বাজেট ২০১৩-১৪ ॥ প্রতিক্রিয়া ও সুপারিশ by ড. আবুল বারকাত ও ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী
(গতকালের পর)
৪২. ভূগর্ভস্থ পানির আর্সেনিক দূষণ একটি নীরব ঘাতক এবং বড় স্বাস্থ্য বিপর্যয়মূলক ইস্যু। কিন্তু সে তুলনায় আর্সেনিকমুক্ত সুপেয় পানি সরবরাহের কর্মসূচি যথেষ্ট গুরুত্ব পায়নি।
৪২. ভূগর্ভস্থ পানির আর্সেনিক দূষণ একটি নীরব ঘাতক এবং বড় স্বাস্থ্য বিপর্যয়মূলক ইস্যু। কিন্তু সে তুলনায় আর্সেনিকমুক্ত সুপেয় পানি সরবরাহের কর্মসূচি যথেষ্ট গুরুত্ব পায়নি।
আর্সেনিকমুক্ত পানি সরবরাহের লক্ষ্যে আর্সেনিক আক্রান্ত এলাকাসমূহে সনোফিল্টারের সহজলভ্যতাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরী।
৪৩. পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন, স্বাস্থ্য পরিচর্যা (ধিঃবৎ, ংধহরঃধঃরড়হ, যুমরবহব) খাতে বাজেট বরাদ্দ প্রতিশ্রুত অগ্রাধিকারের তুলনায় স্বল্প। আর এ খাতের বরাদ্দ প্রধানত বড় শহরমুখী। এ খাতে একদিকে বরাদ্দ অনেক বাড়াতে হবে, আর অন্যদিকে গ্রামসহ প্রান্তিক-সুবিধা বঞ্চিত এলাকায় (চর, হাওর, বাওর, উপকূলীয় অঞ্চল, পার্বত্য এলাকা, শহরের বস্তি) বরাদ্দ অনেক বাড়াতে হবে।
৪৪. শিশু স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মায়ের দুধের বিকল্প নেই। অথচ শিশু-খাদ্য উৎপাদন-বিপণনকারী বহুজাতিক কোম্পানিরা এ দেশে শিশু খাদ্য নিয়ে রমরমা ব্যবসা করছেÑযা প্রকৃত অর্থে শিশু স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এসব শিশু খাদ্যের আমদানি নিষিদ্ধ হওয়া উচিত; না পারলে এসবে উচ্চ হারে আমদানি শুল্ক আরোপ জরুরী। এসব শিশু খাদ্যের এ্যাডভারটাইজমেন্ট নিষিদ্ধ করা উচিত।
৪৫. মাতৃস্বাস্থ্য ও শিশু পুষ্টির উন্নয়ন বরাদ্দ বৃদ্ধি প্রয়োজন।
৪৬. পরিবেশবান্ধব বাজেট বাস্তবায়নের জন্য শুধু অর্থমন্ত্রীর সদিচ্ছা ও আর্থিক বরাদ্দই যথেষ্ট নয়। সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রনয়ন ও সঠিক বাস্তবায়নের জন্য দরকার প্রভাবশালী স্বার্থগোষ্ঠীর পরিবেশ বিরোধী অন্যায় কার্যকলাপ প্রতিরোধে রাজনৈতিক অঙ্গীকার।
৪৭. আমরা দেখছি বছরের শুরুতে বাজেটে নারীর জন্য প্রকল্পের একটি বড় অংশ বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু আমাদের জানা হয় না বাস্তবে এর কতখানি কার্যকর হয়েছে। এটি পরিবীক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। এই পরিবীক্ষণের দায়িত্ব দেয়া যায় একটি জাতীয় পর্যায়ের মনিটরিং কোষকে, যেখানে থাকবেন জেন্ডার বাজেট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি, নারী অধিকার আন্দোলনের প্রতিনিধি, সরকারের সংশ্লিষ্ট উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি।
৪৮. নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে। এ বিষয়ে পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগও দেখা গেছে। কিন্তু এর ধীরগতি এই সরকারের মেয়াদে নীতি বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কমিয়ে দিচ্ছে।
৪৯. গ্রামে অথবা শহরে নারীর জীবন যন্ত্রণাময়Ñবাল্যবিয়ে, যৌন হয়রানি, যৌতুক ও পারিবারিক নির্যাতন এসবই নারী এককভাবে সহ্য করে। এসব প্রতিরোধে নির্বাচিত স্থানীয় প্রতিনিধি, সরকারের স্থানীয় কর্মকর্তা এবং নির্বাচিত নারী প্রতিনিধি সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ইতোমধ্যে সিডও সনদের অনুসরণে “পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০” জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। তবে এটি ব্যবহারের জন্য বিধি প্রণয়নের কাজটি আরও দ্রুতগতিতে করা দরকার।
৫০. নারীর সাংসারিক কাজের ফলে যে মূল্য সংযোজন হয়, তার অর্থনৈতিক স্বীকৃতি দানের উদ্যোগটি সরকারকে গ্রহণ করতে হবে। টেকসই অর্থনীতির স্বার্থে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ এ কাজে অগ্রসর হয়েছে। নারীর অস্বীকৃত কাজের অর্থনৈতিক স্বীকৃতি নারীকে সমাজে সম্মানিত করবে এবং ঘরে-বাইরে নারী নির্যাতনের মতো কঠিন সমস্যাসমূহ স্বাভাবিকভাবেই বিস্মৃত হবে।
৫১. বাজেটের ব্যয় খাতসমূহের ব্যয়-অগ্রাধিকার পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে।
৫২. জেলাÑওয়ারি বাজেট প্রণয়ন জরুরী। জেলাÑওয়ারি বাজেটে রাজস্ব ও উন্নয়ন উভয় বাজেটই থাকা দরকার।
৫৩. বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর আওতায় নূতন প্রকল্প যত কম নেয়া যায় ততই মঙ্গল। যে সব প্রকল্প বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে আছে সেগুলোতে জোর দিতে হবে।
৫৪. খাদ্য নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিতে জোর দিতে হবে।
৫৫. আমাদের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাব্যবস্থার কারিকুলাম প্রণেতা ও লেখকদের জেন্ডার সংবেদনশীল প্রশিক্ষণের জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। মাদ্রাসা শিক্ষায় ছাত্রী ভর্তির হার দ্রুত বেড়ে চলেছে। এ শিক্ষার কর্মসংস্থান নেই। মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকীকরণ করার কথা সবসময় বলা হয়েছে। এটি দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন। মূল ধারার শিক্ষায় দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের প্রবেশাধিকার বাড়াতে সুনির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন।
আমাদের প্রস্তাব ও সরকারের বাজেট ঘোষণার মধ্যে দূরত্ব খুব বেশী নয়। অকপটে সরকারী ব্যর্থতা স্বীকার করা, রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধির হার, এডিপির বাস্তবায়ন হার বাড়ানোর পদক্ষেপ, ঘাটতি অর্থায়ন হ্রাস করা তথা ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ গ্রহণ কমিয়ে আনা, সম্প্রসারনশীল বাজেট আকার, দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার কার্যক্রম, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সম্পর্কিত প্রস্তাবনাসমূহ স্পষ্টভাবে মেনে চলতে হবে। তার অর্থ এই নয় যে, বাজেটের কোন দুর্বলতা বা ফড়হিংরফব ঝুঁকি নেই। চূড়ান্ত বাজেট প্রণয়নে সেগুলো অবশ্যই বিবেচনায় এনে কার্যকর আরও কিছু পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত করে বাজেটকে এর স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য অর্জনে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
বাজেটের অনুমান ভিত্তি
২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নে মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামোর অন্ত:স্থ কয়েকটি অনুমানসহ চলমান অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রেক্ষাপটসমূহকে ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়েছে। বাজেটের প্রক্ষেপণ ভিত্তিগুলো নিম্নরূপ: সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকবে; রাজস্ব ও মুদ্রানীতি কৌশলের ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে; মন্দা থেকে ইউরোপসহ বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে এবং বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে; বৃদ্ধি পাবে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের চাহিদা; উন্নয়ন সহযোগীসহ অন্যান্য সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে আস্থা বাড়বে ফলে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (ঋউও) বৃদ্ধি পাবে এবং পাইপ লাইনে থাকা বৈদেশিক সাহায্য অবমুক্তি সহজতর হবেÑযা প্রকল্প সহায়তার ব্যবহার বাড়াবে এবং এডিপি বাস্তবায়ন গতি বাড়াবে; সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বৃদ্ধি এবং ডায়াসপোরা বন্ড ছাড়ার ফলে ব্যক্তিখাতে ঋণ ও বিনিয়োগ প্রবাহ হ্রাসের সম্ভাবনা থাকবে না; রাজস্ব ও মুদ্রাখাতে পরিসর সৃষ্টি হবে; ত্বরান্বি^ত হবে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম এবং ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ; সরকারী বিনিয়োগ হবে জিডিপি-র ২৭.৯ শতাংশর সমান (প্রবৃদ্ধি ৮.৬%), কৃষি খাতের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি বজায় থাকবে; রপ্তানি বাণিজ্যে অবস্থান সুদৃঢ় হবে (প্রবৃদ্ধি হবে ১৫%); অভ্যন্তরীণ চাহিদা বজায় রাখার সক্ষমতা থাকবে; ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে প্রক্ষেপিত নামিক জিডিপি হবে ১১ লক্ষ ৮ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা; আগামী অর্থবছরে প্রকৃত জিডিপি-র প্রবৃদ্ধির হার হবে ৭.২ শতাংশ যা ২০১৪-১৫ অর্থবছর নাগাদ ৮ শতাংশে উন্নীত হবে। প্রাক্কলিত রেমিট্যান্স বেড়ে দাড়াবে ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে (প্রবৃদ্ধি ১৫%); বছর শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হবে ১৪.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; চচচ সহ বিভিন্নভাবে বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে এবং সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগ বাড়বে; কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়বে; বিদ্যুৎ-জ্বালানি-যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নতি হবে; মেয়াদি শিল্প ঋণের উচ্চ প্রবৃদ্ধি বজায় থাকবে; রাজস্ব আহরণ জিডিপির ১৪.১ শতাংশে উন্নীত হবে; একইভাবে মোট ব্যয় দাড়াবে জিডিপি-র ১৮.৭ শতাংশ তার মধ্যে এডিপি-র বরাদ্দ হবে জিডিপি-র ৫.৫ শতাংশ; বাজেট ঘাটতি হবে জিডিপি-র ৪.৬ শতাংশের সমপরিমান; মূল্যস্ফীতি আগামী অর্থবছরে হ্রাস পেয়ে ৭.০ শতাংশে উপনিত হবে (এবং ক্রমান্বয়ে মধ্যমেয়াদে তা ৫.৫ শতাংশে নেমে আসবে); প্রক্ষেপিত রপ্তানি হবে ৩০.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (১৫% প্রবৃদ্ধি) এবং আমদানি (এফওবি হবে ৩৭.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (১০% প্রবৃদ্ধি বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষা হবে; অভ্যন্তরীণ ও জাতীয় সঞ্চয় বৃদ্ধি পাবে। বাজেটে জিডিপি-র প্রবৃদ্ধি সংশ্লিষ্ট অনুমান ভিত্তির ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী গুরুত্বপূর্ণ যে বাস্তব সত্যটি উল্লেখ করেছেন তা হলো, “তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ধংসাত্মক রাজনৈতিক কর্মসূচী পরিহার করা গেলে এ প্রবৃদ্ধির হার আরও বৃদ্ধি পাবে”। উক্তিটি দেশের বর্তমান অবস্থায় প্রণিধানযোগ্য।
অর্থনীতি শাস্ত্রে¿র অনেক গুরুর মতে প্রক্ষেপণের অনুমান ভিত্তি অনেক সময় কাজ করে না। যে কারণে বলা হয় “অর্থনীতিবিদদের কাজ হলো গত কাল অনুমানের ভিত্তিতে যে প্রক্ষেপণ করা হয়েছিলো তা কেন আজ কাজ করলো না সে বিষয়ে ভবিষ্যতে বিচার-বিশ্লেষণ করা”-এসব কথা সত্য হতে পারে যখন প্রক্ষেপণের অনুমান ভিত্তি হয় বাস্তবতা বিবর্জিত। বাংলাদেশের অর্থনীতির শক্তিশালী ও দুর্বল দিকসমূহসহ অভ্যন্তরীণ ও বহি:স্থ বিভিন্ন সমীকরণের ভিত্তিতে বলা সম্ভব যে সঞ্চয় হার যখন ক্রমবর্ধ্বমান (এমন কি বিনিয়োগ হারের চেয়ে বেশি), যখন বিনিয়োগ স্থবিরতা দূর হবার লক্ষণসমূহ স্পষ্ট, যখন রপ্তানি ও আমদানি বাণিজ্যের ভারসাম্যপূর্ণ প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যণীয়, যখন রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ার লক্ষণ স্পষ্ট, যখন কৃষির গতি বাড়ছে, যখন মেয়াদি শিল্প ঋণ বাড়ছে, যখন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে গতি সঞ্চারিত হচ্ছে, যখন অবকাঠামো উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট নীতি কৌশল বিনির্মিত হচ্ছে, যখন বহি:স্থ-চাপ এড়ানোর সক্ষমতা বাড়ছে, যখন মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানির প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, যখন বিনিয়োগে সম্ভাব্য “ভীতি ফ্যাক্টর” কমছে এবং সেইসঙ্গে যখন বাড়ছে উন্নয়ন প্রতিশ্রুতি রক্ষা ও সুরক্ষার উপাদানÑএ অবস্থায় বাজেটের অনুমান ভিত্তিসমূহ আমাদের মতে কাক্সিক্ষত মাত্রায় যুক্তিসংগত এবং বাস্তবসম্মত। তবে আমরা মনে করি যে, যেসব ফ্যাক্টরকে অনুমান-ভিত্তি হিসেবে দেখা হয়েছে তার মধ্যে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সার্বিক আইন শৃংখলা পরিস্থিতি, নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি, দুর্নীতি এবং বিদ্যুত-জ্বালানি পরিস্থিতি। এসব ফ্যাক্টরে বড় ধরণের বিপত্তি না হলে প্রতিশ্রুত অর্জন অসম্ভব নয়। (চলবে)
৪৩. পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন, স্বাস্থ্য পরিচর্যা (ধিঃবৎ, ংধহরঃধঃরড়হ, যুমরবহব) খাতে বাজেট বরাদ্দ প্রতিশ্রুত অগ্রাধিকারের তুলনায় স্বল্প। আর এ খাতের বরাদ্দ প্রধানত বড় শহরমুখী। এ খাতে একদিকে বরাদ্দ অনেক বাড়াতে হবে, আর অন্যদিকে গ্রামসহ প্রান্তিক-সুবিধা বঞ্চিত এলাকায় (চর, হাওর, বাওর, উপকূলীয় অঞ্চল, পার্বত্য এলাকা, শহরের বস্তি) বরাদ্দ অনেক বাড়াতে হবে।
৪৪. শিশু স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মায়ের দুধের বিকল্প নেই। অথচ শিশু-খাদ্য উৎপাদন-বিপণনকারী বহুজাতিক কোম্পানিরা এ দেশে শিশু খাদ্য নিয়ে রমরমা ব্যবসা করছেÑযা প্রকৃত অর্থে শিশু স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এসব শিশু খাদ্যের আমদানি নিষিদ্ধ হওয়া উচিত; না পারলে এসবে উচ্চ হারে আমদানি শুল্ক আরোপ জরুরী। এসব শিশু খাদ্যের এ্যাডভারটাইজমেন্ট নিষিদ্ধ করা উচিত।
৪৫. মাতৃস্বাস্থ্য ও শিশু পুষ্টির উন্নয়ন বরাদ্দ বৃদ্ধি প্রয়োজন।
৪৬. পরিবেশবান্ধব বাজেট বাস্তবায়নের জন্য শুধু অর্থমন্ত্রীর সদিচ্ছা ও আর্থিক বরাদ্দই যথেষ্ট নয়। সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রনয়ন ও সঠিক বাস্তবায়নের জন্য দরকার প্রভাবশালী স্বার্থগোষ্ঠীর পরিবেশ বিরোধী অন্যায় কার্যকলাপ প্রতিরোধে রাজনৈতিক অঙ্গীকার।
৪৭. আমরা দেখছি বছরের শুরুতে বাজেটে নারীর জন্য প্রকল্পের একটি বড় অংশ বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু আমাদের জানা হয় না বাস্তবে এর কতখানি কার্যকর হয়েছে। এটি পরিবীক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। এই পরিবীক্ষণের দায়িত্ব দেয়া যায় একটি জাতীয় পর্যায়ের মনিটরিং কোষকে, যেখানে থাকবেন জেন্ডার বাজেট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি, নারী অধিকার আন্দোলনের প্রতিনিধি, সরকারের সংশ্লিষ্ট উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি।
৪৮. নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে। এ বিষয়ে পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগও দেখা গেছে। কিন্তু এর ধীরগতি এই সরকারের মেয়াদে নীতি বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কমিয়ে দিচ্ছে।
৪৯. গ্রামে অথবা শহরে নারীর জীবন যন্ত্রণাময়Ñবাল্যবিয়ে, যৌন হয়রানি, যৌতুক ও পারিবারিক নির্যাতন এসবই নারী এককভাবে সহ্য করে। এসব প্রতিরোধে নির্বাচিত স্থানীয় প্রতিনিধি, সরকারের স্থানীয় কর্মকর্তা এবং নির্বাচিত নারী প্রতিনিধি সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ইতোমধ্যে সিডও সনদের অনুসরণে “পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০” জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। তবে এটি ব্যবহারের জন্য বিধি প্রণয়নের কাজটি আরও দ্রুতগতিতে করা দরকার।
৫০. নারীর সাংসারিক কাজের ফলে যে মূল্য সংযোজন হয়, তার অর্থনৈতিক স্বীকৃতি দানের উদ্যোগটি সরকারকে গ্রহণ করতে হবে। টেকসই অর্থনীতির স্বার্থে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ এ কাজে অগ্রসর হয়েছে। নারীর অস্বীকৃত কাজের অর্থনৈতিক স্বীকৃতি নারীকে সমাজে সম্মানিত করবে এবং ঘরে-বাইরে নারী নির্যাতনের মতো কঠিন সমস্যাসমূহ স্বাভাবিকভাবেই বিস্মৃত হবে।
৫১. বাজেটের ব্যয় খাতসমূহের ব্যয়-অগ্রাধিকার পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে।
৫২. জেলাÑওয়ারি বাজেট প্রণয়ন জরুরী। জেলাÑওয়ারি বাজেটে রাজস্ব ও উন্নয়ন উভয় বাজেটই থাকা দরকার।
৫৩. বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর আওতায় নূতন প্রকল্প যত কম নেয়া যায় ততই মঙ্গল। যে সব প্রকল্প বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে আছে সেগুলোতে জোর দিতে হবে।
৫৪. খাদ্য নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিতে জোর দিতে হবে।
৫৫. আমাদের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাব্যবস্থার কারিকুলাম প্রণেতা ও লেখকদের জেন্ডার সংবেদনশীল প্রশিক্ষণের জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। মাদ্রাসা শিক্ষায় ছাত্রী ভর্তির হার দ্রুত বেড়ে চলেছে। এ শিক্ষার কর্মসংস্থান নেই। মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকীকরণ করার কথা সবসময় বলা হয়েছে। এটি দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন। মূল ধারার শিক্ষায় দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের প্রবেশাধিকার বাড়াতে সুনির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন।
আমাদের প্রস্তাব ও সরকারের বাজেট ঘোষণার মধ্যে দূরত্ব খুব বেশী নয়। অকপটে সরকারী ব্যর্থতা স্বীকার করা, রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধির হার, এডিপির বাস্তবায়ন হার বাড়ানোর পদক্ষেপ, ঘাটতি অর্থায়ন হ্রাস করা তথা ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ গ্রহণ কমিয়ে আনা, সম্প্রসারনশীল বাজেট আকার, দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার কার্যক্রম, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সম্পর্কিত প্রস্তাবনাসমূহ স্পষ্টভাবে মেনে চলতে হবে। তার অর্থ এই নয় যে, বাজেটের কোন দুর্বলতা বা ফড়হিংরফব ঝুঁকি নেই। চূড়ান্ত বাজেট প্রণয়নে সেগুলো অবশ্যই বিবেচনায় এনে কার্যকর আরও কিছু পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত করে বাজেটকে এর স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য অর্জনে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
বাজেটের অনুমান ভিত্তি
২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নে মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামোর অন্ত:স্থ কয়েকটি অনুমানসহ চলমান অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রেক্ষাপটসমূহকে ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়েছে। বাজেটের প্রক্ষেপণ ভিত্তিগুলো নিম্নরূপ: সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকবে; রাজস্ব ও মুদ্রানীতি কৌশলের ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে; মন্দা থেকে ইউরোপসহ বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে এবং বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে; বৃদ্ধি পাবে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের চাহিদা; উন্নয়ন সহযোগীসহ অন্যান্য সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে আস্থা বাড়বে ফলে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (ঋউও) বৃদ্ধি পাবে এবং পাইপ লাইনে থাকা বৈদেশিক সাহায্য অবমুক্তি সহজতর হবেÑযা প্রকল্প সহায়তার ব্যবহার বাড়াবে এবং এডিপি বাস্তবায়ন গতি বাড়াবে; সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বৃদ্ধি এবং ডায়াসপোরা বন্ড ছাড়ার ফলে ব্যক্তিখাতে ঋণ ও বিনিয়োগ প্রবাহ হ্রাসের সম্ভাবনা থাকবে না; রাজস্ব ও মুদ্রাখাতে পরিসর সৃষ্টি হবে; ত্বরান্বি^ত হবে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম এবং ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ; সরকারী বিনিয়োগ হবে জিডিপি-র ২৭.৯ শতাংশর সমান (প্রবৃদ্ধি ৮.৬%), কৃষি খাতের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি বজায় থাকবে; রপ্তানি বাণিজ্যে অবস্থান সুদৃঢ় হবে (প্রবৃদ্ধি হবে ১৫%); অভ্যন্তরীণ চাহিদা বজায় রাখার সক্ষমতা থাকবে; ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে প্রক্ষেপিত নামিক জিডিপি হবে ১১ লক্ষ ৮ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা; আগামী অর্থবছরে প্রকৃত জিডিপি-র প্রবৃদ্ধির হার হবে ৭.২ শতাংশ যা ২০১৪-১৫ অর্থবছর নাগাদ ৮ শতাংশে উন্নীত হবে। প্রাক্কলিত রেমিট্যান্স বেড়ে দাড়াবে ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে (প্রবৃদ্ধি ১৫%); বছর শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হবে ১৪.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; চচচ সহ বিভিন্নভাবে বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে এবং সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগ বাড়বে; কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়বে; বিদ্যুৎ-জ্বালানি-যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নতি হবে; মেয়াদি শিল্প ঋণের উচ্চ প্রবৃদ্ধি বজায় থাকবে; রাজস্ব আহরণ জিডিপির ১৪.১ শতাংশে উন্নীত হবে; একইভাবে মোট ব্যয় দাড়াবে জিডিপি-র ১৮.৭ শতাংশ তার মধ্যে এডিপি-র বরাদ্দ হবে জিডিপি-র ৫.৫ শতাংশ; বাজেট ঘাটতি হবে জিডিপি-র ৪.৬ শতাংশের সমপরিমান; মূল্যস্ফীতি আগামী অর্থবছরে হ্রাস পেয়ে ৭.০ শতাংশে উপনিত হবে (এবং ক্রমান্বয়ে মধ্যমেয়াদে তা ৫.৫ শতাংশে নেমে আসবে); প্রক্ষেপিত রপ্তানি হবে ৩০.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (১৫% প্রবৃদ্ধি) এবং আমদানি (এফওবি হবে ৩৭.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (১০% প্রবৃদ্ধি বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষা হবে; অভ্যন্তরীণ ও জাতীয় সঞ্চয় বৃদ্ধি পাবে। বাজেটে জিডিপি-র প্রবৃদ্ধি সংশ্লিষ্ট অনুমান ভিত্তির ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী গুরুত্বপূর্ণ যে বাস্তব সত্যটি উল্লেখ করেছেন তা হলো, “তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ধংসাত্মক রাজনৈতিক কর্মসূচী পরিহার করা গেলে এ প্রবৃদ্ধির হার আরও বৃদ্ধি পাবে”। উক্তিটি দেশের বর্তমান অবস্থায় প্রণিধানযোগ্য।
অর্থনীতি শাস্ত্রে¿র অনেক গুরুর মতে প্রক্ষেপণের অনুমান ভিত্তি অনেক সময় কাজ করে না। যে কারণে বলা হয় “অর্থনীতিবিদদের কাজ হলো গত কাল অনুমানের ভিত্তিতে যে প্রক্ষেপণ করা হয়েছিলো তা কেন আজ কাজ করলো না সে বিষয়ে ভবিষ্যতে বিচার-বিশ্লেষণ করা”-এসব কথা সত্য হতে পারে যখন প্রক্ষেপণের অনুমান ভিত্তি হয় বাস্তবতা বিবর্জিত। বাংলাদেশের অর্থনীতির শক্তিশালী ও দুর্বল দিকসমূহসহ অভ্যন্তরীণ ও বহি:স্থ বিভিন্ন সমীকরণের ভিত্তিতে বলা সম্ভব যে সঞ্চয় হার যখন ক্রমবর্ধ্বমান (এমন কি বিনিয়োগ হারের চেয়ে বেশি), যখন বিনিয়োগ স্থবিরতা দূর হবার লক্ষণসমূহ স্পষ্ট, যখন রপ্তানি ও আমদানি বাণিজ্যের ভারসাম্যপূর্ণ প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যণীয়, যখন রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ার লক্ষণ স্পষ্ট, যখন কৃষির গতি বাড়ছে, যখন মেয়াদি শিল্প ঋণ বাড়ছে, যখন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে গতি সঞ্চারিত হচ্ছে, যখন অবকাঠামো উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট নীতি কৌশল বিনির্মিত হচ্ছে, যখন বহি:স্থ-চাপ এড়ানোর সক্ষমতা বাড়ছে, যখন মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানির প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, যখন বিনিয়োগে সম্ভাব্য “ভীতি ফ্যাক্টর” কমছে এবং সেইসঙ্গে যখন বাড়ছে উন্নয়ন প্রতিশ্রুতি রক্ষা ও সুরক্ষার উপাদানÑএ অবস্থায় বাজেটের অনুমান ভিত্তিসমূহ আমাদের মতে কাক্সিক্ষত মাত্রায় যুক্তিসংগত এবং বাস্তবসম্মত। তবে আমরা মনে করি যে, যেসব ফ্যাক্টরকে অনুমান-ভিত্তি হিসেবে দেখা হয়েছে তার মধ্যে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সার্বিক আইন শৃংখলা পরিস্থিতি, নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি, দুর্নীতি এবং বিদ্যুত-জ্বালানি পরিস্থিতি। এসব ফ্যাক্টরে বড় ধরণের বিপত্তি না হলে প্রতিশ্রুত অর্জন অসম্ভব নয়। (চলবে)
No comments