এখানে সেখানে জবর জেনেভা by সুমনা শারমীন
হোটেল ইবিস নেশনসের লবিতেই দেখা মিজানুর
রহমানের সঙ্গে। বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান। সঙ্গে
তাঁরই তরুণ সহকর্মী আশিক। সবাই এসেছি জাতিসংঘে বাংলাদেশের মানবাধিকার
পরিস্থিতি পর্যালোচনা অধিবেশনে যোগ দিতে।
দলের অন্যরা
আগেই পৌঁছে কাজে ব্যস্ত হোটেলের বাইরে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, মেঘলা আকাশ।
হোটেলের ঘর থেকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েই মনে হলো বাড়ির কথা, ছেলের কথা।
একটা ফোনের সিম আমার চাই।
নেমে এলাম নিচে লবিতে। আশিক বললেন, ‘এই রাস্তা দিয়ে একটু হেঁটে গেলে সিটি সেন্টার। (এই একটু হাঁটা মানে, ঢাকার কারওয়ান বাজার থেকে শাহবাগ) ট্রেন স্টেশনের ওপারে বাংলাদেশের আমজাদ ভাইয়ের দোকান। খুবই সহযোগিতা করেন। তাঁর কাছ থেকে সিম কিনেছি আমরা।’ ছাতা মাথায় একাই রওনা হলাম। ঘণ্টা খানেক আগে আসা এক ভিনদেশি আমি। শিল্পীর আঁকা ল্যান্ডসস্কেপের মতো সাজানো শহরে হঠাৎ এক-দুজন মানুষ। এরা ফরাসি বলে, ইংরেজি বোঝে না। ফলে আকার-ইঙ্গিত ছাড়া কথা জিজ্ঞেস করার উপায় নাই। নতুন পদ্ধতি নিলাম। ইংরেজিতে লেখা আমজাদ ভাইয়ের নেমকার্ড দেখাই, ওরা বলে ‘ফঁসে ফঁসে’। আমি বাংলায় বলি, সিঁড়ি দিয়ে নেমে ওই পারে যাব? ওরা মাথা নাড়ায়, আমি হাঁটি। আর মনে মনে বলি, ভাগ্যিস, ছাতা তুমি ছিলে মোর সনে।
অবশেষে পাওয়া গেল আমজাদ ভাইয়ের বোম্বে রেস্টুরেন্ট। পাশেই তাঁর মানি এক্সচেঞ্জ, সাইবার কিওস্ক। নিজেই কাউন্টারে বসে ব্যস্ত হাতে সামলাচ্ছেন লোকজন। পরিচয় হতেই আন্তরিক কণ্ঠস্বর, ‘আপা, আগে আমার ফোন থেকে ছেলের সঙ্গে কথা বলেন দেশে, তারপর সিম দিচ্ছি।’ জানালেন, ম্যানেজার অসুস্থ, তাই এক হাতে নিজেকেই সামলাতে হচ্ছে কাজ। এরই ফাঁকে বেরিয়ে রেস্টুরেন্ট ঘুরিয়ে দেখালেন। আরও দুই ভাই আছেন সেখানে। একটা টেবিলে দুজন খাচ্ছিলেন, বাংলায় কথা শুনে দাঁড়ালেন। কবে এসেছেন? কোন কাজে? কত দিন থাকবেন? ইত্যাদি প্রশ্ন সেরেই একজন বললেন, ‘এখানেই খাওয়াদাওয়া করবেন, আমি আপনাদের কথা বলে দিচ্ছি।’ রেস্টুরেন্টে দেশি-বিদেশি ক্রেতা তো ছিলই, যাঁরা খাবার দিচ্ছেলেন, তাঁদের মধ্যে ফরাসি-ব্রিটিশ মেয়েরাও আছেন। এঁরা বেশির ভাগই ছাত্রী, পড়ার ফাঁকে আমজাদ ভাইয়ের রেস্টুরেন্টে কাজ করেন।
বাংলাদেশের এই যুবক, পড়াশোনার কারণে পাড়ি জমিয়েছিলেন সুইজারল্যান্ডে ১৬ বছর আগে। আর এই জেনেভায় ব্যবসা শুরু করেন বছর আটেক আগে। বিয়ে করেছেন নেপালি একটি মেয়েকে। বিকেলের পর থেকে তিনিও এসে কাজকর্ম তদারক করেন। (সন্ধ্যা বলতে পারছি না, কারণ জেনেভায় নয়টার আগে সূর্য ডোবে না।) কর্মঠ আমজাদ চৌধুরীর ব্যবসা দিনকে দিন বিস্তৃত হচ্ছে, লেক জেনেভার ধারে এখন তাঁর দ্বিতীয় রেস্টুরেন্টও চালু হয়ে গেছে। শিগগিরই উদ্বোধন হবে একটি মিনি সুপার মার্কেট। জেনেভায় এখন তিনি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনেরও সভাপতি। কুমিল্লা থেকে জেনেভায় যাওয়া এই বাংলাদেশি যুবক এখন উৎফুল্ল কণ্ঠে বলেন, ‘পরিশ্রম করি, রোজগার করি। একটা মার্সিডিজ গাড়ি কিনছি। ছেলেটার বয়স তিন বছর। ওর জন্য যেন কিছু করে যেতে পারি। ভালো আছি, আপা। তবে বাংলাদেশ থেকে কেউ এলে সবচেয়ে ভালো লাগে।’
পরে কাছাকাছি আরেকটি রেস্টুরেন্টেও গেলাম, ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে যাওয়া দেলোয়ারের ইন্ডিয়ান প্লাজা রেস্টুরেন্ট। পরিশ্রমী দেলোয়ারের ফুরসত নেই, কখনো তিনি কিচেনে, কখনো খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত, তাঁর রেস্টুরেন্টে দেখলাম নেপালি ছাত্রীরা কাজ করছে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, রেস্টুরেন্টের নামগুলো বোম্বে কিংবা ইন্ডিয়া কেন? দেলোয়ারের ত্বরিত উত্তর, ‘বাংলাদেশি বললে কেউ চেনে না। যদিও যারা খেতে আসে, তাদের আমরা বাংলা খাবারও পরিবেশন করি।’ তবে আমজাদ চৌধুরী জানিয়েছেন, তাঁর নতুন মিনি সুপার মার্কেটটির নাম তিনি রাখছেন ‘বঙ্গবাজার’।
হোটেলের লবিতে বড় বড় দুটি টিভি। একটিতে চলছে ইউরন নিউজ, অন্যটিতে ফ্রেঞ্চ ২৪। সারাক্ষণই বিশ্বের সর্বশেষ খবরগুলো পরিবেশন করছে। আর কতক্ষণ পরপর ব্রেকিং নিউজে দেখাচ্ছে বাংলাদেশের সাভারে রানা প্লাজা ধসের ভয়াবহ সেই ছবি (সময়টা ছিল এপ্রিলের শেষ)। ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে বের করে আনা হচ্ছে আহত-নিহত শ্রমিকদের। দেখানো হচ্ছে, গ্রেপ্তার হওয়া যুবক রানাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। নিজের দেশের এমন খবর বিমর্ষ করে দিল। ভাবি, মানুষের লোভ, দায়িত্বহীনতা, আর দ্রুত বড়লোক হওয়ার এই মানসিকতায় কত অসহায় মানুষের জীবন গেল! অথচ পরিশ্রম করে, একটু একটু করে নিজের ও পরিবারের অন্যদের ভাগ্য যে পরিবর্তন করা যায়, সন্তানদের জন্য একটা নিশ্চিত ভবিষ্যৎ গড়ে রেখে অন্য মানুষের জন্যও যে কিছু করা যায়, তার উদাহরণ তো দেশ থেকে বিদেশে আসা যুবকেরাই করে দেখাচ্ছেন। তবে?
চারদিকে যা কিছু দেখি, তার অনেক কিছুরই হিসাব মেলে না। ছোটবেলায় শিখেছিলাম, বেনীআসহকলা। রংধনুর সাত রং। ঢাকায় শেষ কবে রংধনু দেখেছি, মনে নেই। লেক জেনেভার বুক চিরে বের হওয়া রংধনু দেখে সেই তারিখের হিসাব মেলাতে পারলাম না। ঢাকা যে এখন ঢাকাই।
হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে গেলাম অবসরপ্রাপ্ত মানুষগুলোর সময় কাটানোর কেন্দ্রে। খোলা জায়গায় হাঁটুর সমান ঘুঁটি দিয়ে দাবা খেলছেন তাঁরা। দাঁড়িয়ে দেখছি। উমা একি! চোখে দেখে না নাকি লোকটা! পরিষ্কার দেখছি, হাতি দিয়ে কোনাকুনি মন্ত্রী খাওয়া যায়। হাত নিশপিশ করছে। মনে হচ্ছে, আমিই চাল দিয়ে দিই। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে লাঠিতে ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি হাতির চাল দিল সোজাসুজি। বলে কী! দাবার হাতি কবে আবার সোজা হেঁটেছে? হিসাবটা মিলল না কিছুতেই...।
নেমে এলাম নিচে লবিতে। আশিক বললেন, ‘এই রাস্তা দিয়ে একটু হেঁটে গেলে সিটি সেন্টার। (এই একটু হাঁটা মানে, ঢাকার কারওয়ান বাজার থেকে শাহবাগ) ট্রেন স্টেশনের ওপারে বাংলাদেশের আমজাদ ভাইয়ের দোকান। খুবই সহযোগিতা করেন। তাঁর কাছ থেকে সিম কিনেছি আমরা।’ ছাতা মাথায় একাই রওনা হলাম। ঘণ্টা খানেক আগে আসা এক ভিনদেশি আমি। শিল্পীর আঁকা ল্যান্ডসস্কেপের মতো সাজানো শহরে হঠাৎ এক-দুজন মানুষ। এরা ফরাসি বলে, ইংরেজি বোঝে না। ফলে আকার-ইঙ্গিত ছাড়া কথা জিজ্ঞেস করার উপায় নাই। নতুন পদ্ধতি নিলাম। ইংরেজিতে লেখা আমজাদ ভাইয়ের নেমকার্ড দেখাই, ওরা বলে ‘ফঁসে ফঁসে’। আমি বাংলায় বলি, সিঁড়ি দিয়ে নেমে ওই পারে যাব? ওরা মাথা নাড়ায়, আমি হাঁটি। আর মনে মনে বলি, ভাগ্যিস, ছাতা তুমি ছিলে মোর সনে।
অবশেষে পাওয়া গেল আমজাদ ভাইয়ের বোম্বে রেস্টুরেন্ট। পাশেই তাঁর মানি এক্সচেঞ্জ, সাইবার কিওস্ক। নিজেই কাউন্টারে বসে ব্যস্ত হাতে সামলাচ্ছেন লোকজন। পরিচয় হতেই আন্তরিক কণ্ঠস্বর, ‘আপা, আগে আমার ফোন থেকে ছেলের সঙ্গে কথা বলেন দেশে, তারপর সিম দিচ্ছি।’ জানালেন, ম্যানেজার অসুস্থ, তাই এক হাতে নিজেকেই সামলাতে হচ্ছে কাজ। এরই ফাঁকে বেরিয়ে রেস্টুরেন্ট ঘুরিয়ে দেখালেন। আরও দুই ভাই আছেন সেখানে। একটা টেবিলে দুজন খাচ্ছিলেন, বাংলায় কথা শুনে দাঁড়ালেন। কবে এসেছেন? কোন কাজে? কত দিন থাকবেন? ইত্যাদি প্রশ্ন সেরেই একজন বললেন, ‘এখানেই খাওয়াদাওয়া করবেন, আমি আপনাদের কথা বলে দিচ্ছি।’ রেস্টুরেন্টে দেশি-বিদেশি ক্রেতা তো ছিলই, যাঁরা খাবার দিচ্ছেলেন, তাঁদের মধ্যে ফরাসি-ব্রিটিশ মেয়েরাও আছেন। এঁরা বেশির ভাগই ছাত্রী, পড়ার ফাঁকে আমজাদ ভাইয়ের রেস্টুরেন্টে কাজ করেন।
বাংলাদেশের এই যুবক, পড়াশোনার কারণে পাড়ি জমিয়েছিলেন সুইজারল্যান্ডে ১৬ বছর আগে। আর এই জেনেভায় ব্যবসা শুরু করেন বছর আটেক আগে। বিয়ে করেছেন নেপালি একটি মেয়েকে। বিকেলের পর থেকে তিনিও এসে কাজকর্ম তদারক করেন। (সন্ধ্যা বলতে পারছি না, কারণ জেনেভায় নয়টার আগে সূর্য ডোবে না।) কর্মঠ আমজাদ চৌধুরীর ব্যবসা দিনকে দিন বিস্তৃত হচ্ছে, লেক জেনেভার ধারে এখন তাঁর দ্বিতীয় রেস্টুরেন্টও চালু হয়ে গেছে। শিগগিরই উদ্বোধন হবে একটি মিনি সুপার মার্কেট। জেনেভায় এখন তিনি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনেরও সভাপতি। কুমিল্লা থেকে জেনেভায় যাওয়া এই বাংলাদেশি যুবক এখন উৎফুল্ল কণ্ঠে বলেন, ‘পরিশ্রম করি, রোজগার করি। একটা মার্সিডিজ গাড়ি কিনছি। ছেলেটার বয়স তিন বছর। ওর জন্য যেন কিছু করে যেতে পারি। ভালো আছি, আপা। তবে বাংলাদেশ থেকে কেউ এলে সবচেয়ে ভালো লাগে।’
পরে কাছাকাছি আরেকটি রেস্টুরেন্টেও গেলাম, ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে যাওয়া দেলোয়ারের ইন্ডিয়ান প্লাজা রেস্টুরেন্ট। পরিশ্রমী দেলোয়ারের ফুরসত নেই, কখনো তিনি কিচেনে, কখনো খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত, তাঁর রেস্টুরেন্টে দেখলাম নেপালি ছাত্রীরা কাজ করছে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, রেস্টুরেন্টের নামগুলো বোম্বে কিংবা ইন্ডিয়া কেন? দেলোয়ারের ত্বরিত উত্তর, ‘বাংলাদেশি বললে কেউ চেনে না। যদিও যারা খেতে আসে, তাদের আমরা বাংলা খাবারও পরিবেশন করি।’ তবে আমজাদ চৌধুরী জানিয়েছেন, তাঁর নতুন মিনি সুপার মার্কেটটির নাম তিনি রাখছেন ‘বঙ্গবাজার’।
হোটেলের লবিতে বড় বড় দুটি টিভি। একটিতে চলছে ইউরন নিউজ, অন্যটিতে ফ্রেঞ্চ ২৪। সারাক্ষণই বিশ্বের সর্বশেষ খবরগুলো পরিবেশন করছে। আর কতক্ষণ পরপর ব্রেকিং নিউজে দেখাচ্ছে বাংলাদেশের সাভারে রানা প্লাজা ধসের ভয়াবহ সেই ছবি (সময়টা ছিল এপ্রিলের শেষ)। ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে বের করে আনা হচ্ছে আহত-নিহত শ্রমিকদের। দেখানো হচ্ছে, গ্রেপ্তার হওয়া যুবক রানাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। নিজের দেশের এমন খবর বিমর্ষ করে দিল। ভাবি, মানুষের লোভ, দায়িত্বহীনতা, আর দ্রুত বড়লোক হওয়ার এই মানসিকতায় কত অসহায় মানুষের জীবন গেল! অথচ পরিশ্রম করে, একটু একটু করে নিজের ও পরিবারের অন্যদের ভাগ্য যে পরিবর্তন করা যায়, সন্তানদের জন্য একটা নিশ্চিত ভবিষ্যৎ গড়ে রেখে অন্য মানুষের জন্যও যে কিছু করা যায়, তার উদাহরণ তো দেশ থেকে বিদেশে আসা যুবকেরাই করে দেখাচ্ছেন। তবে?
চারদিকে যা কিছু দেখি, তার অনেক কিছুরই হিসাব মেলে না। ছোটবেলায় শিখেছিলাম, বেনীআসহকলা। রংধনুর সাত রং। ঢাকায় শেষ কবে রংধনু দেখেছি, মনে নেই। লেক জেনেভার বুক চিরে বের হওয়া রংধনু দেখে সেই তারিখের হিসাব মেলাতে পারলাম না। ঢাকা যে এখন ঢাকাই।
হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে গেলাম অবসরপ্রাপ্ত মানুষগুলোর সময় কাটানোর কেন্দ্রে। খোলা জায়গায় হাঁটুর সমান ঘুঁটি দিয়ে দাবা খেলছেন তাঁরা। দাঁড়িয়ে দেখছি। উমা একি! চোখে দেখে না নাকি লোকটা! পরিষ্কার দেখছি, হাতি দিয়ে কোনাকুনি মন্ত্রী খাওয়া যায়। হাত নিশপিশ করছে। মনে হচ্ছে, আমিই চাল দিয়ে দিই। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে লাঠিতে ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি হাতির চাল দিল সোজাসুজি। বলে কী! দাবার হাতি কবে আবার সোজা হেঁটেছে? হিসাবটা মিলল না কিছুতেই...।
No comments