হিন্দু আইন সংস্কারের এক ধাপ- নীনা গোস্বামী
প্রাচীন হিন্দু আইনে বিধিবদ্ধ আইনের
সংখ্যা খুবই কম। প্রথার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা হিন্দু আইনে যা কিছু
সংস্কার সেই ঔপনিবেশিক আমলেই হয়। তাই তো সাহসী সব পদক্ষেপ, যেমনÑ সতীদাহ
প্রথা রদ এবং হিন্দু বিধবা আইনের প্রচলন এই সময়ই হয়।
যেসব
বিধিবদ্ধ আইনের ওপর ভিত্তি করে হিন্দু আইন বা হিন্দুদের ব্যক্তিগত আইনের
একটি কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- The Hindu Married
Women’s Right to Separate Residence and Maintenance Act, 1946, The Hindu
Women’s Rights to Property Act, 1937, The Hindu Gains of Learning Act,
1930, The Hindu Disposition of Property Act. 1916 (Act. No. xv of 1961),
The Hindu Inheritance (Removal of Disabilities) Act (Act. No. xii of
1928), The Hindu Law of Inheritance (Amendment) Act, 1929, The Hindu
Marriage Disabilities Removal Act, 1946, The Hindu Women’s Rights to
Property (Extension to Agricultural Land) Act, 1943 (Assam Act No. xiii
of 1943), The Hindu Widow’s Re-marriage Act, 1856 (Act No. xv of 1856),
The Hindu Religious Welfare Trust Ordinance, 1983 (Ordinance No. lixivia
of 1983) প্রভৃতি।
উপরোক্ত আইনগুলো দেখলেই বোঝা যায় পারিবারিক আইন ‘বিবাহ, ভরণপোষণ, বিবাহ রেজিস্ট্রেশন, বিবাহ বিচ্ছেদ’ বিষয়ক (শুধু The Hindu Married Women’s Right to Separate Residence and Maintenance Act, 1946) বাদে কোনো আইনই অদ্যাবধি তৈরি হয়নি।
১৯৪৬ সালের পরে হিন্দু আইনের কোন সংস্কার দেখা যায় না। এই সত্তর বছরে কোন সরকারই এই বিশেষ দিকটির প্রয়োজন আছে বলে মনে করেনি। গত আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই হিন্দু নারীদের মধ্যে থেকে বেশকিছু দাবি উত্থাপিত হতে থাকে। ১৯৮৫-৮৬ সালে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোডের দাবি উত্থাপিত হয়। সব ধর্মের সকল নারীর মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টিকারী সকল আইন বাতিল করে ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড প্রণয়নের এই দাবি উত্থাপন করেন নারী নেতৃবৃন্দ এবং তাদের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। সকল ধর্মের কট্টরপন্থীরা এর বিরোধিতা করেন। সমস্যা ছিল অন্য জায়গাতেও। মুসলিম পারিবারিক আইনে নারীদের কিছু অধিকার থাকলেও অন্য ধর্মে, বিশেষ করে হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী নারীদের অধিকারের জায়গাটি ছিল প্রায় শূন্য। এক কথায় বলতে গেলে ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোডের জন্য যে ধরনের ‘সাম্য’ অবস্থার এবং সহ-অবস্থান প্রয়োজন, তা ছিল না। ১৯৮৯-৯০ সালে আবারও বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। এর পাশাপাশি নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত হয়, হিন্দুধর্মের ছোট ছোট সংস্কারের দাবি উত্থাপন করার। এই সিদ্ধান্তেরও বিরোধিতা হয়েছে। কট্টরপন্থীরা বলেছেন, হিন্দু ধর্মের সংস্কার সংসদের আইন দ্বারা কখনো হয়নি। কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিলেন উপরোল্লিখিত আইনগুলোর কথা, যা এখনো চলমান। তবু আন্দোলন থেমে থাকেনি। এত সব আন্দোলনের পরেও দেখা যায়, যখন যে সরকারই এসেছে তারা আইনে ‘ইউনিফর্ম’ অর্থাৎ সকল নাগরিকের জন্য একই আইন এই তথ্য আমলে নেয়নি। কারণ ব্যক্তিগত আইনকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে সবসময়।
পারিবারিক আইনের ব্যবহারে ব্যক্তিগত আইনের প্রয়োগ থাকায় হিন্দু আইন সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের অবস্থানেই রয়ে গেছে। মানুষের প্রয়োজনেই যে আইন এ কথাটি আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। আজ মনে হয়, আইনের প্রয়োজনেই মানুষ এ কথাটি বুঝি একদিন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে।
নারী আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ২০০৯ সালে গঠিত হয় হিন্দু আইন প্রণয়নে নাগরিক জোট। এই জোটের পক্ষ থেকে পূর্ণাঙ্গ হিন্দু বিয়ে আইনের একটি খসড়া প্রণয়ন করে আইন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়। এ আইনের মধ্যে ছিল বিয়ে রেজিস্ট্রেশন, আদালতের মাধ্যমে বিয়ে বিচ্ছেদ, বহুবিয়ে রোধ ইত্যাদি। কিন্তু নাগরিক জোটের প্রেরিত খসড়া আইন থেকে সরকার শুধু বিয়ে রেজিস্ট্রেশন আইন পাস করে।
তবে অনেক না পাওয়ার মধ্যে বর্তমান সরকারের নেয়া উল্লেখযোগ্য আইনী সংস্কার হলো- হিন্দু বিয়ে নিবন্ধন আইন ২০১২ এবং জবমরংঃৎধঃরড়হ (অসবহফসবহঃ) ২০১২ জাতীয় সংসদে পাস করা। হিন্দু বিয়ে নিবন্ধন আইন ২০১২-এর কয়েকটি সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, সংবিধিবদ্ধ আইনের অনুপস্থিতির ঝুড়িতে এটি পার্লামেন্ট থেকে পাসকৃত আইন। এর ফলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা চাইলে অন্তত তাদের বিয়ে নিবন্ধন করতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, এই আইনটি সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত আইনের সংস্কারে ছোট হলেও একটি আইনের যোগ। যার দ্বারা অন্তত এটি বলা যায় ‘হিন্দু ব্যক্তিগত আইন সংস্কারযোগ্য নয়’- কথাটি ঠিক না।
এই আইনটির বেশকিছু অসুবিধাও আছে। যেমন : এই আইনটি হিন্দু সম্প্রদায়ের সকল নাগরিক মানতে বাধ্যÑ এমন বাধ্যবাধকতা না থাকায় শুধু এক শ্রেণীর মানুষ এই আইনটির সুবিধা ভোগ করবে। সকল শ্রেণীর নাগরিক সুবিধা পাবে না। উদাহরণ : যারা বিদেশে যেতে চাইবে তারাই শুধু বিয়ে রেজিস্ট্রি বেশি করবে। অন্যদিকে সুবিধাবঞ্চিত নারীদের অবস্থার কোনো উন্নতি হবে না। কারণ কোন কোন ক্ষেত্রে বিয়ে অস্বীকারের যে প্রবণতার জন্য নারীরা দিনের পর দিন প্রতারিত হয় এই আইনের প্রয়োগে বাধ্যবাধকতার ক্লজটি বাদ দেয়ায় আইনটি নারীদের জন্য কোন সুফল বয়ে আনবে না। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা হিন্দু আইন অনুসরণ করেন। তাদের ব্যক্তিগত আইন বলে কিছু নেই। এই আইনটি শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য তৈরি হয়েছে। কিন্তু হিন্দু আইন অনুসারীরা এই আইনের আওতায় বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন এমন কথাটি যদি যুক্ত করা হতো, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী যারা হিন্দু আইন অনুসারী তারাও এই আইনের সুবিধা ভোগ করতে পারতেন। সবচেয়ে বড় অসুবিধা এই যে, আইনটির কার্যকরের তারিখ নির্ধারণ করে এখনও প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। বিধি প্রণয়নও হয়নি। বিধি প্রণয়ন হওয়ার পরই কেবল সরকার হিন্দু বিয়ে রেজিস্ট্রার নিয়োগ দিতে পারবেন। আর তখনই আইনটি প্রায়োগিক দিক থেকে কার্যকারিতা পাবে।
প্রসঙ্গক্রমে শতাধিক বছর আগে রেজিস্ট্রেশন এ্যাক্ট ১৯০৮-এর যে সংশোধনী আনা হয়, যা এখানে তুলে ধরা হলো-
(bb) registration fee payable for registration of a declaration of gift of any immovable property made under the Hindu, Christian and Buddhist Personal Law, if such gift is permitted by their Personal Law, shall be one hundred taka irrespective of the value of the property, provided such gift is made between spouses, parents and children, grand parents and grand children, full brothers, full sisters and, full brothers and full sisters
এই আইনটিতে সংশোধনী আনার ফলে সুবিধা ভোগ করবেন হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকল ধর্মাবলম্বীই।
এর উল্লেখযোগ্য দিক হলো, কোনো মা-বাবা তার জীবিত অবস্থায় বিশেষত হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা যদি চান তাদের কন্যাসন্তানকে কিছু সম্পত্তি দিয়ে যেতে (যেহেতু মৃত্যুর পর ছেলে থাকলে কন্যাসন্তানরা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়), তাহলে তারা মাত্র ১০০ টাকা কোর্ট ফি দিয়ে নির্ধারিত সম্পত্তি কন্যার অনুকূলে দান বা গিফট করতে পারবেন। এই আইনটির ক্ষেত্রেও একই অসুবিধা আছে। এখনও এর প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। আমরা আশা করব উল্লিখিত দুটি আইনেরই কার্যকারিতা সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারির বিষয়ে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
হিন্দু বিয়ে নিবন্ধন আইন ২০১২ অনেক না পাওয়ার মধ্যেও আলো বয়ে আনে। এটির ব্যাপক প্রচার আবশ্যক। এ ব্যাপারে একটি কথা না বললেই নয়। হিন্দু বিয়ে নিবন্ধন আইনের কারণে ভুক্তভোগী হিন্দু স্বামী-স্ত্রীদের জন্য বিয়ে বিচ্ছেদ আইন প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবি। The Hindu Married Women’s Right to Separate Residence and Maintenance Act,1946 কারণে ভুক্তভোগী স্বামী-স্ত্রী একে অপরের থেকে আলাদা থাকতে পারেন। কিন্তু তা বিবাহের পরিসমাপ্তি ঘটায় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই সারাজীবন আইন না থাকার কারণে অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। এ বিষয়টিকে মাথায় রেখে সরকারের উচিত হবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে হলেও শর্তসাপেক্ষে আদালতের মাধ্যমে বিয়ে বিচ্ছেদ আইন প্রণয়নে উদ্যোগী হওয়া।
উপরোক্ত আইনগুলো দেখলেই বোঝা যায় পারিবারিক আইন ‘বিবাহ, ভরণপোষণ, বিবাহ রেজিস্ট্রেশন, বিবাহ বিচ্ছেদ’ বিষয়ক (শুধু The Hindu Married Women’s Right to Separate Residence and Maintenance Act, 1946) বাদে কোনো আইনই অদ্যাবধি তৈরি হয়নি।
১৯৪৬ সালের পরে হিন্দু আইনের কোন সংস্কার দেখা যায় না। এই সত্তর বছরে কোন সরকারই এই বিশেষ দিকটির প্রয়োজন আছে বলে মনে করেনি। গত আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই হিন্দু নারীদের মধ্যে থেকে বেশকিছু দাবি উত্থাপিত হতে থাকে। ১৯৮৫-৮৬ সালে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোডের দাবি উত্থাপিত হয়। সব ধর্মের সকল নারীর মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টিকারী সকল আইন বাতিল করে ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড প্রণয়নের এই দাবি উত্থাপন করেন নারী নেতৃবৃন্দ এবং তাদের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। সকল ধর্মের কট্টরপন্থীরা এর বিরোধিতা করেন। সমস্যা ছিল অন্য জায়গাতেও। মুসলিম পারিবারিক আইনে নারীদের কিছু অধিকার থাকলেও অন্য ধর্মে, বিশেষ করে হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী নারীদের অধিকারের জায়গাটি ছিল প্রায় শূন্য। এক কথায় বলতে গেলে ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোডের জন্য যে ধরনের ‘সাম্য’ অবস্থার এবং সহ-অবস্থান প্রয়োজন, তা ছিল না। ১৯৮৯-৯০ সালে আবারও বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। এর পাশাপাশি নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত হয়, হিন্দুধর্মের ছোট ছোট সংস্কারের দাবি উত্থাপন করার। এই সিদ্ধান্তেরও বিরোধিতা হয়েছে। কট্টরপন্থীরা বলেছেন, হিন্দু ধর্মের সংস্কার সংসদের আইন দ্বারা কখনো হয়নি। কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিলেন উপরোল্লিখিত আইনগুলোর কথা, যা এখনো চলমান। তবু আন্দোলন থেমে থাকেনি। এত সব আন্দোলনের পরেও দেখা যায়, যখন যে সরকারই এসেছে তারা আইনে ‘ইউনিফর্ম’ অর্থাৎ সকল নাগরিকের জন্য একই আইন এই তথ্য আমলে নেয়নি। কারণ ব্যক্তিগত আইনকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে সবসময়।
পারিবারিক আইনের ব্যবহারে ব্যক্তিগত আইনের প্রয়োগ থাকায় হিন্দু আইন সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের অবস্থানেই রয়ে গেছে। মানুষের প্রয়োজনেই যে আইন এ কথাটি আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। আজ মনে হয়, আইনের প্রয়োজনেই মানুষ এ কথাটি বুঝি একদিন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে।
নারী আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ২০০৯ সালে গঠিত হয় হিন্দু আইন প্রণয়নে নাগরিক জোট। এই জোটের পক্ষ থেকে পূর্ণাঙ্গ হিন্দু বিয়ে আইনের একটি খসড়া প্রণয়ন করে আইন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়। এ আইনের মধ্যে ছিল বিয়ে রেজিস্ট্রেশন, আদালতের মাধ্যমে বিয়ে বিচ্ছেদ, বহুবিয়ে রোধ ইত্যাদি। কিন্তু নাগরিক জোটের প্রেরিত খসড়া আইন থেকে সরকার শুধু বিয়ে রেজিস্ট্রেশন আইন পাস করে।
তবে অনেক না পাওয়ার মধ্যে বর্তমান সরকারের নেয়া উল্লেখযোগ্য আইনী সংস্কার হলো- হিন্দু বিয়ে নিবন্ধন আইন ২০১২ এবং জবমরংঃৎধঃরড়হ (অসবহফসবহঃ) ২০১২ জাতীয় সংসদে পাস করা। হিন্দু বিয়ে নিবন্ধন আইন ২০১২-এর কয়েকটি সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, সংবিধিবদ্ধ আইনের অনুপস্থিতির ঝুড়িতে এটি পার্লামেন্ট থেকে পাসকৃত আইন। এর ফলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা চাইলে অন্তত তাদের বিয়ে নিবন্ধন করতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, এই আইনটি সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত আইনের সংস্কারে ছোট হলেও একটি আইনের যোগ। যার দ্বারা অন্তত এটি বলা যায় ‘হিন্দু ব্যক্তিগত আইন সংস্কারযোগ্য নয়’- কথাটি ঠিক না।
এই আইনটির বেশকিছু অসুবিধাও আছে। যেমন : এই আইনটি হিন্দু সম্প্রদায়ের সকল নাগরিক মানতে বাধ্যÑ এমন বাধ্যবাধকতা না থাকায় শুধু এক শ্রেণীর মানুষ এই আইনটির সুবিধা ভোগ করবে। সকল শ্রেণীর নাগরিক সুবিধা পাবে না। উদাহরণ : যারা বিদেশে যেতে চাইবে তারাই শুধু বিয়ে রেজিস্ট্রি বেশি করবে। অন্যদিকে সুবিধাবঞ্চিত নারীদের অবস্থার কোনো উন্নতি হবে না। কারণ কোন কোন ক্ষেত্রে বিয়ে অস্বীকারের যে প্রবণতার জন্য নারীরা দিনের পর দিন প্রতারিত হয় এই আইনের প্রয়োগে বাধ্যবাধকতার ক্লজটি বাদ দেয়ায় আইনটি নারীদের জন্য কোন সুফল বয়ে আনবে না। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা হিন্দু আইন অনুসরণ করেন। তাদের ব্যক্তিগত আইন বলে কিছু নেই। এই আইনটি শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য তৈরি হয়েছে। কিন্তু হিন্দু আইন অনুসারীরা এই আইনের আওতায় বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন এমন কথাটি যদি যুক্ত করা হতো, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী যারা হিন্দু আইন অনুসারী তারাও এই আইনের সুবিধা ভোগ করতে পারতেন। সবচেয়ে বড় অসুবিধা এই যে, আইনটির কার্যকরের তারিখ নির্ধারণ করে এখনও প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। বিধি প্রণয়নও হয়নি। বিধি প্রণয়ন হওয়ার পরই কেবল সরকার হিন্দু বিয়ে রেজিস্ট্রার নিয়োগ দিতে পারবেন। আর তখনই আইনটি প্রায়োগিক দিক থেকে কার্যকারিতা পাবে।
প্রসঙ্গক্রমে শতাধিক বছর আগে রেজিস্ট্রেশন এ্যাক্ট ১৯০৮-এর যে সংশোধনী আনা হয়, যা এখানে তুলে ধরা হলো-
(bb) registration fee payable for registration of a declaration of gift of any immovable property made under the Hindu, Christian and Buddhist Personal Law, if such gift is permitted by their Personal Law, shall be one hundred taka irrespective of the value of the property, provided such gift is made between spouses, parents and children, grand parents and grand children, full brothers, full sisters and, full brothers and full sisters
এই আইনটিতে সংশোধনী আনার ফলে সুবিধা ভোগ করবেন হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকল ধর্মাবলম্বীই।
এর উল্লেখযোগ্য দিক হলো, কোনো মা-বাবা তার জীবিত অবস্থায় বিশেষত হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা যদি চান তাদের কন্যাসন্তানকে কিছু সম্পত্তি দিয়ে যেতে (যেহেতু মৃত্যুর পর ছেলে থাকলে কন্যাসন্তানরা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়), তাহলে তারা মাত্র ১০০ টাকা কোর্ট ফি দিয়ে নির্ধারিত সম্পত্তি কন্যার অনুকূলে দান বা গিফট করতে পারবেন। এই আইনটির ক্ষেত্রেও একই অসুবিধা আছে। এখনও এর প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। আমরা আশা করব উল্লিখিত দুটি আইনেরই কার্যকারিতা সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারির বিষয়ে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
হিন্দু বিয়ে নিবন্ধন আইন ২০১২ অনেক না পাওয়ার মধ্যেও আলো বয়ে আনে। এটির ব্যাপক প্রচার আবশ্যক। এ ব্যাপারে একটি কথা না বললেই নয়। হিন্দু বিয়ে নিবন্ধন আইনের কারণে ভুক্তভোগী হিন্দু স্বামী-স্ত্রীদের জন্য বিয়ে বিচ্ছেদ আইন প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবি। The Hindu Married Women’s Right to Separate Residence and Maintenance Act,1946 কারণে ভুক্তভোগী স্বামী-স্ত্রী একে অপরের থেকে আলাদা থাকতে পারেন। কিন্তু তা বিবাহের পরিসমাপ্তি ঘটায় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই সারাজীবন আইন না থাকার কারণে অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। এ বিষয়টিকে মাথায় রেখে সরকারের উচিত হবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে হলেও শর্তসাপেক্ষে আদালতের মাধ্যমে বিয়ে বিচ্ছেদ আইন প্রণয়নে উদ্যোগী হওয়া।
No comments