ট্রানজিট রুট বাংলাদেশ-হেরোইন-কোকেনের ট্রানজিট বাণিজ্যে জড়িত বিদেশিরা by এস এম আজাদ
প্রচলিত মাদকদ্রব্য হেরোইন ও স্বল্প
প্রচলিত কোকেন পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বাংলাদেশকে।
পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে হেরোইনের চালান বাংলাদেশে নিয়ে আসছে
আন্তর্জাতিক মাদক ব্যবসায়ী চক্র।
এরপর চালান পাঠানো হচ্ছে
যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশে। আর কোকেনের চালান আসছে ল্যাটিন আমেরিকার
বিভিন্ন দেশ থেকে। বাংলাদেশে হেরোইন ও কোকেনের এ 'ট্রানজিট বাণিজ্যে'
জড়িতরা বেশির ভাগই বিদেশি। পাকিস্তানি ও নাইজেরিয়ানরা এ ক্ষেত্রে এগিয়ে।
সাম্প্রতিক সময়ে কোকেনের সবচেয়ে বড় চালান এবং হেরোইনের কয়েকটি চালান আটক
করার পর এমন অনেক তথ্য পেয়েছে আইন প্রয়োগকারী কয়েকটি সংস্থা।
একাধিক গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, মাল্টিপল ভিসা ও ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে এসে হেরোইন ও কোকেন পাচার করছে কিছু পাকিস্তানি মাদক ব্যবসায়ী। একইভাবে কিছু নাইজেরিয়ান ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও গোপনে চালিয়ে যাচ্ছে কারবার। বেশির ভাগ চালান আনা-নেওয়া করা হচ্ছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে। কয়েকজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, পাকিস্তানি রুটে হেরোইন ও কোকেনের ট্রানজিট বাণিজ্য বন্ধ করতে ইতিমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে মাঠে নেমেছে গোয়েন্দারা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইকবাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পাকিস্তানসহ কয়েকটি দেশের নাগরিকদের হেরোইন ও কোকেন বাণিজ্যের তৎপরতা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। গত বছরই আমরা এসব বিষয় খতিয়ে দেখতে কাজ শুরু করি। এখন আমরা পাকিস্তানি দূতাবাসের মাধ্যমে সে দেশের অ্যান্টি নারকোটিকস ফোর্সের সহায়তায় কাজ করছি।'
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এ টি এম হাবিবুর রহমান বলেন, 'বিদেশি মাদক পাচারকারীরা বাংলাদেশকে ব্যবহার করছে ট্রানজিট রুট হিসেবে। র্যাবের নিজস্ব গোয়েন্দা তৎপরতার নজরদারির মাধ্যমে সর্বশেষ উত্তরা থেকে আড়াই কেজি হেরোইনসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগেও র্যাব এমন চালান ধরেছে।'
জানা গেছে, গত মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর বারিধারায় অভিযান চালিয়ে কোকেন বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগে পাকিস্তানি নাগরিক মোস্তফা আশরাফ ও শামসুল হককে গ্রেপ্তার করে ডিএনসি। অভিযানে সন্দেহভাজন হিসেবে সাবরিনা ও সাদিয়া নামের দুই বাংলাদেশিকেও গ্রেপ্তার করা হয়। চারজনকেই এক দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ডিএনসির কর্মকর্তারা জানান, গত ১১ জুন কারওয়ান বাজারের হোটেল লা-ভিঞ্চি থেকে পেরুর নাগরিক হুয়ান পাবলো রাফায়েল জাগাজিটাকে তিন কেজি কোকেনসহ গ্রেপ্তার করা হয়। এটি বাংলাদেশে আটক হওয়া কোকেনের সবচেয়ে বড় চালান। তিন কেজি কোকেনের আর্থিক মূল্য প্রায় ৬০ কোটি টাকা। গত রবিবার পাবলো আদালতে ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। সে ডিএনসি কর্মকর্তাদের জানায়, কোকেনের পরবর্তী গন্তব্য ছিল পাকিস্তান। এ তথ্যের ভিত্তিতে দুই পাকিস্তানিকে শনাক্ত করে ডিএনসি। পাবলোর বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণপত্রটি পাঠানো হয় গ্রেপ্তার হওয়া পাকিস্তানিদের প্রতিষ্ঠান থেকেই। মোস্তফা ও শামসুল বাংলাদেশে কাপড় ও সুতার ব্যবসার আড়ালে মাদকের সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। গ্রেপ্তারকৃতরা আগে 'ক্রস ওসান প্রাইভেট লিমিটেড' নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যবসা করত। বর্তমানে তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম 'সাদিক অ্যান্ড সন্স'।
সূত্র জানায়, মোস্তফার বাবা আশরাফ নাসিম দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করছিল। গত ১১ জুন পাবলো গ্রেপ্তারের দিনই সে পাকিস্তানে চলে যায়। সাদিক নামের এক বাংলাদেশি তার ব্যবসার অংশীদার। তাদের প্রতিষ্ঠান ২০১০ সাল থেকে অনেককেই আমন্ত্রণপত্র পাঠায়। হোটেল লা-ভিঞ্চিতে পাবলোর কক্ষটি লন্ডন থেকে আগেই বুকিং দেওয়া হয়।
ডিএনসি সূত্র জানায়, ২০০০ সাল থেকে হোমিও চিকিৎসক শামসুল হক ও আশরাফ নাসিম বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করছে। ধারণা করা হচ্ছে, তাদের প্রতিষ্ঠানের বর্তমান কর্মী সাবরিনা ও সাবেক কর্মী সাদিয়া মাদক পাচারের সঙ্গে যুক্ত। পাবলো তার জবানবন্দিতে জানিয়েছে, হোটেলে গিয়ে এক মোটা নারী তার কাছ থেকে কোকেনের প্যাকেট নিয়ে যাবে বলেই নির্দেশনা ছিল।
ডিএনসির ঢাকা মেট্রো উপ-অঞ্চলের উপপরিচালক আলী আসলাম হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কোকেন বাণিজ্যের সিন্ডিকেটে পাকিস্তানিসহ বড় চক্র জড়িত। আমরা তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়েই রয়েছি।'
সূত্র জানায়, গত বছরের ১৬ মে বনানীর প্যাসিফিক ইন ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে আইকেমি চিজোবা বেতসি নামের এক নাইজেরিয়ান নারীকে আটকের পর তার পেট থেকে ৪৫০ গ্রাম কোকেন বের করা হয়। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বেতসি বলেছে, আফ্রিকার দেশ ক্যামেরুন থেকে সে ওই কোকেন নিয়ে এসেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতেই কয়েক দিন থেকে এসব কোকেন সে পাকস্থলীতে বহন করছিল। বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কাজী মাইনুল হোসেন বলেন, বাংলাদেশে অবস্থানকারী একজন মাদক ব্যবসায়ীর কাছে ওই কোকেন পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল। বেতসি গত বছরের ৩০ এপ্রিল, ১০ মে ও ১৪ মে তিনবার কোকেন নিয়ে বাংলাদেশে আসে।
ডিএনসির কর্মকর্তারা জানান, বিশ্বের ৮০ শতাংশ কোকেন উৎপাদনকারী দেশ ল্যাটিন আমেরিকার কলম্বিয়া। বাকি ২০ শতাংশ উৎপাদিত হয় পাশের পেরু ও বলিভিয়ায়। সন্দেহমুক্ত থেকে ইউরোপে পাচারের জন্যই এই মাদক বাংলাদেশে আনা হচ্ছে। বিশ্বে মাদক প্রস্তুত ও পাচারকারী দেশ হিসেবে সন্দেহের তালিকায় বাংলাদেশ নেই।
হেরোইনের কারবার : জানা গেছে, সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার উত্তরার একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে দুই কেজি হেরোইন, দুই হাজার নকল ডলার ও গাড়িসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-১। এই চক্রের হোতা নাইজেরিয়ার নাগরিক অনিকা গডসন বামালো। র্যাব-১-এর অধিনায়ক কিসমত হায়াৎ বলেন, এই চক্র দীর্ঘদিন ধরে আফগানিস্তান ও ভারত হয়ে বাংলাদেশে হেরোইন আনছে।
এর আগে দুই কেজি হেরোইনসহ আকমল ও তাহির রিয়াজ নামের দুই পাকিস্তানি নাগরিককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। একই ঘটনায় উত্তরা এলাকা থেকে শওকত নামের আরেক পাকিস্তানিকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত ১১ মার্চ গুলশান থানায় মামলা দায়ের করার পর ১৪ মার্চ থেকে প্রথম দুই আসামিকে পাঁচ দিনের এবং ৩০ মার্চ থেকে শওকতকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গুলশান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মনির হোসেন কালের কণ্ঠকে জানান, গত ২ মার্চ বনানী ব্রিজের কাছে সন্দেহভাজন হিসেবে দুই পাকিস্তানিকে ১৭২টি শটগানের গুলির মতো রোলসহ গ্রেপ্তার করা হয়। আলামতগুলো সিআইডির পরীক্ষাগারে পরীক্ষার পর গত ১০ মার্চ প্রতিবেদনে জানানো হয়, রোলগুলোর মধ্যে বিশেষ কৌশলে রাখা উপাদানগুলো হেরোইন। জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা জানায়, মাল্টিপল ভিসায় আকমল ৯ বার ও রিয়াজ পাঁচবার বাংলাদেশ সফর করেছে। তারা বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে হেরোইন ব্যবসা চালানোর কথাও স্বীকার করেছে। গত ১ মার্চ তারা দুবাই হয়ে বাংলাদেশে আসে। আর শওকত বাংলাদেশে আসে ৫ মার্চ।
সূত্র জানায়, গত ২২ ফেব্রুয়ারি উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর রোডের ৫৪ নম্বর বাড়ির এ/৩ নম্বর ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে দুই কেজি ৭০০ গ্রাম হেরোইনসহ ছয় নাইজেরিয়ান নাগরিককে গ্রেপ্তার করে র্যাব-১। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো এমেকা, কসমস, চুকওমেকা স্যামুয়েল, একানা কে সি, ম্যাক ও চেলে ইকেনা। আসামিদের তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি খন্দকার রেজাউল হাসান কালের কণ্ঠকে জানান, আফগানিস্তান থেকে তারা হেরোইন সংগ্রহ করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। সেখান থেকে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে ঢাকায় আনে। জিজ্ঞাসাবাদে আসামিদের কাছ থেকে ঢাকার মাদক ব্যবসার গডফাদারসহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। ওসি আরো বলেন, 'আসামিরা ভ্রমণ ভিসায় ৩০ দিনের জন্য ঢাকায় এসে আর ফেরত যায়নি। এক সপ্তাহে তারা হেরোইনের তিনটি চালান ঢাকায় আনে। এক সপ্তাহ পর আরো একটি চালান আনার পরিকল্পনা ছিল।' ওসি রেজাউল হাসান জানান, উত্তরা এলাকা থেকে এক বছরে শতাধিক নাইজেরিয়া ও ঘানার নাগরিককে মাদকসহ বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের অন্তত ৪০ জনের ভিসার মেয়াদ ছিল না।
পাচারে বিমানবন্দর ব্যবহার : হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে দায়িত্বরত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ও ইমিগ্রেশন পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, গত পাঁচ বছরে বিমানবন্দর ব্যবহার করে হেরোইন বাণিজ্যের প্রবণতা ধরা পড়েছে। সর্বশেষ গত ২৭ ফেব্রয়ারি বিমানবন্দর থেকে ১০ কেজি হেরোইনসহ হারুন ও আলন বক্স নামের দুই পাকিস্তানি নাগরিককে গ্রেপ্তার করে এপবিএন। তারা জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, চট্টগ্রামের ড. শামসাদের নামে হেরোইনের চালান আনা হয়েছে। হারুন ১৭ বার এবং আলন বক্স পাঁচবার বাংলাদেশ হয়ে যাতায়াত করে বলে তাদের পাসপোর্ট থেকে নিশ্চিত হয় পুলিশ। সূত্র জানায়, দায়িত্বশীলদের সঙ্গে আঁতাত করেই মাদকের চালান পাচার হয়। জিজ্ঞাসাবাদে পেরুর নাগরিক পাবলো জানিয়েছে, ভ্রমণ ভিসায় বিমানবন্দরে নামার পর তাকে তল্লাশি করা হয়নি। এ জন্য সে ৪০ ডলার ঘুষ দিয়েছে বলেও দাবি করেছে।
এপিবিএনের সহকারী পুলিশ সুপার মনিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে জানান, গত বছর হেরোইনসদৃশ ইয়াবার কাঁচামালের ২৬ কেজির একটি চালান আটক করেন তাঁরা। ২০১১ সালের ১৮ আগস্ট বিমানবন্দর থেকে ২০ কেজি হেরোইন উদ্ধার করা হয়। ওই হেরোইন ওয়াটার হিটারে (পানি গরম করার যন্ত্র) বহন করা হচ্ছিল। একই সময়ে বিমানবন্দর এলাকায় বাজারের ব্যাগ থেকে এক কেজি হেরোইনসহ দুই মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই বছর ছয় কেজি হেরোইনসহ তিন নাইজেরিয়ানকেও গ্রেপ্তার করে এপিবিএন।
একাধিক গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, মাল্টিপল ভিসা ও ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে এসে হেরোইন ও কোকেন পাচার করছে কিছু পাকিস্তানি মাদক ব্যবসায়ী। একইভাবে কিছু নাইজেরিয়ান ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও গোপনে চালিয়ে যাচ্ছে কারবার। বেশির ভাগ চালান আনা-নেওয়া করা হচ্ছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে। কয়েকজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, পাকিস্তানি রুটে হেরোইন ও কোকেনের ট্রানজিট বাণিজ্য বন্ধ করতে ইতিমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে মাঠে নেমেছে গোয়েন্দারা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইকবাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'পাকিস্তানসহ কয়েকটি দেশের নাগরিকদের হেরোইন ও কোকেন বাণিজ্যের তৎপরতা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। গত বছরই আমরা এসব বিষয় খতিয়ে দেখতে কাজ শুরু করি। এখন আমরা পাকিস্তানি দূতাবাসের মাধ্যমে সে দেশের অ্যান্টি নারকোটিকস ফোর্সের সহায়তায় কাজ করছি।'
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এ টি এম হাবিবুর রহমান বলেন, 'বিদেশি মাদক পাচারকারীরা বাংলাদেশকে ব্যবহার করছে ট্রানজিট রুট হিসেবে। র্যাবের নিজস্ব গোয়েন্দা তৎপরতার নজরদারির মাধ্যমে সর্বশেষ উত্তরা থেকে আড়াই কেজি হেরোইনসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগেও র্যাব এমন চালান ধরেছে।'
জানা গেছে, গত মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর বারিধারায় অভিযান চালিয়ে কোকেন বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগে পাকিস্তানি নাগরিক মোস্তফা আশরাফ ও শামসুল হককে গ্রেপ্তার করে ডিএনসি। অভিযানে সন্দেহভাজন হিসেবে সাবরিনা ও সাদিয়া নামের দুই বাংলাদেশিকেও গ্রেপ্তার করা হয়। চারজনকেই এক দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ডিএনসির কর্মকর্তারা জানান, গত ১১ জুন কারওয়ান বাজারের হোটেল লা-ভিঞ্চি থেকে পেরুর নাগরিক হুয়ান পাবলো রাফায়েল জাগাজিটাকে তিন কেজি কোকেনসহ গ্রেপ্তার করা হয়। এটি বাংলাদেশে আটক হওয়া কোকেনের সবচেয়ে বড় চালান। তিন কেজি কোকেনের আর্থিক মূল্য প্রায় ৬০ কোটি টাকা। গত রবিবার পাবলো আদালতে ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। সে ডিএনসি কর্মকর্তাদের জানায়, কোকেনের পরবর্তী গন্তব্য ছিল পাকিস্তান। এ তথ্যের ভিত্তিতে দুই পাকিস্তানিকে শনাক্ত করে ডিএনসি। পাবলোর বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণপত্রটি পাঠানো হয় গ্রেপ্তার হওয়া পাকিস্তানিদের প্রতিষ্ঠান থেকেই। মোস্তফা ও শামসুল বাংলাদেশে কাপড় ও সুতার ব্যবসার আড়ালে মাদকের সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। গ্রেপ্তারকৃতরা আগে 'ক্রস ওসান প্রাইভেট লিমিটেড' নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যবসা করত। বর্তমানে তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম 'সাদিক অ্যান্ড সন্স'।
সূত্র জানায়, মোস্তফার বাবা আশরাফ নাসিম দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করছিল। গত ১১ জুন পাবলো গ্রেপ্তারের দিনই সে পাকিস্তানে চলে যায়। সাদিক নামের এক বাংলাদেশি তার ব্যবসার অংশীদার। তাদের প্রতিষ্ঠান ২০১০ সাল থেকে অনেককেই আমন্ত্রণপত্র পাঠায়। হোটেল লা-ভিঞ্চিতে পাবলোর কক্ষটি লন্ডন থেকে আগেই বুকিং দেওয়া হয়।
ডিএনসি সূত্র জানায়, ২০০০ সাল থেকে হোমিও চিকিৎসক শামসুল হক ও আশরাফ নাসিম বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করছে। ধারণা করা হচ্ছে, তাদের প্রতিষ্ঠানের বর্তমান কর্মী সাবরিনা ও সাবেক কর্মী সাদিয়া মাদক পাচারের সঙ্গে যুক্ত। পাবলো তার জবানবন্দিতে জানিয়েছে, হোটেলে গিয়ে এক মোটা নারী তার কাছ থেকে কোকেনের প্যাকেট নিয়ে যাবে বলেই নির্দেশনা ছিল।
ডিএনসির ঢাকা মেট্রো উপ-অঞ্চলের উপপরিচালক আলী আসলাম হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কোকেন বাণিজ্যের সিন্ডিকেটে পাকিস্তানিসহ বড় চক্র জড়িত। আমরা তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়েই রয়েছি।'
সূত্র জানায়, গত বছরের ১৬ মে বনানীর প্যাসিফিক ইন ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে আইকেমি চিজোবা বেতসি নামের এক নাইজেরিয়ান নারীকে আটকের পর তার পেট থেকে ৪৫০ গ্রাম কোকেন বের করা হয়। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বেতসি বলেছে, আফ্রিকার দেশ ক্যামেরুন থেকে সে ওই কোকেন নিয়ে এসেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতেই কয়েক দিন থেকে এসব কোকেন সে পাকস্থলীতে বহন করছিল। বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কাজী মাইনুল হোসেন বলেন, বাংলাদেশে অবস্থানকারী একজন মাদক ব্যবসায়ীর কাছে ওই কোকেন পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল। বেতসি গত বছরের ৩০ এপ্রিল, ১০ মে ও ১৪ মে তিনবার কোকেন নিয়ে বাংলাদেশে আসে।
ডিএনসির কর্মকর্তারা জানান, বিশ্বের ৮০ শতাংশ কোকেন উৎপাদনকারী দেশ ল্যাটিন আমেরিকার কলম্বিয়া। বাকি ২০ শতাংশ উৎপাদিত হয় পাশের পেরু ও বলিভিয়ায়। সন্দেহমুক্ত থেকে ইউরোপে পাচারের জন্যই এই মাদক বাংলাদেশে আনা হচ্ছে। বিশ্বে মাদক প্রস্তুত ও পাচারকারী দেশ হিসেবে সন্দেহের তালিকায় বাংলাদেশ নেই।
হেরোইনের কারবার : জানা গেছে, সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার উত্তরার একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে দুই কেজি হেরোইন, দুই হাজার নকল ডলার ও গাড়িসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-১। এই চক্রের হোতা নাইজেরিয়ার নাগরিক অনিকা গডসন বামালো। র্যাব-১-এর অধিনায়ক কিসমত হায়াৎ বলেন, এই চক্র দীর্ঘদিন ধরে আফগানিস্তান ও ভারত হয়ে বাংলাদেশে হেরোইন আনছে।
এর আগে দুই কেজি হেরোইনসহ আকমল ও তাহির রিয়াজ নামের দুই পাকিস্তানি নাগরিককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। একই ঘটনায় উত্তরা এলাকা থেকে শওকত নামের আরেক পাকিস্তানিকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত ১১ মার্চ গুলশান থানায় মামলা দায়ের করার পর ১৪ মার্চ থেকে প্রথম দুই আসামিকে পাঁচ দিনের এবং ৩০ মার্চ থেকে শওকতকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গুলশান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মনির হোসেন কালের কণ্ঠকে জানান, গত ২ মার্চ বনানী ব্রিজের কাছে সন্দেহভাজন হিসেবে দুই পাকিস্তানিকে ১৭২টি শটগানের গুলির মতো রোলসহ গ্রেপ্তার করা হয়। আলামতগুলো সিআইডির পরীক্ষাগারে পরীক্ষার পর গত ১০ মার্চ প্রতিবেদনে জানানো হয়, রোলগুলোর মধ্যে বিশেষ কৌশলে রাখা উপাদানগুলো হেরোইন। জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা জানায়, মাল্টিপল ভিসায় আকমল ৯ বার ও রিয়াজ পাঁচবার বাংলাদেশ সফর করেছে। তারা বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে হেরোইন ব্যবসা চালানোর কথাও স্বীকার করেছে। গত ১ মার্চ তারা দুবাই হয়ে বাংলাদেশে আসে। আর শওকত বাংলাদেশে আসে ৫ মার্চ।
সূত্র জানায়, গত ২২ ফেব্রুয়ারি উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর রোডের ৫৪ নম্বর বাড়ির এ/৩ নম্বর ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে দুই কেজি ৭০০ গ্রাম হেরোইনসহ ছয় নাইজেরিয়ান নাগরিককে গ্রেপ্তার করে র্যাব-১। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো এমেকা, কসমস, চুকওমেকা স্যামুয়েল, একানা কে সি, ম্যাক ও চেলে ইকেনা। আসামিদের তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি খন্দকার রেজাউল হাসান কালের কণ্ঠকে জানান, আফগানিস্তান থেকে তারা হেরোইন সংগ্রহ করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। সেখান থেকে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে ঢাকায় আনে। জিজ্ঞাসাবাদে আসামিদের কাছ থেকে ঢাকার মাদক ব্যবসার গডফাদারসহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। ওসি আরো বলেন, 'আসামিরা ভ্রমণ ভিসায় ৩০ দিনের জন্য ঢাকায় এসে আর ফেরত যায়নি। এক সপ্তাহে তারা হেরোইনের তিনটি চালান ঢাকায় আনে। এক সপ্তাহ পর আরো একটি চালান আনার পরিকল্পনা ছিল।' ওসি রেজাউল হাসান জানান, উত্তরা এলাকা থেকে এক বছরে শতাধিক নাইজেরিয়া ও ঘানার নাগরিককে মাদকসহ বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের অন্তত ৪০ জনের ভিসার মেয়াদ ছিল না।
পাচারে বিমানবন্দর ব্যবহার : হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে দায়িত্বরত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ও ইমিগ্রেশন পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, গত পাঁচ বছরে বিমানবন্দর ব্যবহার করে হেরোইন বাণিজ্যের প্রবণতা ধরা পড়েছে। সর্বশেষ গত ২৭ ফেব্রয়ারি বিমানবন্দর থেকে ১০ কেজি হেরোইনসহ হারুন ও আলন বক্স নামের দুই পাকিস্তানি নাগরিককে গ্রেপ্তার করে এপবিএন। তারা জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, চট্টগ্রামের ড. শামসাদের নামে হেরোইনের চালান আনা হয়েছে। হারুন ১৭ বার এবং আলন বক্স পাঁচবার বাংলাদেশ হয়ে যাতায়াত করে বলে তাদের পাসপোর্ট থেকে নিশ্চিত হয় পুলিশ। সূত্র জানায়, দায়িত্বশীলদের সঙ্গে আঁতাত করেই মাদকের চালান পাচার হয়। জিজ্ঞাসাবাদে পেরুর নাগরিক পাবলো জানিয়েছে, ভ্রমণ ভিসায় বিমানবন্দরে নামার পর তাকে তল্লাশি করা হয়নি। এ জন্য সে ৪০ ডলার ঘুষ দিয়েছে বলেও দাবি করেছে।
এপিবিএনের সহকারী পুলিশ সুপার মনিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে জানান, গত বছর হেরোইনসদৃশ ইয়াবার কাঁচামালের ২৬ কেজির একটি চালান আটক করেন তাঁরা। ২০১১ সালের ১৮ আগস্ট বিমানবন্দর থেকে ২০ কেজি হেরোইন উদ্ধার করা হয়। ওই হেরোইন ওয়াটার হিটারে (পানি গরম করার যন্ত্র) বহন করা হচ্ছিল। একই সময়ে বিমানবন্দর এলাকায় বাজারের ব্যাগ থেকে এক কেজি হেরোইনসহ দুই মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই বছর ছয় কেজি হেরোইনসহ তিন নাইজেরিয়ানকেও গ্রেপ্তার করে এপিবিএন।
No comments