কলকাতায় যেখানে পাবেন আসল কাশ্মীরি শাল by ভাস্কর সরদার
শীত
নিবারণে শালের জুড়ি নেই। আর সেটি যদি হয় কাশ্মীরি, তাহলে তো সোনায় সোহাগা।
নারী-পুরুষ সবারই প্রিয় কাশ্মীরি শাল। সবাই চায় আসল কাশ্মীরি শাল কিনতে।
কিন্তু, কোথায় পাবেন আসল কাশ্মীরি শাল!
বাজারে
কাশ্মীরি শাল বলে যা বিক্রি হয় তার বেশির ভাগই আসল নয়। ফলে প্রতিদিন অনেক
ক্রেতাই প্রতারিত হন। দোকানদারের মিষ্টি কথায় প্রলুব্ধ হয়ে ক্রেতারা আসল
কাশ্মীরি শালের নামে হরহামেশাই কিনছেন নকল কাশ্মীরি শাল।
কলকাতার বিভিন্ন মার্কেটে কয়েকদিন খোঁজ-খবর নিয়ে জানা যায় কাশ্মীরি শালের আদ্যোপান্ত। কোথায়, কীভাবে এবং কারা তৈরি করেন এই শাল। সেসব জানা-অজানা কথা নিয়েই বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য এই প্রতিবেদন।
শীত পেরিয়ে এখন চলছে বসন্ত। হিম শীতল সকাল কিংবা সন্ধ্যায় শীতকে যারা পরম আদরে আলিঙ্গন করতে চান, তারা জানেন এক কাপ ধূমায়িত চায়ের সঙ্গে একটি নরম, পেলব নক্সা কাটা শাল এক অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। সেটি যদি হয় কাশ্মীরি পশমিনা, তাহলে আরামের অনুভূতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে আভিজাত্যের উষ্ণতাও। হিমালয়ের কোলে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার ভারতের কাশ্মীর। ঠিক যেন হিমালয়ের সন্তান। সে কারণেই বোধ হয় হিমালয় তার সমস্ত সৌন্দর্য দিয়ে সাজিয়ে তুলেছে কাশ্মীরকে। তাই কাশ্মীরকে বলা হয় ভূস্বর্গ।
কাশ্মীরি শালের ইতিহাস ঘাটতে গিয়ে জানা গেল ‘শাল’ শব্দটি পার্সিয়ান। ‘শাহাল’ শব্দ থেকে শাল শব্দটির উৎপত্তি। অন্যদিকে সংস্কৃত শব্দ ‘শাতি’র অপভ্রংশ থেকে শাল শব্দের উৎপত্তির কথাও জানা যায়।
কাশ্মীরি শালের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে দু’টি মত পাওয়া যায়। একদল ঐতিহাসিকের মতে ভারতের কাশ্মীরেই এই শালের জন্ম। অন্যদল দাবি করছেন পারস্যে প্রথম জন্ম হয়েছিল ‘শাল’র।
ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, সপ্তদশ শতাব্দীতে পারস্য অঞ্চলে শাল বোনা হতো। তবে ষোড়শ শতকে মুঘল আমলেও ‘শাল’ ব্যবহারের কথা শোনা যায়। আবুল ফজলের লেখা আইন-ই–আকবরী গ্রন্থে একটি গোটা অধ্যায় কাশ্মীরি শালের বর্ণনা রয়েছে। বোঝা যায় ‘শাল’ নিয়ে মুঘল শাসকরা বেশ সৌখিন ছিলেন।
কাশ্মীরি শালের খোঁজ-খবর নিতে ইতিহাসের পাতা থেকে একেবারে ২০১৪ সালের কলকাতা শহরে নামেন প্রতিবেদক। অনেক খোঁজ-খবর নিয়ে জানা যায়, আসল কাশ্মীরি শাল বিক্রি হয় কলকাতার নিউমার্কেটের বিখ্যাত ‘কাশ্মীর শাল অ্যাম্পোরিয়াম’-এ। সুঁই-সুতোর কাজে, রঙের বাহারে, নকশার কারিগরিতে চোখের সামনে ভেসে উঠল একের পর কাশ্মীরি শালের চোখ ধাঁধানো সুনিপুণ অসাধারণ শিল্পকর্ম। ঠিক যেন খরস্রোতা পাহাড়ি নদী, যার প্রতিটি বাঁকেই এক একটি স্বর্গীয় দৃশ্যপট।
সে শিল্প সুষমা মাঝে মধ্যেই কল্পনার সীমাকে অতিক্রম করে পৌঁছে যাচ্ছিল এক অকল্পনীয় মাধুর্যে। স্পর্শ করছিল অনুভূতির এক বিশেষ স্তরে।
৮৫ বছরের পুরনো প্রতিষ্ঠান ‘কাশ্মীর শাল অ্যাম্পোরিয়াম’। কলকাতার প্রথম কাশ্মীরি শালের দোকান। জগৎ বিখ্যাত পশমিনা শাল এই দোকানের প্রধান আকর্ষণ। সঙ্গে আছে কাশ্মীরের নানা হস্তশিল্পের সংগ্রহ। শুধুমাত্র কাশ্মীরে নিজেদের কারখানার কারিগরদের তৈরি শাল বিক্রি হয় সেখানে। দোকানের দুই কর্ণধার শাজাদ পাম্পোজ এবং সরফরাজ পাম্পোজ জানান, পিতামহের হাত ধরেই তাদের এই ব্যবসায় আসা। তারপর থেকে এটাই তাদের জীবন-জীকিকার একমাত্র উৎস। জার্মানি, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, চীন এবং বাংলাদেশে রয়েছে তাদের তৈরি পশমিনা শালের ব্যাপক চাহিদা। প্রাণ খোলা শাজাদ ও সরফরাজ পাম্পোজ জানান বাংলাদেশের অনেক তারকা, রাজনীতিবিদ ও অভিজাত ব্যক্তি তাদের দোকান থেকেই শাল কেনেন। কলকাতা ও মুম্বাইর তারকাদের প্রথম পছন্দ তাদেরই দোকানের শাল।
সরফরাজ পাম্পোজ জানালেন পশমিনা শাল দুই রকম। তার মধ্যে ‘কানি পশমিনা’ শালের পরিচিতি সারা বিশ্বজুড়ে।
মুঘল আমলের ইতিহাস আবার উঠে এলো কথায় কথায়। কানি পশমিনার উৎপত্তি সেই মুঘল আমলে। শুধু কাঠের সুঁচ ব্যবাহার করে তৈরি এই কানি পশমিনা শাল। দাম আট হাজার রুপি থেকে সাড়ে চার লাখ রুপি। তবে একশ পঞ্চাশ রুপি থেকে সাড়ে চার লাখ রুপির বিভিন্ন ধরনের শাল পাওয়া যায় তাদের দোকানে।
তাদের দোকানে অন্য শালের মধ্যে আরিবরগ চেন স্টিচ শালের দাম দেড় হাজার রুপি থেকে পনের হাজার রুপি। সুচের কাজ করা সেজিনি শাল সাতশ’ থেকে পাঁচ হাজার রুপি। সেমি পশমিনা আড়াই হাজার থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার রুপি। পশমিনা সাত হাজার থেকে সাড়ে চার লাখ রুপি। কানি পশমিনা সত্তর হাজার থেকে সাড়ে তিন লাখ রুপি। সেমি পশমিনা কানি তিন হাজার থেকে দশ হাজার রুপি। মেশিনে তৈরি কৃত্রিম শাল আটশ’ থেকে দুই হাজার রুপি।
কাশ্মীরি শালের চাহিদার প্রসঙ্গ উঠতেই দরাজ হাসিতে ভরে গেল শাজাদ পাম্পোজের মুখ। শাজাদ পাম্পোজ জানান, নভেম্বর থেকে মার্চ এই সময়ে দুই থেকে আড়াই হাজার মানুষ ১২২, ১২৩ ও ১২৫ নিউমার্কেটের তাদের দোকানে আসেন কাশ্মীরি শাল কিনতে। তাদের মধ্যে প্রায় এক হাজার বিভিন্ন দেশের নাগরিক অথবা প্রবাসী ভারতীয়।
তিনি জানান, মাদার তেরেসা প্রতিষ্ঠিত মিশনারিজ অফ চ্যারিটি’র সব শাল তাদের দোকান থেকেই সংগ্রহ করা হয়।
পশমিনা শাল বা আমিল কা, দুরুক্ষা শাল বা দোশালা, সাতোস শাল, নামাদা এবং গুব্বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরেন সৌখিন মানুষেরা। আজও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্মান জানানোর একটি প্রধান উপকরণ এসব শাল।
শীত পড়লেই সাইকেলের পেছনে বড় বড় বোঁচকা বেঁধে কলকাতার অলি-গলিতে আগে ঘুরে ঘুরে শাল বিক্রি করতেন আফগানদের মতো দেখতে লম্বা, ফর্সা আর ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে কথা বলা এই শাল ওয়ালারা। গৃহবধূরা ছিলেন তাদের মূল খরিদ্দার। কাশ্মীর থেকে আসাতে কেউ কেউ তাদের আবার আঁড় চোখেও দেখতেন। কাশ্মীর তখন উত্তাল। হাস্যকরভাবে পাড়ার উঠতি যুবকরা মাঝে মধ্যে তাদের জেরায় জেরায় জর্জরিত করতেন।
আজকাল তাদের খুব একটা দেখা না গেলেও, কলকাতার বিভিন্ন রাস্তায় হঠাৎ হঠাৎ তাদের দেখা মেলে নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত। তাদের ঝুলিতে থাকে আখরোট, পেস্তা, বাদাম আর কাশ্মীরের বিভিন্ন খাবার-দাবার।
একদিকে বাড়তে থাকা শপিংমল আর মুক্ত বাজার অর্থনীতি ও সস্তা দামের শাল কাশ্মীরি শালের বাজার কিছুটা খারাপ করে দিয়েছে। মেশিনে তৈরি সস্তা শালের কথা তুলতেই মুচকি হাসেন শাজাদ। বললেন সমঝদার লোকেরাই আসেন তাদের দোকানে। তাই সস্তা শাল নিয়ে তারা মোটেও চিন্তিত নন। সস্তা দরের শালে আর যাই থাকুক তাতে কাশ্মীরের ছোঁয়া নেই, নেই আভিজাত্যের গরিমা।
কাশ্মীরি শালের ইতিহাস থেকে জানা যায়, সম্রাট আকবর নিজের জন্য দুরুক্ষা নামে একটি বিশেষ ধরনের শাল তৈরি করেছিলেন। আজ যাকে দো শালা নামেও ডাকা হয়। বেশ বড় মাপের এই শালের দু’টি দিক। এর বিশেষত্ব হোল এই। এ শালের ভিতরের দিকটি কোনভাবেই বাইরের মানুষ দেখতে পায় না। সোনা রুপার জরি দিয়ে কাজ করা থাকতো সেসময়ের এই শালগুলোতে।
কাশ্মীরি শালের বাজারটা গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পরে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের শুরুর দিকে। তখন ইউরোপের সৌখিন মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে কাশ্মীরি শাল। তখন পারসিয়ান শালের বদলে জায়গা করে নেয় অপূর্ব নকশা করা কাশ্মীরি শাল। এর পরেই কাশ্মীরি শালের নকশায় পড়ে ইউরোপীয় শিল্পের ছাপ। কাশ্মীরি শালের মধ্যে সব থেকে পরিচিত শাল ‘পশমিনা’। ভেড়ার পশম দিয়ে এই শাল তৈরি হয়। গোটা পৃথিবীর বাজারে এই শাল সবচেয়ে জনপ্রিয়। কায়প্রা প্রজাতির ভেড়ার গলার নিচের এবং পেটের তলার অংশের পশম দিয়ে এই শাল তৈরি করা হয়। উন্নতমানের একটি পশমিনা শাল তৈরি করতে একজন কারিগরের সময় লাগে ত্রিশ মাস।
তিব্বতের পার্বত্য অঞ্চলের ‘চিরু ‘প্রজাতির ভেড়ার লোম দিয়ে তৈরি শালের দাম সবচেয়ে বেশি বলে জানান শাজাদ পাম্পোজ। তিনি জানান, তিন বছর আগে ভারতসহ অনেক দেশেই এই ‘চিরু’ প্রজাতির পশম ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই এই শাল এখন আর তৈরি হয় না। কারণ এই প্রজাতির ভেড়া এখন বিলুপ্তপ্রায়।
অতীতে শাল একটু বয়স্কদের পোশাক তালিকায় থাকলেও আজ সেটা তরুণদের মাঝেও জায়গা করে নিয়েছে বলে জানান হাল আমলের ফ্যশান ডিজাইনাররা। তাই বাজারে এখন পাওয়া যাচ্ছে নানা রকমের হাল ফ্যাশনের শাল। দিনদিন এর চাহিদাও বাড়ছে।
কলকাতার বিভিন্ন মার্কেটে কয়েকদিন খোঁজ-খবর নিয়ে জানা যায় কাশ্মীরি শালের আদ্যোপান্ত। কোথায়, কীভাবে এবং কারা তৈরি করেন এই শাল। সেসব জানা-অজানা কথা নিয়েই বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য এই প্রতিবেদন।
শীত পেরিয়ে এখন চলছে বসন্ত। হিম শীতল সকাল কিংবা সন্ধ্যায় শীতকে যারা পরম আদরে আলিঙ্গন করতে চান, তারা জানেন এক কাপ ধূমায়িত চায়ের সঙ্গে একটি নরম, পেলব নক্সা কাটা শাল এক অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। সেটি যদি হয় কাশ্মীরি পশমিনা, তাহলে আরামের অনুভূতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে আভিজাত্যের উষ্ণতাও। হিমালয়ের কোলে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার ভারতের কাশ্মীর। ঠিক যেন হিমালয়ের সন্তান। সে কারণেই বোধ হয় হিমালয় তার সমস্ত সৌন্দর্য দিয়ে সাজিয়ে তুলেছে কাশ্মীরকে। তাই কাশ্মীরকে বলা হয় ভূস্বর্গ।
কাশ্মীরি শালের ইতিহাস ঘাটতে গিয়ে জানা গেল ‘শাল’ শব্দটি পার্সিয়ান। ‘শাহাল’ শব্দ থেকে শাল শব্দটির উৎপত্তি। অন্যদিকে সংস্কৃত শব্দ ‘শাতি’র অপভ্রংশ থেকে শাল শব্দের উৎপত্তির কথাও জানা যায়।
কাশ্মীরি শালের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে দু’টি মত পাওয়া যায়। একদল ঐতিহাসিকের মতে ভারতের কাশ্মীরেই এই শালের জন্ম। অন্যদল দাবি করছেন পারস্যে প্রথম জন্ম হয়েছিল ‘শাল’র।
ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, সপ্তদশ শতাব্দীতে পারস্য অঞ্চলে শাল বোনা হতো। তবে ষোড়শ শতকে মুঘল আমলেও ‘শাল’ ব্যবহারের কথা শোনা যায়। আবুল ফজলের লেখা আইন-ই–আকবরী গ্রন্থে একটি গোটা অধ্যায় কাশ্মীরি শালের বর্ণনা রয়েছে। বোঝা যায় ‘শাল’ নিয়ে মুঘল শাসকরা বেশ সৌখিন ছিলেন।
কাশ্মীরি শালের খোঁজ-খবর নিতে ইতিহাসের পাতা থেকে একেবারে ২০১৪ সালের কলকাতা শহরে নামেন প্রতিবেদক। অনেক খোঁজ-খবর নিয়ে জানা যায়, আসল কাশ্মীরি শাল বিক্রি হয় কলকাতার নিউমার্কেটের বিখ্যাত ‘কাশ্মীর শাল অ্যাম্পোরিয়াম’-এ। সুঁই-সুতোর কাজে, রঙের বাহারে, নকশার কারিগরিতে চোখের সামনে ভেসে উঠল একের পর কাশ্মীরি শালের চোখ ধাঁধানো সুনিপুণ অসাধারণ শিল্পকর্ম। ঠিক যেন খরস্রোতা পাহাড়ি নদী, যার প্রতিটি বাঁকেই এক একটি স্বর্গীয় দৃশ্যপট।
সে শিল্প সুষমা মাঝে মধ্যেই কল্পনার সীমাকে অতিক্রম করে পৌঁছে যাচ্ছিল এক অকল্পনীয় মাধুর্যে। স্পর্শ করছিল অনুভূতির এক বিশেষ স্তরে।
৮৫ বছরের পুরনো প্রতিষ্ঠান ‘কাশ্মীর শাল অ্যাম্পোরিয়াম’। কলকাতার প্রথম কাশ্মীরি শালের দোকান। জগৎ বিখ্যাত পশমিনা শাল এই দোকানের প্রধান আকর্ষণ। সঙ্গে আছে কাশ্মীরের নানা হস্তশিল্পের সংগ্রহ। শুধুমাত্র কাশ্মীরে নিজেদের কারখানার কারিগরদের তৈরি শাল বিক্রি হয় সেখানে। দোকানের দুই কর্ণধার শাজাদ পাম্পোজ এবং সরফরাজ পাম্পোজ জানান, পিতামহের হাত ধরেই তাদের এই ব্যবসায় আসা। তারপর থেকে এটাই তাদের জীবন-জীকিকার একমাত্র উৎস। জার্মানি, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, চীন এবং বাংলাদেশে রয়েছে তাদের তৈরি পশমিনা শালের ব্যাপক চাহিদা। প্রাণ খোলা শাজাদ ও সরফরাজ পাম্পোজ জানান বাংলাদেশের অনেক তারকা, রাজনীতিবিদ ও অভিজাত ব্যক্তি তাদের দোকান থেকেই শাল কেনেন। কলকাতা ও মুম্বাইর তারকাদের প্রথম পছন্দ তাদেরই দোকানের শাল।
সরফরাজ পাম্পোজ জানালেন পশমিনা শাল দুই রকম। তার মধ্যে ‘কানি পশমিনা’ শালের পরিচিতি সারা বিশ্বজুড়ে।
মুঘল আমলের ইতিহাস আবার উঠে এলো কথায় কথায়। কানি পশমিনার উৎপত্তি সেই মুঘল আমলে। শুধু কাঠের সুঁচ ব্যবাহার করে তৈরি এই কানি পশমিনা শাল। দাম আট হাজার রুপি থেকে সাড়ে চার লাখ রুপি। তবে একশ পঞ্চাশ রুপি থেকে সাড়ে চার লাখ রুপির বিভিন্ন ধরনের শাল পাওয়া যায় তাদের দোকানে।
তাদের দোকানে অন্য শালের মধ্যে আরিবরগ চেন স্টিচ শালের দাম দেড় হাজার রুপি থেকে পনের হাজার রুপি। সুচের কাজ করা সেজিনি শাল সাতশ’ থেকে পাঁচ হাজার রুপি। সেমি পশমিনা আড়াই হাজার থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার রুপি। পশমিনা সাত হাজার থেকে সাড়ে চার লাখ রুপি। কানি পশমিনা সত্তর হাজার থেকে সাড়ে তিন লাখ রুপি। সেমি পশমিনা কানি তিন হাজার থেকে দশ হাজার রুপি। মেশিনে তৈরি কৃত্রিম শাল আটশ’ থেকে দুই হাজার রুপি।
কাশ্মীরি শালের চাহিদার প্রসঙ্গ উঠতেই দরাজ হাসিতে ভরে গেল শাজাদ পাম্পোজের মুখ। শাজাদ পাম্পোজ জানান, নভেম্বর থেকে মার্চ এই সময়ে দুই থেকে আড়াই হাজার মানুষ ১২২, ১২৩ ও ১২৫ নিউমার্কেটের তাদের দোকানে আসেন কাশ্মীরি শাল কিনতে। তাদের মধ্যে প্রায় এক হাজার বিভিন্ন দেশের নাগরিক অথবা প্রবাসী ভারতীয়।
তিনি জানান, মাদার তেরেসা প্রতিষ্ঠিত মিশনারিজ অফ চ্যারিটি’র সব শাল তাদের দোকান থেকেই সংগ্রহ করা হয়।
পশমিনা শাল বা আমিল কা, দুরুক্ষা শাল বা দোশালা, সাতোস শাল, নামাদা এবং গুব্বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরেন সৌখিন মানুষেরা। আজও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্মান জানানোর একটি প্রধান উপকরণ এসব শাল।
শীত পড়লেই সাইকেলের পেছনে বড় বড় বোঁচকা বেঁধে কলকাতার অলি-গলিতে আগে ঘুরে ঘুরে শাল বিক্রি করতেন আফগানদের মতো দেখতে লম্বা, ফর্সা আর ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে কথা বলা এই শাল ওয়ালারা। গৃহবধূরা ছিলেন তাদের মূল খরিদ্দার। কাশ্মীর থেকে আসাতে কেউ কেউ তাদের আবার আঁড় চোখেও দেখতেন। কাশ্মীর তখন উত্তাল। হাস্যকরভাবে পাড়ার উঠতি যুবকরা মাঝে মধ্যে তাদের জেরায় জেরায় জর্জরিত করতেন।
আজকাল তাদের খুব একটা দেখা না গেলেও, কলকাতার বিভিন্ন রাস্তায় হঠাৎ হঠাৎ তাদের দেখা মেলে নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত। তাদের ঝুলিতে থাকে আখরোট, পেস্তা, বাদাম আর কাশ্মীরের বিভিন্ন খাবার-দাবার।
একদিকে বাড়তে থাকা শপিংমল আর মুক্ত বাজার অর্থনীতি ও সস্তা দামের শাল কাশ্মীরি শালের বাজার কিছুটা খারাপ করে দিয়েছে। মেশিনে তৈরি সস্তা শালের কথা তুলতেই মুচকি হাসেন শাজাদ। বললেন সমঝদার লোকেরাই আসেন তাদের দোকানে। তাই সস্তা শাল নিয়ে তারা মোটেও চিন্তিত নন। সস্তা দরের শালে আর যাই থাকুক তাতে কাশ্মীরের ছোঁয়া নেই, নেই আভিজাত্যের গরিমা।
কাশ্মীরি শালের ইতিহাস থেকে জানা যায়, সম্রাট আকবর নিজের জন্য দুরুক্ষা নামে একটি বিশেষ ধরনের শাল তৈরি করেছিলেন। আজ যাকে দো শালা নামেও ডাকা হয়। বেশ বড় মাপের এই শালের দু’টি দিক। এর বিশেষত্ব হোল এই। এ শালের ভিতরের দিকটি কোনভাবেই বাইরের মানুষ দেখতে পায় না। সোনা রুপার জরি দিয়ে কাজ করা থাকতো সেসময়ের এই শালগুলোতে।
কাশ্মীরি শালের বাজারটা গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পরে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের শুরুর দিকে। তখন ইউরোপের সৌখিন মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে কাশ্মীরি শাল। তখন পারসিয়ান শালের বদলে জায়গা করে নেয় অপূর্ব নকশা করা কাশ্মীরি শাল। এর পরেই কাশ্মীরি শালের নকশায় পড়ে ইউরোপীয় শিল্পের ছাপ। কাশ্মীরি শালের মধ্যে সব থেকে পরিচিত শাল ‘পশমিনা’। ভেড়ার পশম দিয়ে এই শাল তৈরি হয়। গোটা পৃথিবীর বাজারে এই শাল সবচেয়ে জনপ্রিয়। কায়প্রা প্রজাতির ভেড়ার গলার নিচের এবং পেটের তলার অংশের পশম দিয়ে এই শাল তৈরি করা হয়। উন্নতমানের একটি পশমিনা শাল তৈরি করতে একজন কারিগরের সময় লাগে ত্রিশ মাস।
তিব্বতের পার্বত্য অঞ্চলের ‘চিরু ‘প্রজাতির ভেড়ার লোম দিয়ে তৈরি শালের দাম সবচেয়ে বেশি বলে জানান শাজাদ পাম্পোজ। তিনি জানান, তিন বছর আগে ভারতসহ অনেক দেশেই এই ‘চিরু’ প্রজাতির পশম ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই এই শাল এখন আর তৈরি হয় না। কারণ এই প্রজাতির ভেড়া এখন বিলুপ্তপ্রায়।
অতীতে শাল একটু বয়স্কদের পোশাক তালিকায় থাকলেও আজ সেটা তরুণদের মাঝেও জায়গা করে নিয়েছে বলে জানান হাল আমলের ফ্যশান ডিজাইনাররা। তাই বাজারে এখন পাওয়া যাচ্ছে নানা রকমের হাল ফ্যাশনের শাল। দিনদিন এর চাহিদাও বাড়ছে।
No comments