ধান-চাল সংগ্রহ-কৃষক বঞ্চিত, লাভ ব্যবসায়ীদের?
বোরো ধানের বাম্পার ফলনে কৃষক ও কৃষি মজুরদের শ্রম-ঘাম এবং সরকারের কৃষি-বান্ধব নীতি-কৌশলের অবদান অনস্বীকার্য। গত আমন মৌসুমেও ফলন ছিল আশাতীত। সম্মিলিত চেষ্টায় এ অর্জন খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে উৎকণ্ঠা-উদ্বেগ বহুলাংশে দূর করেছে।
কৃষকের গোলায়, মিলারদের চাতালে এবং সরকারি গুদামে এত খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে যে, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী কিছু পরিমাণ চাল রফতানির সম্ভাবনার কথাও বলতে পারছেন। সরকার ২৮ টাকা কেজি দরে ৯ লাখ টন চাল এবং ১৮ টাকা কেজি দরে দেড় লাখ টন ধান কিনবে, এ সিদ্ধান্ত হয়েছে সপ্তাহ খানেক আগে এবং সংবাদপত্র ও বেতার-টেলিভিশন দ্রুতই এ খবর পেঁৗছে দিয়েছে উৎপাদকদের কাছে। এ দাম পেলে মোটামুটি ভালো লাভ থাকে, যা কৃষক পরিবারে কিছুটা হলেও সচ্ছলতা আনতে পারে। একই সঙ্গে সঞ্চিত হতে পারে বিনিয়োগ করার মতো অর্থ। কিন্তু বাস্তব চিত্র এখন পর্যন্ত হতাশায় ভরা। খাদ্য মন্ত্রণালয় আদৌ ধান-চাল কেনার জন্য প্রস্তুত নয়। শুক্রবার সমকালে 'এক ছটাকও ধান-চাল কেনেনি সরকার' শীর্ষক প্রতিবেদনে খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, 'বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু করতে হয়।' কিন্তু বোরো ধানের যে বাম্পার ফলন মিলবে, সে সম্ভাবনা মাস খানেক আগেই স্পষ্ট হয়েছে। তাহলে খাদ্য মন্ত্রণালয় কেন এতদিন 'বিভিন্ন প্রক্রিয়া' শুরু করেনি? সরকার ধান-চাল সংগ্রহ করে দুটি লক্ষ্য সামনে রেখে_ এক. উৎপাদকদের লাভ নিশ্চিত করা এবং দুই. বাজার অস্থির হয়ে পড়লে নিজের মজুদ থেকে জোগান দিয়ে তার লাগাম টেনে ধরা। কিন্তু খাদ্য মন্ত্রণালয় সংগ্রহ অভিযানে সময়মতো না নামলেও মিলার-মজুদদাররা বসে নেই। তারা পাঁচশ'-সাড়ে পাঁচশ' টাকায় ধান কিনে মজুদ করছে এবং সরকারের কাছে তা বিক্রি করে নির্ধারিত সংগ্রহ মূল্য ৭২০ টাকা আদায় করে নেবে। এমনটি ঘটলে খাদ্যশস্য সংগ্রহের প্রথম উদ্দেশ্য পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে যাবে। আমরা মনে করি, যাদের শ্রমে-ঘামে আমাদের দেশ খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পর্যায়ে পেঁৗছেছে তাদের কোনোভাবেই এর সুফল থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। আমরা এটা বলব না যে সরকার আর্দ্রতাযুক্ত ধান কিনে গুদাম ভরে ফেলুক। কিন্তু কী ধরনের ধান কেনা হবে, সেটা অবশ্যই কৃষকদের কাছে ব্যাখ্যা করতে হবে। আর এ প্রক্রিয়ায় তাদের কোনোভাবেই হয়রানি-ভোগান্তিতে ফেলা যাবে না। বোরো মৌসুমে খাদ্য সংগ্রহের জন্য সরকারের অন্তত তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। স্বল্প সময়ের মধ্যে রাজকোষ থেকে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হবে, কিন্তু এজন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি থাকবে না_ সেটা কি বিশ্বাসযোগ্য? নাকি খাদ্য বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা ধরেই নিয়েছেন যে, এ সংগ্রহ অভিযানের প্রধান লক্ষ্য কৃষক নয়, বরং বড় ব্যবসায়ীদের জন্য বিপুল অঙ্কের লাভ নিশ্চিত করা? সরকার এই প্রথম খাদ্যশস্য সংগ্রহ করছে না। বরং এ ক্ষেত্রে রয়েছে কয়েক যুগের অভিজ্ঞতা। কৃষকের স্বার্থ কীভাবে সংরক্ষণ করা যায় এবং কোন ধরনের কাজ করলে তাদের সর্বনাশ ও বড় ব্যবসায়ীদের লাভ সে জ্ঞান পুরোপুরিই তাদের থাকার কথা। তারা সঠিক পথে থাকবেন, এটাই প্রত্যাশা। অন্যথায় কৃষকের ক্ষতি, সার্বিক অর্থনীতির ক্ষতি আরও বেশি।
No comments