রিহ্যাব ও বিএলডিএর সংবাদ সম্মেলন-দেশীয় উদ্যোক্তারাই স্যাটেলাইট সিটি নির্মাণে সক্ষম

আবাসন খাতে বিদেশি বিনিয়োগ নেওয়ার আগে দেশের স্বার্থ বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছে এ খাতের দুই সংগঠন রিহ্যাব ও বিএলডিএ। ঢাকার আশপাশে স্যাটেলাইট সিটি করতে দেশীয় উদ্যোক্তারাই সক্ষম উল্লেখ করে এই দুই সংগঠনের নেতারা বলেছেন, আবাসন খাতের এ ধরনের প্রকল্পে বিদেশি বিনিয়োগ নেওয়ার ক্ষেত্রে দেশীয় শিল্পমালিকদের সঙ্গে ব্যাপকভিত্তিক আলোচনা শুরু করা উচিত।


গতকাল শনিবার ঢাকায় রূপসী বাংলা হোটেলে যৌথভাবে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএলডিএ) ও বাংলাদেশ রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন (রিহ্যাব)। এতে বিএলডিএর সভাপতি ও দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প উদ্যোক্তা আহমেদ আকবর সোবহান, রিহ্যাবের সভাপতি সংসদ সদস্য নসরুল হামিদ বিপুসহ সংগঠন দুটির শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে স্যাটেলাইট সিটি নির্মাণে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রিহ্যাব ও বিএলডিএ সরকারের কাছে তিনটি প্রস্তাব দেয়। এগুলো হলো- স্যাটেলাইট সিটির প্রকল্পের স্থান, আয়তন ও প্রকল্প সম্পাদনের সম্ভাব্য মডেল নিয়ে আবাসন খাতের সবার সঙ্গে ব্যাপক আলোচনা শুরু করা, ঢাকার আশপাশে স্যাটেলাইট সিটি নির্মাণে রিহ্যাব ও বিএলডিএর সঙ্গে সরকারের সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেওয়া এবং আবাসন খাতে বিদেশি বিনিয়োগ অনুমোদনের আগে স্থানীয় আবাসন ব্যবসায়ীদের যৌথ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে একটি উপযোগী মডেল অনুসন্ধান করা। 'রাজধানী ঢাকার আশপাশে স্যাটেলাইট সিটি নির্মাণে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাব্যতার বিষয়ে রিহ্যাবের অবস্থান' শীর্ষক অনুষ্ঠানে সাহারা গ্রুপ সম্পর্কে সাংবাদিকরা নানা প্রশ্ন করলেও আবাসন শিল্পের উদ্যোক্তারা বলেন, 'আমাদের কথা কোনো বিশেষ কম্পানি সম্পর্কে নয়। আমরা সব বিদেশি বিনিয়োগ সম্পর্কে বলছি।'
তাঁরা বলেন, 'বাংলাদেশের আবাসন শিল্পের বার্ষিক টার্নওভার প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১২-১৫ শতাংশ আসে এ খাত থেকে। এ খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লক্ষাধিক পেশাজীবী এবং ২০ লাখেরও বেশি দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। ২০০টিরও বেশি সহযোগী শিল্প খাত এ খাতের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের আবাসন খাত পেশাগত, কারিগরি ও আর্থিক বিচারে এ অঞ্চলের যেকোনো বড় আবাসন প্রতিষ্ঠানের সমকক্ষ।'
বিএলডিএর সভাপতি ও বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান বলেন, 'ব্যবসায়ী হিসেবে আমরা বিদেশি বিনিয়োগকে স্বাগত জানাই। তবে এতে দেশের স্বার্থ সমুন্নত রাখতে হবে। আমরা মনে করি না, কোনো সরকার এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবে যেখানে দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়।'
দেশের আবাসন খাতের বর্তমান দুরবস্থার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, তিন বছর ধরে বাংলাদেশের আবাসন খাত ক্রান্তিকাল পার করছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগের অভাবে হাজার হাজার ফ্ল্যাট হস্তান্তর করা যাচ্ছে না। ২০০৪ সালের পর একটি বিধিমালার কারণে কোনো ভূমি প্রকল্প অনুমোদন হয়নি।
ভারতের সাহারা গ্রুপের বিনিয়োগ-সংক্রান্ত সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারা যা করতে চেয়েছে বাংলাদেশের কোনো শিল্প পরিবার সেটা পারে। তাদের যেসব সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে তা পেলে ঢাকার পাশে স্যাটেলাইট সিটি গড়তে রিহ্যাব ও বিএলডিএ যথেষ্ট রকমের সামর্থ্যবান।
তিনি বলেন, 'নিঝুম দ্বীপ ও চট্টগ্রামের মিরেরসরাইয়ে প্রচুর পরিমাণে জমি আছে। সেখানে বিদেশি বিনিয়োগ করা হলে সেটা হবে দেশের জন্য যথেষ্ট মঙ্গলজনক। ঢাকার আশপাশে স্যাটেলাইট সিটি করতে বিদেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই। সরকার সাহারাকে এক লাখ একর জমি দেবে। তাহলে বিএলডিএ ও রিহ্যাবকে কেন এক লাখ একর করে জমি দেওয়া হবে না। আমাদেরও এক লাখ একর করে জমি দিলে প্রতিযোগিতার সমান অবস্থা তৈরি হবে। দেশীয় উদ্যোক্তারা বেশি দামে নিজেরা জমি কিনবেন আর সরকার তাদের (সাহারা) জমি দেবে, এতে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা হয় না।'
ঢাকার পাশে স্যাটেলাইট সিটি করা সম্ভব কি না- এ প্রশ্নের জবাবে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, এমন সুযোগ রয়েছে। তবে এ জন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব দরকার। কেননা সরকার কোনো জমি অধিগ্রহণ করতে গেলে বিঘাপ্রতি হয়তো দুই লাখ টাকা দেয়। অন্যদিকে বেসরকারিভাবে কিনতে গেলে ৫০ লাখ থেকে ৮০ লাখ পর্যন্ত টাকা লাগে।
তিনি বলেন, 'সরকার চাইলে ঢাকার চারপাশে স্যাটেলাইট সিটি করা যেতে পারে। তবে কৃষক বা ওই সব এলাকার জনগণকে কোনোভাবে বঞ্চিত করা যাবে না। সরকার অধিগ্রহণ করতে গেলে মিছিল হয়, প্রতিবাদ করে। কই কেউ তো আমার বিরুদ্ধে মিছিল করেনি। যেহেতু কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে সেহেতু ওই টাকা দিয়ে তারা অন্য জায়গায় অনেক জমি কিনতে পারছে। যখন ন্যায্যমূল্য পায় তখন তারা বিক্ষোভ করে না।'
পরিকল্পিত শহর হচ্ছে না বলে এক সাংবাদিকের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, 'এক লাখ একর জমি পেলে অনেক ভালো শহর নির্মাণ করা সম্ভব। সরকার শহরায়নের জন্য জায়গা নির্বাচন করে দিলে অনেক বেশি সুন্দর শহর নির্মাণ সম্ভব। তবে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অনেক এলাকাকে জলাভূমি হিসেবে চিহ্নিত করে আবাসন করতে দিচ্ছে না। কিন্তু এখন তারাই আবার ওই সব জমি অধিগ্রহণ করছে। রাজউক নামের প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আপনাদের আরো অনেক বেশি সোচ্চার হওয়া উচিত।'
বিএলডিএ ও রিহ্যাবের পক্ষে সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তব্য পাঠ করেন রিহ্যাবের সভাপতি সংসদ সদস্য নসরুল হামিদ বিপু। তিনি বলেন, 'দুই বছর ধরে আবাসন খাতে মন্দাবস্থা চলছে। শহরাঞ্চলে নির্মাণযোগ্য জমির অভাব এর প্রধান কারণ। বেশি দামের কারণে আবাসন মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এ সমস্যা সমাধান করতে আমরা অনেক বছর ধরেই সরকারের ব্যবস্থাপনায় ভূমি অধিগ্রহণ করে বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে স্যাটেলাইট সিটি নির্মাণের প্রস্তাব করে আসছি। কিছুদিন আগে গণমাধ্যমে জানতে পারলাম সরকার একটি বিদেশি আবাসন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে স্যাটেলাইট সিটি নির্মাণের জন্য সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এ দেশের একটি প্রতিষ্ঠিত শিল্পে বিদেশি বিনিয়োগের আগে এ খাতের সবার সঙ্গে ব্যাপক আলোচনা করা প্রয়োজন।'
তিনি বলেন, 'বিশ্বায়নের যুগে আমরা বিদেশি বিনিয়োগের বিপক্ষে নই। তবে তা হতে হবে স্থানীয় শিল্পকে সংরক্ষণ করে। বিদ্যুৎ গ্যাস যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ দেশের জন্য ভালো হবে।'
তিনি আরো বলেন, 'জমির সংকটে যেখানে দেশীয় শিল্প স্থবির, সেখানে বিদেশি কম্পানিকে বিপুল পরিমাণ জমি দেওয়ার বিষয়ে আমাদের অবশ্যই ভাবতে হবে। দেশীয় উদ্যোক্তারাই স্যাটেলাইট সিটি নির্মাণে সক্ষম। প্রয়োজন হলে বিদেশি বিনিয়োগ আসতে পারে। তবে এটি যৌথ মালিকানায় হলেই দেশীয় স্বার্থ সংরক্ষিত হতে পারে।'
সংবাদ সম্মেলনে বিএলডিএর সেক্রেটারি জেনারেল মোস্তফা কামাল মহিউদ্দিন, রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী তানভিরুল হক প্রবাল, বর্তমান সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বিদ্যুত, যুগ্ম সম্পাদক মেজর (অব.) জামসেদ হাসান, কার্যনির্বাহী সদস্য প্রকৌশলী এম আনিসুজ্জামান ভূঁইয়া রানা, বিল্ডিং টেকনোলজি অ্যান্ড আইডিয়াস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এফ আর খান উপস্থিত ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.