বাঘের থাবায় স্বামীহারাদের জীবন সংগ্রাম
দুপুর বেলা গোসল করা যাবে না। মাথায় সাবান
দেয়া যাবে না। ঘরের দরজা বন্ধ করা যাবে না। ঝাল পোড়ানো যাবে না। শুক্রবার
ছাড়া কাপড় পরিষ্কার করা যাবে না। এত কিছু বিধিনিষেধ মেনে চলার পরও যদি কারও
স্বামীকে বাঘে ধরে বা বাঘের মুখে প্রাণ হারায় তবে সেই গৃহবধূ হয় অপয়া।
বউয়ের
কারণে তার স্বামীকে বাঘে খেয়েছে এই অপবাদ মাথায় নিয়ে শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ ও
শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় স্বজনদের অত্যাচারে স্বামীর ভিটেমাটি ছাড়তে হয়
সুন্দরবন সংলগ্ন জনপদের বাঘের মুখে স্বামী হারানো গৃহবধূদের। সামাজিক
বিধিনিষেধ আর কুসংষ্কারের বেড়াজালে বন্দী ওদের জীবন। স্বামী হারানোর সঙ্গে
সঙ্গে ওরা হারিয়েছে ওদের সংসার। স্বামীর ভিটেমাটি আর মাথা গোঁজার ঠাঁই
হারিয়ে ওরা বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে সুন্দরবন সংলগ্ন নদী সহ উপকলীয়
জনপদে।
সুন্দরবন সংলগ্ন গাবুরা ইউনিয়নের চাঁদনিমুখা গ্রামের মৃত আক্কাস আলি মোড়লের স্ত্রী আছিয়া খাতুন (৩৫)। স্বামী সুন্দরবনে কাঠ কাটত। কোন কোন সময় মধু সংগ্রহ করত। ২০০২ সালের মার্চে তাঁর স্বামীকে বাঘে ধরে। একদিন পর সে খবর পায়। কিন্তু লাশ পাওয়া যায়না । স্বামী মারা যাওয়ার সময সে ছিল ৫ মাসের অন্তঃসত্তা। স্বামীর মৃত্যুর পর তাকে বাড়ির বাইরে বেরুতে দেয়া হয় না। শ্বশুরবাড়িতে তার যায়গা হয় মাত্র ১০ দিন। অপয়া, অলক্ষ্মী বলে তাকে স্বামীর ভিটে থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। বিচার চেয়ে আবেদন করেছিল স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদে। বিচার মেলেনি। চলে আসে বাবার বাড়িতে। বাঘের মুখে প্রাণ হারানো বাবা সাহেব আলি শেখের ভিটে মাটিতে আশ্রয় নিয়ে সে এখন জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকার যুদ্ধ করছে। ছেলে আছাদুল, আকরাম, আর মেয়ে আঙ্গুরাকে নিয়ে সে এখন সুন্দরবনের নদীতে কাঁকড়া ধরে। বড় ছেলে ইটভাঁটিতে কাজ করে। বাঘের মুখে স্বামী হারানোর ঘটনায় স্থানীয় কদমতলা ফরেস্ট অফিসে নাম জমা দেয়ার পরও সে কোন সাহায্য পায়নি।
শুধু আছিয়া নয়, আছিয়ার মতো বাঘের মুখে প্রাণ হারানো সুন্দরবনের জনপদের কয়েক শ’ নারী বেঁচে থাকার লড়াই-এ সংগ্রাম করছে। বুড়িগোয়ালিনি গ্রামের বাঘের মুকে নিহত মনিরুলের স্ত্রী রোকসানা (২৮)। সুন্দরবনের বয়ারসিং খালে কাঁকড়া ধরার সময় ২০০৮ সালে বাঘের মুখে প্রাণ হারায় তার স্বামী। সংসারে একমাত্র মেয়ে ৫ বছরের সাথীকে নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য সে নদীতে মাছ ধরে। মাছে জন মজুরি দিয়ে চলে তার সংসার। একই বছর সুন্দরবনের মালঞ্চ নদীতে কাঁকড়া ধরার সময় বাঘের মুখে প্রাণ হারায় গাবুরা ইউনিয়নের ডুমুরিয়া গ্রামের ইকবাল খান। স্ত্রী আঞ্জুয়ারা (২৫) ৫ বছরের মেয়ে সোনামনিকে নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য সুন্দরবনের নদীতে চিংড়িপোনা ধরে। বাঘের মুখে স্বামী হারানো ভবেন সরকারের স্ত্রী সোনামনির (৫০) বাড়ি মুন্সীগঞ্জের জেলে পাড়ায়। ২০০২ সালে নদীতে মাছ ধরতে যেয়ে তার স্বামীকে বাঘে নিযে যায়। লাশ পাওয়া যায়নি। ২ ছেলে আর ২ মেয়েকে নিয়ে তার সংসার। সে বাজার ঝাড়ু দেয়। আর ছেলেরা বাবার মতো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদীতে মাছের পোনা ধরে জীবন চালায়। পাশ্বেমারি গ্রামের সুফিয়া খাতুন (৫০) এর স্বামী আনছার আলি মোড়লকে ২০০৩ সালে সুন্দরবনে মাছ ধরার সময় বাঘে নিয়ে যায়। ৩ ছেলে আর ১ মেয়েকে নিয়ে জন মজুরি দিয়ে চলে তার সংসার। একই অবস্থা বাঘের মুখে প্রাণ হারানো মাকসুদুল সরদারের স্ত্রী হোসনে আরা খাতুনের (৫২)। ২০০০ সালের ফালগুণে তার স্বামীকে বাঘে ধরে নিয়ে যায়। তিনদিন পর জঙ্গল থেকে তার লাশ উদ্ধার হয়। সংসারে ৩ মেয়ে। বেঁচে থাকার লড়াই এ সুন্দরবনে বাঘের মুখে প্রাণ হারানো হোসনে আরার দিন চলে অর্ধাহারে অনাহারে।
গত দশ বছরে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের ৪টি ইউনিয়নে বাঘের আক্রমণে ৩শ’ ২৭ জন জেলে বাওয়ালি, মাওয়ালি নিহত হয়েছে। এ সকল নিহত পরিবারের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয়নি। বিধবা নারীরা জানান, পরিবারের আয়ক্ষম ব্যক্তিটি মারা যাওয়ার পর পরিবারগুলো চরম অসহায় হয়ে পড়ে এবং সামাজিক সংস্কারের কারণে অলক্ষ্মী অপবাদ নিয়ে স্বামীর বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। সুন্দরবনের পশ্চিম বনবিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের আওতায় শ্যামনগর উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের বিধবা পরিবারের সংখ্যা ৩শ’ ২৭ জন। সামাজিক কুসংস্কারের কারণে তারা সমাজে অবহেলিত, নির্যাতিত ও বিতাড়িত। বন বিভাগ ও স্থানীয় একটি বেসরকারী সংস্থা লিডার্স ও ইউনিয়ন পরিষদের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এক জরিপে ২০০০ সাল থেকে জুলাই ২০১০ পর্যন্ত শুধু মাত্র গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনী, মুন্সীগঞ্জ ও রমজাননগর ইউনিয়নে ৩শ’ ২৭ জন মানুষ বাঘের আক্রমণে মারা গেছে বলে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। বিধবা হওয়ার পর সামাজিক কুসংস্কার, পরিবারের অবহেলা, নির্যাতন প্রভৃতি কারণে বাবার বাড়ি, সরকারী খাস জমি, নদীর চরে বসবাস করতে বাধ্য হয় এ সকল অসহায় নারীরা। সেবা প্রদানকারী সংস্থার মধ্যে তৃণমূল পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিনিধিরা সামাজিক সমস্যার কারণে তাদের এড়িয়ে চলেন। ফলে সরকার ও বেসরকারী সহযোগিতা প্রদানের ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দেয়া হয় না না।
বাঘের মুখে প্রাণ হারানো এ সকল অসহায় বিধবাদের দাবি, বন্যপ্রাণী দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ক্ষতিপূরণ প্রদান আইন সংশোধন করে ২০১০-এর পূর্বে যে সকল পরিবারের সদস্য বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে সেসকল পরিবারের সদস্যদের ক্ষতিপূরণ প্রদান ও পুনর্বাসন করার ব্যবস্থা করতে হবে। খাস জমি বন্দোবস্তো নীতিমালা সংশোধন করে সক্ষম পুত্র সন্তান না থাকলেও সব বিধবা পরিবারের খাস জমি পাওয়ার বিধান করার জন্য তারা সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে। সরকারী বেসরকারী নিরাপত্তা বেষ্টনী কার্যক্রমে বিধবা নারীদের অগ্রাধিকার দেয়াসহ সুন্দরবন এলাকায় জন্য বিশেষ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরির দাবি এ সকল অসহায় নারী সদস্যদের।
-মিজানুর রহমান, সাতক্ষীরা
সুন্দরবন সংলগ্ন গাবুরা ইউনিয়নের চাঁদনিমুখা গ্রামের মৃত আক্কাস আলি মোড়লের স্ত্রী আছিয়া খাতুন (৩৫)। স্বামী সুন্দরবনে কাঠ কাটত। কোন কোন সময় মধু সংগ্রহ করত। ২০০২ সালের মার্চে তাঁর স্বামীকে বাঘে ধরে। একদিন পর সে খবর পায়। কিন্তু লাশ পাওয়া যায়না । স্বামী মারা যাওয়ার সময সে ছিল ৫ মাসের অন্তঃসত্তা। স্বামীর মৃত্যুর পর তাকে বাড়ির বাইরে বেরুতে দেয়া হয় না। শ্বশুরবাড়িতে তার যায়গা হয় মাত্র ১০ দিন। অপয়া, অলক্ষ্মী বলে তাকে স্বামীর ভিটে থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। বিচার চেয়ে আবেদন করেছিল স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদে। বিচার মেলেনি। চলে আসে বাবার বাড়িতে। বাঘের মুখে প্রাণ হারানো বাবা সাহেব আলি শেখের ভিটে মাটিতে আশ্রয় নিয়ে সে এখন জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকার যুদ্ধ করছে। ছেলে আছাদুল, আকরাম, আর মেয়ে আঙ্গুরাকে নিয়ে সে এখন সুন্দরবনের নদীতে কাঁকড়া ধরে। বড় ছেলে ইটভাঁটিতে কাজ করে। বাঘের মুখে স্বামী হারানোর ঘটনায় স্থানীয় কদমতলা ফরেস্ট অফিসে নাম জমা দেয়ার পরও সে কোন সাহায্য পায়নি।
শুধু আছিয়া নয়, আছিয়ার মতো বাঘের মুখে প্রাণ হারানো সুন্দরবনের জনপদের কয়েক শ’ নারী বেঁচে থাকার লড়াই-এ সংগ্রাম করছে। বুড়িগোয়ালিনি গ্রামের বাঘের মুকে নিহত মনিরুলের স্ত্রী রোকসানা (২৮)। সুন্দরবনের বয়ারসিং খালে কাঁকড়া ধরার সময় ২০০৮ সালে বাঘের মুখে প্রাণ হারায় তার স্বামী। সংসারে একমাত্র মেয়ে ৫ বছরের সাথীকে নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য সে নদীতে মাছ ধরে। মাছে জন মজুরি দিয়ে চলে তার সংসার। একই বছর সুন্দরবনের মালঞ্চ নদীতে কাঁকড়া ধরার সময় বাঘের মুখে প্রাণ হারায় গাবুরা ইউনিয়নের ডুমুরিয়া গ্রামের ইকবাল খান। স্ত্রী আঞ্জুয়ারা (২৫) ৫ বছরের মেয়ে সোনামনিকে নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য সুন্দরবনের নদীতে চিংড়িপোনা ধরে। বাঘের মুখে স্বামী হারানো ভবেন সরকারের স্ত্রী সোনামনির (৫০) বাড়ি মুন্সীগঞ্জের জেলে পাড়ায়। ২০০২ সালে নদীতে মাছ ধরতে যেয়ে তার স্বামীকে বাঘে নিযে যায়। লাশ পাওয়া যায়নি। ২ ছেলে আর ২ মেয়েকে নিয়ে তার সংসার। সে বাজার ঝাড়ু দেয়। আর ছেলেরা বাবার মতো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদীতে মাছের পোনা ধরে জীবন চালায়। পাশ্বেমারি গ্রামের সুফিয়া খাতুন (৫০) এর স্বামী আনছার আলি মোড়লকে ২০০৩ সালে সুন্দরবনে মাছ ধরার সময় বাঘে নিয়ে যায়। ৩ ছেলে আর ১ মেয়েকে নিয়ে জন মজুরি দিয়ে চলে তার সংসার। একই অবস্থা বাঘের মুখে প্রাণ হারানো মাকসুদুল সরদারের স্ত্রী হোসনে আরা খাতুনের (৫২)। ২০০০ সালের ফালগুণে তার স্বামীকে বাঘে ধরে নিয়ে যায়। তিনদিন পর জঙ্গল থেকে তার লাশ উদ্ধার হয়। সংসারে ৩ মেয়ে। বেঁচে থাকার লড়াই এ সুন্দরবনে বাঘের মুখে প্রাণ হারানো হোসনে আরার দিন চলে অর্ধাহারে অনাহারে।
গত দশ বছরে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের ৪টি ইউনিয়নে বাঘের আক্রমণে ৩শ’ ২৭ জন জেলে বাওয়ালি, মাওয়ালি নিহত হয়েছে। এ সকল নিহত পরিবারের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয়নি। বিধবা নারীরা জানান, পরিবারের আয়ক্ষম ব্যক্তিটি মারা যাওয়ার পর পরিবারগুলো চরম অসহায় হয়ে পড়ে এবং সামাজিক সংস্কারের কারণে অলক্ষ্মী অপবাদ নিয়ে স্বামীর বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। সুন্দরবনের পশ্চিম বনবিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের আওতায় শ্যামনগর উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের বিধবা পরিবারের সংখ্যা ৩শ’ ২৭ জন। সামাজিক কুসংস্কারের কারণে তারা সমাজে অবহেলিত, নির্যাতিত ও বিতাড়িত। বন বিভাগ ও স্থানীয় একটি বেসরকারী সংস্থা লিডার্স ও ইউনিয়ন পরিষদের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এক জরিপে ২০০০ সাল থেকে জুলাই ২০১০ পর্যন্ত শুধু মাত্র গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনী, মুন্সীগঞ্জ ও রমজাননগর ইউনিয়নে ৩শ’ ২৭ জন মানুষ বাঘের আক্রমণে মারা গেছে বলে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। বিধবা হওয়ার পর সামাজিক কুসংস্কার, পরিবারের অবহেলা, নির্যাতন প্রভৃতি কারণে বাবার বাড়ি, সরকারী খাস জমি, নদীর চরে বসবাস করতে বাধ্য হয় এ সকল অসহায় নারীরা। সেবা প্রদানকারী সংস্থার মধ্যে তৃণমূল পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিনিধিরা সামাজিক সমস্যার কারণে তাদের এড়িয়ে চলেন। ফলে সরকার ও বেসরকারী সহযোগিতা প্রদানের ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দেয়া হয় না না।
বাঘের মুখে প্রাণ হারানো এ সকল অসহায় বিধবাদের দাবি, বন্যপ্রাণী দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ক্ষতিপূরণ প্রদান আইন সংশোধন করে ২০১০-এর পূর্বে যে সকল পরিবারের সদস্য বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে সেসকল পরিবারের সদস্যদের ক্ষতিপূরণ প্রদান ও পুনর্বাসন করার ব্যবস্থা করতে হবে। খাস জমি বন্দোবস্তো নীতিমালা সংশোধন করে সক্ষম পুত্র সন্তান না থাকলেও সব বিধবা পরিবারের খাস জমি পাওয়ার বিধান করার জন্য তারা সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে। সরকারী বেসরকারী নিরাপত্তা বেষ্টনী কার্যক্রমে বিধবা নারীদের অগ্রাধিকার দেয়াসহ সুন্দরবন এলাকায় জন্য বিশেষ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরির দাবি এ সকল অসহায় নারী সদস্যদের।
-মিজানুর রহমান, সাতক্ষীরা
No comments