সন্ত্রাসবাদ- জামায়াতের ‘গৃহযুদ্ধ’ ও জাওয়াহিরির হুংকার by মইনুল ইসলাম
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিরক্ষা
বিশ্লেষক সংস্থা ‘জেইনস’-এর মার্কিন সহযোগী সংস্থা ‘আইএইচএস’ তাদের
প্রকাশিত ‘গ্লোবাল টেররিজম অ্যান্ড ইনসারজেন্সি অ্যাটাকস ইনডেক্স’-এর
ভিত্তিতে নির্ধারিত বিশ্বের সন্ত্রাসী সংগঠনের শীর্ষ ১০টির তালিকায়
জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে তৃতীয় বৃহত্তম সন্ত্রাসী
সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
ইসলামী
ছাত্রশিবিরের পাকিস্তানি পূর্বসূরি ইসলামী ছাত্র সংঘের ঐতিহাসিক বিকাশের
ধারা একই সঙ্গে বিবেচনা করলে সংগঠনটি এই ১০টি শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রুপের
মধ্যে এক নম্বর উপাধিটাও পেতে পারত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আলবদর ও
রাজাকার বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়ে ইসলামী ছাত্র সংঘের ক্যাডাররা পাকিস্তানি
ঘাতক সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করার ফলেই লাখ লাখ বাঙালিকে হত্যায় সফল হয়েছিল
তারা। পাকিস্তানি জেনারেল-কর্নেল-মেজর সাহেবরা তাঁদেরই লিখিত বিভিন্ন
পুস্তকে এটা স্বীকার করেছেন। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী
ছাত্র সংঘ নিষিদ্ধ থাকলেও দালালদের ক্ষমা ঘোষণার সুযোগ নিয়ে তখনকার
বিভিন্ন সরকারবিরোধী ছাত্রসংগঠনে ভিড়ে গিয়েছিল ইসলামী ছাত্র সংঘের
ক্যাডাররা। তারা গোপনে ইসলামী ছাত্র সংঘের সাংগঠনিক কার্যক্রম পুরোপুরিই
চালিয়ে গেছে। ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমানের জারি করা রাজনৈতিক দলবিধির সুযোগ
নিয়ে জামায়াতে ইসলামী নতুন নামে ‘ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগে’ আত্মপ্রকাশ করে
১৯৭৭ সালে। ওই দলের অঙ্গসংগঠন হিসেবে পুনরাবির্ভাব ঘটে ছাত্র সংঘের স্থলে
নতুন নামধারী ইসলামী ছাত্রশিবিরের, যার প্রথম সভাপতি ছিলেন বর্তমানে
মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারাধীন আসামি মীর কাসেম আলী। ১৯৭৯ সালে জামায়াতে
ইসলামী স্বনামে আসার কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ থেকে চিরতরে
গুটিয়ে নেওয়া হয় ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগকে।
আমরা অনেকেই হয়তো এখন ভুলে গেছি যে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল আজিজ আল সৌদকে পুরো আরব উপদ্বীপের প্রধান শাসকের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন বিশ্বের প্রধান সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিতে পরিণত হয়, তখন সৌদি আরবের শাসক পরিবারের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তদানীন্তন ভারতবর্ষে স্বাধীনতাসংগ্রাম জোরদার হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৪১ সালে ব্রিটিশ শাসকদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় ‘জামায়াতে ইসলামী হিন্দ’ প্রতিষ্ঠা করেন মাওলানা মওদুদী। তখনকার জনপ্রিয় পাকিস্তান প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেন মাওলানা মওদুদী, পাকিস্তানকে নাম দেন ‘নাপাকিস্তান’। কিন্তু ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই পাকিস্তানে ঘাঁটি গাড়েন মওদুদী ও তাঁর দল জামায়াতে ইসলামী। ১৯৫৩ সালে জামায়াতে ইসলামীর ইন্ধনে কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে সংঘটিত মারাত্মক দাঙ্গায় কয়েক হাজার মানুষ প্রাণ হারালে মওদুদীসহ জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতার আদালতের বিচারে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তদানীন্তন সৌদি বাদশা ইবনে সৌদের প্রবল চাপে নতি স্বীকার করে পাকিস্তান সরকার তাদের ক্ষমা করে দিতে বাধ্য হয়।
ষাটের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে যে খাদ্যসাহায্য দিত, তার মূল্য থেকে যে অংশটি ‘কাউন্টার পার্ট ফান্ড’ হিসেবে স্থানীয় মুদ্রায় পরিশোধ করা হতো, তার বিরাট একটা অংশ জামায়াতের জন্য বরাদ্দ করা হতো। ঠান্ডা যুদ্ধের ওই সময়টায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের সহায়তায় বিশ্বের দেশে দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম জোরদার হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন ভূরাজনৈতিক রণকৌশলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে ধর্মীয় উন্মাদনাকে হাতিয়ার হিসেবে মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে উৎসাহিত করার নীতি অগ্রাধিকার পেয়েছিল। মিসরের ইথওয়ানুল মুসলেমিন, ইন্দোনেশিয়ার জামাহ্ ইসলামিয়া, পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামী তখন থেকেই মার্কিন আগ্রহে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে যত্নবান হয়।
১৯৭৯ সালে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে স্বনামে কার্যক্রম জোরদার করার পর্যায়ে তার প্রধান আর্থিক পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় ছিল সৌদি সরকার, মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ধনকুবেররা ও ক্রমবর্ধমান ইসলামি এনজিওগুলো। একই ধারাবাহিকতায় ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবির ক্রমাগতভাবে শক্তি সঞ্চয় করতে শুরু করে। অন্যদিকে, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল থেকে শুরু করে পুরো সত্তর দশক অগ্রগামী ছিল বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগানধারী বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও মুজিববাদী ছাত্রলীগ। জিয়ার আমলে যুক্ত হয় বিএনপির ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল।
১৯৮০ সালের চাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের উভয় গ্রুপে ভাঙনের ফলে ইসলামী ছাত্রশিবির সহসভাপতিসহ অধিকাংশ পদে জয়ী হয়। তখন থেকেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছাত্রশিবিরের সশস্ত্র ক্যাডারদের অভয়ারণ্য হয়ে ওঠে। ১৯৮২ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মদদে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির সারা দেশে দ্রুত শক্তি বাড়াতে সমর্থ হয় বলে অভিযোগ আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান পরিচালিত আফগান যুদ্ধে বাংলাদেশ থেকে যে শত শত ‘মুজাহিদ’ পাঠানো হয়, তাতে এখানকার ধর্মীয় সংগঠনগুলোর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। কক্সবাজার ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোকেও জামায়াত-শিবির জঙ্গি প্রশিক্ষণের ক্যাম্প হিসেবে পুরো আশির দশকে ব্যবহার করেছে। যেহেতু সৌদি আরবের বিভিন্ন জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ অর্থায়নে মুজাহিদ সংগ্রহের ওই কর্মসূচি পরিচালিত হয়েছিল, তাই বাংলাদেশ সরকার জামায়াত-শিবিরের সেসব প্রশিক্ষণ কর্মসূচির বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
১৯৮২ সালে এরশাদ বেসরকারি খাতে ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের একাধিক সংস্থার অর্থায়নে প্রতিষ্ঠা পায় ‘ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ’। বাংলাদেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক সর্ববৃহৎ ব্যাংকে পরিণত হয়েছে। গত ৩২ বছরে জামায়াত-শিবিরের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য বিস্তারের মূল চাবিকাঠি ধারণ করে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক। মধ্যপ্রাচ্য থেকে এ দেশে আসা প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি এককভাবে আসে এ ব্যাংকের মাধ্যমে। জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা যে নিয়মিত ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন, তার উৎস কোথায়, সেটিও খুঁজে বের করা জরুরি।
ইসলামী ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে প্রশিক্ষণকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে—এটা আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবে ১৯৮৬ সালের মাঝামাঝি জাতিকে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জানিয়েছিলাম। তখন আওয়ামী লীগসহ দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো গুরুত্বপূর্ণ নেতাই আমার সে কথায় যথাযথ গুরুত্ব দেননি। ১৯৮৬ সালের ২৬ নভেম্বর এরশাদের ছাত্রসংগঠন জাতীয় ছাত্রসমাজের নেতা হামিদের হাতের কবজি কেটে নিয়ে ছুরির আগায় গেঁথে ইসলামী ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিজয় মিছিল করেছিল। এর ধারাবাহিকতায় ক্রমেই একটি ‘কিলিং স্কোয়াড’ হিসেবে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার অঙ্গনগুলো দখল করার অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছে ইসলামী ছাত্রশিবির। এখন শুধু জামায়াতে ইসলামীর জন্য নয়, ১৯-দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জন্যও ইসলামী ছাত্রশিবির সংঘাতমূলক রাজনীতির মাঠে প্রধানতম শক্তির উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
১৯৯১ সালে ইসলামী ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্যকে প্রথমে মাসাধিক কাল ক্যাম্পাসের ‘সাব-জেলে’ অবরুদ্ধ রাখার পরবর্তী পর্যায়ে ক্যাম্পাস থেকে সপরিবারে বিতাড়িত করে এক বছর বিশ্ববিদ্যালয়কে পুরোপুরি অচল করে রেখেছিল বেগম খালেদা জিয়ার সরকার। কিন্তু ওই ঘটনা সম্ভব হয়েছিল ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর গোপন গাঁটছড়ার কারণে। ওই গাঁটছড়া ১৯৯৬ সালে কিছুটা ছিন্ন হয়েছিল জামায়াত এককভাবে নির্বাচনী রাজনীতিতে নিজেদের শক্তিমত্তা পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে। কিন্তু ১৯৯৬ সালে মাত্র তিনটি সংসদীয় আসনে জয়ী হয়েছিল তারা। এর মাধ্যমেই জামায়াত-শিবির পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছে, আরও বহুদিন বিএনপির কাঁধে সওয়ার হয়ে তাদের নির্বাচনে অবতীর্ণ হতে হবে। একই সঙ্গে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে তারা নিজেদের সমর্থক সংগ্রহ করে শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে চলেছে। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে দেশের কিছু বাছাই করা অঞ্চলেই জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব ছিল সবচেয়ে
বেশি। সেসব পকেটে তারা পুলিশ বাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর কৌশলগত কারণেই জামায়াত-শিবির সাময়িকভাবে সংঘাত কমিয়ে সাংগঠনিক শক্তিকে পুনর্গঠিত করে নিচ্ছে। পরবর্তী মানবতাবিরোধী অপরাধীর রায় যখন সুপ্রিম কোর্ট থেকে বেরোবে, তখন আবারও শুরু হবে তাদের সশস্ত্র তাণ্ডব। এর মধ্যে এসেছে আল-কায়েদা নেতা জাওয়াহিরির অডিওবার্তা।
রাজনৈতিক মহলের ধারণা, জামায়াত-শিবির একটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের বাংলাদেশি এজেন্সি। রসুনের কোয়া অনেক থাকলেও গোড়া থাকে একটাই। বাংলাদেশের অনেক সন্ত্রাসী গ্রুপের সূতিকাগার জামায়াত-শিবির। ওই গ্রুপগুলো জামায়াত-শিবিরের পকেট-সংগঠন। প্রয়োজনে এক পকেট থেকে বেরোবে জেএমবি-বাংলা ভাই, আরেক পকেট থেকে বেরোবে হুজি, লস্কর-ই-তাইয়েবা, হিজুবত তাহ্রীর কিংবা হিজবুত তওহীদ। তাই রসুনের কোয়া নিয়ে মাতামাতি করলে সন্ত্রাসের ‘মাদার অর্গানাইজেশন’ থেকে ফোকাসটা সরে যায়।
আল-কায়েদার জাওয়াহিরির অডিও-বার্তা কোত্থেকে আপলোড করা হয়েছে, ওটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, ওই বার্তার ড্রাফট জামায়াত-শিবিরের ‘থিংক-ট্যাংক’ থেকেই গেছে বলে অনেকে মনে করেন। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জামায়াতের একাধিক নেতা গৃহযুদ্ধ শুরু করার ঘোষণা দিয়েই তাণ্ডবে নেমেছিলেন। ১৯৯১ সালে সরকারের তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রসচিব লুতফুল্লাহিল মজিদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্যদের সঙ্গে এক আনুষ্ঠানিক বৈঠকেই ঘোষণা করেছিলেন, জামায়াত-শিবির এ দেশের একটি ‘সিভিল আর্মি’। আর ২৩ বছরের ব্যবধানে তারা এখন রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করেছে।
জাওয়াহিরির রণহুংকার সেই যুদ্ধেরই নতুন অধ্যায় শুরুর জানান দিচ্ছে মাত্র।
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।
আমরা অনেকেই হয়তো এখন ভুলে গেছি যে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল আজিজ আল সৌদকে পুরো আরব উপদ্বীপের প্রধান শাসকের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন বিশ্বের প্রধান সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিতে পরিণত হয়, তখন সৌদি আরবের শাসক পরিবারের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তদানীন্তন ভারতবর্ষে স্বাধীনতাসংগ্রাম জোরদার হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৪১ সালে ব্রিটিশ শাসকদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় ‘জামায়াতে ইসলামী হিন্দ’ প্রতিষ্ঠা করেন মাওলানা মওদুদী। তখনকার জনপ্রিয় পাকিস্তান প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেন মাওলানা মওদুদী, পাকিস্তানকে নাম দেন ‘নাপাকিস্তান’। কিন্তু ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই পাকিস্তানে ঘাঁটি গাড়েন মওদুদী ও তাঁর দল জামায়াতে ইসলামী। ১৯৫৩ সালে জামায়াতে ইসলামীর ইন্ধনে কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে সংঘটিত মারাত্মক দাঙ্গায় কয়েক হাজার মানুষ প্রাণ হারালে মওদুদীসহ জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতার আদালতের বিচারে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তদানীন্তন সৌদি বাদশা ইবনে সৌদের প্রবল চাপে নতি স্বীকার করে পাকিস্তান সরকার তাদের ক্ষমা করে দিতে বাধ্য হয়।
ষাটের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে যে খাদ্যসাহায্য দিত, তার মূল্য থেকে যে অংশটি ‘কাউন্টার পার্ট ফান্ড’ হিসেবে স্থানীয় মুদ্রায় পরিশোধ করা হতো, তার বিরাট একটা অংশ জামায়াতের জন্য বরাদ্দ করা হতো। ঠান্ডা যুদ্ধের ওই সময়টায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের সহায়তায় বিশ্বের দেশে দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম জোরদার হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন ভূরাজনৈতিক রণকৌশলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে ধর্মীয় উন্মাদনাকে হাতিয়ার হিসেবে মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে উৎসাহিত করার নীতি অগ্রাধিকার পেয়েছিল। মিসরের ইথওয়ানুল মুসলেমিন, ইন্দোনেশিয়ার জামাহ্ ইসলামিয়া, পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামী তখন থেকেই মার্কিন আগ্রহে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে যত্নবান হয়।
১৯৭৯ সালে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে স্বনামে কার্যক্রম জোরদার করার পর্যায়ে তার প্রধান আর্থিক পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় ছিল সৌদি সরকার, মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ধনকুবেররা ও ক্রমবর্ধমান ইসলামি এনজিওগুলো। একই ধারাবাহিকতায় ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবির ক্রমাগতভাবে শক্তি সঞ্চয় করতে শুরু করে। অন্যদিকে, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল থেকে শুরু করে পুরো সত্তর দশক অগ্রগামী ছিল বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগানধারী বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও মুজিববাদী ছাত্রলীগ। জিয়ার আমলে যুক্ত হয় বিএনপির ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল।
১৯৮০ সালের চাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের উভয় গ্রুপে ভাঙনের ফলে ইসলামী ছাত্রশিবির সহসভাপতিসহ অধিকাংশ পদে জয়ী হয়। তখন থেকেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছাত্রশিবিরের সশস্ত্র ক্যাডারদের অভয়ারণ্য হয়ে ওঠে। ১৯৮২ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মদদে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির সারা দেশে দ্রুত শক্তি বাড়াতে সমর্থ হয় বলে অভিযোগ আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান পরিচালিত আফগান যুদ্ধে বাংলাদেশ থেকে যে শত শত ‘মুজাহিদ’ পাঠানো হয়, তাতে এখানকার ধর্মীয় সংগঠনগুলোর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। কক্সবাজার ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোকেও জামায়াত-শিবির জঙ্গি প্রশিক্ষণের ক্যাম্প হিসেবে পুরো আশির দশকে ব্যবহার করেছে। যেহেতু সৌদি আরবের বিভিন্ন জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ অর্থায়নে মুজাহিদ সংগ্রহের ওই কর্মসূচি পরিচালিত হয়েছিল, তাই বাংলাদেশ সরকার জামায়াত-শিবিরের সেসব প্রশিক্ষণ কর্মসূচির বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
১৯৮২ সালে এরশাদ বেসরকারি খাতে ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের একাধিক সংস্থার অর্থায়নে প্রতিষ্ঠা পায় ‘ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ’। বাংলাদেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক সর্ববৃহৎ ব্যাংকে পরিণত হয়েছে। গত ৩২ বছরে জামায়াত-শিবিরের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য বিস্তারের মূল চাবিকাঠি ধারণ করে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক। মধ্যপ্রাচ্য থেকে এ দেশে আসা প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি এককভাবে আসে এ ব্যাংকের মাধ্যমে। জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা যে নিয়মিত ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন, তার উৎস কোথায়, সেটিও খুঁজে বের করা জরুরি।
ইসলামী ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে প্রশিক্ষণকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে—এটা আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবে ১৯৮৬ সালের মাঝামাঝি জাতিকে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জানিয়েছিলাম। তখন আওয়ামী লীগসহ দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো গুরুত্বপূর্ণ নেতাই আমার সে কথায় যথাযথ গুরুত্ব দেননি। ১৯৮৬ সালের ২৬ নভেম্বর এরশাদের ছাত্রসংগঠন জাতীয় ছাত্রসমাজের নেতা হামিদের হাতের কবজি কেটে নিয়ে ছুরির আগায় গেঁথে ইসলামী ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিজয় মিছিল করেছিল। এর ধারাবাহিকতায় ক্রমেই একটি ‘কিলিং স্কোয়াড’ হিসেবে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার অঙ্গনগুলো দখল করার অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছে ইসলামী ছাত্রশিবির। এখন শুধু জামায়াতে ইসলামীর জন্য নয়, ১৯-দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জন্যও ইসলামী ছাত্রশিবির সংঘাতমূলক রাজনীতির মাঠে প্রধানতম শক্তির উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
১৯৯১ সালে ইসলামী ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্যকে প্রথমে মাসাধিক কাল ক্যাম্পাসের ‘সাব-জেলে’ অবরুদ্ধ রাখার পরবর্তী পর্যায়ে ক্যাম্পাস থেকে সপরিবারে বিতাড়িত করে এক বছর বিশ্ববিদ্যালয়কে পুরোপুরি অচল করে রেখেছিল বেগম খালেদা জিয়ার সরকার। কিন্তু ওই ঘটনা সম্ভব হয়েছিল ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর গোপন গাঁটছড়ার কারণে। ওই গাঁটছড়া ১৯৯৬ সালে কিছুটা ছিন্ন হয়েছিল জামায়াত এককভাবে নির্বাচনী রাজনীতিতে নিজেদের শক্তিমত্তা পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে। কিন্তু ১৯৯৬ সালে মাত্র তিনটি সংসদীয় আসনে জয়ী হয়েছিল তারা। এর মাধ্যমেই জামায়াত-শিবির পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছে, আরও বহুদিন বিএনপির কাঁধে সওয়ার হয়ে তাদের নির্বাচনে অবতীর্ণ হতে হবে। একই সঙ্গে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে তারা নিজেদের সমর্থক সংগ্রহ করে শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে চলেছে। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে দেশের কিছু বাছাই করা অঞ্চলেই জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব ছিল সবচেয়ে
বেশি। সেসব পকেটে তারা পুলিশ বাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর কৌশলগত কারণেই জামায়াত-শিবির সাময়িকভাবে সংঘাত কমিয়ে সাংগঠনিক শক্তিকে পুনর্গঠিত করে নিচ্ছে। পরবর্তী মানবতাবিরোধী অপরাধীর রায় যখন সুপ্রিম কোর্ট থেকে বেরোবে, তখন আবারও শুরু হবে তাদের সশস্ত্র তাণ্ডব। এর মধ্যে এসেছে আল-কায়েদা নেতা জাওয়াহিরির অডিওবার্তা।
রাজনৈতিক মহলের ধারণা, জামায়াত-শিবির একটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের বাংলাদেশি এজেন্সি। রসুনের কোয়া অনেক থাকলেও গোড়া থাকে একটাই। বাংলাদেশের অনেক সন্ত্রাসী গ্রুপের সূতিকাগার জামায়াত-শিবির। ওই গ্রুপগুলো জামায়াত-শিবিরের পকেট-সংগঠন। প্রয়োজনে এক পকেট থেকে বেরোবে জেএমবি-বাংলা ভাই, আরেক পকেট থেকে বেরোবে হুজি, লস্কর-ই-তাইয়েবা, হিজুবত তাহ্রীর কিংবা হিজবুত তওহীদ। তাই রসুনের কোয়া নিয়ে মাতামাতি করলে সন্ত্রাসের ‘মাদার অর্গানাইজেশন’ থেকে ফোকাসটা সরে যায়।
আল-কায়েদার জাওয়াহিরির অডিও-বার্তা কোত্থেকে আপলোড করা হয়েছে, ওটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, ওই বার্তার ড্রাফট জামায়াত-শিবিরের ‘থিংক-ট্যাংক’ থেকেই গেছে বলে অনেকে মনে করেন। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জামায়াতের একাধিক নেতা গৃহযুদ্ধ শুরু করার ঘোষণা দিয়েই তাণ্ডবে নেমেছিলেন। ১৯৯১ সালে সরকারের তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রসচিব লুতফুল্লাহিল মজিদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্যদের সঙ্গে এক আনুষ্ঠানিক বৈঠকেই ঘোষণা করেছিলেন, জামায়াত-শিবির এ দেশের একটি ‘সিভিল আর্মি’। আর ২৩ বছরের ব্যবধানে তারা এখন রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করেছে।
জাওয়াহিরির রণহুংকার সেই যুদ্ধেরই নতুন অধ্যায় শুরুর জানান দিচ্ছে মাত্র।
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।
No comments