নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক এবং ভারত বন্ধুর কাঁটাতারের বেড়া by মোস্তফা কামাল
সময়ের প্রতিধ্বনি-ট্রানজিট আলোচনাটা বেশ জমে উঠেছিল। আর এতে ঘি ঢালছিলেন বিএনপির কয়েকজন নেতা এবং কয়েকজন কলামিস্ট। তাঁরা যেন একটা ইস্যু পেয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের দেশে ভারত-বিরোধিতার কোনো ইস্যু পেলেই হলো। সেটা নিয়ে শুরু হয়ে যায় বিতর্ক-পাল্টা বিতর্ক।
এ ইস্যুতে যুক্তি দিয়ে কেউ কথা বলতে চান না। যেহেতু ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার বিষয়, সেহেতু বিরোধিতা করতেই হবে। যদিও বর্তমান সরকার এককভাবে কোনো দেশকে ট্রানজিট দেওয়ার পক্ষে মত দেয়নি, তার পরও ইস্যুটি নিয়ে বিতর্ক চলছে।
সর্বশেষ বিতর্ক শুরু হয় ট্রানজিট ফি ভারত দেবে কী দেবে না, তা নিয়ে। আর এই বিতর্কটা বিরোধী পক্ষের হাতে তুলে দেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান। তিনি বলেছিলেন, ভারতের কাছ থেকে ট্রানজিট ফি আদায় করা হবে না। ব্যস, বিরোধী পক্ষ ইস্যু পেয়ে গেল। যদিও ভারত ট্রানজিট ফি দেবে না এ কথা কখনো বলেনি, তার পরও অর্থ উপদেষ্টা কী কারণে ভারতের কাছ থেকে ট্রানজিট ফি আদায় না করার ব্যাপারে 'অতি উদার' মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। তবে তাঁর কারণে যে একটা অনালোচিত ইস্যু উঠে এল আলোচনা-সমালোচনার শীর্ষে_সেটাই উদ্বেগের বিষয়। অথচ আমরা দেখলাম, শুধু ভারত নয়, নেপাল ও ভুটানকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার মতো অবকাঠামো আছে কি না এবং দেওয়া হলে এর ট্রানজিট ফি কী হবে, কোন কোন রুটে যানবাহন চলাচল করবে, তা খতিয়ে দেখার জন্য একটি বিশেষ কমিটি (কোর গ্রুপ) গঠন করেছে সরকার।
গত বছরের ২ ডিসেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমানকে সভাপতি করে বিশেষ কমিটি গঠন করে। কমিটিতে আরো আছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. রহমতউল্লাহ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ এবং এনবিআরের সদস্য শাহ আলম খান। কমিটি দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর প্রতিবেদন তৈরি করে। তাতে বলা হয়, ভারত, নেপাল ও ভুটানকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার মতো অবকাঠামো বাংলাদেশের নেই। অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণেই ট্রানজিট দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ প্রস্তুত নয়। এ জন্য কমপক্ষে তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে। আর এ সময় অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে হবে ৫০ হাজার কোটি টাকা। ট্রানজিট দেওয়ার আগ পর্যন্ত আপাতত ট্রান্সশিপমেন্ট দেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিটি।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিট দেওয়া হলে বছরে এক কোটি ৭৩ লাখ টন কার্গো বহন করা সম্ভব হবে। আপাতত ট্রান্সশিপমেন্ট দিলে ১০ শতাংশ, অর্থাৎ ১৮ লাখ টন কার্গো বহন করা যাবে। কমিটি ট্রানজিটের জন্য সড়ক ও রেলপথের জন্য সাতটি করে ১৪টি এবং নৌপথের জন্য তিনটি মোট ১৭টি রুট চিহ্নিত করেছে। একই সঙ্গে বর্তমান রুটের পরিস্থিতি ও অবকাঠামো উন্নয়নের সুপারিশ করেছে। প্রস্তাবিত রুটগুলোর মধ্যে রয়েছে_আখাউড়া-আগরতলা, সাবরুম-রামগড়, দেমাগিড়ি-থেগামুখ, বিবিরবাজার-শ্রীমন্তপুর, বেতুলি-পুরাতন রাঘনাবাজার, চাতলাপুর-মানু, তামাবিল-ডাউকি, হালুয়াঘাট-ঘাসুয়াপাড়া, সুনামগঞ্জ-শীলবাজার, দর্শনা-গেদে, রোহনপুর-সিংহাবাদ, বিরল-রাধিকাপুর এবং বেনাপোল-পেট্রাপোল।
এদিকে ঢাকায় সফরে এসে ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মা বলেছেন, ট্রানজিট ফি দিতে ভারত রাজি আছে। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের বিষয়েও বাংলাদেশের কাছে একটি খসড়া তুলে ধরেন তিনি। তিনি বলেন, ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট হলে উভয় দেশের মানুষই লাভবান হবে। এ জন্য উভয় দেশের আলোচনার ভিত্তিতে ট্রানজিট ফি বা মাসুল নির্ধারণ করলে ভারত তা দিতে রাজি।
আমরা জানি, ভারত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ সহজতর করতে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যাতায়াত সুবিধা চেয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। তা ছাড়া চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারেরও সুবিধা চায় তারা। গত বছর নয়াদিলি্লতে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে স্বাক্ষরিত যৌথ ইশতেহারেও এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পায়। ইশতেহারে বলা হয়, ভারত, নেপাল ও ভুটানকে ট্রানজিট দিতে রাজি আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশও ভারতের কাছে ট্রানজিট সুবিধা চেয়েছে। এর উদ্দেশ্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আন্তরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য বাড়ানো। ট্রানজিট সুবিধা বিনিময়ের মাধ্যমে দেশের বাণিজ্য বাড়ানো সম্ভব হলে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা কোথায়?
ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানগত কারণেই বাংলাদেশ এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশ থেকে অনেক সুবিধা নিতে পারে। সম্ভাবনা ও সুযোগকে সময়মতো কাজে লাগাতে না পারলে আমরা পিছিয়েই থাকব। দেশের উন্নয়ন চাইলে খোলা মন নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। সব দরজা বন্ধ রেখে ঘরে বসে থাকলে একঘরে হয়ে যেতে হবে। এখন আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা উন্নয়নের গতিধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত হব, নাকি হাত গুটিয়ে বসে থাকব!
আমরা মনে করি, আঞ্চলিক ভিত্তিতে ট্রানজিট বিনিময় অবশ্যই সমর্থনযোগ্য। বিশ্বের সব অঞ্চলেই পরস্পরের স্বার্থে এক দেশ আরেক দেশকে ট্রানজিট দিচ্ছে। এক ভিসায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব দেশ ভ্রমণ করা যায়। সেখানে বর্ডার উন্মুক্ত। অভিন্ন বাজার ও মুদ্রাব্যবস্থা। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব, পারস্পরিক অবিশ্বাস বেড়েই চলেছে। ভিসাব্যবস্থা সহজতর করার পরিবর্তে আরো কড়াকড়ি করা হচ্ছে। সীমান্তজুড়ে নির্মিত হচ্ছে কাঁটাতারের বেড়া। আস্থাহীনতার কারণেই ট্রানজিট আমাদের কাছে স্পর্শকাতর ইস্যু হয়ে উঠেছে। ভারত-বিরোধিতা এবং এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির জন্য বিরোধী পক্ষ মাঠ গরম করার চেষ্টা করছে। তারা বলার চেষ্টা করছে, আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে দিচ্ছে।
ট্রানজিট নিয়ে যারা রাজনীতি করার চেষ্টা করছে তাদের আসল মতলবটা বোঝা দরকার। জল ঘোলা করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করা হলে সাধারণ মানুষ তা কোনোভাবেই মেনে নেবে না। আমরা এ কথা বলি না, সরকার এককভাবে কিংবা একতরফাভাবে ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দিক। অবশ্যই ট্রানজিটের সঙ্গে বাংলাদেশের সুবিধা আদায়ের বিষয়টি জড়িত। বাংলাদেশের কাছ থেকে কিছু পেতে হলে ভারতকেও তার হাত প্রসারিত করতে হবে। আমাদের অমীমাংসিত সমস্যাগুলো, বিশেষ করে সীমানা নির্ধারণ, ছিটমহল বিনিময় এবং অপদখলীয় জমি হস্তান্তর দ্রুত হওয়া দরকার। মাত্র সাড়ে ছয় কিলোমিটার সীমানা নির্ধারণ বাকি থাকায় পুরো বিষয়টি ঝুলে আছে। তা ছাড়া এখন দুই দেশের সামনে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হচ্ছে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ।
সমুদ্রসীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই জাতিসংঘের কাছে আর্জি জানিয়েছে। কারণ ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সমস্যার সমাধান না করেই তাদের সমুদ্রসীমার প্রস্তাব জাতিসংঘে উত্থাপন করেছে। এখন ভারতকেই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। তা না করে ভারত তার সীমান্তজুড়ে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরো তিক্ত করে তুলছে। এটি বাংলাদেশের মর্যাদার প্রশ্ন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এতটা খারাপ নয় যে বাংলাদেশিরা দলে দলে ভারতে পাড়ি জমাবে।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আই কে গুজরাল বলেছিলেন, বড় দেশ হিসেবে ভারতেরই উচিত প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন করা। এ বক্তব্যের সঙ্গে আমরাও একমত পোষণ করি। আমরাও মনে করি, বড় দেশ হিসেবে প্রতিবেশী দেশগুলোর আর্থসামাজিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা ভারতকেই রাখতে হবে। ছোট দেশগুলোকে ভয়ে এবং চাপে রেখে ভারত কিছুই আদায় করতে পারবে না। বরং ভারতের কাঁটাতারের বেড়া অবিশ্বাস আরো বাড়াবে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়ন করতে হলে প্রতিবেশীর মর্যাদার বিষয়টিও ভারতকে ভাবতে হবে।
বাঙালি এমন এক জাতি, যে জাতি আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে বারবার রক্ত দিয়েছে। রক্ত দিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি আদায় করেছে। লাখো প্রাণের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠা করেছে স্বাধীন আবাসভূমি বাংলাদেশ। বাঙালি জাতির এই আত্মত্যাগ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। আমাদের এই মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং স্বাধীনতা অর্জনে ভারত যে বন্ধুর হাত বাড়িয়েছিল সেই দেশটি কেন কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বাঙালি জাতির মর্যাদাহানি করছে? আমরা ট্রানজিট অবশ্যই দেব। কিন্তু তার বিনিময়ে ভারত যদি কাঁটাতারের বেড়া দেয়, তাহলে নিশ্চয়ই তা আমাদের আত্মসম্মানে লাগে। এই দেশের নাগরিক হিসেবেও নিজেকে খুব ছোট মনে হয়। আমরা আশা করি, ভারতের শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং ভারত বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারবে।
একই সঙ্গে এ-ও বলতে চাই, যাঁরা কারণে-অকারণে ভারতীয় জুজুর ভয় দেখান, কথায় কথায় ভারত-বিরোধিতার নামে রাজনীতির মাঠ গরম করেন, তাঁরাও অসৎ উদ্দেশ্য থেকে কাজগুলো করেন। এদের ব্যাপারেও আমাদের সচেতন থাকতে হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamalbd@hotmail.com
সর্বশেষ বিতর্ক শুরু হয় ট্রানজিট ফি ভারত দেবে কী দেবে না, তা নিয়ে। আর এই বিতর্কটা বিরোধী পক্ষের হাতে তুলে দেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান। তিনি বলেছিলেন, ভারতের কাছ থেকে ট্রানজিট ফি আদায় করা হবে না। ব্যস, বিরোধী পক্ষ ইস্যু পেয়ে গেল। যদিও ভারত ট্রানজিট ফি দেবে না এ কথা কখনো বলেনি, তার পরও অর্থ উপদেষ্টা কী কারণে ভারতের কাছ থেকে ট্রানজিট ফি আদায় না করার ব্যাপারে 'অতি উদার' মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। তবে তাঁর কারণে যে একটা অনালোচিত ইস্যু উঠে এল আলোচনা-সমালোচনার শীর্ষে_সেটাই উদ্বেগের বিষয়। অথচ আমরা দেখলাম, শুধু ভারত নয়, নেপাল ও ভুটানকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার মতো অবকাঠামো আছে কি না এবং দেওয়া হলে এর ট্রানজিট ফি কী হবে, কোন কোন রুটে যানবাহন চলাচল করবে, তা খতিয়ে দেখার জন্য একটি বিশেষ কমিটি (কোর গ্রুপ) গঠন করেছে সরকার।
গত বছরের ২ ডিসেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমানকে সভাপতি করে বিশেষ কমিটি গঠন করে। কমিটিতে আরো আছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. রহমতউল্লাহ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ এবং এনবিআরের সদস্য শাহ আলম খান। কমিটি দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর প্রতিবেদন তৈরি করে। তাতে বলা হয়, ভারত, নেপাল ও ভুটানকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার মতো অবকাঠামো বাংলাদেশের নেই। অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণেই ট্রানজিট দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ প্রস্তুত নয়। এ জন্য কমপক্ষে তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে। আর এ সময় অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে হবে ৫০ হাজার কোটি টাকা। ট্রানজিট দেওয়ার আগ পর্যন্ত আপাতত ট্রান্সশিপমেন্ট দেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিটি।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, পূর্ণাঙ্গ ট্রানজিট দেওয়া হলে বছরে এক কোটি ৭৩ লাখ টন কার্গো বহন করা সম্ভব হবে। আপাতত ট্রান্সশিপমেন্ট দিলে ১০ শতাংশ, অর্থাৎ ১৮ লাখ টন কার্গো বহন করা যাবে। কমিটি ট্রানজিটের জন্য সড়ক ও রেলপথের জন্য সাতটি করে ১৪টি এবং নৌপথের জন্য তিনটি মোট ১৭টি রুট চিহ্নিত করেছে। একই সঙ্গে বর্তমান রুটের পরিস্থিতি ও অবকাঠামো উন্নয়নের সুপারিশ করেছে। প্রস্তাবিত রুটগুলোর মধ্যে রয়েছে_আখাউড়া-আগরতলা, সাবরুম-রামগড়, দেমাগিড়ি-থেগামুখ, বিবিরবাজার-শ্রীমন্তপুর, বেতুলি-পুরাতন রাঘনাবাজার, চাতলাপুর-মানু, তামাবিল-ডাউকি, হালুয়াঘাট-ঘাসুয়াপাড়া, সুনামগঞ্জ-শীলবাজার, দর্শনা-গেদে, রোহনপুর-সিংহাবাদ, বিরল-রাধিকাপুর এবং বেনাপোল-পেট্রাপোল।
এদিকে ঢাকায় সফরে এসে ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মা বলেছেন, ট্রানজিট ফি দিতে ভারত রাজি আছে। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের বিষয়েও বাংলাদেশের কাছে একটি খসড়া তুলে ধরেন তিনি। তিনি বলেন, ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট হলে উভয় দেশের মানুষই লাভবান হবে। এ জন্য উভয় দেশের আলোচনার ভিত্তিতে ট্রানজিট ফি বা মাসুল নির্ধারণ করলে ভারত তা দিতে রাজি।
আমরা জানি, ভারত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ সহজতর করতে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যাতায়াত সুবিধা চেয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। তা ছাড়া চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারেরও সুবিধা চায় তারা। গত বছর নয়াদিলি্লতে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে স্বাক্ষরিত যৌথ ইশতেহারেও এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পায়। ইশতেহারে বলা হয়, ভারত, নেপাল ও ভুটানকে ট্রানজিট দিতে রাজি আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশও ভারতের কাছে ট্রানজিট সুবিধা চেয়েছে। এর উদ্দেশ্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আন্তরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য বাড়ানো। ট্রানজিট সুবিধা বিনিময়ের মাধ্যমে দেশের বাণিজ্য বাড়ানো সম্ভব হলে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা কোথায়?
ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানগত কারণেই বাংলাদেশ এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশ থেকে অনেক সুবিধা নিতে পারে। সম্ভাবনা ও সুযোগকে সময়মতো কাজে লাগাতে না পারলে আমরা পিছিয়েই থাকব। দেশের উন্নয়ন চাইলে খোলা মন নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। সব দরজা বন্ধ রেখে ঘরে বসে থাকলে একঘরে হয়ে যেতে হবে। এখন আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা উন্নয়নের গতিধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত হব, নাকি হাত গুটিয়ে বসে থাকব!
আমরা মনে করি, আঞ্চলিক ভিত্তিতে ট্রানজিট বিনিময় অবশ্যই সমর্থনযোগ্য। বিশ্বের সব অঞ্চলেই পরস্পরের স্বার্থে এক দেশ আরেক দেশকে ট্রানজিট দিচ্ছে। এক ভিসায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব দেশ ভ্রমণ করা যায়। সেখানে বর্ডার উন্মুক্ত। অভিন্ন বাজার ও মুদ্রাব্যবস্থা। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব, পারস্পরিক অবিশ্বাস বেড়েই চলেছে। ভিসাব্যবস্থা সহজতর করার পরিবর্তে আরো কড়াকড়ি করা হচ্ছে। সীমান্তজুড়ে নির্মিত হচ্ছে কাঁটাতারের বেড়া। আস্থাহীনতার কারণেই ট্রানজিট আমাদের কাছে স্পর্শকাতর ইস্যু হয়ে উঠেছে। ভারত-বিরোধিতা এবং এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির জন্য বিরোধী পক্ষ মাঠ গরম করার চেষ্টা করছে। তারা বলার চেষ্টা করছে, আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে দিচ্ছে।
ট্রানজিট নিয়ে যারা রাজনীতি করার চেষ্টা করছে তাদের আসল মতলবটা বোঝা দরকার। জল ঘোলা করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করা হলে সাধারণ মানুষ তা কোনোভাবেই মেনে নেবে না। আমরা এ কথা বলি না, সরকার এককভাবে কিংবা একতরফাভাবে ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দিক। অবশ্যই ট্রানজিটের সঙ্গে বাংলাদেশের সুবিধা আদায়ের বিষয়টি জড়িত। বাংলাদেশের কাছ থেকে কিছু পেতে হলে ভারতকেও তার হাত প্রসারিত করতে হবে। আমাদের অমীমাংসিত সমস্যাগুলো, বিশেষ করে সীমানা নির্ধারণ, ছিটমহল বিনিময় এবং অপদখলীয় জমি হস্তান্তর দ্রুত হওয়া দরকার। মাত্র সাড়ে ছয় কিলোমিটার সীমানা নির্ধারণ বাকি থাকায় পুরো বিষয়টি ঝুলে আছে। তা ছাড়া এখন দুই দেশের সামনে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হচ্ছে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ।
সমুদ্রসীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই জাতিসংঘের কাছে আর্জি জানিয়েছে। কারণ ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সমস্যার সমাধান না করেই তাদের সমুদ্রসীমার প্রস্তাব জাতিসংঘে উত্থাপন করেছে। এখন ভারতকেই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। তা না করে ভারত তার সীমান্তজুড়ে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরো তিক্ত করে তুলছে। এটি বাংলাদেশের মর্যাদার প্রশ্ন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এতটা খারাপ নয় যে বাংলাদেশিরা দলে দলে ভারতে পাড়ি জমাবে।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আই কে গুজরাল বলেছিলেন, বড় দেশ হিসেবে ভারতেরই উচিত প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন করা। এ বক্তব্যের সঙ্গে আমরাও একমত পোষণ করি। আমরাও মনে করি, বড় দেশ হিসেবে প্রতিবেশী দেশগুলোর আর্থসামাজিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা ভারতকেই রাখতে হবে। ছোট দেশগুলোকে ভয়ে এবং চাপে রেখে ভারত কিছুই আদায় করতে পারবে না। বরং ভারতের কাঁটাতারের বেড়া অবিশ্বাস আরো বাড়াবে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়ন করতে হলে প্রতিবেশীর মর্যাদার বিষয়টিও ভারতকে ভাবতে হবে।
বাঙালি এমন এক জাতি, যে জাতি আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে বারবার রক্ত দিয়েছে। রক্ত দিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি আদায় করেছে। লাখো প্রাণের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠা করেছে স্বাধীন আবাসভূমি বাংলাদেশ। বাঙালি জাতির এই আত্মত্যাগ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। আমাদের এই মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং স্বাধীনতা অর্জনে ভারত যে বন্ধুর হাত বাড়িয়েছিল সেই দেশটি কেন কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বাঙালি জাতির মর্যাদাহানি করছে? আমরা ট্রানজিট অবশ্যই দেব। কিন্তু তার বিনিময়ে ভারত যদি কাঁটাতারের বেড়া দেয়, তাহলে নিশ্চয়ই তা আমাদের আত্মসম্মানে লাগে। এই দেশের নাগরিক হিসেবেও নিজেকে খুব ছোট মনে হয়। আমরা আশা করি, ভারতের শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং ভারত বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারবে।
একই সঙ্গে এ-ও বলতে চাই, যাঁরা কারণে-অকারণে ভারতীয় জুজুর ভয় দেখান, কথায় কথায় ভারত-বিরোধিতার নামে রাজনীতির মাঠ গরম করেন, তাঁরাও অসৎ উদ্দেশ্য থেকে কাজগুলো করেন। এদের ব্যাপারেও আমাদের সচেতন থাকতে হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamalbd@hotmail.com
No comments