প্রতিবাদ ও ভালোবাসার গানের শিল্পী by ফকির আলমগীর
উপমহাদেশের প্রখ্যাত গণসঙ্গীত শিল্পী অজিত
পাণ্ডে আর আমাদের মধ্যে বেঁচে নেই। গত ১৩ জুন বৃহস্পতিবার কলকাতায় তিনি
শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।
১৯৩৯
সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের
মধ্য দিয়ে শৈশবে তার সঙ্গীত জীবনের শুরু। মুর্শিদাবাদের এক সংস্কৃতি
পরিবারে তিনি বেড়ে ওঠেন। পরবর্তী পর্যায়ে অজিত পাণ্ডে সক্রিয়ভাবে রাজনীতির
সঙ্গে যুক্ত হন। তারই ধারাবাহিকতায় তিনি পশ্চিমবঙ্গের পার্লামেন্টে সদস্য
নির্বাচিত হন। তারই প্রচেষ্টায় ক্যালকাট্টাকে (Calcutta) কলকাতায় (Kolkata)
রূপান্তর করা হয়। এ ছাড়া বাম ঘরানার এই শিল্পী গণনাট্যের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে
যুক্ত ছিলেন। রাজনৈতিকসচেতন এই গণশিল্পী আজীবন রাজনীতির পাশাপাশি
মাঠে-ময়দানে গণসঙ্গীত পরিবেশন করে শিল্পীর সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছেন।
হেমাঙ্গ বিশ্বাস নেই, সলিল চৌধুরী নেই, নেই আসামের ভূপেন হাজারিকা। আজ
অজিত পাণ্ডের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের গণসঙ্গীতের আরেক দিকপালের
জীবনের অবসান ঘটল। অজিত পাণ্ডে আমার ভালো বন্ধু ছিলেন, আমরা দুই বাংলায়
গণসঙ্গীতের একই নৌকার যাত্রী ছিলাম। পরস্পর সবসময় খোঁজখবর নিতাম চিঠির
মাধ্যমে, ফোনের মাধ্যমে। আমি তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
তার সঙ্গে আমার কিছু স্মৃতি, কিছু কথা নিয়ে একটি লেখা পাঠকের সামনে তুলে
ধরছি।
কোনো মসৃণ সুন্দর পথ ধরে নয়। কাঁটা ঝোপঝাড়, রুক্ষ পাথুরে পথ কিংবা একপা কাদা নিয়ে উঠে আসার মানুষটি গাইছেন ৪৮ বছর ধরে। না দুঃখিত, কোনো বিনোদনের গান নয়। তবে কী? মিটিং-মিছিল? হ্যাঁ মিটিং-মিছিল, আন্দোলন, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, অভিমান, কান্না আর কিছু স্বপ্ন দেখানোর গান। বড় বড় সমালোচক, তাত্তি্বক গবেষক, নামিদামি কলমবাজদের কলমে তার জায়গা নির্দয় প্রত্যাখ্যানে। ওদের কাছে একেবারেই ব্রাত্য। অবশ্য ব্রাত্য শব্দটি বড় অভিজাত। বরং ভালো শোনাবে হরিজন বা চণ্ডাল অথবা অচ্ছুত_ অজিত পাণ্ডে তার নাম। গণসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে অজিত পাণ্ডে গান গাইছেন ৫০ বছর ধরে। অন্য রকমের গান। শুরুতে ছিল শুধুই গণসঙ্গীত। পরে তাতে যোগ হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গান, লালনের গান। তার মতে এসব গানের চেয়ে ভালো গণসঙ্গীত আর কী আছে! আধুনিক কবিতায় সুর দিয়ে গান করার সাহস ও নিষ্ঠা দেখিয়েছেন তিনি। তার কণ্ঠে চাসনালা খনির সেই হৃদয়বিদায়ক কাহিনী, অমলকান্তির রোদ্দুর হওয়ার স্বপ্ন বা তুষার সাগরে আগুন জ্বালাতে দেখেছি আমরা। এক সময়ের ব্যস্ত বিধায়ক (এমএলএ) হলেও গান তিনি ছাড়েননি কখনও। উল্টো সদর্পে জানিয়েছেন গান চলবে। মানুষের জন্য, জীবনের জন্য গান গাইছেন তিনি অবিরাম। সেই অজিত পাণ্ডে অনেকবার বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন প্রগতিশীল সংস্থা ঋষিজ, আওয়ামী লীগ এবং উদীচীর আমন্ত্রণে। 'দ্রোহের বীণায় উঠুক বেজে অসুরনাশী গান'_ স্লোগানটি ধারণ করে উদীচীর আয়োজনে। মহানগর নাট্যমঞ্চে গত ২৮ মার্চ ২০০৯ শনিবার অনুষ্ঠিত হয়ে গেল সত্যেন সেন গণসঙ্গীতের উৎসব ও জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। বর্ণাঢ্য এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট রবীন্দ্র ও গণসঙ্গীত শিল্পী অজিত রায়। প্রধান অতিথি ছিলেন ওপার বাংলার খ্যাতিমান গণসঙ্গীত শিল্পী অজিত পাণ্ডে। বিকেলের রোদে যখন দুই বাংলার খ্যাতিমান অজিত দলীয় এবং জাতীয় পতাকা উত্তোলন করছিলেন, তখন উদীচীর বন্ধুরা সমবেত কণ্ঠে গাইছিলেন, 'আরশির সামনে একা একা দাঁড়িয়ে যদি ভাবি কোটি জনতার মুখ দেখব, হয় না, হয় না, হয় না, কেবল সে হয় না এসো এই মঞ্চে উদীচী এমনই এক আয়না'।
বিনয়ী এই শিল্পী সবসময়ই যে কথা বলে থাকেন, রবীন্দ্র, নজরুল, মুকুন্দ দাস, বটুক, হেমাঙ্গ, সলিল, পল রোবসন, পিট সিগারের ছবি আমার মাথার ওপর টাঙানো। আমি রোজ আমার উচ্চতা মাপি আর নিজেই লজ্জা পাই। এর মধ্য দিয়ে শিল্পীর মহানুভবতার পরিচয় মেলে। যাদের স্নেহ-ছায়ায় বেড়ে ওঠা তাদের মধ্যে চারু মজুমদার, হরেকৃষ্ণ কোঙার, প্রমোদ দাশগুপ্ত, উৎপল দত্ত, সত্যজিৎ রায়, সবিতাব্রত দত্ত, বিষ্ণু দে, শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। এ ছাড়া জ্যোতি বসু, বিনয় চৌধুরী, বিমান বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, ভি-বাল সারা, রুমা গুহঠাকুরতা, সৌমিত্র, ইন্দ্রনাথসহ অনেকের কাছে তিনি ঋণী। অজিত পাণ্ডে গণসঙ্গীত বলতে প্রতিবাদ ও ভালোবাসার গানকেই বোঝেন। আর এই গানের প্রধান অবলম্বন অবশ্যই কবিতা। জীবন জয়ের গানে তিনি কালজয়ী।
স ফকির আলমগীর : গণসঙ্গীতশিল্পী
কোনো মসৃণ সুন্দর পথ ধরে নয়। কাঁটা ঝোপঝাড়, রুক্ষ পাথুরে পথ কিংবা একপা কাদা নিয়ে উঠে আসার মানুষটি গাইছেন ৪৮ বছর ধরে। না দুঃখিত, কোনো বিনোদনের গান নয়। তবে কী? মিটিং-মিছিল? হ্যাঁ মিটিং-মিছিল, আন্দোলন, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, অভিমান, কান্না আর কিছু স্বপ্ন দেখানোর গান। বড় বড় সমালোচক, তাত্তি্বক গবেষক, নামিদামি কলমবাজদের কলমে তার জায়গা নির্দয় প্রত্যাখ্যানে। ওদের কাছে একেবারেই ব্রাত্য। অবশ্য ব্রাত্য শব্দটি বড় অভিজাত। বরং ভালো শোনাবে হরিজন বা চণ্ডাল অথবা অচ্ছুত_ অজিত পাণ্ডে তার নাম। গণসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে অজিত পাণ্ডে গান গাইছেন ৫০ বছর ধরে। অন্য রকমের গান। শুরুতে ছিল শুধুই গণসঙ্গীত। পরে তাতে যোগ হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গান, লালনের গান। তার মতে এসব গানের চেয়ে ভালো গণসঙ্গীত আর কী আছে! আধুনিক কবিতায় সুর দিয়ে গান করার সাহস ও নিষ্ঠা দেখিয়েছেন তিনি। তার কণ্ঠে চাসনালা খনির সেই হৃদয়বিদায়ক কাহিনী, অমলকান্তির রোদ্দুর হওয়ার স্বপ্ন বা তুষার সাগরে আগুন জ্বালাতে দেখেছি আমরা। এক সময়ের ব্যস্ত বিধায়ক (এমএলএ) হলেও গান তিনি ছাড়েননি কখনও। উল্টো সদর্পে জানিয়েছেন গান চলবে। মানুষের জন্য, জীবনের জন্য গান গাইছেন তিনি অবিরাম। সেই অজিত পাণ্ডে অনেকবার বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন প্রগতিশীল সংস্থা ঋষিজ, আওয়ামী লীগ এবং উদীচীর আমন্ত্রণে। 'দ্রোহের বীণায় উঠুক বেজে অসুরনাশী গান'_ স্লোগানটি ধারণ করে উদীচীর আয়োজনে। মহানগর নাট্যমঞ্চে গত ২৮ মার্চ ২০০৯ শনিবার অনুষ্ঠিত হয়ে গেল সত্যেন সেন গণসঙ্গীতের উৎসব ও জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। বর্ণাঢ্য এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট রবীন্দ্র ও গণসঙ্গীত শিল্পী অজিত রায়। প্রধান অতিথি ছিলেন ওপার বাংলার খ্যাতিমান গণসঙ্গীত শিল্পী অজিত পাণ্ডে। বিকেলের রোদে যখন দুই বাংলার খ্যাতিমান অজিত দলীয় এবং জাতীয় পতাকা উত্তোলন করছিলেন, তখন উদীচীর বন্ধুরা সমবেত কণ্ঠে গাইছিলেন, 'আরশির সামনে একা একা দাঁড়িয়ে যদি ভাবি কোটি জনতার মুখ দেখব, হয় না, হয় না, হয় না, কেবল সে হয় না এসো এই মঞ্চে উদীচী এমনই এক আয়না'।
বিনয়ী এই শিল্পী সবসময়ই যে কথা বলে থাকেন, রবীন্দ্র, নজরুল, মুকুন্দ দাস, বটুক, হেমাঙ্গ, সলিল, পল রোবসন, পিট সিগারের ছবি আমার মাথার ওপর টাঙানো। আমি রোজ আমার উচ্চতা মাপি আর নিজেই লজ্জা পাই। এর মধ্য দিয়ে শিল্পীর মহানুভবতার পরিচয় মেলে। যাদের স্নেহ-ছায়ায় বেড়ে ওঠা তাদের মধ্যে চারু মজুমদার, হরেকৃষ্ণ কোঙার, প্রমোদ দাশগুপ্ত, উৎপল দত্ত, সত্যজিৎ রায়, সবিতাব্রত দত্ত, বিষ্ণু দে, শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। এ ছাড়া জ্যোতি বসু, বিনয় চৌধুরী, বিমান বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, ভি-বাল সারা, রুমা গুহঠাকুরতা, সৌমিত্র, ইন্দ্রনাথসহ অনেকের কাছে তিনি ঋণী। অজিত পাণ্ডে গণসঙ্গীত বলতে প্রতিবাদ ও ভালোবাসার গানকেই বোঝেন। আর এই গানের প্রধান অবলম্বন অবশ্যই কবিতা। জীবন জয়ের গানে তিনি কালজয়ী।
স ফকির আলমগীর : গণসঙ্গীতশিল্পী
No comments