বিশ্বায়নের কাল- অজ্ঞাতনামাদের ‘উদ্ধার’ করবে কে? by কামাল আহমেদ
বিশ্বপরিসরে মানবাধিকারকর্মীরা প্রায়ই
ইংরেজিতে ডিহিউম্যানইজিং কথাটি ব্যবহার করে থাকেন। মানুষের মনুষ্যত্ব বা
মানবিক বোধ নষ্ট কিংবা ভোঁতা করে দেওয়ার মতো নিষ্ঠুর আচরণের বর্ণনায় এটি
ব্যবহূত হয়ে থাকে। বাংলা একাডেমির অভিধান অনুসারে এর অর্থ হচ্ছে
‘অমানবিকীকরণ’।
অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির লাশ উদ্ধার অথবা অভিযুক্ত ব্যক্তির ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মৃত্যুর খবর সংবাদমাধ্যমে এখন আর তেমন গুরুত্ব পায় না। হয়তো সংবাদমাধ্যম এই অমানবিকীকরণের শিকার। একই ঘটনা নিয়মিত ঘটতে থাকলে সাধারণত তার সংবাদমূল্য থাকে না, তা সে ঘটনাটি যত মানবিক বা হূদয়বিদারকই হোক না কেন। এ রকমই একটি সংবাদ ‘মৃতদেহটি উদ্ধারে এগিয়ে এল না কেউ’ (ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১৪, প্রথম আলো)। ফরিদপুরের চরভদ্রাসনের ফকিরেরডাঙ্গি গ্রামে পদ্মার পাড়ে হাত-পা বাঁধা আনুমানিক ৩৫ বছর বয়সী যুবকের লাশটি পড়ে থাকতে দেখে গ্রামবাসী পুলিশ ও প্রশাসনকে খবর দিলেও ১৬ ঘণ্টা অপেক্ষার পরও কেউ না আসায় তাঁরা সেই লাশ আবার পানিতে ভাসিয়ে দেন।
ফেব্রুয়ারির যে দিনটির খবর উদ্ধৃত করলাম, সেদিন জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তরের গুমবিষয়ক কর্মপরিষদের ১০২তম অধিবেশন চলছিল। অধিবেশনে ৩২টি দেশের ছয় শতাধিক অভিযোগ পর্যালোচনা করা হয়েছে; ওই ৩২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও আছে। তবে বাংলাদেশের বিবেচনাধীন গুমের সংখ্যা বা অভিযোগগুলোর কোনো বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। অন্য দেশগুলো হলো আলজেরিয়া, অ্যাঙ্গোলা, বাহরাইন, চিলি, উত্তর কোরিয়া, ইকুয়েডর, গিনি, কেনিয়া, লাওস, মেক্সিকো, মরক্কো, পাকিস্তান, পেরু, স্পেন, শ্রীলঙ্কা, সিরিয়া, থাইল্যান্ড, টোগো, তুরস্ক, উজবেকিস্তান ও ভেনেজুয়েলা। জানানো হয়েছে যে পূর্ববর্তী তিন মাসে সংঘটিত গুমের অভিযোগগুলোও পর্যালোচনায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। অনিষ্পন্ন পুরোনো অভিযোগগুলোর বিষয়ে নতুন যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, সেগুলোও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর কোনো অভিযোগের তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু প্রকাশ করে না। তবে তদন্ত শেষে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দেশটির জন্য যত বিব্রতকরই হোক না কেন, তদন্তের ফলাফল প্রকাশে তারা পিছিয়ে যায় না। আশা করা যায়, আগামী মে মাসে এই গ্রুপের পরবর্তী বৈঠকে এসব তদন্তের বিষয়ে কিছু তথ্য পাওয়া যেতে পারে।
১৯৮০ সালে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেস’ বা গুমবিষয়ক কর্মপরিষদ প্রতিষ্ঠা করে। এই বিশেষজ্ঞ দলের ম্যান্ডেট হচ্ছে গুমের শিকার ব্যক্তির পরিবার ও সংশ্লিষ্ট সরকারের মধ্যে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা, যাতে করে ঘটনাটির তদন্ত নিশ্চিত করা যায়। গুম হওয়া ব্যক্তির ভাগ্যে কী ঘটেছে, সেই সত্য প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তদন্ত অব্যাহত থাকে এবং তদন্ত শেষ হওয়ার পরই ওই মামলার নিষ্পত্তি হয়। জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যক্রমের এই বিশেষজ্ঞ দলের বাংলাদেশ সফরের অনুরোধ এখনো সম্মতির অপেক্ষায় পড়ে আছে। জাতিসংঘ প্রতিনিধিদের অনুমতি দেওয়ায় তো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সমস্যা থাকার কথা নয়। সরকার কি এ ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণই শ্রেয় কৌশল মনে করছে?
বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সংকলিত হিসাব অনুযায়ী, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ডামাডোলের আট সপ্তাহে (২৯ ডিসেম্বর থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি) ৩৪ ব্যক্তির লাশ পাওয়া গেছে, যাঁদের পরিচয় অজ্ঞাতনামা। তাঁদের মধ্যে মাথাহীন দেহ থেকে শুরু করে হাত-পা বাঁধা, গুলিবিদ্ধ, ক্ষতবিক্ষত—নানা ধরনের লাশ ছিল। দেশের সব বিভাগেই এমন লাশ পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বেশি ১১ জন ঢাকায়, তারপর নয়জন রাজশাহীতে। ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’সহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন ৪৭ জন। আর ২০১৩ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ক্রসফায়ার/বন্দুকযুদ্ধ ও নির্যাতনে নিহতের সংখ্যা ২০৮। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে এ বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৫৪ দিনে দেশে গুম হয়েছেন মোট ২৮ জন।
বিষয়টিকে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দিতে সরকার আদৌ প্রস্তুত বলে মনে হয় না। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সম্প্রতি বলেছেন, দেশে কোনো গুম বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে না (প্রথম আলো, ২৩ ফেব্রুয়ারি)। অথচ মাত্র এক দিন আগে ঢাকায় বিএনপির একজন নেতাসহ সাতজন গুম হওয়ার যে খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে তাঁর স্বীকারোক্তি রয়েছে যে তিনি ওই অভিযোগের কূলকিনারা পাচ্ছেন না (প্রথম আলো, ২২ ফেব্রুয়ারি)। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, রাজধানীতে র্যাবের পোশাক ও গাড়ি ব্যবহার করে কাউকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর অপহরণকারীদের পরিচয় নিশ্চিত করতে না পারার পরও পরিস্থিতির গুরুত্ব সরকার উপলব্ধি করতে পারছে বলে বিশ্বাস করা কঠিন। বিশেষত, এ ধরনের অভিযোগ যখন এটিই প্রথম নয়, এর আগে দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক হাঙ্গামায় লিপ্ত—বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে যাঁদের বিরুদ্ধে—এ রকম কয়েকজনের মৃতদেহ উদ্ধার হওয়ার পর তাঁদের পরিবারগুলো অভিযোগ করেছে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁদের উঠিয়ে নিয়ে গেছে।
এসব গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ভূমিকা সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে যে চিত্র পাওয়া গেল, তা আরও উদ্বেগজনক। দ্বিদলীয় রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে মানবাধিকার সংগঠকদের মধ্যে যে অনৈক্য আগে থেকে ছিল, তা আরও প্রকট হয়েছে। একদল এখন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূলের স্লোগানকেই মানবাধিকারের প্রথম পাঠ হিসেবে গ্রহণ করেছে। অপর পক্ষের মধ্যে তৈরি হয়েছে একধরনের ভীতিকর আবহ। বিদেশি মানবাধিকারকর্মীরাও অবাধে কাজ করতে পারছেন না। ফেব্রুয়ারিতেই হিউম্যান রাইটস ওয়াচের একজন বিদেশি গবেষক উলি সোভাগ ও তাঁর দুজন স্থানীয় গাইডকে সাতক্ষীরায় পুলিশ তথ্যানুসন্ধানে বাধা দিয়েছে; সেই বিদেশি কাজ না করেই দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা ও ইন্টারন্যাশনাল কভনেন্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস (আইসিসিপিআর)—এই উভয় সনদেই প্রত্যেক ব্যক্তির পরিচয়ের স্বীকৃতিকে তার মৌলিক মানবাধিকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। বাংলাদেশ এই দুটি সনদেরই অংশীদার। মানবাধিকারের এসব সনদেই গুম বা এনফোর্সড ডিজঅ্যাপেয়ারেন্স থেকে সুরক্ষার অধিকারকে প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ওই সনদেই বলা আছে যে গুম হওয়ার সময় থেকে গুমের শিকার ব্যক্তির জীবিত বা মৃত অবস্থায় হদিস না মেলা পর্যন্ত সময় অপরাধ সংঘটন অব্যাহত ছিল বলে বিবেচিত হবে। সুতরাং, গুমের মতো অপরাধে যাঁরাই জড়িত থাকুন না কেন, তা সে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অথবা কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠী বা অপরাধী চক্র, তাদের অপরাধের দায় অকস্মাৎ উবে যাবে—এমনটি ধরে নেওয়া সমীচীন হবে না। নাগরিক গোষ্ঠী বা সুশীল সমাজকে ভীতি প্রদর্শন, হয়রানি বা চাপের মধ্যে রেখে সাময়িকভাবে তৃপ্তি পেলেও এসব অপরাধের দায় ভবিষ্যতে তার হোতারা এড়াতে পারবেন, তেমন ভাবনা নির্বুদ্ধিতা ছাড়া কিছুই নয়।
সুতরাং, এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র কি তার নাগরিকদের প্রতি সেই দায়িত্ব পালন করছে? ফরিদপুরের ফকিরেরডাঙ্গি গ্রামে পদ্মায় ভেসে ওঠা যুবকের পরিচয় উদ্ধারের চেষ্টা তো দূরের কথা, মৃত্যুর পর তাঁকে মানবিক মর্যাদাটুকুও কি দেওয়া হয়েছে? ডিএনএ প্রযুক্তি, জাতীয় পরিচয়পত্র, নাগরিকদের বিষয়ে জাতীয় তথ্যভান্ডারের ডিজিটাল রূপান্তর—এগুলোর উপযোগিতা কী ও কতটুকু? আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে কি আমরা কিছুই শিখব না? সে সময়ে লাখ লাখ শহীদের অনেকেরই ঠাঁই হয়েছিল গণকবরে। এসব গণকবর চিহ্নিত করা এবং শহীদদের তালিকা করার কোনো সরকারি উদ্যোগ না থাকলেও ড. এম এ হাসানের গণকবর অনুসন্ধান প্রকল্প সেই দুঃসাধ্য কাজটি সীমিত আকারে হলেও চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু স্বাধীনতার চার দশক পরও যদি কোনো নাগরিককে নামপরিচয়হীন অবস্থায় পরিবার-পরিজনের অজান্তে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের দয়ায় সমাহিত হতে হয়, তা নিশ্চয়ই জাতি হিসেবে আমাদের মানবিক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে না।
‘অজ্ঞাতনামা’ পরিচিতির আরেকটি ভয়াবহ দিক হচ্ছে তার অপব্যবহার। হাজার হাজার অজ্ঞাতনামাকে আসামি করা পুলিশের জন্য রেওয়াজে পরিণত হয়েছে বলেই মনে হয়। যত বেশিসংখ্যক অজ্ঞাতনামাকে আসামি করা যায়, তত বেশি ‘আর্থিক পুরস্কার‘ই তার কারণ বলে অনেকের ধারণা। মানবাধিকারকর্মীদের অনেকের মতে, সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আর্থিক পুরস্কার না থাকলেও তা পুষিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে সন্দেহভাজন হিসেবে যে কাউকে ধরে নিয়ে অর্থ আদায়। সংবাদপত্রের ভাষায় একে বলা হয় গ্রেপ্তার-বাণিজ্য। আর বিরোধী রাজনীতিকদের ভাষায় এটি হচ্ছে প্রতিপক্ষকে হয়রানি করার হাতিয়ার। রাজনীতির বাইরে ব্যক্তিগত রেষারেষি ও দ্বন্দ্বের ক্ষোভ মেটানোর জন্যও ‘অজ্ঞাতনামা আসামি’র অজুহাত কাজে লাগানোর অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে।
রাজনৈতিক হাঙ্গামা অথবা অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সবাইকে সঙ্গে সঙ্গে চিহ্নিত করা যে সম্ভব নয়, সেই বাস্তবতা নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু অপরাধের প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ, ঘটনাস্থলে রেখে যাওয়া আলামত, অপরাধের উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ ইত্যাদির মাধ্যমে সন্দেহভাজন অপরাধীকে চিহ্নিত করার প্রথাগত পদ্ধতি প্রয়োগের পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার অপরাধীর পরিচয় উদ্ঘাটনকে এখন অনেক সহজ করে দিয়েছে। পুলিশের কার্যক্রম পরিচালনায় প্রযুক্তির ব্যবহার এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে লন্ডনসহ পাশ্চাত্যের অনেক শহরেই কাউকে গ্রেপ্তারের সময় পুলিশ বাড়াবাড়ি করছে কি না, তার রেকর্ড রাখার জন্য পুলিশের ইউনিফর্মের অংশ হয়েছে ক্ষুদ্রাকার ভিডিও ক্যামেরা। লন্ডনের মেট্রোপলিটন পুলিশের মতো অতটা যেতে না পারলেও বাংলাদেশ পুলিশের অভিধান থেকে অজ্ঞাতনামা শব্দের বিলোপ প্রয়োজন। সেটা যত তাড়াতাড়ি হয়, ততই ভালো।
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন।
No comments