণেই তাই ভোটে ভাটার টান। বিধানসভার দুটি কেন্দ্রে উপনির্বাচনে ভোট কমেছে তৃণমূলের। এক বছরেই তাদের ভাঁড়ারে হাত বাড়াচ্ছে বিরোধীরা। বাঁকুড়ায় তৃণমূল আগের মার্জিন ধরে রাখতে পারেনি। হ্রাস পেয়ে অর্ধেক। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুরেও একই অবস্থায়। এই দুটি উপনির্বাচনে তৃণমূলের জয় নিশ্চিত ছিল। দেখার বিষয় ছিল ব্যবধানের মাত্রা। সেটা উঠছে, না নামছে। ফলাফল বলছে নিম্নমুখী।
ধাক্কাটা পাশ কাটিয়ে যাবার একটা কৈফিয়ত আছে। এত গরমে ভোট পড়েছে কম। গতবার বাঁকুড়ায় ৮০.০৬% ভোটার ভোট দিয়েছিলেন। এবার কমে হয়েছে ৬৭.২৪%। দাসপুরেও তাই। আগে ভোটার ছিল ৮২.০৮%। এবার ৭৪%। গরমের দোহাই দিলে বলতে হয়, সব ভোট বসন্তকালে হওয়া উচিত। মৃদুমন্দ বাতাসে ভাসতে ভাসতে, কোকিলের ডাক শুনতে শুনতে ভোটাররা পোলিং বুথে ভোট দিতে যাবেন। ইভিএম মেশিনে ভোট উপচে পড়বে।
যুক্তিটা ঠিক নয়। এক বছর আগে গ্রীষ্মেই ভোট হয়েছিল। বুথে বুথে তখন জনবিস্ফোরণ। তাপ প্রবাহের পরোয়া না করেই ভোটাররা ঝাঁপিয়েছিলেন ভোট দিতে। এবার দুটি কেন্দ্রেই তৃণমূলের প্রয়াত দুই বিধায়কের বিধবা পত্নী প্রার্থী হয়েছিলেন। সে কারণে সেন্টিমেন্টের জোয়ার থাকার কথা ছিল তাদের পক্ষে। সেটা দেখা যায়নি। উপনির্বাচনে ভোট কম পড়ে ঠিকই। এক্ষেত্রে কিন্তু নিয়মটা ঘটে না। তৃণমূল মাত্র এক বছর ক্ষমতায় এসেছে। তার পাশ থেকে একটি ভোটার সরে গেলেও, ক্ষতির সূচক।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম নির্বাচনী যুদ্ধে নামেন ১৯৮৪তে। যাদবপুরে লোকসভা কেন্দ্রে তখনকার সিপিএমের হেভিওয়েট নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়ে জয় ছিনিয়ে নেন। এই জয়ের পেছনেও ছিল আবেগ। ইন্দিরা গান্ধী নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর সেই নির্বাচনে শোক প্রবাহ এতটাই গভীর ছিল যে, কংগ্রেসকে ভোট দিয়ে ইন্দিরাকে শ্রদ্ধা জানাতে মানুষ দ্বিধা করেননি। সেদিন মমতার পাশে ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তার সুপারিশেই টিকিট পেয়েছিলেন মমতা।

অমিত বসু : ভারতীয় সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.