দারিদ্র্য বিমোচন- অগ্রযাত্রায় নতুন চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের সরকারি অবকাঠামো কিংবা
আর্থ-সামজিক অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজই সময়মতো শেষ হয় না। '১৮ মাসে বছর'
প্রবাদটির প্রয়োগ এ ক্ষেত্রে যথার্থ। কিন্তু দারিদ্র্য হ্রাসে জাতিসংঘ
ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) হার নির্ধারিত
সময়ের
দুই বছর আগেই অর্জন করতে পারা_ এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের ইতিবাচক ব্যতিক্রম।
আমরা যে পারি_ এরই স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্বব্যাংকের 'দারিদ্র্য মূল্যায়ন
প্রতিবেদন'। বৃহস্পতিবার ঢাকায় সরেজমিন অনুসন্ধান ও গবেষণালব্ধ ফলের
ভিত্তিতে প্রণীত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক দশকে এক কোটি ৬০ লাখ মানুষকে
দারিদ্র্যপীড়িত জীবনবৃত্ত থেকে বের করে আনতে পারা বাংলাদেশের জন্য 'বিরল ও
উল্লেখযোগ্য' অর্জন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থাকা
জনবহুল বাংলাদেশে ২০১৫ সালে দারিদ্র্যের হার নেমে আসার কথা ২৬ দশমিক ৫১
শতাংশে। প্রতি বছর যে হারে দারিদ্র্য কমছে, তাতে অত্যন্ত রক্ষণশীলভাবে
হিসাব করলেও চলতি ২০১৩ সালেই অর্জিত হয়ে যাবে ২০১৫ সালের লক্ষ্যমাত্রা।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি সত্ত্বেও ১০ বছরে ২৬ শতাংশ
দারিদ্র্য কমাতে পারা। ২০০০ সালে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা যেখানে ছিল ছয় কোটি
৭০ লাখ, ২০১০ সালে তা কমে আসে চার কোটি ৭০ লাখে। সাম্প্রতিক বৈশ্বিক
মন্দাও বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়নের ধারায় তেমন বিরূপ
প্রভাব ফেলতে পারেনি। দারিদ্র্য হ্রাসের পদক্ষেপে কাঠামোগত পরিবর্তনও
গবেষণার ফলাফলে স্বীকৃত। এক সময়ে পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে অপেক্ষাকৃত দ্রুত
হারে উন্নতি হয়েছে। সম্প্রতি পশ্চিমাঞ্চলে দারিদ্র্যের হার বেশি কমেছে।
সত্তরের দশকে বাংলাদেশকে বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ
'সম্ভাবনাহীন' ও 'তলাবিহীন ঝুড়ি' আখ্যায়িত করেছিলেন। পরবর্তী চার দশকেরও কম
সময়ে দেশটি যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে_ তা আজ স্বীকৃত। এ অর্জনের কৃতিত্ব নিয়ে
রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক হতে পারে। একবিংশ শতাব্দীতে কেবল ভাত-কাপড় আর
সামান্য কিছু শিক্ষার ছোঁয়া পাওয়াই তিন-চার কোটি মানুষের জন্য যথেষ্ট
কি-না, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতপার্থক্য থাকাও স্বাভাবিক। তবে সিঁড়ির একটি
ধাপ অতিক্রম করতে পারাই পরের ধাপে ওঠার ভিত রচনা করে দেয়। সহস্রাব্দ
উন্নয়নের আরও কিছু লক্ষ্য অর্জনেও বাংলাদেশের সাফল্য স্বীকৃত। বিশেষ করে
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সৃষ্ট সুবিধাদি অতিদরিদ্র বিপুলসংখ্যক পরিবারও ভোগ
করছে। প্রসূতি ও সদ্যোজাত শিশুদের মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্য হারে কমানো সম্ভব
হয়েছে। শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বেড়ে চলেছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এখন
বাংলাদেশের সামনে দুটি চ্যালেঞ্জ। এক. এখনও বাংলাদেশের চার কোটি ৭০ লাখ
মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে এবং এদের মধ্যে দুই কোটি ৬০ লাখ লোক
চরম দরিদ্র। অর্থাৎ তাদের প্রতিদিন দুই বেলা খাবার জোটে না। এদের জীবনমানে
পরিবর্তন আনার কাজটি আগের তুলনায় দ্রুত করা সম্ভব। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি
পর্যায়ে যে পরিকল্পনা রয়েছে, তার দ্রুত বাস্তবায়ন চাই। দুই. দারিদ্র্য
হ্রাসে সাফল্যের ধারাবাহিকতায় কার্যকর দারিদ্র্য হ্রাসের পথে এগিয়ে যাওয়া।
অর্থাৎ দারিদ্র্যের অভিশাপমুক্ত জনগোষ্ঠীর জন্য আধুনিক ও উন্নত জীবন
নিশ্চিত করা। এ জন্য চাই আর্থ-সামাজিক খাতে আরও বেশি বিনিয়োগ। একই সঙ্গে
চাই ধনী ও দরিদ্রের বৈষম্য কমিয়ে আনার প্রতিও অধিকতর মনোযোগ প্রদান। এ
লক্ষ্য অর্জনে বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের পাশে থাকবে,
এটাই প্রত্যাশিত।
No comments