কিংব্যাক মুন্নাকে আমরা কি ভুলেই যেতে বসেছি! by জাহিদ রহমান
২০০৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। আমাদের
ক্রীড়াঙ্গনের জন্য এক শোক ও বিষাদময় দিন। এই দিনে চিকিৎসকদের সব চেষ্টা
ব্যর্থ করে দেশের অন্যতম সেরা ফুটবলার 'কিংব্যাক' খ্যাত মোনেম মুন্না
সবাইকে শোকসাগরে ভাসিয়ে চলে যান পরপারে।
মৃতু্যর বেশ আগে
থেকেই মুন্না চিকিৎসকদের পরামর্শমতো চলছিলেন। বছর পাঁচেক আগে মুন্নার কিডনি
রোগ ধরা পড়লে দ্রম্নতই তাঁকে ব্যাংককে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। এক
পর্যায় বড় বোন শামসুন্নাহার আইভীর কিডনিও তার শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়।
সেই কিডনি নিয়েই মুন্না টানা পাঁচবছর বেঁচে থাকলেও পরবর্তীতে ফের অসুস্থ
হয়ে পড়েন এবং চিরকালের জন্য সবাইকে ছেড়ে চলে যান। এ বছরে মুন্নার মৃতু্যর
পাঁচবছর পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু এই পাঁচ বছরেই মনে হয়েছে ঢাকার মাঠের সেই
মারকুটে সাহসী দুর্দানত্ম ব্যতিক্রম চরিত্রের ফুটবলার মুন্নাকে আমরা ভুলে
যেতে বসেছি। আমাদের মন, স্মৃতি থেকে বোধ মুন্না যেন দ্রম্নতই মিইয়ে যাচ্ছে।
এ কারণেই বোধ হয় মুন্নার তিরোধান দিবস নিয়ে কোথাও হইচই ছিল না।
ইলেকট্রনিক, পিন্ট মিডিয়াও মুন্নাকে নিয়ে তেমন কোন সংবাদ প্রচার করেছে বলে
মনে হয়নি। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন থেকে শুরম্ন করে আবাহনী কাব লিমিটেড
কেউই তাকে সেভাবে স্মরণ করেনি। পত্রিকায় যতটুকু খবর বেরিয়েছে সে মতে
শুধুমাত্র নারায়ণগঞ্জে সোনালী অতীত কাব তাঁর স্মরণে এক স্মরণসভার আয়োজন
করেছিল-এই যা। মোদ্দা কথা সেভাবে কোথাও কিংব্যাক খ্যাত মুন্নাকে স্মরণ করা
হয়নি। মোনেম মুন্না শুধু বাংলাদেশ নয়, তিনি ছিলেন দণি এশিয়ার এক সেরা
ফুটবলার। স্টপার পজিশনে খেলেও যিনি সর্বসাধারণের মাঝে তুমুলভাবে জনপ্রিয়
হয়ে উঠেছিলেন। মাঠে শুধু চোখ ধাঁধানো নৈপুণ্য নয়, বরাবরই দ নেতৃত্ব এবং
ফুটবলে দুর্দানত্ম পেশাদারিত্ব প্রদর্শন করে রীতিমতো ফুটবল আইকনে পরিণত
হয়েছিলেন তিনি। আর এ কারণেই 'কিংব্যাকে' উপাধী তার জন্য ছিল অনিবার্য। আশির
দশকের শেষ লগ্ন এবং নব্বই দশক জুড়ে যে দেশের ফুটবলাঙ্গন ছিল মুন্নাময়_এতে
কোন সন্দেহ নেই। তিনি যেমন নিজে খেলতেন তেমনি সতীর্থদের খেলাতেনও। কখনও
কখনও তারম্নণ্য নির্ভর আবাহনীকে নেতৃত্ব দিয়ে একাই টেনে নিয়ে গেছেন
সর্বোচ্চ উচ্চতায়। আবাহনীর সাথে মুন্নার ছিল অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। আর তাই
জীবনের শেষ দিন পর্যনত্মও তিনি নিজেকে বেঁধে রেখেছিলেন এই কাবের সাথে।
অনেকেরই হয়ত মনে হয়েছে নব্বই-এর গণভু্যত্থানের পর একবার দেশের সেরা সব
ফুটবলার চড়া দামে মুক্তিযোদ্ধা কাবে নাম লেখালেও সে সময় মুন্না একাই
আবাহনীতেই ছিলেন। এবং সেবছর মুন্না একাই একদল তরম্নণ খেলোয়াড়দের সাথে নিয়ে
আবাহনীর মর্যাদা সমুন্নত রেখেছিলেন। শুধু আবাহনীই নয়, মুন্না যতদিন মাঠে
ছিলেন ততদিন দেশের জন্যেও নিজেকে উজাড় করে খেলেছেন। সবসময়ই নিজের
সর্বোচ্চটুকু দেশের জন্য দিতে সচেষ্ট থেকেছেন। ৮০-৮১ সালে পাইনিওর লীগে নাম
লেখানোর মধ্যে দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে অভিষেক ঘটেছিল মুন্নার। পরের
মৌসুম শানত্মিনগরে খেলার পর মুন্না যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কাবে।
পরের বছরই মুক্তিযোদ্ধা সংসদ প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে খেলার যোগ্যতা অর্জন
করে। বলা যায় এ সময়ই মুন্না কর্মকর্তাদের নজর কাড়তে সম হয়। এরই
ধারাবাহিকতায় ৮৬ সালে ব্রাদার্স ইউনিয়ন কাবে নাম লেখান মুন্না। এ মৌসুমে
দুর্দানত্ম পারফর্ম করে সবার নজর কাড়েন। এসময়ই আবাহনী কর্মকর্তাদের নজরে
পড়েন তিনি। পরের মৌসুমেই মুন্না যোগ দেন আবাহনী ক্রীড়া চক্রে। এ সময়
আবাহনীর হয়ে খেলে যারা জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিলেন তাদের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য
হলেন-আশরাফ উদ্দিন চুন্নু, গোলাম রাব্বানী হেলাল, ইমতিয়াজ সুলতান জনি,
খোরশেদ বাবুল, গাফফারসহ অন্যরা। তরম্নণ ফুটবলার মুন্না এসে এই অভিজ্ঞদের
মাঝে নিজের জায়গা করে নেন। এরপর মুন্নাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। যেখানেই
মুন্না পা রেখেছেন সেখানেই সাফল্য এসে ধরা দিয়েছে। একটানা ৯৭ সাল পর্যনত্ম
আবাহনীতে খেলেন তিনি। আবাহনীর হয়েই ফুটবলের বর্ণাঢ্য জীবন ছেড়ে অবসরে যান।
তবে ফুটবল খেলা ছাড়লেও মুন্না কর্মকর্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন সহসাই।
আবাহনীর ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মৃতু্য অবধি। সর্বশেষ আবাহনী
মাঠেই তার শেষ জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। মুন্নার খেলোয়াড়ি জীবন ছিল বড্ড আলোকময়।
আবাহনীর হয়ে যেমন দাপটের সাথে খেলেছেন তেমনি কলকাতা ফুটবল লীগেও টানা তিন
বছর খেলে সমান দারম্নণভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। ৯১ সালে ইস্ট বেঙ্গল
কাবের কোচ নাইমুদ্দিনই প্রথম মুন্নাকে প্রসত্মাব দিয়ে কলকাতা লীগে খেলার
সুযোগ করে দেন। কলকাতা লীগে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে মুন্না লিবেরো পজিশনে খেলে
দারম্নণ আলোড়ন তোলেন এবং সহসাই বাংলাদেশের মতো জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এদিকে
জাতীয় দলের হয়ে মুন্না প্রথম খেলার সুযোগ পান ৮৬ সালে। এ বছর সিউলে
অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসের জন্য নির্বাচিত দলে তিনি প্রথমবারের মতো ডাক পান।
তারপর দাপটের সাথে খেলেন ৯৭ সাল পর্যনত্ম। ৯৫ সালে তারই নেতৃত্বে মায়ানমারে
অনুষ্ঠিত চার জাতি কাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশের বাইরে প্রথম বাংলাদেশ
কোন ট্রফি জেতার অনন্য কৃতিত্ব দেখায়। এই টুর্নামেন্টে মুন্নার একক
পারফরমেন্স ছিল দেখার মতো। একথা সত্য যে, মুন্না যতদিন মাঠে ছিলেন সেসময়
ঢাকার মাঠে যত বড় স্ট্রাইকারের আবির্ভাবই ঘটুক না কেন মুন্নাকে সমীহ করতেই
হয়েছে। মুন্নাকে ভেদ অথবা পরাজিত করে জালে বল প্রবেশ করনোটা কোন
স্ট্রাইকারের কাছেই সহজ কাজ ছিল না। মুন্নার সময়ে বাংলাদেশে যত বিদেশী কোচ
এসেছেন সবাই মুন্নার খেলার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কিন্তু সেই মুন্নার জন্যে
আমাদের দেশে দৃশ্যমান তেমন কিছুই করা হয়নি। কোথাও মুন্নার স্মরণে তেমন কোন
স্মারক চিহ্ন নেই। ২০০৮ সালে সিটি কপের্ারেশনের মেয়র সাদেক হোসেন খোকার
উদ্যোগে ঢাকার ধানম-ির আট নাম্বার রাসত্মার সেতুটি 'মুন্না সেতু' হিসেবে
নামকরণ করা হলেও সেখানেও অবহেলার ছাপ স্পষ্ট। মুন্না নামটিও ঠিকমতো বুঝা
যায় না। খুব ভাল হতো যদি সেতুর পাশে মুন্নার কোন ছবি স্থাপন করা হতো।
যেমনটি ঢাকার বিভিন্ন রাসত্মায় মুক্তিযোদ্ধা ও ভাষাসৈনিকদের নামে করা
হয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে সাবেক ফুটবলার ইমতিয়াজ সুলতান জনির দৃষ্টি আকর্ষণ করা
হলে তিনি বলেন, মুন্নাকে মনে রাখতে সরকারের অনেক করণীয় আছে। সরকারের উচিত
মুন্নার নামে কোন স্থাপনার নামকরণ করা-যা এই প্রজন্মের মাঝে ফুটবল স্পিরিট
তৈরি করতে ভূমিকা রাখবে। জনি আরও বলেন, নিশ্চিত করেই বলা যায় মুন্না বেঁচে
থাকলে এ দেশের ফুটবল উন্নয়নে ভূমিকা রাখত। ফুটবলের জন্য সেছিল নিবেদিত এক
প্রাণ। আমাদের মাঝ থেকে মুন্না হারিয়ে গেলেও এটি সত্য মুন্নার সেই ফুটবল
সৌন্দর্য হারায়নি। খেলার মাঠে মুন্নার দৃঢ়তা, প্রিতা, তীব্রতা, অঙ্গীকার,
বিশ্বাস যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবে। তরম্নণ প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণার
অাঁধার হয়ে থাকবে মুন্না। এ কারণেই ফুটবল আলোচনায়, অনুষঙ্গে, স্বপ্নে
বারবার ফিরে আসে মুন্নার নাম। কিন্তু দুঃখ হয় এমন এক খেলোয়াড়ের মৃতু্যদিবস
যখন নীরবে চলে যায়, শোকের দিনটিতে মুন্নার স্ত্রী সুরভী, মেয়ে দানিয়া ছেলে
আজমান চারপাশ থেকে সামান্যতম সৌজন্যতাও যখন পান না তখন কেন জানি মনে
হয়-'মুন্নাকে বুঝি আমরা ভুলেই যেতে বসেছি'। মুন্নার উত্তরাধিকাররাও সত্যিই
এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে পান না।
No comments