তামিমের বিয়ে by বিশ্বজিৎ চৌধুরী
‘জানি, আজ তামিমের বিয়ে। কার সঙ্গে হচ্ছে
যেন বিয়েটা?’—অনেক তরুণীর প্রশ্ন এটা। প্রশ্নটা শোনা যায়, দীর্ঘশ্বাসটা
শোনা যায় না, সেটা চাপা থাকে বুকের ভেতরে।
তামিম ইকবালের
বিয়ে হচ্ছে আয়েশার সঙ্গে। ক্রিকেট নিয়ে তেমন আগ্রহ নেই, কদিন আগেও খেলাটির
আগা-মাথাই বুঝতেন না, তবু তাঁর সঙ্গেই বিয়ে হচ্ছে বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে
মারকুটে ব্যাটসম্যানটির। কেন?
মনস্তাত্ত্বিকেরা কী বলবেন জানি না, তবে আমাদের ধারণা, সারা দিন ক্রিকেটের মধ্যে ডুবে থাকা মানুষটি বুঝি খুঁজে বেড়ান এমন একজনকে, যাঁর সান্নিধ্য পেলে ক্রিকেট থেকে আলাদা করে নেওয়া যাবে কিছুটা সময়। নইলে লক্ষ-কোটি হূদয়ে ঝড় তোলা শচীন টেন্ডুলকার কেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্রী অঞ্জলীর প্রেমে পড়েছিলেন, যাঁর ক্রিকেট-জ্ঞান প্রায় শূন্য, এমনকি ‘মাস্টার ব্লাস্টার’কে নিয়েও যাঁর মধ্যে ছিল না কোনো কৌতূহল বা বিস্ময়!
তামিম ইকবাল বললেন, ‘বউ ক্রিকেট খেলা না বুঝলেই ভালো। কোনো দিন মাঠে খারাপ করলে দর্শকদের দুয়োধ্বনি শুনে ঘরে ফিরে বউয়ের কাছেও নিন্দা-মন্দ শুনতে কার ভালো লাগবে, বলুন? তার চেয়ে মাঠ আর ঘর আলাদা হয়েই থাকুক।’
তা থাকুক। কিন্তু এমন ক্রিকেটবিমুখ মানুষটির সন্ধান পেলেন কোথায়?
তামিম হাসেন, চোখে কি ভিড় করে এল নানা রঙের স্মৃতি, যে স্মৃতি সতত সুখের? বললেন, ‘সে অনেক কথা।’
অনেক কথার সব তো আর পাঠককে জানানো যাবে না। তবে এটুকু জানানো যাক, দীর্ঘ আট বছর ধরে প্রেমের পথে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ এখানে আসা।
একটু একটু প্রেমের গল্প
আয়েশা সিদ্দিকা তখন চট্টগ্রাম সানশাইন গ্রামার স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী, এক অনুষ্ঠানে তাঁকে দেখেছিলেন একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ‘এ’ লেভেলের ছাত্র তামিম ইকবাল। দেখেই কুপোকাত, যাকে বলে ‘লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’। এক বান্ধবীকে দিয়ে আয়েশার কাছে মনের কথা, ভালোবাসার কথা বলে পাঠালেন তামিম। শুনেই যাকে বলে পত্রপাঠ বিদায়। আয়েশা বলেছিলেন, ‘লাভ? আই হেইট দ্য ওয়ার্ড—লাভ!’ এ রকম প্রত্যাখ্যানের পর ভালোবাসা যে আরও বাড়ে, এটা গুণীজনেরা বলেন। তামিমেরও তা-ই হলো, লেগে রইলেন। ফোন করে, স্কুলের আঙিনায় নানাভাবে বুঝিয়ে তুলে ধরতে চেষ্টা করলেন হূদয়ের আকুতি। ফলাফল শূন্য।
‘সব চেষ্টা বিফলে যাওয়ার পর একদিন বললাম, আমরা অন্তত বন্ধু তো হতে পারি? এই প্রস্তাবে কাজ হলো। এ রকম নির্দোষ একটি প্রস্তাবে রাজি হয়েই বেচারি ফেঁসে গেল। বন্ধুত্বের পর্বে আমাকে জানার সুযোগ হলো তার, দেখল যত খারাপ ভেবেছিল তত খারাপ মানুষ নই আমি...এবার টোপটা গিলে ফেলল...হা হা হা।’
চট্টগ্রামের রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে, প্রেম-পর্ব চালিয়ে যেতে অসুবিধা হয়নি কোনো?
‘হয়নি আবার! স্কুলে যাওয়ার সময় সঙ্গে কেউ থাকে, কোচিং সেন্টারে যাওয়ার সময়ও আছে কেউ না কেউ, বাসার সামনে দারোয়ান জামালের প্রহরা এমনই নিশ্ছিদ্র, তামিম তো দূরের কথা, একটা মাছি যাওয়ারও উপায় নেই। ফোনে কথা বলাটাই একমাত্র ভরসা, তা-ও তো একবার ধরা পড়ে গেলাম।’
সেটা কেমন?
‘একবার একটা এসএমএস পাঠিয়েছিলাম। সেটা দেখে ফেলেছিলেন বাড়ির লোকজন। ব্যস, বাজেয়াপ্ত হয়ে গেল তার সেলফোন। আর কোনো যোগাযোগ নেই। কী হয়েছে আমি তো আর জানি না, কেন সব যোগাযোগ বন্ধ। কী যে অস্থিরতার মধ্যে কেটেছে কয়েকটা দিন। শেষে একদিন ফোন এল। আমি তখন আমার এক বন্ধুর গাড়িতে, চলন্ত গাড়ি থেকেই লাফ দিয়ে নেমেছি রাস্তায়। তার সব দুর্ভোগের কথা শুনলাম। জানা গেল, আপাতত ফাঁড়া কেটেছে। সে দিনটি ছিল কী সুখের দিন!’
তার মানে, অনেক বিড়ম্বনা সইতে হয়েছে?
‘একেবারে ফিল্মের মতো। ওকে টুকটাক উপহার দিতে চাইতাম, সোজা রাস্তায় তারও উপায় নেই। বাঁকা পথ ধরতে হলো, ফোনে আগেই কথা থাকত, দেয়ালের ওপার থেকে ওদের ব্যালকনিতে ছুড়ে দিতাম...।’
কী ধরনের উপহার দিতেন?
‘বেশির ভাগ সময়েই পারফিউম। এখানেও একটা মজার কাহিনি আছে। তখন তো টাকাপয়সা ছিল না তেমন, ছোট বোন উরুসার আলমারি থেকে ওর পারফিউম চুরি করতাম। আমার খালা বিদেশ থেকে পারফিউম পাঠাতেন ওর জন্য, আমি সেখান থেকে...।’
ধরা পড়েননি কখনো?
‘না। সন্দেহটা ছিল আমার ওপরই, কিন্তু প্রমাণ তো নেই। হা হা হা। তবে এখন সেটা শোধ দিচ্ছি সুদে-আসলে। এখনো দেশের বাইরে গেলে পারফিউম নিয়ে আসি ছোট বোনের জন্য।’
আয়েশার পরিবারে এই প্রেম নিয়ে নানা সমস্যা হলেও তামিমের পরিবারে কিন্তু ব্যাপারটা মোটেই ও রকম ছিল না। মা নুসরাত ইকবালকে কখনো কিছু লুকাননি তামিম, এই সম্পর্কের কথাও তাই অকপটে জানিয়েছিলেন। তিনি শুধু বলেছিলেন, ভালো পরিবারের মেয়ে হলে তাঁর কোনো আপত্তি নেই। তামিম বলেন, ‘বাবা তো মারা গেছেন অনেক আগে, তাই মা-ই আমাদের সবকিছু, মা আমাদের অভিভাবক যেমন, আবার তেমনি ভালো বন্ধুও।’
ক্রীড়া পরিবার
মা-বাবার কথা যখন এলই, তামিমের পরিবার নিয়েও কিছু বলা যাক। তামিমের বাবা ইকবাল খান ছিলেন নামী ফুটবলার। নিজে খেলেছেন, আবার কোচ হিসেবে তাঁর হাতেই গড়ে উঠেছেন অনেক নামী ফুটবলার। জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আশীষ ভদ্র, সত্যজিৎ দাশ রুপুরা তো বেড়ে উঠেছিলেন তাঁর হাত ধরেই। ‘কেকেআরসি’ নামের একটি ফুটবল দল গড়ে তুলেছিলেন তিনি, পরপর কয়েক বছর চট্টগ্রাম ফুটবল লিগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল এই দল। পরে এই ‘কেকেআরসি’ চট্টগ্রামে আবাহনী ক্রীড়া চক্রে রূপান্তরিত হয়। নিজে ফুটবল খেললেও তিনি চাইতেন পরিবারের অন্যরা ক্রিকেটে মনোযোগ দিক। তাঁর চাওয়া যে পূর্ণ হয়েছিল, তার প্রমাণ তো ছোট ভাই আকরাম খান আর বড় ছেলে নাফিস ইকবাল।
তামিম বললেন, ‘এমন এক পরিবারে জন্মেছি, ক্রিকেটার না হওয়ার যেন উপায়ই ছিল না। ভেবে দেখুন, আমার যখন আট বছর বয়স, তখন চাচা আকরাম খানের নেতৃত্বে মালয়েশিয়ার আইসিসি ট্রফি জিতল বাংলাদেশ, সেদিন আমাদের কাজীর দেউড়ির বাড়িতে চট্টগ্রাম শহরের মানুষ ভেঙে পড়েছিল, সে কী রং ছোড়াছুড়ি! কম বয়সে এ রকম সব ঘটনা ঘটলে তার প্রভাব এড়ানো কি সম্ভব? চাচা আকরাম খানকে দেখেছি, বড় ভাই নাফিস ইকবালকে দেখেছি, তখন থেকেই আমার ভেতরে ক্রিকেটার হওয়ার অদম্য বাসনার জন্ম হয়েছে।’
একটি অসাধারণ ঘটনার কথা বললেন তামিম। কী একটা অসুখের কারণে তখন তাঁর বাবা ইকবাল খানের একটা পা কেটে বাদ দিতে হয়েছে অস্ত্রোপচার করে। কিন্তু তীব্র রোদের মধ্যে ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে তিনি আম্পায়ারিং করতেন মাঠে, ছেলেদের খেলা দেখতেন, ঘরে ফিরে ভুল-ত্রুটির কথা তুলে কীভাবে শোধরাতে হবে, তার পরামর্শ দিতেন। এই পরিবারের ছেলের খেলোয়াড় না হয়ে আর কীই-বা হওয়ার ছিল?
চাচা আকরাম খানের কথাও তুললেন। একবার ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে খেলার জন্য একটি ক্লাবের সঙ্গে কথাবার্তা চূড়ান্ত হলো। কিন্তু শেষ দিন কথা রাখলেন না ক্লাবের কর্মকর্তারা, তামিমের সঙ্গে চুক্তি করলেন না তাঁরা। ওই দিনই কোনো ক্লাবের সঙ্গে চুক্তি না হলে প্রিমিয়ার লিগে খেলা হবে না, খেলতে হবে ফার্স্ট ডিভিশন লিগে। ভেঙে পড়েছিলেন তামিম, নিজের হতাশা ও দুঃখের কথা ফোনে জানিয়েছিলেন চাচাকে। আকরাম খান বলেছিলেন, তখনই তাঁর ক্লাবে (ওল্ড ডিওএইচএস) গিয়ে চুক্তি করে নিতে। এই সুযোগ পাওয়ার ফলে সে বছর প্রিমিয়ার ক্রিকেটে খেলতে পেরেছিলেন তামিম আর প্রিমিয়ার লিগের পারফরম্যান্সই তাঁকে জায়গা করে দিয়েছিল জাতীয় দলে।
তামিম বলেন, ‘ওল্ড ডিওএইচএসে যোগ দেওয়ার পর আমার দিকে বাড়তি নজর দিয়েছিলেন চাচা। ক্লাবের প্র্যাকটিস শুরু হতো সকাল নয়টায়, চাচা সকাল সাতটা থেকে আমাকে আলাদা করে প্র্যাকটিস করাতেন।’
আকরাম খানের এই ভালোবাসা ও সহযোগিতার মর্যাদা অবশ্য রেখেছিলেন তামিম, সে বছরই প্রিমিয়ার লিগে সবচেয়ে বেশি রান করেছিলেন তিনি।
লাভ ইন মালয়েশিয়া
আবার তামিম-আয়েশার প্রেমের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। লুকিয়ে-চুরিয়ে যা হোক চলছিল প্রেম। কিন্তু এরই মধ্যে পড়াশোনা করতে মালয়েশিয়ায় চলে গেলেন আয়েশা। বেশ মুষড়ে পড়েছিলেন তামিম। কিন্তু সেই সময়টাতেই জাতীয় দলে জায়গা হয়ে গেল। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুবাদে মাঝেমধ্যে মালয়েশিয়া যাওয়ার সামর্থ্য হলো। তামিম বলেন, তাঁর প্রিয় উড়ালযান ‘মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস’। মাঝেমধ্যেই মালয়েশিয়ায় গিয়ে হাজির হতেন। হোস্টেলের নানা নিয়মকানুনের ফাঁক গলে দুপুরে বা সন্ধ্যায় দেখা করতে আসতেন আয়েশা। একসঙ্গে রেস্তোরাঁয় খাওয়া, একটু বেড়ানো, কয়েকটা দিন কেটে যেত যেন কয়েক মুহূর্তে। ‘ফিরে আসার সময় কষ্টে বুক ফেটে যেত, অদ্ভুত অনুভূতি, যেন আর কখনোই তাকে দেখতে পাব না আমি।’
প্রেমিকের সেই আশঙ্কা অবশ্য সত্য হয়নি। আবার দেখা হয়েছে দুজনের। এভাবেই কখন কেটে গেছে দীর্ঘ আটটি বছর।
কুয়ালালামপুর সানওয়ে ইউনিভার্সিটি থেকে মার্কেটিংয়ে স্নাতক আয়েশা সিদ্দিকা দেশে ফিরে এসেছেন। এবার তাঁর গন্তব্য তামিম ইকবালের বাড়ি।
বিয়ের সানাই
এখানে-ওখানে নানা কথা, কোনো কোনো কাগজেও নাকি ছাপা হয়েছে আড়াই কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে এ বিয়েতে, ভারত থেকে বড় বড় শিল্পী আসছেন। তামিম ইকবাল বলেন, ‘ওরা কোথায় এ খবর পেল, বলুন তো, আমিই বা এত টাকা পাব কোথায়?’
তামিম ইকবালের বিয়ে বলে কথা! কৌতূহল তো থাকবেই, বরং আপনিই বলুন বিয়ের আয়োজন সম্পর্কে।
তামিম বললেন, ‘মোট পাঁচটি অনুষ্ঠান হবে। আব্বা-চাচা-চাচি-দাদা-দাদিকে স্মরণ করে একটি মেজবান হবে, চট্টগ্রামের ঐতিহ্য এটা। গায়েহলুদের অনুষ্ঠানটি করা হবে দুই পরিবার মিলে যৌথভাবে, আর বিয়ের অনুষ্ঠান দুটি—একটি চট্টগ্রামে, একটি ঢাকায়। ঢাকায় এখন ক্রিকেটারদের ক্যাম্প চলছে, আমার বন্ধুরা যেন বিয়ের আনন্দ থেকে বাদ না পড়ে, সে জন্য ঢাকায় হবে একটি অনুষ্ঠান। এর দেখভাল করছেন আমার চাচা।’
আর ভারতীয় শিল্পী?
‘ওহ্ হো, আইপিএল খেলতে গিয়ে সেখানে কয়েকজন শিল্পীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল আমার, তারা আসছে, বন্ধুর বিয়েতে আসছে।’
কাজীর দেউড়ির বাড়িটিতে এখন তিল ধারণের জায়গা নেই। আত্মীয়স্বজনেরা এসে পড়েছেন অনেকে, কেউ আছেন পথে। তামিমের বেডরুমটিও বেহাত হয়ে গেছে। বাড়ির পাশেই একটি হোটেলের লবিতে বসে কথা বলছিলাম। বললেন, ‘কয়েক দিন ধরে এই হোটেলই আমার আস্তানা।’
বিদায় নিয়ে আসার সময় বলেছিলাম, আপনি তো গুছিয়ে বেশ ভালোই কথা বলতে পারেন...।
তামিমের উত্তর, ‘আমি তার চেয়ে ভালো ব্যাট চালাতে পারি। হা হা হা।’
মনস্তাত্ত্বিকেরা কী বলবেন জানি না, তবে আমাদের ধারণা, সারা দিন ক্রিকেটের মধ্যে ডুবে থাকা মানুষটি বুঝি খুঁজে বেড়ান এমন একজনকে, যাঁর সান্নিধ্য পেলে ক্রিকেট থেকে আলাদা করে নেওয়া যাবে কিছুটা সময়। নইলে লক্ষ-কোটি হূদয়ে ঝড় তোলা শচীন টেন্ডুলকার কেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্রী অঞ্জলীর প্রেমে পড়েছিলেন, যাঁর ক্রিকেট-জ্ঞান প্রায় শূন্য, এমনকি ‘মাস্টার ব্লাস্টার’কে নিয়েও যাঁর মধ্যে ছিল না কোনো কৌতূহল বা বিস্ময়!
তামিম ইকবাল বললেন, ‘বউ ক্রিকেট খেলা না বুঝলেই ভালো। কোনো দিন মাঠে খারাপ করলে দর্শকদের দুয়োধ্বনি শুনে ঘরে ফিরে বউয়ের কাছেও নিন্দা-মন্দ শুনতে কার ভালো লাগবে, বলুন? তার চেয়ে মাঠ আর ঘর আলাদা হয়েই থাকুক।’
তা থাকুক। কিন্তু এমন ক্রিকেটবিমুখ মানুষটির সন্ধান পেলেন কোথায়?
তামিম হাসেন, চোখে কি ভিড় করে এল নানা রঙের স্মৃতি, যে স্মৃতি সতত সুখের? বললেন, ‘সে অনেক কথা।’
অনেক কথার সব তো আর পাঠককে জানানো যাবে না। তবে এটুকু জানানো যাক, দীর্ঘ আট বছর ধরে প্রেমের পথে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ এখানে আসা।
একটু একটু প্রেমের গল্প
আয়েশা সিদ্দিকা তখন চট্টগ্রাম সানশাইন গ্রামার স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী, এক অনুষ্ঠানে তাঁকে দেখেছিলেন একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ‘এ’ লেভেলের ছাত্র তামিম ইকবাল। দেখেই কুপোকাত, যাকে বলে ‘লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’। এক বান্ধবীকে দিয়ে আয়েশার কাছে মনের কথা, ভালোবাসার কথা বলে পাঠালেন তামিম। শুনেই যাকে বলে পত্রপাঠ বিদায়। আয়েশা বলেছিলেন, ‘লাভ? আই হেইট দ্য ওয়ার্ড—লাভ!’ এ রকম প্রত্যাখ্যানের পর ভালোবাসা যে আরও বাড়ে, এটা গুণীজনেরা বলেন। তামিমেরও তা-ই হলো, লেগে রইলেন। ফোন করে, স্কুলের আঙিনায় নানাভাবে বুঝিয়ে তুলে ধরতে চেষ্টা করলেন হূদয়ের আকুতি। ফলাফল শূন্য।
‘সব চেষ্টা বিফলে যাওয়ার পর একদিন বললাম, আমরা অন্তত বন্ধু তো হতে পারি? এই প্রস্তাবে কাজ হলো। এ রকম নির্দোষ একটি প্রস্তাবে রাজি হয়েই বেচারি ফেঁসে গেল। বন্ধুত্বের পর্বে আমাকে জানার সুযোগ হলো তার, দেখল যত খারাপ ভেবেছিল তত খারাপ মানুষ নই আমি...এবার টোপটা গিলে ফেলল...হা হা হা।’
চট্টগ্রামের রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে, প্রেম-পর্ব চালিয়ে যেতে অসুবিধা হয়নি কোনো?
‘হয়নি আবার! স্কুলে যাওয়ার সময় সঙ্গে কেউ থাকে, কোচিং সেন্টারে যাওয়ার সময়ও আছে কেউ না কেউ, বাসার সামনে দারোয়ান জামালের প্রহরা এমনই নিশ্ছিদ্র, তামিম তো দূরের কথা, একটা মাছি যাওয়ারও উপায় নেই। ফোনে কথা বলাটাই একমাত্র ভরসা, তা-ও তো একবার ধরা পড়ে গেলাম।’
সেটা কেমন?
‘একবার একটা এসএমএস পাঠিয়েছিলাম। সেটা দেখে ফেলেছিলেন বাড়ির লোকজন। ব্যস, বাজেয়াপ্ত হয়ে গেল তার সেলফোন। আর কোনো যোগাযোগ নেই। কী হয়েছে আমি তো আর জানি না, কেন সব যোগাযোগ বন্ধ। কী যে অস্থিরতার মধ্যে কেটেছে কয়েকটা দিন। শেষে একদিন ফোন এল। আমি তখন আমার এক বন্ধুর গাড়িতে, চলন্ত গাড়ি থেকেই লাফ দিয়ে নেমেছি রাস্তায়। তার সব দুর্ভোগের কথা শুনলাম। জানা গেল, আপাতত ফাঁড়া কেটেছে। সে দিনটি ছিল কী সুখের দিন!’
তার মানে, অনেক বিড়ম্বনা সইতে হয়েছে?
‘একেবারে ফিল্মের মতো। ওকে টুকটাক উপহার দিতে চাইতাম, সোজা রাস্তায় তারও উপায় নেই। বাঁকা পথ ধরতে হলো, ফোনে আগেই কথা থাকত, দেয়ালের ওপার থেকে ওদের ব্যালকনিতে ছুড়ে দিতাম...।’
কী ধরনের উপহার দিতেন?
‘বেশির ভাগ সময়েই পারফিউম। এখানেও একটা মজার কাহিনি আছে। তখন তো টাকাপয়সা ছিল না তেমন, ছোট বোন উরুসার আলমারি থেকে ওর পারফিউম চুরি করতাম। আমার খালা বিদেশ থেকে পারফিউম পাঠাতেন ওর জন্য, আমি সেখান থেকে...।’
ধরা পড়েননি কখনো?
‘না। সন্দেহটা ছিল আমার ওপরই, কিন্তু প্রমাণ তো নেই। হা হা হা। তবে এখন সেটা শোধ দিচ্ছি সুদে-আসলে। এখনো দেশের বাইরে গেলে পারফিউম নিয়ে আসি ছোট বোনের জন্য।’
আয়েশার পরিবারে এই প্রেম নিয়ে নানা সমস্যা হলেও তামিমের পরিবারে কিন্তু ব্যাপারটা মোটেই ও রকম ছিল না। মা নুসরাত ইকবালকে কখনো কিছু লুকাননি তামিম, এই সম্পর্কের কথাও তাই অকপটে জানিয়েছিলেন। তিনি শুধু বলেছিলেন, ভালো পরিবারের মেয়ে হলে তাঁর কোনো আপত্তি নেই। তামিম বলেন, ‘বাবা তো মারা গেছেন অনেক আগে, তাই মা-ই আমাদের সবকিছু, মা আমাদের অভিভাবক যেমন, আবার তেমনি ভালো বন্ধুও।’
ক্রীড়া পরিবার
মা-বাবার কথা যখন এলই, তামিমের পরিবার নিয়েও কিছু বলা যাক। তামিমের বাবা ইকবাল খান ছিলেন নামী ফুটবলার। নিজে খেলেছেন, আবার কোচ হিসেবে তাঁর হাতেই গড়ে উঠেছেন অনেক নামী ফুটবলার। জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আশীষ ভদ্র, সত্যজিৎ দাশ রুপুরা তো বেড়ে উঠেছিলেন তাঁর হাত ধরেই। ‘কেকেআরসি’ নামের একটি ফুটবল দল গড়ে তুলেছিলেন তিনি, পরপর কয়েক বছর চট্টগ্রাম ফুটবল লিগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল এই দল। পরে এই ‘কেকেআরসি’ চট্টগ্রামে আবাহনী ক্রীড়া চক্রে রূপান্তরিত হয়। নিজে ফুটবল খেললেও তিনি চাইতেন পরিবারের অন্যরা ক্রিকেটে মনোযোগ দিক। তাঁর চাওয়া যে পূর্ণ হয়েছিল, তার প্রমাণ তো ছোট ভাই আকরাম খান আর বড় ছেলে নাফিস ইকবাল।
তামিম বললেন, ‘এমন এক পরিবারে জন্মেছি, ক্রিকেটার না হওয়ার যেন উপায়ই ছিল না। ভেবে দেখুন, আমার যখন আট বছর বয়স, তখন চাচা আকরাম খানের নেতৃত্বে মালয়েশিয়ার আইসিসি ট্রফি জিতল বাংলাদেশ, সেদিন আমাদের কাজীর দেউড়ির বাড়িতে চট্টগ্রাম শহরের মানুষ ভেঙে পড়েছিল, সে কী রং ছোড়াছুড়ি! কম বয়সে এ রকম সব ঘটনা ঘটলে তার প্রভাব এড়ানো কি সম্ভব? চাচা আকরাম খানকে দেখেছি, বড় ভাই নাফিস ইকবালকে দেখেছি, তখন থেকেই আমার ভেতরে ক্রিকেটার হওয়ার অদম্য বাসনার জন্ম হয়েছে।’
একটি অসাধারণ ঘটনার কথা বললেন তামিম। কী একটা অসুখের কারণে তখন তাঁর বাবা ইকবাল খানের একটা পা কেটে বাদ দিতে হয়েছে অস্ত্রোপচার করে। কিন্তু তীব্র রোদের মধ্যে ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে তিনি আম্পায়ারিং করতেন মাঠে, ছেলেদের খেলা দেখতেন, ঘরে ফিরে ভুল-ত্রুটির কথা তুলে কীভাবে শোধরাতে হবে, তার পরামর্শ দিতেন। এই পরিবারের ছেলের খেলোয়াড় না হয়ে আর কীই-বা হওয়ার ছিল?
চাচা আকরাম খানের কথাও তুললেন। একবার ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে খেলার জন্য একটি ক্লাবের সঙ্গে কথাবার্তা চূড়ান্ত হলো। কিন্তু শেষ দিন কথা রাখলেন না ক্লাবের কর্মকর্তারা, তামিমের সঙ্গে চুক্তি করলেন না তাঁরা। ওই দিনই কোনো ক্লাবের সঙ্গে চুক্তি না হলে প্রিমিয়ার লিগে খেলা হবে না, খেলতে হবে ফার্স্ট ডিভিশন লিগে। ভেঙে পড়েছিলেন তামিম, নিজের হতাশা ও দুঃখের কথা ফোনে জানিয়েছিলেন চাচাকে। আকরাম খান বলেছিলেন, তখনই তাঁর ক্লাবে (ওল্ড ডিওএইচএস) গিয়ে চুক্তি করে নিতে। এই সুযোগ পাওয়ার ফলে সে বছর প্রিমিয়ার ক্রিকেটে খেলতে পেরেছিলেন তামিম আর প্রিমিয়ার লিগের পারফরম্যান্সই তাঁকে জায়গা করে দিয়েছিল জাতীয় দলে।
তামিম বলেন, ‘ওল্ড ডিওএইচএসে যোগ দেওয়ার পর আমার দিকে বাড়তি নজর দিয়েছিলেন চাচা। ক্লাবের প্র্যাকটিস শুরু হতো সকাল নয়টায়, চাচা সকাল সাতটা থেকে আমাকে আলাদা করে প্র্যাকটিস করাতেন।’
আকরাম খানের এই ভালোবাসা ও সহযোগিতার মর্যাদা অবশ্য রেখেছিলেন তামিম, সে বছরই প্রিমিয়ার লিগে সবচেয়ে বেশি রান করেছিলেন তিনি।
লাভ ইন মালয়েশিয়া
আবার তামিম-আয়েশার প্রেমের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। লুকিয়ে-চুরিয়ে যা হোক চলছিল প্রেম। কিন্তু এরই মধ্যে পড়াশোনা করতে মালয়েশিয়ায় চলে গেলেন আয়েশা। বেশ মুষড়ে পড়েছিলেন তামিম। কিন্তু সেই সময়টাতেই জাতীয় দলে জায়গা হয়ে গেল। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুবাদে মাঝেমধ্যে মালয়েশিয়া যাওয়ার সামর্থ্য হলো। তামিম বলেন, তাঁর প্রিয় উড়ালযান ‘মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস’। মাঝেমধ্যেই মালয়েশিয়ায় গিয়ে হাজির হতেন। হোস্টেলের নানা নিয়মকানুনের ফাঁক গলে দুপুরে বা সন্ধ্যায় দেখা করতে আসতেন আয়েশা। একসঙ্গে রেস্তোরাঁয় খাওয়া, একটু বেড়ানো, কয়েকটা দিন কেটে যেত যেন কয়েক মুহূর্তে। ‘ফিরে আসার সময় কষ্টে বুক ফেটে যেত, অদ্ভুত অনুভূতি, যেন আর কখনোই তাকে দেখতে পাব না আমি।’
প্রেমিকের সেই আশঙ্কা অবশ্য সত্য হয়নি। আবার দেখা হয়েছে দুজনের। এভাবেই কখন কেটে গেছে দীর্ঘ আটটি বছর।
কুয়ালালামপুর সানওয়ে ইউনিভার্সিটি থেকে মার্কেটিংয়ে স্নাতক আয়েশা সিদ্দিকা দেশে ফিরে এসেছেন। এবার তাঁর গন্তব্য তামিম ইকবালের বাড়ি।
বিয়ের সানাই
এখানে-ওখানে নানা কথা, কোনো কোনো কাগজেও নাকি ছাপা হয়েছে আড়াই কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে এ বিয়েতে, ভারত থেকে বড় বড় শিল্পী আসছেন। তামিম ইকবাল বলেন, ‘ওরা কোথায় এ খবর পেল, বলুন তো, আমিই বা এত টাকা পাব কোথায়?’
তামিম ইকবালের বিয়ে বলে কথা! কৌতূহল তো থাকবেই, বরং আপনিই বলুন বিয়ের আয়োজন সম্পর্কে।
তামিম বললেন, ‘মোট পাঁচটি অনুষ্ঠান হবে। আব্বা-চাচা-চাচি-দাদা-দাদিকে স্মরণ করে একটি মেজবান হবে, চট্টগ্রামের ঐতিহ্য এটা। গায়েহলুদের অনুষ্ঠানটি করা হবে দুই পরিবার মিলে যৌথভাবে, আর বিয়ের অনুষ্ঠান দুটি—একটি চট্টগ্রামে, একটি ঢাকায়। ঢাকায় এখন ক্রিকেটারদের ক্যাম্প চলছে, আমার বন্ধুরা যেন বিয়ের আনন্দ থেকে বাদ না পড়ে, সে জন্য ঢাকায় হবে একটি অনুষ্ঠান। এর দেখভাল করছেন আমার চাচা।’
আর ভারতীয় শিল্পী?
‘ওহ্ হো, আইপিএল খেলতে গিয়ে সেখানে কয়েকজন শিল্পীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল আমার, তারা আসছে, বন্ধুর বিয়েতে আসছে।’
কাজীর দেউড়ির বাড়িটিতে এখন তিল ধারণের জায়গা নেই। আত্মীয়স্বজনেরা এসে পড়েছেন অনেকে, কেউ আছেন পথে। তামিমের বেডরুমটিও বেহাত হয়ে গেছে। বাড়ির পাশেই একটি হোটেলের লবিতে বসে কথা বলছিলাম। বললেন, ‘কয়েক দিন ধরে এই হোটেলই আমার আস্তানা।’
বিদায় নিয়ে আসার সময় বলেছিলাম, আপনি তো গুছিয়ে বেশ ভালোই কথা বলতে পারেন...।
তামিমের উত্তর, ‘আমি তার চেয়ে ভালো ব্যাট চালাতে পারি। হা হা হা।’
No comments