অভিমত ॥ নারীর সেকাল একাল... by শামশাদ আহম্মেদ
আমার জন্ম জেলা শহর কুমিল্লায় ১৯৩৪ সালে।
এদেশের অনেক উথাল-পাতাল, ধ্বংস ও প্রতিষ্ঠা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ আমি
পেয়েছি। ব্রিটিশ রাজত্ব এবং পাকিস্তানের কুশাসন থেকে মুক্তি পেয়ে বর্তমান
বাংলাদেশের সৃষ্টি।
বাংলাদেশ বর্তমানে যে উন্নতির শিখরে
উঠেছে তা এমনিতেই হয়নি। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত ও সংগ্রাম পেরিয়ে অর্থনৈতিক
সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এতটুকু উপার্জন সম্ভব হয়েছে। এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে
পুরুষ ও নারীর সম্মিলিত উদ্যোগ ও অঢেল পরিশ্রমের ফলশ্রুতি বিশেষ করে
নারীদের সর্বস্তরে অমূল্য সম্পৃক্ততা ও অবদান।
১৯৪৪/৪৫ সালে (দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অন্তিমকালে) যানবাহনের মধ্যে দেখেছি শুধু বাস ও রিকশা। প্রাইভেটকার কদাচিৎ ৮/১০টা। মহিলারা এবাড়ি ওবাড়ি আত্মীয় পরিজনের বাড়িতের বেড়াতে যেতেন রিকশা করে তাও আবার রিকশার হুড শাড়ি দিয়ে ঢেকে। ৫১/৫২ সালে যখন ঢাকায় পড়াশোনা করি তখন দেখলাম খোলা রিকশায় বোরখা পরে মা ওপাশে বসা আর খোলা চেহারায় মেয়ে কিংবা ছোটবোন। ’৭১এর স্বাধীনতার পর নারীদের জগৎ গেল পাল্টে। আমাদের সমাজ তখন বুঝল নারী ও পুরুষের সম্মিলিত প্রয়াস ছাড়া দেশের দারিদ্র্য দূর করা এবং পরিবারে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আনায়ন সম্ভবপর নয়। আঁচ করতে পারলাম ঘুণে ধরা এই সমাজে ঘূর্ণন ও বিবর্তন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তখন দেশের আপামর জনসাধারণ বিশেষ করে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন অভিভাবকরা মেয়েদের কিংবা তাদের স্ত্রীদের ছাড় দিতে শুরু করলেন। যার ফলশ্রুতিতে দেশ বিশেষ করে নারী সমাজ এখন কত উচ্চ শিখড়ে উঠে এসেছে। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা কৃতজ্ঞতার সাথে প্রশংসার দাবিদার। নারীরা এখন প্রাইমারি পর্যায় থেকে ইউনিভার্সিটি স্তর পর্যন্ত শিক্ষকতা ও শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করছেন। অফিস-আদালতে ব্যাংক-বীমা ও বেসরকারী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে নারীদের সম্পৃক্ততা আশাতীত উন্নিত হয়েছে। এসএসসি ও এইচএসসির ফল দেখলে দেখা যায় মেয়েদের সাফল্য ছেলেদের তুলনায় কোন অংশে কম নয়। মেয়ে পরীক্ষার্থীদের সংখ্যাও আশাতীতভাবে বেড়ে গেছে যা আমাদের যুগে কল্পনাও করতে পারতাম না। দেশে ও আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনেও মেয়েরা অংশ নিচ্ছে, এমন কি পুরস্কারও অর্জন করেছে। আজ তারা শুধু ক্রিকেট ও ফুটবল নিয়ে নয়, অন্যান্য খেলায় এমনকি কুস্তিতেও অংশগ্রহণ করছে। সামরিক ও বেসামরিক আইনশৃঙ্খলা অঙ্গনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। সামরিক বাহিনীর প্যারাট্রুপার ব্যাটালিয়নে সাফল্যের সাথে অনেক উর্ধের প্লেন থেকে প্যারাসুটযোগে মাটিতে অবতরণ করতে সক্ষম হচ্ছে। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু দুটি পর্বতশৃঙ্গ আমাদের দেশের মেয়েরা জয় করে সারা বিশ্বকে বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বকে (যাদের অভিভাবক একমাত্র পাকিস্তান) তাক লাগিয়ে দিয়েছে।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো পোশাক শিল্প। এ দেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে পোশাক শিল্প ও তার আনুষঙ্গিক শিল্পগুলোর ওপর। পোশাক শিল্পের সাথে জড়িত ৪০ লাখ কর্মীর ৮০ ভাগই নারী। এদের কর্মপরায়ণতা ও অংশীদারিত্বের ফলশ্রুতিতে পোশাক শিল্পে দেশের জন্য সর্ববৃহৎ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভবপর হয়েছে। বর্তমানে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৪ বিলিয়ন ডলারের ওপর। পুরুষ প্রবাসীদের মতো নারীরাও চাকরি নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। শহর-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে ক্ষেত-খামারে ইটভাঙ্গা থেকে সড়ক-মহাসড়ক ও ইমারত নির্মাণ কাজে নারীদের কর্মকা- পরিলক্ষিত হয়। তাদের এ ধরনের কার্যকলাপে তাদের নিজ নিজ সংসারে অভাব দূরীভূত করার প্রয়াসে আর্থিক স্বচ্ছলতার অবদান রাখছে।
এছাড়া অনেক দেশের রাষ্ট্র প্রধান ও সরকারপ্রধান পদ নারীরা অলঙ্কৃত করেছেন ও করছেন। এক কথায় দৈনন্দিন জীবনে এবং সর্বস্তরে নারীরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে পড়েছে। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয় নারীদের এই উজ্জ্বল অগ্রযাত্রাকে রোধ করার জন্য কিছু সংখ্যক জীবন যুদ্ধে পরাজিত ও হতাশ এক শ্রেণী এবং বিভিন্ন অপশক্তি নারীদের এ সাফল্য দেখে হিংসুক হয়ে নানাভাবে ষড়যন্ত্র করে আসছে এখনও করছে এবং তাদের ঈর্ষাকাতরতা চরিতার্থ করার নিমিত্তে আত্মঘাতী প্রচেষ্টায় উদ্যোগী হয়েছে। এটা মোটেই কাম্য নয়। বরঞ্চ তাদের এই মহতী অগ্রযাত্রাকে মসৃণ করার নিমিত্তে জাতি বর্ণ ও যুবক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সবাইকে সর্বপ্রকার সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া দেশ ও দশের স্বার্থে একান্ত প্রয়োজন। দেশের অর্ধেক জনসমষ্টিকে নিষ্ক্রিয় করা হলে দেশ মধ্যযুগীয় অন্ধকারাচ্ছন্নতায় নিমজ্জিত হবে। যখন সৌদি আরবের মতো রক্ষণশীল দেশ নারীদের দেশের শাসন ইত্যাদিতে ভূমিকা রাখার জন্য হালে সেদেশের নারীদের অধিকার প্রদানে সম্মত হয়ে বর্তমান বাদশা অনুমতি দিয়েছেন। সেই অবস্থার প্রেক্ষিতে আমাদের নারীরা এতটা সফলতা লাভ করে পিছিয়ে যেতে দেশপ্রেমী জনতা কিছুতেই হতে দিবে না।
আমাদের স্মরণ রাখতে হবে জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম অনেক পূর্বে যথাযথই বলে গেছেন, “বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর”। এই মূল মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে আমাদের অর্থাৎ পুরুষদের এমন কিছু করা ন্যায়ানুগ হবে না যাতে নারীদের মসৃণ অগ্রযাত্রা বিঘ্নিত বা বাধাপ্রাপ্ত হয়।
আমার এই ক্ষুদ্র মতামত ও পর্যবেক্ষণ দেশপ্রেমিক পাঠকরা গুরুত্বসহকারে ভেবে দেখবেন এবং অন্যদেরকেও ভাবতে অনুরোধ করবেন।
উত্তরা, ঢাকা।
১৯৪৪/৪৫ সালে (দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অন্তিমকালে) যানবাহনের মধ্যে দেখেছি শুধু বাস ও রিকশা। প্রাইভেটকার কদাচিৎ ৮/১০টা। মহিলারা এবাড়ি ওবাড়ি আত্মীয় পরিজনের বাড়িতের বেড়াতে যেতেন রিকশা করে তাও আবার রিকশার হুড শাড়ি দিয়ে ঢেকে। ৫১/৫২ সালে যখন ঢাকায় পড়াশোনা করি তখন দেখলাম খোলা রিকশায় বোরখা পরে মা ওপাশে বসা আর খোলা চেহারায় মেয়ে কিংবা ছোটবোন। ’৭১এর স্বাধীনতার পর নারীদের জগৎ গেল পাল্টে। আমাদের সমাজ তখন বুঝল নারী ও পুরুষের সম্মিলিত প্রয়াস ছাড়া দেশের দারিদ্র্য দূর করা এবং পরিবারে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আনায়ন সম্ভবপর নয়। আঁচ করতে পারলাম ঘুণে ধরা এই সমাজে ঘূর্ণন ও বিবর্তন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তখন দেশের আপামর জনসাধারণ বিশেষ করে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন অভিভাবকরা মেয়েদের কিংবা তাদের স্ত্রীদের ছাড় দিতে শুরু করলেন। যার ফলশ্রুতিতে দেশ বিশেষ করে নারী সমাজ এখন কত উচ্চ শিখড়ে উঠে এসেছে। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা কৃতজ্ঞতার সাথে প্রশংসার দাবিদার। নারীরা এখন প্রাইমারি পর্যায় থেকে ইউনিভার্সিটি স্তর পর্যন্ত শিক্ষকতা ও শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করছেন। অফিস-আদালতে ব্যাংক-বীমা ও বেসরকারী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে নারীদের সম্পৃক্ততা আশাতীত উন্নিত হয়েছে। এসএসসি ও এইচএসসির ফল দেখলে দেখা যায় মেয়েদের সাফল্য ছেলেদের তুলনায় কোন অংশে কম নয়। মেয়ে পরীক্ষার্থীদের সংখ্যাও আশাতীতভাবে বেড়ে গেছে যা আমাদের যুগে কল্পনাও করতে পারতাম না। দেশে ও আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনেও মেয়েরা অংশ নিচ্ছে, এমন কি পুরস্কারও অর্জন করেছে। আজ তারা শুধু ক্রিকেট ও ফুটবল নিয়ে নয়, অন্যান্য খেলায় এমনকি কুস্তিতেও অংশগ্রহণ করছে। সামরিক ও বেসামরিক আইনশৃঙ্খলা অঙ্গনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। সামরিক বাহিনীর প্যারাট্রুপার ব্যাটালিয়নে সাফল্যের সাথে অনেক উর্ধের প্লেন থেকে প্যারাসুটযোগে মাটিতে অবতরণ করতে সক্ষম হচ্ছে। পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু দুটি পর্বতশৃঙ্গ আমাদের দেশের মেয়েরা জয় করে সারা বিশ্বকে বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বকে (যাদের অভিভাবক একমাত্র পাকিস্তান) তাক লাগিয়ে দিয়েছে।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো পোশাক শিল্প। এ দেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে পোশাক শিল্প ও তার আনুষঙ্গিক শিল্পগুলোর ওপর। পোশাক শিল্পের সাথে জড়িত ৪০ লাখ কর্মীর ৮০ ভাগই নারী। এদের কর্মপরায়ণতা ও অংশীদারিত্বের ফলশ্রুতিতে পোশাক শিল্পে দেশের জন্য সর্ববৃহৎ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভবপর হয়েছে। বর্তমানে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৪ বিলিয়ন ডলারের ওপর। পুরুষ প্রবাসীদের মতো নারীরাও চাকরি নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। শহর-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে ক্ষেত-খামারে ইটভাঙ্গা থেকে সড়ক-মহাসড়ক ও ইমারত নির্মাণ কাজে নারীদের কর্মকা- পরিলক্ষিত হয়। তাদের এ ধরনের কার্যকলাপে তাদের নিজ নিজ সংসারে অভাব দূরীভূত করার প্রয়াসে আর্থিক স্বচ্ছলতার অবদান রাখছে।
এছাড়া অনেক দেশের রাষ্ট্র প্রধান ও সরকারপ্রধান পদ নারীরা অলঙ্কৃত করেছেন ও করছেন। এক কথায় দৈনন্দিন জীবনে এবং সর্বস্তরে নারীরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে পড়েছে। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয় নারীদের এই উজ্জ্বল অগ্রযাত্রাকে রোধ করার জন্য কিছু সংখ্যক জীবন যুদ্ধে পরাজিত ও হতাশ এক শ্রেণী এবং বিভিন্ন অপশক্তি নারীদের এ সাফল্য দেখে হিংসুক হয়ে নানাভাবে ষড়যন্ত্র করে আসছে এখনও করছে এবং তাদের ঈর্ষাকাতরতা চরিতার্থ করার নিমিত্তে আত্মঘাতী প্রচেষ্টায় উদ্যোগী হয়েছে। এটা মোটেই কাম্য নয়। বরঞ্চ তাদের এই মহতী অগ্রযাত্রাকে মসৃণ করার নিমিত্তে জাতি বর্ণ ও যুবক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সবাইকে সর্বপ্রকার সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া দেশ ও দশের স্বার্থে একান্ত প্রয়োজন। দেশের অর্ধেক জনসমষ্টিকে নিষ্ক্রিয় করা হলে দেশ মধ্যযুগীয় অন্ধকারাচ্ছন্নতায় নিমজ্জিত হবে। যখন সৌদি আরবের মতো রক্ষণশীল দেশ নারীদের দেশের শাসন ইত্যাদিতে ভূমিকা রাখার জন্য হালে সেদেশের নারীদের অধিকার প্রদানে সম্মত হয়ে বর্তমান বাদশা অনুমতি দিয়েছেন। সেই অবস্থার প্রেক্ষিতে আমাদের নারীরা এতটা সফলতা লাভ করে পিছিয়ে যেতে দেশপ্রেমী জনতা কিছুতেই হতে দিবে না।
আমাদের স্মরণ রাখতে হবে জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম অনেক পূর্বে যথাযথই বলে গেছেন, “বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর”। এই মূল মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে আমাদের অর্থাৎ পুরুষদের এমন কিছু করা ন্যায়ানুগ হবে না যাতে নারীদের মসৃণ অগ্রযাত্রা বিঘ্নিত বা বাধাপ্রাপ্ত হয়।
আমার এই ক্ষুদ্র মতামত ও পর্যবেক্ষণ দেশপ্রেমিক পাঠকরা গুরুত্বসহকারে ভেবে দেখবেন এবং অন্যদেরকেও ভাবতে অনুরোধ করবেন।
উত্তরা, ঢাকা।
No comments