আবু আবদুল্লাহ : বন্ধুত্বে মুগ্ধ আমরা ক'জন by মাহমুদ হাসান
আবু আহমেদ আবদুল্লাহ। ডাক নাম চুন্নুু। আরও ছোট নাম চুনি। তবে এই নামে সম্ভবত চুনির প্রাক্তন স্ত্রী চিত্রিতা ও আমি ছাড়া আর কেউ তাকে ডাকেনি। চুন্নুুর সঙ্গে চিত্রিতার আলাপ, বন্ধুত্ব, প্রেম। কেম্ব্রিজে তখন দু'জনই হার্ভার্ডের ছাত্র। আবদুল্লাহ অর্থনীতির, আর চিত্রিতা ইংরেজির ছাত্র, প্রেসিডেন্সির ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট। আবদুল্লাহর মেধায় মুগ্ধ।
ওখানেই বিয়ে। চিত্রিতার সঙ্গে আবদুল্লাহর যে সংসার ছিল, তার বয়স যখন ১০ বছর, তখন ঠাণ্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে একদিন চুন্নুু চিত্রিতাকে বুঝিয়ে বলল, 'তোর বয়স কম। আমার সঙ্গে থেকে থেকে জীবনটা নষ্ট করে দিস না। তোর অনেক কিছু করার আছে, অনেক কিছু পাবার আছে। আমার সঙ্গে থেকে তুই যেমন বলতে গেলে কিছুই পেলি না, আমার সঙ্গে থাকলে তোর কিছুই করা হবে না; যেমন আমার হলো না।'
চিত্রিতা হতবাক হয়ে শুনেছে; যুক্তিতে যায়নি। এক পর্যায়ে এটা দু'জনার কাছেই পরিষ্কার হয়ে গেল যে, ওদের আর একসঙ্গে থাকা হবে না। এটা চুন্নুুর কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না; এক ধরনের অপরাধবোধ ছিল। ও যে চিত্রিতার কাছে কোনো অপরাধ করেছে তা নয়, কিন্তু ওর কারণে তো চিত্রিতার জীবন নষ্ট হচ্ছে। এই বাঁধন থেকে চিত্রিতাকে মুক্তি না দিলে সেটা অন্যায় হবে। চিত্রিতাকে মুক্তি দেওয়ার যেমন প্রয়োজন ছিল, তেমনি অন্যায়বোধ থেকে নিজেকে মুক্ত করাও ওর কাছে জরুরি হয়ে পড়েছিল।
সেই ঢাকা কলেজ থেকে দিনের প্রায় প্রতিটি মুহূর্ত আমরা দু'জনে কাটিয়েছি ক্লাসরুমের প্রথম বেঞ্চিতে প্রথম দুটি আসনে পাশাপাশি বসে, খাতায় সারাক্ষণ কাটাকাটি খেলে; নিউমার্কেটে, মহিউদ্দিন ও জিনাত বুকস স্টোরে বই কিনে; লাইট বিস্কুট ফ্যাক্টরিতে কেক ও ভিটাকোলা খেয়ে, ইডেন কলেজ থেকে আসা মেয়েদের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে। কলেজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা টেবিল টেনিস খেলে।
চুন্নুু আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জানত। অনেক বেশি বুঝত। ওর পড়াশোনা ছিল আমাদের চাইতে ঢের বেশি_ এটা আমরা সবাই কম-বেশি উপলব্ধি করতাম। কিন্তু কতটা বেশি, তা বোঝার উপায় ছিল না। ঢাকা কলেজে ইংরেজির এক শিক্ষক পড়াতে পড়াতে কিছুক্ষণ পর পরই গর্ব করে নিজের সম্পর্কে বলতেন '২০ ুবধৎং বীঢ়বৎরবহপব রহ ঃবধপযরহম।' আমরা তার নাম দিয়েছিলাম '২০ ুবধৎং বীঢ়বৎরবহপব রহ ঃবধপযরহম।' এক পরীক্ষায় ইংরেজি ১ম পত্রে '২০ ুবধৎং বীঢ়বৎরবহপব'-এর কাছে চুন্নুু পেল ৩৮। ২য় পত্রে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সবে পাস করে আসা ধারাল শিক্ষক রুহুল আমিন মজুমদারের হাতে পেল ৮১। পরের পরীক্ষায় সেই ২য় পত্রে '২০ ুবধৎং বীঢ়বৎরবহপব'-এর হাতে পেল ৩৯। আর তরুণ ঝকঝকে শিক্ষক মাসুদ আহমেদের হাতে পেল ৮৩। আমরা ক্লাসে জিজ্ঞেস করলে রুহুল আমিন মজুমদার এবং মাসুদ আহমেদ, দু'জনই খোলাখুলি বললেন, 'আবদুল্লাহ আমাদের চাইতে অনেক বেশি ভালো ইংরেজি জানে।' '২০ ুবধৎং বীঢ়বৎরবহপব' স্যারকে আমরা দুই পরীক্ষায় আবদুল্লাহর নম্বরের পার্থক্য উল্লেখ করে এটা কেমন করে হলো জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, 'ওই ছেলেটা বানিয়ে বানিয়ে ইংরেজি শব্দ তৈরি করে। কী সব লেখে বোঝাই যায় না।'
ঢাকা কলেজে দু'বছরে কেউ আবদুল্লাহকে ক্লাসের বই পড়তে দেখেনি। ও যে ক্লাসের বই একেবারেই পড়ে না_ ওর বড় ভাই প্রয়াত একেএম মুসা সেটা জানতেন। তাই তিনি পরীক্ষার আগের তিন মাস হোস্টেল ছাড়িয়ে ওকে তার বাসায় এনে রাখলেন। ওই বাসা থেকে ও প্রতিদিন হোস্টেলে আসত। আমরা সারাদিন গল্প করতাম, ঘুরেফিরে বেড়াতাম। দিনের শেষে ওর সঙ্গে মুসা ভাইয়ের বাড়িতে যেতাম। আবার আমি আমার সাউথ হোস্টেলে ফিরে আসতাম। পরীক্ষার সিট পড়েছিল নটর ডেম কলেজে। ও সকাল সকাল হোস্টেলে আসত। তারপর দুই বন্ধু রিকশায় করে নটর ডেম কলেজে যেতাম। অংক পরীক্ষার দিন সকালে রিকশায় আমাকে বলল, 'গত রাতে একটা দারুণ বই পড়লাম রে। দেখলাম দাদার বেডরুমের টেবিলের ওপর খধফু ঈযধঃঃবৎষু্থং খড়াবৎ । রাতে দাদা ঘুমিয়ে গেলে নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে বইটা নিজের ঘরে এনে পড়ে যখন শেষ করলাম, তখন রাত প্রায় চারটে। আবার দাদা-ভাবির ঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর বই রেখে আমার ঘরে ফিরে ঘুমোবার চেষ্টা করলাম।' এর ক'দিন পর আবারও ওই একই রকম গল্প শুনলাম। সে রাতে যে বই ওর নজর কেড়েছিল তার নাম খড়ষরঃধ। বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠার টেক্সট প্রায় মুখস্থ বলে গেল। তবুও চুন্নুু ইন্টারমিডিয়েটে পাস করেছিল। পূর্ব পাকিস্তানে তখন একটাই বোর্ড। চুন্নুু বোর্ডে ফার্স্ট হয়েছিল।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ওর পিএইচডি শেষ করার জন্য ওকে হার্ভার্ডে ফেরত পাঠান একাধিক বার। কোনো লাভ হয়নি। প্রথমবারই নিজের বিবেকের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে এক সময় জিতে গেল। তখন ওর থিসিসের ৩টা চ্যাপ্টার লেখা শেষ হয়ে গেছে। সুপারভাইজারকে গিয়ে বলল, 'দেখ, এসব তাত্তি্বক কথাবার্তা কারুর কোনো কাজে আসবে না। কেবল আমার চাকরির সুবিধে হবে। আর চাকরির খাতিরেই হয়তো কোনোদিন এমন কিছু লিখতে হবে, যা আমার বিবেক মেনে নিতে পারবে না। তাতে আমার অনেক অশান্তি হবে। তার চাইতে আমি যেমন আছি তেমনই থাকব। যেখানে চাকরি করছি সেখানেই করে যাব।'
গত বছর এই আজকের দিনে আবদুল্লাহ চলে যাওয়ার ক'দিন পর বিআইডিএসে আয়োজিত এক স্মরণসভায় অধ্যাপক রেহমান সোবহান বললেন, 'আমার জীবনে যত মেধাবী ছাত্র পেয়েছি, আবদুল্লাহ তাদের সবার থেকে ভিন্ন। ও অর্থনীতির যে কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তার সঙ্গে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও দর্শনকে অনায়াসে যুক্ত করত। এই ক্ষমতা আমি আমার জীবনে কেবল দু'জনার মধ্যে দেখেছি; সেই তরুণ বয়সে_ কেমব্রিজে আমার বন্ধু অমর্ত্য সেনের মধ্যে এবং পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংবদন্তি অধ্যাপক আবদুুর রাজ্জাকের মধ্যে।'
চুন্নুু বড় কষ্ট পেয়ে গেছে। ওর পার্কিনসন এমন একটা জায়গায় পেঁৗছেছিল, যখন ওর খাবার গিলতে কষ্ট হতো। এক আততায়ীর আঘাতে ওর একটা চোখ বছরদশেক আগেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। শেষের দিকে অন্য চোখটা দিয়েও সে আর দেখতে পেত না। ওর অসুস্থতার সময় বন্ধুরা টাকা তুলে আমেরিকায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিল। আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শফিকুর রহমান প্রায় বছর দু'য়েক চুন্নুুর বাসার বাজার করে দিয়েছে। শেষের ক'টা বছর ঢাকায় ওর পরামর্শক ডাক্তার অধ্যাপক দীন মোহাম্মদের কাছে যখনি ওকে নিয়ে গেছি, তিনি অপেক্ষা না করিয়ে ওর চিকিৎসা করেছেন; যত্ন করে দেখেছেন। চুন্নুু কাছের মানুষকে ধন্যবাদ দিত না। কাছের মানুষও যে ধন্যবাদ প্রত্যাশা করে_ এটা ও বুঝতই না। এ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝিও হয়েছে। আজ চুন্নুর পক্ষে আমি সবাইকে জানাই অসীম কৃতজ্ঞতা।
নার্স বিজলী, সাদিয়া, এলিনা; আর দীর্ঘ ৩০ বছর একনাগাড়ে যে দেখাশোনা করেছে সেই শাফিয়া_ সবাই অনেক করেছে ওর জন্য। নার্স বিজলীর সঙ্গে এখনও দেখা হলে ঘুরেফিরে ওর কথা বলে; কাঁদে। বিজলীকে, অন্য দুটো মেয়েকে আর চুন্নুর একমাত্র বু'কে যা দেওয়ার কথা ছিল, তা দেওয়া হয়েছে। শাফিয়াকে খুঁজে পাওয়া যায়নি এখনও। তাই তার প্রাপ্যটুকু দেওয়া হয়নি। বিআইডিএসে আবদুল্লাহর নামে একটা স্কলারশিপ ট্রাস্ট করার ব্যবস্থা হয়েছে। অনেক বই ছিল ওর। চুন্নুুর ভাইয়ের মেয়ে সুবর্ণা মুস্তফা কিছু বই নিয়েছে। আমি কয়েকটা নিয়েছি। বাকিগুলো বিআইডিএস-কে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। চুন্নুর সঙ্গে যেমন যেমন কথা ছিল, যেমন ভাবে ও চেয়েছিল, তেমনি সবকিছু করা হয়েছে।
চুনিরে! তোকে বড় মিস করি। তোর আগের ঘড়িটা হারিয়ে যাওয়ার পর তোকে যে ঘড়িটা দিয়েছিলাম, তুই চলে যাওয়ার পর সেটাই আমি পরি। কেমন আছিস? শুক্রবারে ভোরবেলায় আবার আসব কবিতা, তোর গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গান আর ফুল নিয়ে। তোকে দেখতে, তোর সঙ্গে কথা বলতে, তোর গা ঘেঁষে বসতে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হয়? গান শুনিয়েছিস? জীবনানন্দ দাশ আসেন তোদের আড্ডায়?
ভাল থাকবি চুনি। মন খারাপ করবি না।
চিত্রিতা হতবাক হয়ে শুনেছে; যুক্তিতে যায়নি। এক পর্যায়ে এটা দু'জনার কাছেই পরিষ্কার হয়ে গেল যে, ওদের আর একসঙ্গে থাকা হবে না। এটা চুন্নুুর কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না; এক ধরনের অপরাধবোধ ছিল। ও যে চিত্রিতার কাছে কোনো অপরাধ করেছে তা নয়, কিন্তু ওর কারণে তো চিত্রিতার জীবন নষ্ট হচ্ছে। এই বাঁধন থেকে চিত্রিতাকে মুক্তি না দিলে সেটা অন্যায় হবে। চিত্রিতাকে মুক্তি দেওয়ার যেমন প্রয়োজন ছিল, তেমনি অন্যায়বোধ থেকে নিজেকে মুক্ত করাও ওর কাছে জরুরি হয়ে পড়েছিল।
সেই ঢাকা কলেজ থেকে দিনের প্রায় প্রতিটি মুহূর্ত আমরা দু'জনে কাটিয়েছি ক্লাসরুমের প্রথম বেঞ্চিতে প্রথম দুটি আসনে পাশাপাশি বসে, খাতায় সারাক্ষণ কাটাকাটি খেলে; নিউমার্কেটে, মহিউদ্দিন ও জিনাত বুকস স্টোরে বই কিনে; লাইট বিস্কুট ফ্যাক্টরিতে কেক ও ভিটাকোলা খেয়ে, ইডেন কলেজ থেকে আসা মেয়েদের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে। কলেজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা টেবিল টেনিস খেলে।
চুন্নুু আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জানত। অনেক বেশি বুঝত। ওর পড়াশোনা ছিল আমাদের চাইতে ঢের বেশি_ এটা আমরা সবাই কম-বেশি উপলব্ধি করতাম। কিন্তু কতটা বেশি, তা বোঝার উপায় ছিল না। ঢাকা কলেজে ইংরেজির এক শিক্ষক পড়াতে পড়াতে কিছুক্ষণ পর পরই গর্ব করে নিজের সম্পর্কে বলতেন '২০ ুবধৎং বীঢ়বৎরবহপব রহ ঃবধপযরহম।' আমরা তার নাম দিয়েছিলাম '২০ ুবধৎং বীঢ়বৎরবহপব রহ ঃবধপযরহম।' এক পরীক্ষায় ইংরেজি ১ম পত্রে '২০ ুবধৎং বীঢ়বৎরবহপব'-এর কাছে চুন্নুু পেল ৩৮। ২য় পত্রে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সবে পাস করে আসা ধারাল শিক্ষক রুহুল আমিন মজুমদারের হাতে পেল ৮১। পরের পরীক্ষায় সেই ২য় পত্রে '২০ ুবধৎং বীঢ়বৎরবহপব'-এর হাতে পেল ৩৯। আর তরুণ ঝকঝকে শিক্ষক মাসুদ আহমেদের হাতে পেল ৮৩। আমরা ক্লাসে জিজ্ঞেস করলে রুহুল আমিন মজুমদার এবং মাসুদ আহমেদ, দু'জনই খোলাখুলি বললেন, 'আবদুল্লাহ আমাদের চাইতে অনেক বেশি ভালো ইংরেজি জানে।' '২০ ুবধৎং বীঢ়বৎরবহপব' স্যারকে আমরা দুই পরীক্ষায় আবদুল্লাহর নম্বরের পার্থক্য উল্লেখ করে এটা কেমন করে হলো জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, 'ওই ছেলেটা বানিয়ে বানিয়ে ইংরেজি শব্দ তৈরি করে। কী সব লেখে বোঝাই যায় না।'
ঢাকা কলেজে দু'বছরে কেউ আবদুল্লাহকে ক্লাসের বই পড়তে দেখেনি। ও যে ক্লাসের বই একেবারেই পড়ে না_ ওর বড় ভাই প্রয়াত একেএম মুসা সেটা জানতেন। তাই তিনি পরীক্ষার আগের তিন মাস হোস্টেল ছাড়িয়ে ওকে তার বাসায় এনে রাখলেন। ওই বাসা থেকে ও প্রতিদিন হোস্টেলে আসত। আমরা সারাদিন গল্প করতাম, ঘুরেফিরে বেড়াতাম। দিনের শেষে ওর সঙ্গে মুসা ভাইয়ের বাড়িতে যেতাম। আবার আমি আমার সাউথ হোস্টেলে ফিরে আসতাম। পরীক্ষার সিট পড়েছিল নটর ডেম কলেজে। ও সকাল সকাল হোস্টেলে আসত। তারপর দুই বন্ধু রিকশায় করে নটর ডেম কলেজে যেতাম। অংক পরীক্ষার দিন সকালে রিকশায় আমাকে বলল, 'গত রাতে একটা দারুণ বই পড়লাম রে। দেখলাম দাদার বেডরুমের টেবিলের ওপর খধফু ঈযধঃঃবৎষু্থং খড়াবৎ । রাতে দাদা ঘুমিয়ে গেলে নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে বইটা নিজের ঘরে এনে পড়ে যখন শেষ করলাম, তখন রাত প্রায় চারটে। আবার দাদা-ভাবির ঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর বই রেখে আমার ঘরে ফিরে ঘুমোবার চেষ্টা করলাম।' এর ক'দিন পর আবারও ওই একই রকম গল্প শুনলাম। সে রাতে যে বই ওর নজর কেড়েছিল তার নাম খড়ষরঃধ। বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠার টেক্সট প্রায় মুখস্থ বলে গেল। তবুও চুন্নুু ইন্টারমিডিয়েটে পাস করেছিল। পূর্ব পাকিস্তানে তখন একটাই বোর্ড। চুন্নুু বোর্ডে ফার্স্ট হয়েছিল।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ওর পিএইচডি শেষ করার জন্য ওকে হার্ভার্ডে ফেরত পাঠান একাধিক বার। কোনো লাভ হয়নি। প্রথমবারই নিজের বিবেকের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে এক সময় জিতে গেল। তখন ওর থিসিসের ৩টা চ্যাপ্টার লেখা শেষ হয়ে গেছে। সুপারভাইজারকে গিয়ে বলল, 'দেখ, এসব তাত্তি্বক কথাবার্তা কারুর কোনো কাজে আসবে না। কেবল আমার চাকরির সুবিধে হবে। আর চাকরির খাতিরেই হয়তো কোনোদিন এমন কিছু লিখতে হবে, যা আমার বিবেক মেনে নিতে পারবে না। তাতে আমার অনেক অশান্তি হবে। তার চাইতে আমি যেমন আছি তেমনই থাকব। যেখানে চাকরি করছি সেখানেই করে যাব।'
গত বছর এই আজকের দিনে আবদুল্লাহ চলে যাওয়ার ক'দিন পর বিআইডিএসে আয়োজিত এক স্মরণসভায় অধ্যাপক রেহমান সোবহান বললেন, 'আমার জীবনে যত মেধাবী ছাত্র পেয়েছি, আবদুল্লাহ তাদের সবার থেকে ভিন্ন। ও অর্থনীতির যে কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তার সঙ্গে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও দর্শনকে অনায়াসে যুক্ত করত। এই ক্ষমতা আমি আমার জীবনে কেবল দু'জনার মধ্যে দেখেছি; সেই তরুণ বয়সে_ কেমব্রিজে আমার বন্ধু অমর্ত্য সেনের মধ্যে এবং পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংবদন্তি অধ্যাপক আবদুুর রাজ্জাকের মধ্যে।'
চুন্নুু বড় কষ্ট পেয়ে গেছে। ওর পার্কিনসন এমন একটা জায়গায় পেঁৗছেছিল, যখন ওর খাবার গিলতে কষ্ট হতো। এক আততায়ীর আঘাতে ওর একটা চোখ বছরদশেক আগেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। শেষের দিকে অন্য চোখটা দিয়েও সে আর দেখতে পেত না। ওর অসুস্থতার সময় বন্ধুরা টাকা তুলে আমেরিকায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিল। আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শফিকুর রহমান প্রায় বছর দু'য়েক চুন্নুুর বাসার বাজার করে দিয়েছে। শেষের ক'টা বছর ঢাকায় ওর পরামর্শক ডাক্তার অধ্যাপক দীন মোহাম্মদের কাছে যখনি ওকে নিয়ে গেছি, তিনি অপেক্ষা না করিয়ে ওর চিকিৎসা করেছেন; যত্ন করে দেখেছেন। চুন্নুু কাছের মানুষকে ধন্যবাদ দিত না। কাছের মানুষও যে ধন্যবাদ প্রত্যাশা করে_ এটা ও বুঝতই না। এ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝিও হয়েছে। আজ চুন্নুর পক্ষে আমি সবাইকে জানাই অসীম কৃতজ্ঞতা।
নার্স বিজলী, সাদিয়া, এলিনা; আর দীর্ঘ ৩০ বছর একনাগাড়ে যে দেখাশোনা করেছে সেই শাফিয়া_ সবাই অনেক করেছে ওর জন্য। নার্স বিজলীর সঙ্গে এখনও দেখা হলে ঘুরেফিরে ওর কথা বলে; কাঁদে। বিজলীকে, অন্য দুটো মেয়েকে আর চুন্নুর একমাত্র বু'কে যা দেওয়ার কথা ছিল, তা দেওয়া হয়েছে। শাফিয়াকে খুঁজে পাওয়া যায়নি এখনও। তাই তার প্রাপ্যটুকু দেওয়া হয়নি। বিআইডিএসে আবদুল্লাহর নামে একটা স্কলারশিপ ট্রাস্ট করার ব্যবস্থা হয়েছে। অনেক বই ছিল ওর। চুন্নুুর ভাইয়ের মেয়ে সুবর্ণা মুস্তফা কিছু বই নিয়েছে। আমি কয়েকটা নিয়েছি। বাকিগুলো বিআইডিএস-কে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। চুন্নুর সঙ্গে যেমন যেমন কথা ছিল, যেমন ভাবে ও চেয়েছিল, তেমনি সবকিছু করা হয়েছে।
চুনিরে! তোকে বড় মিস করি। তোর আগের ঘড়িটা হারিয়ে যাওয়ার পর তোকে যে ঘড়িটা দিয়েছিলাম, তুই চলে যাওয়ার পর সেটাই আমি পরি। কেমন আছিস? শুক্রবারে ভোরবেলায় আবার আসব কবিতা, তোর গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গান আর ফুল নিয়ে। তোকে দেখতে, তোর সঙ্গে কথা বলতে, তোর গা ঘেঁষে বসতে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হয়? গান শুনিয়েছিস? জীবনানন্দ দাশ আসেন তোদের আড্ডায়?
ভাল থাকবি চুনি। মন খারাপ করবি না।
No comments