‘আমি ছিলাম বিনোদনের ফেরিওয়ালা’
উৎপল শুভ্র: ব্রায়ান লারাকে ব্রায়ান লারা
বানিয়েছে ওই থ্রি সেভেনটি ফাইভ। ওটাই বদলে দিয়েছে আপনার জীবন। এত দিন পর,
১৯৯৪ সালের অ্যান্টিগার কথা ভাবলে কী মনে হয়? ব্রায়ান লারা: মনে পড়ে পরের সময়টার কথা।
এটা ছিল খুব কঠিন। সান্তা ক্রুজ নামে ছোট্ট একটা গ্রাম থেকে উঠে এসে আমি
যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে ও বিশ্ব ক্রিকেটে নিজেকে ব্যাটসম্যান হিসেবে
প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছি, তখন হঠাৎ করেই সব বদলে গেল। পরিবর্তনটা এমন
রাতারাতি হলো যে এটার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া ছিল খুব কঠিন। এর পর যা হয়েছে,
সেটিকে বলতে পারেন ট্রায়াল অ্যান্ড এরর। ভুল করেছি, তা থেকে শিখেছি। আবার
ভুল করেছি, শিখেছি। আমি এর জন্য একদমই প্রস্তুত ছিলাম না। তবে এখন আর এ
নিয়ে আক্ষেপ করি না। এটাই আমার চরিত্র গড়ে দিয়েছে। ওই সবকিছু মিলিয়েই আমি
এই আজকের আমি বা ১০ বছর আগের আমি। ভালো-খারাপ যত অভিজ্ঞতা হয়েছে, সবকিছুই
আমার। এটা নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই।
উ. শু.: ৩৭৫ দিয়েই শুরু হয়েছিল আপনার স্বপ্নযাত্রা। কাউন্টিতে গিয়ে ৫০১ করলেন। সেঞ্চুরি করাটা যেন সকালে নাশতা করার মতো একটা অভ্যাস হয়ে গেল (আট ইনিংসে সাতটি সেঞ্চুরি করেছিলেন লারা)। আপনার কি মনে হয়, ওই সময়টাই ব্যাটসম্যান ব্রায়ান লারার সেরা সময়?
লারা: আমি তা মনে করি না। নতুন ফেনোমেনা হিসেবে তখন হয়তো অনেক হইচই হয়েছে। তবে আমার সেরা সময় ওটা নয়। অবশ্যই ওই ছয়টি মাস ছিল বিশেষ কিছু। তবে আমি বিশ্বাস করি, ১৯৯৯-এর শুরুতে ওয়েস্ট ইন্ডিজে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজে বা এর পর শ্রীলঙ্কায় (২০০১) আমি আরও পরিণত ব্যাটিং করেছি। তত দিনে নিজের খেলাটা আরও ভালো বুঝেছি, ১৯৯৪-এর তুলনায় প্রতিপক্ষও কিন্তু তখন আমার খেলা নিয়ে অনেক বেশি ভালো জানত। ১৯৯৮ সালের শেষ দিকে বা বলতে পারেন ১৯৯৯ সালের শুরু থেকে ব্যাটসম্যান হিসেবে আমার মনে হতো, সবকিছু আমার নিয়ন্ত্রণে আছে। আমি যেকোনো পরিস্থিতি সামলাতে প্রস্তুত।
উ. শু.: লোকে ৩৭৫ বা ৪০০ নটআউটের কথা হয়তো বেশি বলে, কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বারবাডোজে একা ম্যাচ জেতানো অপরাজিত ১৫৩, সিডনিতে ২৭৭—আপনার প্রথম সেঞ্চুরি, শ্রীলঙ্কায় মুরালিকে পাড়ার বোলারের পর্যায়ে নামিয়ে এনে এক টেস্টের দুই ইনিংসে ডাবল সেঞ্চুরি ও সেঞ্চুরি...এমন অসাধারণ সব ইনিংস আছে আপনার। আপনার চোখে এর মধ্যে নাম্বার ওয়ান কোনটি?
লারা: আমি এমন রেটিং করতে পছন্দ করি না। তবে তার পরও বলছি। কারণ আপনি এত সব ইনিংসের কথা বললেন, অথচ বারবাডোজে ওই ১৫৩ নটআউটের এক সপ্তাহ আগে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই জ্যামাইকাতে ২১৩-এর কথা বললেন না। সবাই হয়তো ওই ইনিংসটিকে অন্য অনেক ইনিংসের চেয়ে ওপরে রাখবে না। তবে আমি রাখি। কারণ মাঠে ও মাঠের বাইরে যা হচ্ছিল, সেই ঝাপটাটা আমার গায়েই সবচেয়ে বেশি লাগছিল (দক্ষিণ আফ্রিকায় গোহারা হেরে আসার পর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম টেস্টে ৫১ রানে অলআউট হয়েছিল ব্রায়ান লারার ওয়েস্ট ইন্ডিজ)। এ কারণেই আমি মনে করি, ওই ইনিংসটা আমার জীবন ও আমার ক্রিকেটের জন্য একটা ডিফাইনিং মোমেন্ট। ওই ইনিংসটা এমন একটা আবেগময় অভিজ্ঞতা ছিল যে এখন তা ব্যাখ্যা করা কঠিন। আমার কাছে ওটা বিশেষ একটা ইনিংস হয়ে আছে। চিরদিন তা-ই থাকবে।
উ. শু.: স্টিভ ওয়াহ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, সিরিজে আপনার এমন জ্বলে ওঠায় নাকি বড় ভূমিকা রেখেছিল জ্যামাইকাতে একটা ঝামেলা। আপনি নেটে ব্যাটিং করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু অস্ট্রেলিয়ানরা নেট ছাড়ছিল না। আপনি নাকি ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন...
লারা: ও ঠিকই বলেছে। কথাটা ঠিক, তবে আমি ওই ঘটনার বিস্তারিততে যাচ্ছি না। স্টিভ ওয়াহর বইটাও আমি পড়িনি। তবে এটা ঠিক, ওই সকালে মানে জ্যামাইকা টেস্টের দ্বিতীয় দিন সকালে, ওই ঘটনা আমাকে খুব তাতিয়ে দিয়েছিল।
উ. শু.: নিজেকে উদ্দীপ্ত করতে আপনার কি এমন কিছু লাগত? কথাটা কেন বলছি, মাইকেল আথারটন তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন, তিনি তাঁর খেলোয়াড়দের বলে দিয়েছিলেন, আপনি ব্যাটিং করার সময় আপনাকে যেন কেউ কিছু না বলে...
লারা: না, এমন না যে নিজেকে উদ্দীপ্ত করতে আমার এমন কিছু লাগতই। তবে মাঠে যদি আমাকে চ্যালেঞ্জ করা হতো, সেটি শুধু বল দিয়ে নয়, মুখে কিছু বলেও, তাহলে আমি অমন কিছু করেই জবাব দিতাম। ওসব আমার ওপর নেতিবাচক প্রভাবের বদলে ইতিবাচক প্রভাবই ফেলত।
উ. শু.: কোথাও পড়েছি, ম্যাথু হেইডেন আপনার রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে, এই খবরটা আপনি পেয়েছিলেন প্রায় শেষ রাতে। শোনার পর তাৎক্ষণিক অনুভূতিটা কী হয়েছিল?
লারা: সত্যি বলছি, আমি ভারমুক্তির আনন্দ পেয়েছিলাম। আপনাকে একটু আগেই তো বললাম, ৩৭৫ করার পর কিছুদিন খুব কঠিন যাওয়ার পরে চিন্তাভাবনায় আমি অনেক পরিণত হয়ে গিয়েছিলাম। বলতে পারেন, হেইডেন ওই রেকর্ড ভাঙার বছর চারেক আগে থেকে মানে ১৯৯৯ সাল থেকেই আমি সবকিছু নতুন চোখে দেখতে শুরু করেছিলাম। তত দিনে আমার কাছে খুব পরিষ্কার হয়ে গেছে যে আমি কী করতে চাই, কী অর্জন করতে চাই। এসবের মধ্যে রেকর্ড কোনো বিবেচনাই ছিল না। বরং রেকর্ডটা করার পর কয়েক বছর এটা উল্টো একটা বোঝা হয়ে গিয়েছিল আমার জন্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমার জন্য দুর্ভাগ্য না (হাসি), বলছি ম্যাটি হেইডেনের দুর্ভাগ্যের কথা, ছয় মাস পর আবার ইংল্যান্ড সেই অ্যান্টিগায় এল। অ্যান্ড ইট হ্যাপেনড অ্যাগেইন।
উ. শু.: আপনি বিশ্ব রেকর্ড পুনরুদ্ধার করার পর আমি সেটিকে মোহাম্মদ আলীর হেভিওয়েট বক্সিং শিরোপা পুনরুদ্ধারের সঙ্গে তুলনা করেছিলাম। সবচেয়ে অবিশ্বাস্য দিক ছিল, সাধারণত যে বয়সে ব্যাটসম্যানরা বড় ইনিংস খেলতে পারেন, আপনি সেই বয়সটা পেরিয়ে গিয়েছিলেন (লারা তখন প্রায় ৩৫)। রেকর্ডটা ফিরে পাওয়ার জন্য কি আপনার মনে বাড়তি কোনো জেদ ছিল?
লারা: না, না...আমি তো বললামই, আমি বরং এতে ভারমুক্ত হয়েছিলাম। আমি যদি রেকর্ডটা আবার ফিরে পেতে চাইতাম, তা হলে কখনোই তা করতে পারতাম না। জীবনে আমি ব্যক্তিগত প্রেরণা থেকে যা যা করতে চেয়েছি, তার কোনো কিছুই করতে পারিনি।
উ. শু.: জীবনে যত অর্জন, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় মনে করেন কোনটিকে?
লারা: আমার দুই মেয়ে (হাসি)। সুন্দর দুটি মেয়ে আছে আমার। হ্যাঁ, আমার খুব ভালো একটা ক্যারিয়ার ছিল। আরেকটা কথাও বলি, ক্যারিয়ারজুড়ে নিজেকে আমি বিনোদনের ফেরিওয়ালা হিসেবেই দেখেছি। আমার মনে হয়, ক্রীড়াবিদদের সবারই উচিত নিজেদের সেভাবেই দেখা। মানুষ এত কষ্ট করে টাকা খরচ করে মাঠে আসে বিনোদিত হতে, আপনাকে পারফর্ম করতে দেখতে। আমি আমার সামর্থ্যের সবটা দিয়ে তা করার চেষ্টা করেছি। তবে ক্রিকেটই তো সব নয়, ক্রিকেট মাঠের বাইরের জীবনে আমার দুটি মেয়ে আছে। ওই দুজন আমার কাছে স্পেশাল। ওরাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন।
উ. শু.: ক্রিকেট মাঠ থেকে একেবারে বেরিয়ে যাওয়ার আগে দর্শকদের কাছে আপনার শেষ প্রশ্ন ছিল, ‘ডিড আই এন্টারটেইন?’ আগে থেকেই কি ঠিক করে রেখেছিলেন যে এমন কিছু বলবেন?
লারা: না, ওই প্রশ্নটা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বেরিয়ে এসেছিল। মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ওই মুহূর্তটাতে পুরো ক্যারিয়ার যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। হঠাৎ মনে হলো, গত ১৭ বছর তুমি কী দিয়েছ? এটা করেছ, ওটা করেছ। কিন্তু আসলে তো খেলেছ মানুষকে খুশি করার জন্য। ক্রিকেট খেলা শুরুর দিনটি থেকে বাবার মুখে হাসি দেখাটা ছিল আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। স্কুল ক্রিকেট থেকে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে যখন এগিয়ে যাচ্ছি, কী চাওয়া ছিল আমার? চাওয়া ছিল, বাবাকে খুশি করা, পরিবারকে খুশি করা। এটা করব, ওটা করব, এই রেকর্ড করতে হবে, ওই রেকর্ড...এমন কিছু নয়। আসলে তো ব্যাপারটা তোমার খেলা যারা ভালোবাসে, তাদের খুশি করা। ওই কথাটা তাই স্বতঃস্ফূর্তভাবেই মনে হয়েছিল, হূদয়ের গভীর থেকেই উঠে এসেছিল প্রশ্নটা।
উ. শু.: এমন অনেক ব্যাটসম্যানের সঙ্গেই কথা হয়েছে, যাঁরা লারা হতে চাইতেন বা চান। আপনার কখনো কারও ব্যাটিং দেখে মনে হয়েছে, ইশ্, আমি যদি অমন ব্যাটিং করতে পারতাম!
লারা: না, না...অবশ্যই অনেকের আমার চেয়ে ভালো টেকনিক ছিল। নির্দিষ্ট কোনো বোলিং হয়তো কেউ আমার চেয়ে ভালো খেলেছে। তবে কাউকে দেখেই আমার মনে ঈর্ষা জাগেনি। মনে হয়নি, আহা, আমার কেন ওটা নেই। প্রকৃতিদত্ত যা ছিল আমার, সেটির জন্যই আমি কৃতজ্ঞতা মেনেছি। সেটি দিয়েই প্রকাশ করেছি নিজেকে। আমার কোনো আক্ষেপ নেই।
উ. শু.: ১৯৯৫ সালে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আপনাকে প্রশ্ন করেছিলাম, এমন তিনজনের নাম বলতে যাঁদের আপনি ডিনারে আমন্ত্রণ জানাতে চান। আপনি আর্নি এলস, মাইকেল জর্ডান ও মাইকেল জ্যাকসনের কথা বলেছিলেন। আর্নি এলসের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছে জানি, তাঁর সঙ্গে গলফও খেলেছেন অনেকবার। বাকি দুজনের সঙ্গে কি দেখা হয়েছে?
লারা: না, না, ওই দুজনের সঙ্গে দেখা হয়নি। তবে আমার মনে হয়, এত দিনে তালিকাটায় একটু পরিবর্তন হয়েছে। সেটিই তো স্বাভাবিক, তাই না?
উ. শু.: এখন তা হলে সেখানে কোন তিনটি নাম?
লারা: বারাক ওবামার সঙ্গে দেখা হওয়াটা ছিল খুব স্পেশাল। কয়েক মিনিটের জন্যই দেখা হয়েছিল। উনি মজা করে ব্যাটিং করেছিলেন। ভালোই লেগেছে। তবে ডিনারে আমন্ত্রণ জানাব কাকে, এটা যদি প্রশ্ন হয়, এখন হয়তো তা জানাব আমার মেয়েদের বয়ফ্রেন্ডদেরই (হাসি)। বড় মেয়েটা তো ষোলো হয়ে গেল! আসলে বিশ্বের নানা দেশে গিয়ে অনেক বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে, আমি তা খুব উপভোগও করেছি। আমার জীবনটা মন্দ না!
উ. শু.: নেলসন ম্যান্ডেলা ত্রিনিদাদে নেমে প্রথম প্রশ্নটাই নাকি করেছিলেন, ‘হোয়ার ইজ ব্রায়ান লারা?’
লারা: আমিও তা শুনেছি। তবে তখন আমি ওখানে ছিলাম না।
উ. শু.: পরে তো ম্যান্ডেলার সঙ্গে দেখা হয়েছে, তাই না?
লারা: হ্যাঁ, দেখা হয়েছে।
উ. শু.: একজন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান হিসেবে নেলসন ম্যান্ডেলাকে কী চোখে দেখেন?
লারা: ওয়েস্ট ইন্ডিজে ম্যান্ডেলাকে সবাই খুব সম্মান করে। শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজ কেন, সারা বিশ্বই তো ওনাকে অন্য চোখে দেখে। গ্রেট ম্যান। সারা জীবন নীতি ও আদর্শের জন্য লড়ে গেছেন। উনি বোধ হয় এখন নব্বইয়ের ঘরে। আমার মনে হয়, উনি এমন একজন মানুষ, পুরো বিশ্বেই অনেক মানুষ যাঁকে আদর্শ মানে।
উ. শু.: ক্যারিয়ারে এত প্রাপ্তির মধ্যে কোনো আক্ষেপ কি নেই?
লারা: না, কোনো আক্ষেপ নেই। দারুণ একটা ক্যারিয়ার কেটেছে। এই বাংলাদেশে এসেও যে ভালোবাসা পাচ্ছি, তাতে আমি অভিভূত। এখনো আমি বিশ্বজুড়ে ঘুরে বেড়াই। আগেই বললাম, আমার দারুণ দুটি মেয়ে আছে। সব মিলিয়ে আমি খুব ভালো আছি। খুব ভালো।
উ. শু.: ৩৭৫ দিয়েই শুরু হয়েছিল আপনার স্বপ্নযাত্রা। কাউন্টিতে গিয়ে ৫০১ করলেন। সেঞ্চুরি করাটা যেন সকালে নাশতা করার মতো একটা অভ্যাস হয়ে গেল (আট ইনিংসে সাতটি সেঞ্চুরি করেছিলেন লারা)। আপনার কি মনে হয়, ওই সময়টাই ব্যাটসম্যান ব্রায়ান লারার সেরা সময়?
লারা: আমি তা মনে করি না। নতুন ফেনোমেনা হিসেবে তখন হয়তো অনেক হইচই হয়েছে। তবে আমার সেরা সময় ওটা নয়। অবশ্যই ওই ছয়টি মাস ছিল বিশেষ কিছু। তবে আমি বিশ্বাস করি, ১৯৯৯-এর শুরুতে ওয়েস্ট ইন্ডিজে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজে বা এর পর শ্রীলঙ্কায় (২০০১) আমি আরও পরিণত ব্যাটিং করেছি। তত দিনে নিজের খেলাটা আরও ভালো বুঝেছি, ১৯৯৪-এর তুলনায় প্রতিপক্ষও কিন্তু তখন আমার খেলা নিয়ে অনেক বেশি ভালো জানত। ১৯৯৮ সালের শেষ দিকে বা বলতে পারেন ১৯৯৯ সালের শুরু থেকে ব্যাটসম্যান হিসেবে আমার মনে হতো, সবকিছু আমার নিয়ন্ত্রণে আছে। আমি যেকোনো পরিস্থিতি সামলাতে প্রস্তুত।
উ. শু.: লোকে ৩৭৫ বা ৪০০ নটআউটের কথা হয়তো বেশি বলে, কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বারবাডোজে একা ম্যাচ জেতানো অপরাজিত ১৫৩, সিডনিতে ২৭৭—আপনার প্রথম সেঞ্চুরি, শ্রীলঙ্কায় মুরালিকে পাড়ার বোলারের পর্যায়ে নামিয়ে এনে এক টেস্টের দুই ইনিংসে ডাবল সেঞ্চুরি ও সেঞ্চুরি...এমন অসাধারণ সব ইনিংস আছে আপনার। আপনার চোখে এর মধ্যে নাম্বার ওয়ান কোনটি?
লারা: আমি এমন রেটিং করতে পছন্দ করি না। তবে তার পরও বলছি। কারণ আপনি এত সব ইনিংসের কথা বললেন, অথচ বারবাডোজে ওই ১৫৩ নটআউটের এক সপ্তাহ আগে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই জ্যামাইকাতে ২১৩-এর কথা বললেন না। সবাই হয়তো ওই ইনিংসটিকে অন্য অনেক ইনিংসের চেয়ে ওপরে রাখবে না। তবে আমি রাখি। কারণ মাঠে ও মাঠের বাইরে যা হচ্ছিল, সেই ঝাপটাটা আমার গায়েই সবচেয়ে বেশি লাগছিল (দক্ষিণ আফ্রিকায় গোহারা হেরে আসার পর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম টেস্টে ৫১ রানে অলআউট হয়েছিল ব্রায়ান লারার ওয়েস্ট ইন্ডিজ)। এ কারণেই আমি মনে করি, ওই ইনিংসটা আমার জীবন ও আমার ক্রিকেটের জন্য একটা ডিফাইনিং মোমেন্ট। ওই ইনিংসটা এমন একটা আবেগময় অভিজ্ঞতা ছিল যে এখন তা ব্যাখ্যা করা কঠিন। আমার কাছে ওটা বিশেষ একটা ইনিংস হয়ে আছে। চিরদিন তা-ই থাকবে।
উ. শু.: স্টিভ ওয়াহ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, সিরিজে আপনার এমন জ্বলে ওঠায় নাকি বড় ভূমিকা রেখেছিল জ্যামাইকাতে একটা ঝামেলা। আপনি নেটে ব্যাটিং করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু অস্ট্রেলিয়ানরা নেট ছাড়ছিল না। আপনি নাকি ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন...
লারা: ও ঠিকই বলেছে। কথাটা ঠিক, তবে আমি ওই ঘটনার বিস্তারিততে যাচ্ছি না। স্টিভ ওয়াহর বইটাও আমি পড়িনি। তবে এটা ঠিক, ওই সকালে মানে জ্যামাইকা টেস্টের দ্বিতীয় দিন সকালে, ওই ঘটনা আমাকে খুব তাতিয়ে দিয়েছিল।
উ. শু.: নিজেকে উদ্দীপ্ত করতে আপনার কি এমন কিছু লাগত? কথাটা কেন বলছি, মাইকেল আথারটন তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন, তিনি তাঁর খেলোয়াড়দের বলে দিয়েছিলেন, আপনি ব্যাটিং করার সময় আপনাকে যেন কেউ কিছু না বলে...
লারা: না, এমন না যে নিজেকে উদ্দীপ্ত করতে আমার এমন কিছু লাগতই। তবে মাঠে যদি আমাকে চ্যালেঞ্জ করা হতো, সেটি শুধু বল দিয়ে নয়, মুখে কিছু বলেও, তাহলে আমি অমন কিছু করেই জবাব দিতাম। ওসব আমার ওপর নেতিবাচক প্রভাবের বদলে ইতিবাচক প্রভাবই ফেলত।
উ. শু.: কোথাও পড়েছি, ম্যাথু হেইডেন আপনার রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে, এই খবরটা আপনি পেয়েছিলেন প্রায় শেষ রাতে। শোনার পর তাৎক্ষণিক অনুভূতিটা কী হয়েছিল?
লারা: সত্যি বলছি, আমি ভারমুক্তির আনন্দ পেয়েছিলাম। আপনাকে একটু আগেই তো বললাম, ৩৭৫ করার পর কিছুদিন খুব কঠিন যাওয়ার পরে চিন্তাভাবনায় আমি অনেক পরিণত হয়ে গিয়েছিলাম। বলতে পারেন, হেইডেন ওই রেকর্ড ভাঙার বছর চারেক আগে থেকে মানে ১৯৯৯ সাল থেকেই আমি সবকিছু নতুন চোখে দেখতে শুরু করেছিলাম। তত দিনে আমার কাছে খুব পরিষ্কার হয়ে গেছে যে আমি কী করতে চাই, কী অর্জন করতে চাই। এসবের মধ্যে রেকর্ড কোনো বিবেচনাই ছিল না। বরং রেকর্ডটা করার পর কয়েক বছর এটা উল্টো একটা বোঝা হয়ে গিয়েছিল আমার জন্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমার জন্য দুর্ভাগ্য না (হাসি), বলছি ম্যাটি হেইডেনের দুর্ভাগ্যের কথা, ছয় মাস পর আবার ইংল্যান্ড সেই অ্যান্টিগায় এল। অ্যান্ড ইট হ্যাপেনড অ্যাগেইন।
উ. শু.: আপনি বিশ্ব রেকর্ড পুনরুদ্ধার করার পর আমি সেটিকে মোহাম্মদ আলীর হেভিওয়েট বক্সিং শিরোপা পুনরুদ্ধারের সঙ্গে তুলনা করেছিলাম। সবচেয়ে অবিশ্বাস্য দিক ছিল, সাধারণত যে বয়সে ব্যাটসম্যানরা বড় ইনিংস খেলতে পারেন, আপনি সেই বয়সটা পেরিয়ে গিয়েছিলেন (লারা তখন প্রায় ৩৫)। রেকর্ডটা ফিরে পাওয়ার জন্য কি আপনার মনে বাড়তি কোনো জেদ ছিল?
লারা: না, না...আমি তো বললামই, আমি বরং এতে ভারমুক্ত হয়েছিলাম। আমি যদি রেকর্ডটা আবার ফিরে পেতে চাইতাম, তা হলে কখনোই তা করতে পারতাম না। জীবনে আমি ব্যক্তিগত প্রেরণা থেকে যা যা করতে চেয়েছি, তার কোনো কিছুই করতে পারিনি।
উ. শু.: জীবনে যত অর্জন, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় মনে করেন কোনটিকে?
লারা: আমার দুই মেয়ে (হাসি)। সুন্দর দুটি মেয়ে আছে আমার। হ্যাঁ, আমার খুব ভালো একটা ক্যারিয়ার ছিল। আরেকটা কথাও বলি, ক্যারিয়ারজুড়ে নিজেকে আমি বিনোদনের ফেরিওয়ালা হিসেবেই দেখেছি। আমার মনে হয়, ক্রীড়াবিদদের সবারই উচিত নিজেদের সেভাবেই দেখা। মানুষ এত কষ্ট করে টাকা খরচ করে মাঠে আসে বিনোদিত হতে, আপনাকে পারফর্ম করতে দেখতে। আমি আমার সামর্থ্যের সবটা দিয়ে তা করার চেষ্টা করেছি। তবে ক্রিকেটই তো সব নয়, ক্রিকেট মাঠের বাইরের জীবনে আমার দুটি মেয়ে আছে। ওই দুজন আমার কাছে স্পেশাল। ওরাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন।
উ. শু.: ক্রিকেট মাঠ থেকে একেবারে বেরিয়ে যাওয়ার আগে দর্শকদের কাছে আপনার শেষ প্রশ্ন ছিল, ‘ডিড আই এন্টারটেইন?’ আগে থেকেই কি ঠিক করে রেখেছিলেন যে এমন কিছু বলবেন?
লারা: না, ওই প্রশ্নটা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বেরিয়ে এসেছিল। মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ওই মুহূর্তটাতে পুরো ক্যারিয়ার যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। হঠাৎ মনে হলো, গত ১৭ বছর তুমি কী দিয়েছ? এটা করেছ, ওটা করেছ। কিন্তু আসলে তো খেলেছ মানুষকে খুশি করার জন্য। ক্রিকেট খেলা শুরুর দিনটি থেকে বাবার মুখে হাসি দেখাটা ছিল আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। স্কুল ক্রিকেট থেকে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে যখন এগিয়ে যাচ্ছি, কী চাওয়া ছিল আমার? চাওয়া ছিল, বাবাকে খুশি করা, পরিবারকে খুশি করা। এটা করব, ওটা করব, এই রেকর্ড করতে হবে, ওই রেকর্ড...এমন কিছু নয়। আসলে তো ব্যাপারটা তোমার খেলা যারা ভালোবাসে, তাদের খুশি করা। ওই কথাটা তাই স্বতঃস্ফূর্তভাবেই মনে হয়েছিল, হূদয়ের গভীর থেকেই উঠে এসেছিল প্রশ্নটা।
উ. শু.: এমন অনেক ব্যাটসম্যানের সঙ্গেই কথা হয়েছে, যাঁরা লারা হতে চাইতেন বা চান। আপনার কখনো কারও ব্যাটিং দেখে মনে হয়েছে, ইশ্, আমি যদি অমন ব্যাটিং করতে পারতাম!
লারা: না, না...অবশ্যই অনেকের আমার চেয়ে ভালো টেকনিক ছিল। নির্দিষ্ট কোনো বোলিং হয়তো কেউ আমার চেয়ে ভালো খেলেছে। তবে কাউকে দেখেই আমার মনে ঈর্ষা জাগেনি। মনে হয়নি, আহা, আমার কেন ওটা নেই। প্রকৃতিদত্ত যা ছিল আমার, সেটির জন্যই আমি কৃতজ্ঞতা মেনেছি। সেটি দিয়েই প্রকাশ করেছি নিজেকে। আমার কোনো আক্ষেপ নেই।
উ. শু.: ১৯৯৫ সালে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আপনাকে প্রশ্ন করেছিলাম, এমন তিনজনের নাম বলতে যাঁদের আপনি ডিনারে আমন্ত্রণ জানাতে চান। আপনি আর্নি এলস, মাইকেল জর্ডান ও মাইকেল জ্যাকসনের কথা বলেছিলেন। আর্নি এলসের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছে জানি, তাঁর সঙ্গে গলফও খেলেছেন অনেকবার। বাকি দুজনের সঙ্গে কি দেখা হয়েছে?
লারা: না, না, ওই দুজনের সঙ্গে দেখা হয়নি। তবে আমার মনে হয়, এত দিনে তালিকাটায় একটু পরিবর্তন হয়েছে। সেটিই তো স্বাভাবিক, তাই না?
উ. শু.: এখন তা হলে সেখানে কোন তিনটি নাম?
লারা: বারাক ওবামার সঙ্গে দেখা হওয়াটা ছিল খুব স্পেশাল। কয়েক মিনিটের জন্যই দেখা হয়েছিল। উনি মজা করে ব্যাটিং করেছিলেন। ভালোই লেগেছে। তবে ডিনারে আমন্ত্রণ জানাব কাকে, এটা যদি প্রশ্ন হয়, এখন হয়তো তা জানাব আমার মেয়েদের বয়ফ্রেন্ডদেরই (হাসি)। বড় মেয়েটা তো ষোলো হয়ে গেল! আসলে বিশ্বের নানা দেশে গিয়ে অনেক বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে, আমি তা খুব উপভোগও করেছি। আমার জীবনটা মন্দ না!
উ. শু.: নেলসন ম্যান্ডেলা ত্রিনিদাদে নেমে প্রথম প্রশ্নটাই নাকি করেছিলেন, ‘হোয়ার ইজ ব্রায়ান লারা?’
লারা: আমিও তা শুনেছি। তবে তখন আমি ওখানে ছিলাম না।
উ. শু.: পরে তো ম্যান্ডেলার সঙ্গে দেখা হয়েছে, তাই না?
লারা: হ্যাঁ, দেখা হয়েছে।
উ. শু.: একজন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান হিসেবে নেলসন ম্যান্ডেলাকে কী চোখে দেখেন?
লারা: ওয়েস্ট ইন্ডিজে ম্যান্ডেলাকে সবাই খুব সম্মান করে। শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজ কেন, সারা বিশ্বই তো ওনাকে অন্য চোখে দেখে। গ্রেট ম্যান। সারা জীবন নীতি ও আদর্শের জন্য লড়ে গেছেন। উনি বোধ হয় এখন নব্বইয়ের ঘরে। আমার মনে হয়, উনি এমন একজন মানুষ, পুরো বিশ্বেই অনেক মানুষ যাঁকে আদর্শ মানে।
উ. শু.: ক্যারিয়ারে এত প্রাপ্তির মধ্যে কোনো আক্ষেপ কি নেই?
লারা: না, কোনো আক্ষেপ নেই। দারুণ একটা ক্যারিয়ার কেটেছে। এই বাংলাদেশে এসেও যে ভালোবাসা পাচ্ছি, তাতে আমি অভিভূত। এখনো আমি বিশ্বজুড়ে ঘুরে বেড়াই। আগেই বললাম, আমার দারুণ দুটি মেয়ে আছে। সব মিলিয়ে আমি খুব ভালো আছি। খুব ভালো।
No comments