৬০ এমপি’র ভাগ্য অনিশ্চিত by আশরাফ খান
প্রচণ্ড টেনশনে সরকারদলীয় এমপিরা। অন্তত
৬০ এমপি’র ভাগ্য ঝুলে আছে। জনবিচ্ছিন্নতা, প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার কারণে
নীতিনির্ধারক পর্যায়ে তাদের স্থলে নতুন মুখ দেয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
এলাকায়
জনপ্রিয়তার দিক থেকে দুর্বল অবস্থানে থাকা এমপিদের মধ্যে আটজন মন্ত্রী ও
প্রভাবশালী দলীয় নেতাও রয়েছেন। চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভরাডুবি ছিল
সরকারি দলের কাছে অভাবিত। এ ফলাফল এমপিদের অনেকের জন্যই দুর্ভাবনা হয়ে
দাঁড়িয়েছে। জাতীয় রাজনীতি, সামগ্রিক পরিস্থিতির প্রভাব প্রতিক্রিয়া ছাড়াও
স্থানীয়ভাবে বিদ্যমান পরিস্থিতির ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়েছে।
সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে প্রত্যেক নির্বাচনী এলাকার পরিস্থিতি, বর্তমান এমপিদের জনপ্রিয়তা, কর্মী, জনসাধারণের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ, এলাকার উন্নয়নকাজ সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর সংগ্রহ করা হচ্ছে। কোন কোন এমপি এলাকার উন্নয়ন, কর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখছেন এবং তাদের স্বার্থে নিবেদিত থাকার চেয়ে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ প্রাধান্য দিয়ে আসছেন, এলাকায় তেমন কোন ভাবমূর্তিও গড়ে তুলতে পারেননি- তাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। দলের সাধারণ সম্পাদককে নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। দু’জন কেন্দ্রীয় নেতাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে দুর্বল এলাকাগুলো সম্পর্কে ভাবাবেগ বর্জিত পক্ষপাতমুক্ত থেকে প্রকৃত পরিস্থিতির ওপর বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের। এসব এলাকায় কর্মী ও সাধারণের মধ্যে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা এবং উন্নত ভাবমূর্তি রয়েছে- এমন সম্ভাব্য প্রার্থীদের সম্পর্কেও বাস্তব অবস্থাভিত্তিক প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
সরকারের একাধিক নেতৃস্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এ পর্যন্ত ৬০ জন এমপি সম্পর্কে হতাশাব্যঞ্জক তথ্য সরকারের শীর্ষপর্যায়ের হাতে এসেছে। দলীয় মাধ্যম ছাড়াও নিজস্ব মাধ্যম ও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এতে ঢাকা শহরসহ ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে হতাশাজনক চিত্র উঠে এসেছে। এ বিভাগে প্রায় বিশজন এমপির ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। দলের শীর্ষপর্যায়ের কয়েক নেতা ও মন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকার হতাশাজনক ভাবমূর্তির উল্লেখ করে নির্বাচনে তাদের সম্ভাব্য বিপর্যয়ের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। এরা ফরিদপুর, ঝালকাঠি, নরসিংদী, শেরপুর, সিরাজগঞ্জ, সাতক্ষীরা, চাঁদপুর, পটুয়াখালী, সিলেট ও ঢাকা শহর থেকে নির্বাচিত। স্থানীয় নেতাকর্মী ও ভোটারদের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, জমিজমা দখলবাজদের লালন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়া, ক্ষমতার অপব্যবহার, ব্যক্তিগতভাবে শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনকে ব্যক্তি, গোষ্ঠী-স্বার্থে ব্যবহার, পরিবারের সদস্য ও দলের চিহ্নিত কিছু নিজস্ব লোকের দুর্ব্যবহার, প্রশাসনকে অবৈধ ব্যবহার, বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হওয়া, প্রত্যাশিত উন্নয়ন করতে না পারাসহ আরও কিছু ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক কারণে মন্ত্রী, শীর্ষস্থানীয়রাসহ ষাটজন এমপিকে নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। ঢাকার মিরপুর এলাকার একজন, একই এলাকার একজন সাবেক ছাত্রনেতা, গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি ও মিডিয়ার মালিক, পুরান ঢাকার একজন সাবেক ছাত্রনেতা, রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র থেকে নির্বাচিত মহাজোটের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা, রাজধানীর উত্তর এলাকা থেকে নির্বাচিত এক প্রভাবশালী নেত্রীর নাম রয়েছে। সাভারে রানা প্লাজাধস ও সহস্রাধিক শ্রমিকের প্রাণহানির ঘটনার পর স্থানীয় এমপির ঘনিষ্ঠজনরাই বুঝতে পারছেন তার রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশ মেঘে ঢেকে গেছে। ঢাকার এক এডভোকেট মহিলা এমপি, ব্যক্তিগত কারণে ব্যাপকভাবে পরিচিত নারায়ণগঞ্জের এক মহিলা এমপি, পাশের নির্বাচনী এলাকার একজন ছাড়াও একজন শিল্পপতি এমপি, মানিকগঞ্জের এক তরুণ বিতর্কিত এমপিসহ দু’জন সম্পর্কে নেতিবাচক রিপোর্ট এসেছে। জাতীয় পর্যায়ে থাকা নরসিংদীর প্রভাবশালী ব্যক্তির কোন প্রভাব এখন আর স্থানীয় পর্যায়ে নেই। ব্যাপকভাবে বিতর্কিত এই নেতা ছাড়াও নরসিংদীর আরও একজনের অবস্থা অত্যন্ত নেতিবাচক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
রাজধানীর পাশের জেলা গাজীপুর। এখনকার সব আসন আওয়ামী লীগের দখলে থাকলেও ঢাকা শহরের সবচেয়ে কাছের দু’টি আসনই হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। ময়মনসিংহে ব্যক্তিগত আচরণ, কর্মী ও মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, কর্মীদের অবৈধ কার্যক্রমে উৎসাহিত করছেন বলে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে এমন একজন সাবেক কর্মকর্তা ও বর্তমান এমপির বিরুদ্ধে। ময়মনসিংহের এক সাবেক অধ্যক্ষ, গাইবান্ধার এক সাবেক চিফ ইঞ্জিনিয়ার, নড়াইলে এক সাবেক উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা, একটি সংসদীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা সাতক্ষীরার এক ইঞ্জিনিয়ারের অবস্থান খুবই দুর্বল। সিলেটে খোদ অর্থমন্ত্রী সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। সিলেটের অপর একটি আসনে, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের দু’টি করে আসনের অবস্থা দোদুল্যমান ও হতাশাজনক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
চট্টগ্রামে বদরাগি হিসেবে পরিচিত ও বহু ঘটন-অঘটনের নায়ক একজন ইঞ্জিনিয়ার, একজন বিএসসি পদবিধারীসহ পাঁচটি আসনে, কুড়িগ্রামে বহুবার দলবদলকারী এক শিল্পপতি, বরিশালে বিতর্কিত ও অন্য দল থেকে আসা একজনসহ দু’জন যশোরে তিনজন, ব্যাপক পারিবারিক পরিচিতি সম্পন্ন বাগেরহাট থেকে নির্বাচিত অস্থানীয় একজন, রাজশাহীতে এক সাবেক ছাত্রনেতাসহ তিনজন, সরকারি দায়িত্বে থাকা পটুয়াখালীর এক প্রভাবশালী ব্যক্তি, মেহেরপুর, চুয়াঙ্গার একজন করে এমপির নাম রয়েছে দুর্বল অবস্থানে থাকাদের মধ্যে।
এসব এলাকায় বিশেষ বরাদ্দ দেয়া ছাড়াও প্রত্যেক নির্বাচনী এলাকায় দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নেয়া হবে। নির্বাচনী এলাকার উন্নয়নের জন্য প্রত্যেক এমপিকে দুই কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হবে। এ অর্থ হবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধীনে বাস্তবায়নাধীন ৪ হাজার ৫শ’ কোটি টাকার অতিরিক্ত। এ সরকারের সময়েই প্রথম ২০০৯-১০ অর্থবছরে এমপিদের নির্বাচনী এলাকার উন্নয়নের জন্য ৩৩৪ কোটি টাকা দেয়া হয়। পরের বছর বরাদ্দ করা হয় ৫শ’ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ করা হয় ১ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপিতে আরও ৭শ’ কোটি টাকা দেয়া হয়। এলজিইডির চিফ ইঞ্জিনিয়ারের দাবি অনুযায়ী প্রত্যেক নির্বাচনী এলাকায় মানসম্পন্ন কাজ হয়েছে। ব্রিজ, কালভার্ট, সড়ক নির্মাণ, হাট-বাজারসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নেই এ অর্থ ব্যয় হয়েছে। এলজিইডি দাবি করলেও দলীয় ঠিকাদার নিজেদের কর্মীদের দিয়ে কাজ করানোর ফলে মানসম্পন্ন কাজ হয়নি অধিকাংশ স্থানে। এ নিয়ে মানুষের মধ্যে অসন্তোষও রয়েছে। তবে সামপ্রতিককালে মানসম্পন্ন কাজ নিশ্চিত করতে এমপিরা সরাসরি তদারকি করছেন। সরকারদলীয় প্রত্যেক এমপি গত বছর চলমান প্রকল্পের বাইরে নতুন গড়ে ৫০টি প্রকল্প দিয়েছেন। আসন্ন অর্থবছরেও তারা নতুন নতুন প্রকল্প দিচ্ছেন। জনস্বার্থে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জোর তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন। এ জন্য অতিরিক্ত চার হাজার কোটি টাকা চাইবে এলজিআরডি। স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলমান প্রকল্পের বাইরে আড়াই হাজার কোটি টাকা দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ অর্থের পুরোটাই ব্যয় হবে নির্বাচনী কাজে। বিরোধীদলীয় এমপিরাও নতুন নতুন প্রকল্প দেয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। গত অর্থবছর পর্যন্ত অর্থ বরাদ্দে সমতা থাকলেও শেষ বছরে তা নাও থাকতে পারে। প্রত্যেক নির্বাচনী এলাকার উন্নয়নে ১৫ কোটি টাকার প্রকল্প রয়েছে। পর্যাপ্ত বরাদ্দ না পাওয়ায় তার সবগুলো বাস্তবায়নের জন্য গ্রহণ করা হয়নি। নির্বাচনকে সামনে রেখে অধিক জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নে হাত দিতে যাচ্ছে এলজিইডি।
সরকারদলীয় এমপিদের জন্য এলাকার উন্নয়নে জেলা পরিষদ থেকে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। জেলা পরিষদের জন্য মোট বরাদ্দই ছিল ৩৫০ কোটি টাকা। মসজিদ, মন্দির, ঈদগাঁ নির্মাণ, উন্নয়নেই প্রধানত এ অর্থ ব্যয় করা হয়। নির্বাচন সামনে রেখে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ছোট ছোট প্রকল্পের মাধ্যমে জনমত প্রভাবিত করার জন্য আগামী অর্থবছরে জেলা পরিষদকে ৪শ’ কোটি টাকা দেয়া হবে। এ অর্থের পুরোটাই নির্বাচনী কাজে ব্যবহৃত হবে। সরকারদলীয় প্রায় ১শ’ এমপির এলাকাকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেয়া হবে। উন্নয়ন প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের পাশাপাশি এমপিদের তদারকি, স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর মাধ্যমে ম্রিয়মাণ ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার উদ্দেশ্যেই নীতিমালাবহির্ভূত প্রকল্প জেলা পরিষদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
No comments