প্রকৃতির প্রতিশোধ-হিমালয় অঞ্চলে মানবসৃষ্ট বিপর্যয় by মহারাজ কে পণ্ডিত
হিমালয় অঞ্চলে এক সপ্তাহ লম্বা সময়। ১৯৮০র
দশকের শেষ দিকে আমি একজন তরুণ গবেষক হিসেবে অরুণাচল প্রদেশ ভ্রমণে
গিয়েছিলাম। সে সময় আমার ফটোগ্রাফির প্রতি খুব উৎসাহ ছিল। আমি তখন দিবাং
নদীতে হেঁটেছিলাম, পাথর টপকে পার হয়েছিলাম।
ততক্ষণ ছিলাম
যতক্ষণ না স্থানীয় উপজাতীয় গাইড আমাকে অবিলম্বে ফিরতে বললেন। তিনি হাসলেন
এবং বললেন, স্যার, এই পর্বতজাত নদী কন্যার মতো। আপনি বুঝতেও পারবেন না কত
তাড়াতাড়ি তারা বেড়ে উঠবে। আমি তার জ্ঞানে মুগ্ধ হয়েছিলাম এবং পরে কখনও সেই
জ্ঞান ভুলে যাইনি।
বর্তমানে ফিরে আসি। আমাদের গবেষক দল সম্প্রতি নদীবিধৌত ভূমিখণ্ড ভাগীরথীতে ১০ দিনের ভ্রমণ সম্পন্ন করেছে। সেখানে আশু বিপর্যয়ের স্পষ্ট লক্ষণ দেখতে পেয়েছি। উত্তর কাশীতে আমরা বছর কয়েক আগেও অসি নদীর (ভাগীরথীর উপনদী) বিপর্যয় দেখেছিলাম। এবার আমরা দেখেছি, নদীর পানিপ্রবাহ শক্তিশালীভাবে বাড়িঘর ও সস্তা হোটেল ভবনগুলোর দিকে ছিল। তা বিপজ্জনকভাবে দুর্বল বাঁধে আঘাত করেছিল।
পরবর্তী দিনটিতে আমরা গঙ্গোত্রী ছেড়ে এসেছিলাম। কিন্তু বিশাল ভূমিধসের কারণে মানেরি গ্রাম অতিক্রম করতে পারিনি। এই ভূমিধসের ফলে রাস্তা ছয় থেকে আট কিলোমিটার উজানের দিক পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে বাস, গাড়ি ও ট্রাকের লম্বা লাইন লেগে গিয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে গ্যারিসন রিজার্ভ ইঞ্জিনিয়ার ফোর্স, বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন ও পুলিশ দীর্ঘক্ষণ কাজ করে বিকল্প রাস্তা তৈরি করতে পেরেছিলেন। আমরা সেই সন্ধ্যাতেই উত্তর কাশীতে ফিরে আসতে পারি।
পরে আমি টেলিভিশনে উত্তর কাশীর বিধ্বস্ততার সংবাদ দেখতে পাই। কেবল আগের দিনেই যেসব ভবনের ছবি তুলেছিলাম সেগুলো ভাগীরথীর নদীর স্রোতে খেলনার মতো ভেসে যাচ্ছিল। এটি দেখে খুবই বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা হয়েছে। হিমালয় অঞ্চলের সাম্প্রতিক দুর্যোগকে কেবল প্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবে উপস্থাপন করলে হয়তো কিছুটা ভুল থেকে যাবে। বরঞ্চ এটি মানবসৃষ্ট বিপর্যয়। মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যাক।
প্রথমত, যথেষ্ট পরিমাণ বৈজ্ঞানিক প্রমাণাদি রয়েছে যে, হিমালয়ের জলধারাগুলো দীর্ঘ সময় ধরে বন উজাড়ীকরণের শিকার হয়েছে। বাণিজ্যিক কার্যকলাপ হিসেবে বন উজাড়ীকরণ সেই ব্রিটিশ আমলে শুরু হয়েছে এবং স্বাধীনতার পরও অখণ্ডভাবে অব্যাহত রয়েছে। সরকারি হিসাবে দাবি করা হয়, হিমালয় অঞ্চলে বনভূমির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বেশ কয়েকটি বিশ্বাসযোগ্য স্বাধীন গবেষণার ফল সরকারের এই দাবির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আসলে কৃষি, জনবসতি ও নগরায়নের জন্য বনের জমি ব্যবহার করা হয়েছে। জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ও সড়ক তৈরির মতো বৃহৎ অবকাঠামোগত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হয়েছে বনের জমি দখলে নিয়ে। বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা অনুযায়ী, বন উজাড়ীকরণ বর্তমান হারে চলতে থাকলে ভারতের হিমালয় অঞ্চলের মোট বনাঞ্চল ২০০০ সালে ৮৪.৯ শতাংশ (১৯৭০ সালের মান অনুযায়ী) কমে যাবে এবং ২১০০ সালে এটি কোনোক্রমেই ৫২.৮ শতাংশের বেশি হবে না। ঘন বনাঞ্চল যার ওপর বনের অনেক প্রজাতি গুরুত্বপূর্ণভাবে নির্ভর করে তা মোট বনাঞ্চলের তুলনায় ২০০০ সালে ৭৫.৪ শতাংশ কমে গেছে এবং ২১০০ সালে তা কেবল ৩৪ শতাংশ হবে। এর মাধ্যমে হিমালয় অঞ্চলের ঘন বনাঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল ২৩.৪ শতাংশ প্রজাতি বিলুপ্ত হতে পারে।
বর্ধনশীল বৃক্ষ পতনশীল বৃষ্টির গতি কমিয়ে দেয় এবং এটি মাটির ক্ষয় ও নালা তৈরি রোধ করে। ভূমিক্ষয় ও নালা তৈরির মতো বিষয়গুলোকে ধস ও বন্যার অগ্রদূত হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ঘন গাছপালা পরিস্বেদনের মাধ্যমে বৃষ্টি পানির প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ভূমিতে পড়তে বাধা দেয়। মাটি পাশাপাশি ধরে রেখে ঘন বনাঞ্চল বৃষ্টির পানি ধীরে শোষণ করে নেয়। যার ফলে বৃষ্টির পানির অতিরিক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। সুতরাং বন উজাড়ীকরণ হলে উঁচু অঞ্চলের ঢালের অস্থিতিশীলতা বাড়ায়, যা ভূমিধস ও বন্যার শঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। এটি অনস্বীকার্য যে, হিমালয়ের পরিসীমা এখনও ভৌগোলিকভাবে নবীন এবং এখনও এর বিস্তার ঘটছে। ফলে বন উজাড়ীকরণ করা হলে এটি এই এলাকাকে অস্থায়িত্বপ্রবণ এলাকা করে ফেলবে। সুতরাং বনভূমির পরিবর্তনের ব্যাপারে আরও গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।
দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে প্রমাণ মিলেছে যে হিমালয় অঞ্চলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে, হিমালয়ের বাস্তুতন্ত্র গত ১০০ বছরে দ্রুত উষ্ণতা বৃদ্ধির মুখোমুখি পেয়েছে এবং এই হার ইউরোপের আল্পস কিংবা পৃথিবীর অন্যান্য পবর্তাঞ্চলের চেয়ে বেশি। এই পরিস্থিতিতে আমরা ধারণা করতে পারি, দ্রুত হিমবাহ গলনের ফলে হিমালয় অঞ্চলের নদীগুলোতে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে।
তৃতীয়ত, জনবসতির বিস্তার ও নগরায়ন বিস্তৃত করতে জমি ব্যবহারে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। সহজ লক্ষ্য হিসেবে প্রাকৃতিক অঞ্চলকে বেছে নেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় অধিবাসীদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও অর্থনৈতিক কমর্কাণ্ড পরিচালনা গুরুত্বপূর্ণ বটে, তবে তা স্থানীয় সরকার ও কর্মকর্তাদের কর্তৃক ভূমি ব্যবহার আইন প্রয়োগে ঘাটতি থাকার কোনো অজুহাত হিসেবে দাঁড়াতে পারে না। উত্তর কাশীতে অসি ও ভাগীরথী নদীর তীরে বিশাল ভবন, সস্তা হোটেল ও জনবসতি নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। জনবসতি ও নদীর মধ্যে মাঝখানের দূরত্ব খুবই কম।
চতুর্থত, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৃহদায়তনের বাঁধ নির্মাণ জমি ব্যবহারে বড়মাপের পরিবর্তন এনেছে। এটি হিমালয় অঞ্চলের জলধারাগুলোতে মারাত্মক সমস্যা তৈরি করেছে। জলবিদ্যুৎ ও সংশ্লিষ্ট নির্মাণ কার্যক্রম ঢালের দুর্বলতা ও অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধির সম্ভাব্য কারণ। নদী এবং পানি ব্যবস্থাপনায় অপকৌশল প্রয়োগের ফলে হিমালয় অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। এর ফলই আমরা এখন দেখছি। বন্যামুক্ত এলাকা ছাড়া বেশিরভাগ ভাটি অঞ্চলের ক্ষয়ক্ষতির জন্য বাঁধ ও ব্যারেজগুলো দায়ী। এই বাঁধ ও ব্যারেজগুলো থেকে অনেক সময় প্রকৌশল অবকাঠামোর সুরক্ষার জন্য বৃহৎ পরিমাণ পানি ছেড়ে দেওয়া হয়। বাঁধের নিয়ন্ত্রকরা প্রায়ই বৃষ্টির সময় ভাটি অঞ্চলের ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি পানি ছেড়ে দেয়। ফলে বন্যার সৃষ্টি হয়।
পঞ্চমত, ভারতের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কিত পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত নব্য ধর্মীয় আন্দোলন হিমালয় অঞ্চলে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি লোক আনার জন্য দায়ী। এটি যেমন জম্মু ও কাশ্মীরের অমরনাথের ক্ষেত্রে বলা যায়, তেমনই গঙ্গোত্রী অঞ্চলের কেদারনাথ, বদ্রিনাথ এবং উত্তরখণ্ড অঞ্চলের হেমকুণ্ডের ক্ষেত্রে বলা যায়। তীর্থযাত্রীদের অধিক সংখ্যার ফলে নদীর তীরজুড়ে বস্তি অঞ্চল, সস্তা আবাসস্থল ও অনেক জীর্ণ ভবন তৈরি হয়েছে।
এখন তাহলে করণীয় কী? হিমালয় অঞ্চলের পরিবেশ ও উন্নয়নের জন্য একটি সমন্বিত নীতিমালার খুব বেশি প্রয়োজন। পাবলিক ডোমেইনে যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য রয়েছে। এখন কেবল এগুলোকে একসঙ্গে নিয়ে আসার ব্যাপার। এগুলোকে দেখতে হবে সংযোজক পদ্ধতিতে। হিমালয় অঞ্চলের রাজ্য সরকারগুলোর উচিত ভ্রমণকারীদের ওপর উচ্চ পরিবেশ কর আরোপ করা। বিশেষ করে গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে এটি বেশি থাকা উচিত। ভঙ্গুর এলাকায় তীর্থযাত্রীদের সংখ্যা কমিয়ে আনার কাজ অবশ্যই শুরু করতে হবে। সব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হয় নিরাপদ করতে হবে, কিংবা নদীর তীর থেকে সরিয়ে নিতে হবে। নদীতীরের ২০০ মিটারের মধ্যে কাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারকে জরিমানার বিধান করতে হবে। জলবিদ্যুৎ নীতিমালায় কমসংখ্যক বাঁধ নির্মাণ বিবেচনায় নিয়ে যেসবে কম পরিবেশগত ও সামাজিক ক্ষতি হয়, সেগুলোতে অগ্রাধিকার প্রয়োজন। বন বিভাগের প্রস্তাবনা অনুযায়ী জলবিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো থেকে তহবিল নিয়ে 'অববাহিকা সুরক্ষা পরিকল্পনা' বাস্তবায়নে স্বাধীন ও ঐকান্তিক পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালিয়ে যেতে হবে। এর প্রতিবেদন গ্রিন ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
অতিথি অধ্যাপক, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর ও অধ্যাপক, দিলি্ল বিশ্ববিদ্যালয়
দ্য হিন্দু থেকে ভাষান্তর
একরামুল হক শামীম
বর্তমানে ফিরে আসি। আমাদের গবেষক দল সম্প্রতি নদীবিধৌত ভূমিখণ্ড ভাগীরথীতে ১০ দিনের ভ্রমণ সম্পন্ন করেছে। সেখানে আশু বিপর্যয়ের স্পষ্ট লক্ষণ দেখতে পেয়েছি। উত্তর কাশীতে আমরা বছর কয়েক আগেও অসি নদীর (ভাগীরথীর উপনদী) বিপর্যয় দেখেছিলাম। এবার আমরা দেখেছি, নদীর পানিপ্রবাহ শক্তিশালীভাবে বাড়িঘর ও সস্তা হোটেল ভবনগুলোর দিকে ছিল। তা বিপজ্জনকভাবে দুর্বল বাঁধে আঘাত করেছিল।
পরবর্তী দিনটিতে আমরা গঙ্গোত্রী ছেড়ে এসেছিলাম। কিন্তু বিশাল ভূমিধসের কারণে মানেরি গ্রাম অতিক্রম করতে পারিনি। এই ভূমিধসের ফলে রাস্তা ছয় থেকে আট কিলোমিটার উজানের দিক পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে বাস, গাড়ি ও ট্রাকের লম্বা লাইন লেগে গিয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে গ্যারিসন রিজার্ভ ইঞ্জিনিয়ার ফোর্স, বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন ও পুলিশ দীর্ঘক্ষণ কাজ করে বিকল্প রাস্তা তৈরি করতে পেরেছিলেন। আমরা সেই সন্ধ্যাতেই উত্তর কাশীতে ফিরে আসতে পারি।
পরে আমি টেলিভিশনে উত্তর কাশীর বিধ্বস্ততার সংবাদ দেখতে পাই। কেবল আগের দিনেই যেসব ভবনের ছবি তুলেছিলাম সেগুলো ভাগীরথীর নদীর স্রোতে খেলনার মতো ভেসে যাচ্ছিল। এটি দেখে খুবই বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা হয়েছে। হিমালয় অঞ্চলের সাম্প্রতিক দুর্যোগকে কেবল প্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবে উপস্থাপন করলে হয়তো কিছুটা ভুল থেকে যাবে। বরঞ্চ এটি মানবসৃষ্ট বিপর্যয়। মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যাক।
প্রথমত, যথেষ্ট পরিমাণ বৈজ্ঞানিক প্রমাণাদি রয়েছে যে, হিমালয়ের জলধারাগুলো দীর্ঘ সময় ধরে বন উজাড়ীকরণের শিকার হয়েছে। বাণিজ্যিক কার্যকলাপ হিসেবে বন উজাড়ীকরণ সেই ব্রিটিশ আমলে শুরু হয়েছে এবং স্বাধীনতার পরও অখণ্ডভাবে অব্যাহত রয়েছে। সরকারি হিসাবে দাবি করা হয়, হিমালয় অঞ্চলে বনভূমির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বেশ কয়েকটি বিশ্বাসযোগ্য স্বাধীন গবেষণার ফল সরকারের এই দাবির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আসলে কৃষি, জনবসতি ও নগরায়নের জন্য বনের জমি ব্যবহার করা হয়েছে। জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ও সড়ক তৈরির মতো বৃহৎ অবকাঠামোগত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হয়েছে বনের জমি দখলে নিয়ে। বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা অনুযায়ী, বন উজাড়ীকরণ বর্তমান হারে চলতে থাকলে ভারতের হিমালয় অঞ্চলের মোট বনাঞ্চল ২০০০ সালে ৮৪.৯ শতাংশ (১৯৭০ সালের মান অনুযায়ী) কমে যাবে এবং ২১০০ সালে এটি কোনোক্রমেই ৫২.৮ শতাংশের বেশি হবে না। ঘন বনাঞ্চল যার ওপর বনের অনেক প্রজাতি গুরুত্বপূর্ণভাবে নির্ভর করে তা মোট বনাঞ্চলের তুলনায় ২০০০ সালে ৭৫.৪ শতাংশ কমে গেছে এবং ২১০০ সালে তা কেবল ৩৪ শতাংশ হবে। এর মাধ্যমে হিমালয় অঞ্চলের ঘন বনাঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল ২৩.৪ শতাংশ প্রজাতি বিলুপ্ত হতে পারে।
বর্ধনশীল বৃক্ষ পতনশীল বৃষ্টির গতি কমিয়ে দেয় এবং এটি মাটির ক্ষয় ও নালা তৈরি রোধ করে। ভূমিক্ষয় ও নালা তৈরির মতো বিষয়গুলোকে ধস ও বন্যার অগ্রদূত হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ঘন গাছপালা পরিস্বেদনের মাধ্যমে বৃষ্টি পানির প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ভূমিতে পড়তে বাধা দেয়। মাটি পাশাপাশি ধরে রেখে ঘন বনাঞ্চল বৃষ্টির পানি ধীরে শোষণ করে নেয়। যার ফলে বৃষ্টির পানির অতিরিক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। সুতরাং বন উজাড়ীকরণ হলে উঁচু অঞ্চলের ঢালের অস্থিতিশীলতা বাড়ায়, যা ভূমিধস ও বন্যার শঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। এটি অনস্বীকার্য যে, হিমালয়ের পরিসীমা এখনও ভৌগোলিকভাবে নবীন এবং এখনও এর বিস্তার ঘটছে। ফলে বন উজাড়ীকরণ করা হলে এটি এই এলাকাকে অস্থায়িত্বপ্রবণ এলাকা করে ফেলবে। সুতরাং বনভূমির পরিবর্তনের ব্যাপারে আরও গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।
দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে প্রমাণ মিলেছে যে হিমালয় অঞ্চলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে, হিমালয়ের বাস্তুতন্ত্র গত ১০০ বছরে দ্রুত উষ্ণতা বৃদ্ধির মুখোমুখি পেয়েছে এবং এই হার ইউরোপের আল্পস কিংবা পৃথিবীর অন্যান্য পবর্তাঞ্চলের চেয়ে বেশি। এই পরিস্থিতিতে আমরা ধারণা করতে পারি, দ্রুত হিমবাহ গলনের ফলে হিমালয় অঞ্চলের নদীগুলোতে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে।
তৃতীয়ত, জনবসতির বিস্তার ও নগরায়ন বিস্তৃত করতে জমি ব্যবহারে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। সহজ লক্ষ্য হিসেবে প্রাকৃতিক অঞ্চলকে বেছে নেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় অধিবাসীদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও অর্থনৈতিক কমর্কাণ্ড পরিচালনা গুরুত্বপূর্ণ বটে, তবে তা স্থানীয় সরকার ও কর্মকর্তাদের কর্তৃক ভূমি ব্যবহার আইন প্রয়োগে ঘাটতি থাকার কোনো অজুহাত হিসেবে দাঁড়াতে পারে না। উত্তর কাশীতে অসি ও ভাগীরথী নদীর তীরে বিশাল ভবন, সস্তা হোটেল ও জনবসতি নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। জনবসতি ও নদীর মধ্যে মাঝখানের দূরত্ব খুবই কম।
চতুর্থত, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৃহদায়তনের বাঁধ নির্মাণ জমি ব্যবহারে বড়মাপের পরিবর্তন এনেছে। এটি হিমালয় অঞ্চলের জলধারাগুলোতে মারাত্মক সমস্যা তৈরি করেছে। জলবিদ্যুৎ ও সংশ্লিষ্ট নির্মাণ কার্যক্রম ঢালের দুর্বলতা ও অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধির সম্ভাব্য কারণ। নদী এবং পানি ব্যবস্থাপনায় অপকৌশল প্রয়োগের ফলে হিমালয় অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। এর ফলই আমরা এখন দেখছি। বন্যামুক্ত এলাকা ছাড়া বেশিরভাগ ভাটি অঞ্চলের ক্ষয়ক্ষতির জন্য বাঁধ ও ব্যারেজগুলো দায়ী। এই বাঁধ ও ব্যারেজগুলো থেকে অনেক সময় প্রকৌশল অবকাঠামোর সুরক্ষার জন্য বৃহৎ পরিমাণ পানি ছেড়ে দেওয়া হয়। বাঁধের নিয়ন্ত্রকরা প্রায়ই বৃষ্টির সময় ভাটি অঞ্চলের ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি পানি ছেড়ে দেয়। ফলে বন্যার সৃষ্টি হয়।
পঞ্চমত, ভারতের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কিত পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত নব্য ধর্মীয় আন্দোলন হিমালয় অঞ্চলে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি লোক আনার জন্য দায়ী। এটি যেমন জম্মু ও কাশ্মীরের অমরনাথের ক্ষেত্রে বলা যায়, তেমনই গঙ্গোত্রী অঞ্চলের কেদারনাথ, বদ্রিনাথ এবং উত্তরখণ্ড অঞ্চলের হেমকুণ্ডের ক্ষেত্রে বলা যায়। তীর্থযাত্রীদের অধিক সংখ্যার ফলে নদীর তীরজুড়ে বস্তি অঞ্চল, সস্তা আবাসস্থল ও অনেক জীর্ণ ভবন তৈরি হয়েছে।
এখন তাহলে করণীয় কী? হিমালয় অঞ্চলের পরিবেশ ও উন্নয়নের জন্য একটি সমন্বিত নীতিমালার খুব বেশি প্রয়োজন। পাবলিক ডোমেইনে যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য রয়েছে। এখন কেবল এগুলোকে একসঙ্গে নিয়ে আসার ব্যাপার। এগুলোকে দেখতে হবে সংযোজক পদ্ধতিতে। হিমালয় অঞ্চলের রাজ্য সরকারগুলোর উচিত ভ্রমণকারীদের ওপর উচ্চ পরিবেশ কর আরোপ করা। বিশেষ করে গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে এটি বেশি থাকা উচিত। ভঙ্গুর এলাকায় তীর্থযাত্রীদের সংখ্যা কমিয়ে আনার কাজ অবশ্যই শুরু করতে হবে। সব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হয় নিরাপদ করতে হবে, কিংবা নদীর তীর থেকে সরিয়ে নিতে হবে। নদীতীরের ২০০ মিটারের মধ্যে কাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারকে জরিমানার বিধান করতে হবে। জলবিদ্যুৎ নীতিমালায় কমসংখ্যক বাঁধ নির্মাণ বিবেচনায় নিয়ে যেসবে কম পরিবেশগত ও সামাজিক ক্ষতি হয়, সেগুলোতে অগ্রাধিকার প্রয়োজন। বন বিভাগের প্রস্তাবনা অনুযায়ী জলবিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো থেকে তহবিল নিয়ে 'অববাহিকা সুরক্ষা পরিকল্পনা' বাস্তবায়নে স্বাধীন ও ঐকান্তিক পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালিয়ে যেতে হবে। এর প্রতিবেদন গ্রিন ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
অতিথি অধ্যাপক, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর ও অধ্যাপক, দিলি্ল বিশ্ববিদ্যালয়
দ্য হিন্দু থেকে ভাষান্তর
একরামুল হক শামীম
No comments