নির্মল সেন-মানবিকতার উজ্জ্বল বাতিঘর
বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ও বাম রাজনীতির এক বিরলপ্রায় আদর্শ ব্যক্তিত্ব ছিলেন নির্মল সেন। তিনি ৮২ বছর বয়সে চিরবিদায় নিলেন গত ৮ জানুয়ারি। পরিণত বয়সে মৃত্যু। তবু তার মৃত্যু আমাদের মন যেন মেনে নিতে পারছে না।
বয়সের বিবেচনায় অকালমৃত্যু বলা যাবে না, কিন্তু তার মতো আদর্শবান একজন প্রগতিশীল রাজনীতিক ও মানবকল্যাণে নিবেদিত সৎ ও মোহমুক্ত সাংবাদিকের মৃত্যু আমাদের অকালমৃত্যুর বেদনাবোধেই আপ্লুত করেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে, সাংবাদিকতার অঙ্গনে তার মৃত্যু এক বড় ধরনের শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। নির্মল সেনের আমৃত্যু স্বপ্ন আর সাধনা ছিল শোষণহীন একটি সাম্যবাদী সমাজ আর কল্যাণ রাষ্ট্রের। সাংবাদিক হিসেবে তার কলম সবসময় সোচ্চার থেকেছে যে কোনো অন্যায়-অসঙ্গতির বিরুদ্ধে। মানবাধিকারের পক্ষে আজীবন সোচ্চার থেকেছেন তিনি। এমনকি যখন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে চলাফেরার শক্তি হারিয়েছেন, তখনও হুইল চেয়ারে করে ছুটে যেতেন তিনি যেখানে মানবতার ডাক সেখানেই। শহীদ মিনারে, প্রেস ক্লাবে কতবার যে এসেছেন হুইল চেয়ারে বসে। দেশের প্রগতিশীল যে কোনো আন্দোলনে তিনি থাকতেন পুরোভাগে! জীবনপঞ্জির দিকে তাকালে দেখা যাবে_ নির্মল সেন জীবনের শুরুতেই দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন ত্যাগী, মানবতাবাদী, দেশপ্রেমিক আর অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের। সেই মূল্যবোধ রাজনীতির ক্ষেত্রে যেমন আজীবন আঁকড়ে থেকেছেন কোনো লোভ, মোহ বা প্রাপ্তির ফাঁদে পা না দিয়ে, তেমনই সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও শুরু থেকেই সততা, নিষ্ঠা আর পেশার প্রতি নিমগ্ন থেকে মানুষের কল্যাণেই কলম চালিয়েছেন। গণতন্ত্র, মানবাধিকার আর মতপ্রকাশের জন্য, সাংবাদিকদের অধিকারের জন্য আন্দোলন করেছেন। লিখেছেন। কারাবরণ করেছেন একাধিকবার। স্বাধীনতা-পরবর্তী অস্থির সময়ে যখন গুপ্তহত্যা সমাজে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল, তখনও সরকারি পত্রিকা দৈনিক বাংলায় চাকরি করেও সেখানেই কলাম লিখেছেন 'স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই'। তার সেই দাবি শাশ্বত মানব আকাঙ্ক্ষার বাণীতে পরিণত আজ বাংলাদেশে। ব্যক্তিগত জীবনে অকৃতদার নির্মল সেন যে কোনো দুস্থ, দরিদ্র শিক্ষার্থীর সংকট জানালে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। তাকে যারা চেনেন তারা জানেন কত তরুণ আশ্রিত ছিল তার সংসারহীন সংসারে। গোপালগঞ্জে নিজ বাড়িটিও তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার জন্য দান করে গেছেন। এমনকি নিজের শরীরটিও দিলেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য। আমাদের ভোগবাদী সমাজে ভোগবিমুখ মানবিকতার বাতিঘর হিসেবে তার নামটি গভীর শ্রদ্ধায় বহুকাল ধরে উচ্চারিত হবে_ এ আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস।
No comments