সদ্য সনদপ্রাপ্ত পুলিশদের কথা by এ কে এম শাহনাওয়াজ
আমাদের দেশে বরাবরই পুলিশ সংবাদ শিরোনাম হয়। যেহেতু দেশে সাংঘর্ষিক রাজনীতি বিরাজ করে। রাজনীতিকদের আচরণে তেমন গণতান্ত্রিক ভাবধারা প্রকাশ পায় না। সরকারে থাকলে সরকারি পক্ষ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য পেশিশক্তি হিসেবে পুলিশ ব্যবহার করে। দলীয়করণের ফর্মুলায় পুলিশের নিয়োগপ্রক্রিয়া চলে।
পুলিশ পদপ্রাপ্তিতে আর্থিক দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে, তাই সংবাদ শিরোনামে পুলিশের স্থান পাওয়াটা সাধারণত ইতিবাচক হয় না। পুলিশের আচরণবিধিতে তাদের জনগণের বন্ধু হওয়ার কথা থাকলেও পুলিশ মানুষের কাছে প্রীতিকর না হয়ে ক্রমে ভীতিকর হয়ে পড়ছে। অতি সম্প্রতি পুলিশ এতটাই অসহিষ্ণু আর মারমুখী হয়ে উঠেছে যে তাতে মনে হচ্ছে, সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের পয়সায় প্রতিপালিত পুলিশ এ দেশের সন্তান নয়, অন্য কোনো ভয়ংকর গ্রহ থেকে আসা। তবে দূষিত রাজনীতির আশকারায়ই যে পুলিশ আজ বেপরোয়া, এতে কারো দ্বিমত থাকবে না।
দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের বাণী থেকে এর সত্যতা বারবার প্রকাশ পাচ্ছে। আমাদের অনেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য আজকাল মানুষ টিভি সেটের সামনে বসে কৌতুকের আনন্দ নিয়ে উপভোগ করে। পরে বিস্মিত, আতঙ্কিত ও লজ্জায় অধোবদন হয়। সাংবাদিক পেটানোর উপর্যুপরি ঘটনা, প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের লাঠিপেটা করা, আইনজীবীদের ওপর হামলা করা, নারী নির্যাতনে অংশ নেওয়ার বীরত্ব প্রদর্শনের ঘটনা ঘটানো পুলিশকে অনিরাপদ সনদ দিয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের পরামর্শ দেন অ্যাকশনে থাকা পুলিশদের নাগালের বাইরে থাকতে। সুশৃঙ্খল বাহিনীর সদস্য বলে তাদের সংযত আচরণ করার কথা অভিভাবক হিসেবে বলেন না। এর এক দিন না যেতে স্বঘোষিত 'সফল' স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশকে সনদ দেওয়ার ভঙ্গিতেই বলেন, 'আগের তুলনায় পুলিশ এখন অনেক ভালো'। মন্ত্রীর বাণী শুনে বোঝা গেল না, এতে পুলিশ মর্যাদাবান হলো, না প্রেক্ষাপটসহ পুলিশের স্বরূপ উন্মোচিত হলো।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয় সনদে আমাদের মধ্যে পুলিশ নিয়ে নতুন করে দুর্ভাবনার উদ্রেক হয়েছে। সাংবাদিক সাগর-রুনির হত্যা নিয়ে পুলিশ ও মন্ত্রীর আশ্বাস, ঘোষণা- সব অসার প্রমাণিত হয়েছে। পুলিশ আদালতে দাঁড়িয়ে নিজেদের ব্যর্থতার দায় কবুল করেছে। সৌদি কূটনীতিক হত্যা-রহস্যের চুল পরিমাণ কিনারাও করতে পারেনি। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী নিখোঁজ নিয়ে খোঁড়াখুঁড়ির দায়িত্ব দুই পক্ষের রাজনীতিকদের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত পুলিশ। দেশজুড়ে খুন-গুমের মিছিল বড় হচ্ছে। ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনা বাড়বাড়ন্ত। সাংবাদিক, শিক্ষক, রাজনীতিকসহ নানা পেশাজীবী মানুষের সামনে পেটোয়া বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত পুলিশ। এমন একটি চিত্রিত বাস্তব পুলিশি ছবির সামনে বসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন এই পারফরম্যান্সের পুলিশকে 'আগের চেয়ে ভালো' বলে সনদ দেন, তখন আতঙ্কের সঙ্গে ভাবতে হয়, 'আগের' পুলিশ কতটা ভয়ংকর ছিল! একটি ইঙ্গিত অবশ্য মন্ত্রী মহোদয় দিয়েছেন। বলেছেন, আগের পুলিশ তাঁর পা ভেঙে দিয়েছিল। অর্থাৎ এখনকার পুলিশ আর তাঁদের পা ভাঙে না।
এ বক্তব্যের উত্তর অবশ্য সাধারণ মানুষের জানা। এই সাধারণ সত্য স্পষ্ট যে সরকারি পুলিশ সরকারি নেতা-মন্ত্রীদের পা ভাঙে না। ভাঙে বিক্ষোভরত বিরোধী রাজনীতিক ও নানা পেশাজীবী মানুষের, আর কর্তব্যরত সাংবাদিকের। এই সূত্রে আজকের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বিরোধী দলে থাকার যুগে রাজপথে বিক্ষোভ করেছিলেন, তখন পুলিশ তাঁর পা ভেঙেছিল। সে সময় সরকারে থাকা বিএনপি-জামায়াতের নেতা-মন্ত্রীরা পুলিশ-আতঙ্ক থেকে নিরাপদে ছিলেন। তাঁদের পা-ও সুরক্ষিত ছিল। তার চেয়ে সনদ প্রদানের সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পরিসংখ্যান দিয়ে যদি জানাতেন, আগের (চলতি রাজনীতির ভাষা অনুযায়ী এখানে 'আগের' বলতে মন্ত্রী সম্ভবত বিএনপি-জামায়াতের রাজত্বকালকে বুঝিয়েছেন) পুলিশ কতজন সাংবাদিক, শিক্ষক, আইনজীবী, রাজনীতিক বা সাধারণ মানুষকে ঠেঙ্গিয়েছে, কতজন নারীকে নির্যাতন করেছে, নিরাপত্তা চাইতে আসা কতজন শিষ্টের দমন করে দুষ্টের পালন করেছে, ঘুষ গ্রহণের পরিমাণ কত ছিল, বিচারবহির্ভূত কয়টি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল পুলিশ, দলীয় বিবেচনায় কয়জন সন্ত্রাসী ক্যাডার পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল, চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা হিসেবে বিশেষ জেলা (লক্ষ্মীপুর বা বগুড়া) কতটা গুরুত্ব পেয়েছিল এবং এই সরকারের চলতি সময় পর্যন্ত এসব বিষয়ের আমলনামা কী, তাহলে 'ভালো' বলাটাকে প্রামাণ্য করা যেত। বিপন্ন অসহায় মানুষ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরবর্তী প্রজ্ঞাপনে এই পরিসংখ্যান জেনে কিছুটা আশ্বস্ত হতে চায়।
সাংবাদিকদের ওপর পুলিশি নির্যাতনের কথা স্বরাস্ট্রমন্ত্রীর কাছে তুলতেই তাঁর আচরণে ছন্দপতন দেখা গেল। মনে হলো, অনেকটা পালিয়ে বাঁচতে চাইলেন তিনি। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যটিও আমি মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করেছি। আমার তখন প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের জন্য মায়া হচ্ছিল। কারণ তাঁর বক্তব্যে সরলতা ও অসহায়ত্ব দুটোই দেখতে পেয়েছিলাম। এই ঘটনার পরদিনই পুলিশ কিছুমাত্র সংযত না হয়ে খোদ রাজধানীতে কোর্ট চত্বরে বিচারপ্রার্থী মা-বাবাকে অন্যায়ভাবে পেটাল আর তরুণী মেয়ের শ্লীলতাহানি করল। এতেও লজ্জিত না হয়ে প্রতিবাদকারী সাংবাদিক ও আইনজীবীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করল পুলিশ। এরও একদিন পর গাজীপুরে পুলিশ আসামি ধরে তাকে সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে দিয়ে নিষ্ঠুর হত্যালীলা প্রত্যক্ষ করল।
এসব দেখে এখন দেশবাসীর মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় পুলিশের ওপর সব রকম নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। আর কী অদ্ভুত চামড়ার পুরুত্বের কারণে অন্য সব ঘটনা বাদ দিলাম, কোর্ট এলাকায় তরুণী নির্যাতনের পর সেই সাগর-রুনি হত্যার সূত্রে 'প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি' বলা পুলিশ প্রধানসহ ঊর্ধ্বতন কোনো পুলিশ কর্মকর্তা একবার দুঃখ প্রকাশও করলেন না। এঁদের কথা বাদ দিলাম এ জন্য যে প্রচলিত অবকাঠামো থেকেই তাঁরা পুলিশ হয়েছেন। কিন্তু সরকারদলীয় রাজনীতিক আর মন্ত্রীদের প্রতিক্রিয়া কোথায়? আওয়ামী লীগ নেতা হানিফ বা প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামদের নিত্যকার কথাবার্তায় না হয় মানুষ কম গুরুত্ব দেয়, কিন্তু মহাজোটের শরিক ইনু, মেনন- তাঁরা বিবেক বন্ধক রাখবেন, তা তো মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না। মতিয়া চৌধুরীর মতো সৎ ইমেজের মন্ত্রী নৈতিক সততার জোরে সরকারে থেকে সরকারকে সতর্ক করবেন এবং অসহায়দের পক্ষ নিয়ে কথা কলবেন- এ ছিল প্রত্যাশিত। তাহলে কি ধরে নেব, সবাই হতাশ হয়ে পর্দায় মুখ লুকাচ্ছেন?
ছাত্রদলের ক্যাডার নেতাদের বলতে শুনেছি, হাওয়া ভবনের সঙ্গে কথা পাকা হয়েছে, বিএনপির শাসনামলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোনোর পর পুলিশে চাকরি নিশ্চিত। একইভাবে এ আমলে ছাত্রলীগের ক্যাডাররাও পুলিশে চাকরি পাওয়ার গ্রিন সিগন্যাল পাচ্ছে বলে দাবি করছে। তাই ক্ষমতাপ্রিয় বিএনপি আর ক্ষমতাপ্রিয় আওয়ামী লীগের মধ্যে এ ক্ষেত্রে দর্শনগত দিক থেকে কোনো ফারাক নেই।
একথা মানছি, পুলিশ বাহিনী রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধ। সরকারের প্রতি বিশ্বস্ততা প্রকাশ পুলিশের কর্তব্য। আমরাও প্রত্যাশা করব, সেই বিশ্বস্ততা থেকে কিছুমাত্র বিচ্যুত হবে না পুলিশ। পাশাপাশি এ সত্যটি সমান গুরুত্বপূর্ণ পুলিশের কাছে যে তাঁরা জনগণের সেবক। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তাঁরা প্রতিপালিত হন, বিভাগটি সজ্জিত হয়। কোনো পক্ষের হীনরাজনৈতিক উদ্দেশ্য সফল করানোর জন্য তাঁদের নিশ্চয়ই লাঠিয়াল বানানো হয়নি। লাঠিয়াল নয়, অনেক সম্মানিত জায়গায় তাঁদের অবস্থান। এ দৃষ্টিতে পুলিশ যদি ঘুরে দাঁড়ায়, সততার সঙ্গে নিজ আদর্শ প্রতিপালন করতে চায়; তবে সর্বংসহা এ দেশের মানুষের নৈতিক সমর্থন ও আশ্রয় নিশ্চয়ই পুলিশ পাবে। এই পরিপ্রেক্ষিত পুলিশকে অনেক বেশি মনস্তাত্তি্বক শক্তি জোগাবে। আর অমন পরিবর্তিত অবস্থা দেখে সুবিধাবাদী সেয়ানা রাজনীতিকরা সুপথ খুঁজে নিতে বাধ্য হবেন।
লেখক : অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের বাণী থেকে এর সত্যতা বারবার প্রকাশ পাচ্ছে। আমাদের অনেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য আজকাল মানুষ টিভি সেটের সামনে বসে কৌতুকের আনন্দ নিয়ে উপভোগ করে। পরে বিস্মিত, আতঙ্কিত ও লজ্জায় অধোবদন হয়। সাংবাদিক পেটানোর উপর্যুপরি ঘটনা, প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের লাঠিপেটা করা, আইনজীবীদের ওপর হামলা করা, নারী নির্যাতনে অংশ নেওয়ার বীরত্ব প্রদর্শনের ঘটনা ঘটানো পুলিশকে অনিরাপদ সনদ দিয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের পরামর্শ দেন অ্যাকশনে থাকা পুলিশদের নাগালের বাইরে থাকতে। সুশৃঙ্খল বাহিনীর সদস্য বলে তাদের সংযত আচরণ করার কথা অভিভাবক হিসেবে বলেন না। এর এক দিন না যেতে স্বঘোষিত 'সফল' স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশকে সনদ দেওয়ার ভঙ্গিতেই বলেন, 'আগের তুলনায় পুলিশ এখন অনেক ভালো'। মন্ত্রীর বাণী শুনে বোঝা গেল না, এতে পুলিশ মর্যাদাবান হলো, না প্রেক্ষাপটসহ পুলিশের স্বরূপ উন্মোচিত হলো।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয় সনদে আমাদের মধ্যে পুলিশ নিয়ে নতুন করে দুর্ভাবনার উদ্রেক হয়েছে। সাংবাদিক সাগর-রুনির হত্যা নিয়ে পুলিশ ও মন্ত্রীর আশ্বাস, ঘোষণা- সব অসার প্রমাণিত হয়েছে। পুলিশ আদালতে দাঁড়িয়ে নিজেদের ব্যর্থতার দায় কবুল করেছে। সৌদি কূটনীতিক হত্যা-রহস্যের চুল পরিমাণ কিনারাও করতে পারেনি। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী নিখোঁজ নিয়ে খোঁড়াখুঁড়ির দায়িত্ব দুই পক্ষের রাজনীতিকদের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত পুলিশ। দেশজুড়ে খুন-গুমের মিছিল বড় হচ্ছে। ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনা বাড়বাড়ন্ত। সাংবাদিক, শিক্ষক, রাজনীতিকসহ নানা পেশাজীবী মানুষের সামনে পেটোয়া বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত পুলিশ। এমন একটি চিত্রিত বাস্তব পুলিশি ছবির সামনে বসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন এই পারফরম্যান্সের পুলিশকে 'আগের চেয়ে ভালো' বলে সনদ দেন, তখন আতঙ্কের সঙ্গে ভাবতে হয়, 'আগের' পুলিশ কতটা ভয়ংকর ছিল! একটি ইঙ্গিত অবশ্য মন্ত্রী মহোদয় দিয়েছেন। বলেছেন, আগের পুলিশ তাঁর পা ভেঙে দিয়েছিল। অর্থাৎ এখনকার পুলিশ আর তাঁদের পা ভাঙে না।
এ বক্তব্যের উত্তর অবশ্য সাধারণ মানুষের জানা। এই সাধারণ সত্য স্পষ্ট যে সরকারি পুলিশ সরকারি নেতা-মন্ত্রীদের পা ভাঙে না। ভাঙে বিক্ষোভরত বিরোধী রাজনীতিক ও নানা পেশাজীবী মানুষের, আর কর্তব্যরত সাংবাদিকের। এই সূত্রে আজকের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বিরোধী দলে থাকার যুগে রাজপথে বিক্ষোভ করেছিলেন, তখন পুলিশ তাঁর পা ভেঙেছিল। সে সময় সরকারে থাকা বিএনপি-জামায়াতের নেতা-মন্ত্রীরা পুলিশ-আতঙ্ক থেকে নিরাপদে ছিলেন। তাঁদের পা-ও সুরক্ষিত ছিল। তার চেয়ে সনদ প্রদানের সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পরিসংখ্যান দিয়ে যদি জানাতেন, আগের (চলতি রাজনীতির ভাষা অনুযায়ী এখানে 'আগের' বলতে মন্ত্রী সম্ভবত বিএনপি-জামায়াতের রাজত্বকালকে বুঝিয়েছেন) পুলিশ কতজন সাংবাদিক, শিক্ষক, আইনজীবী, রাজনীতিক বা সাধারণ মানুষকে ঠেঙ্গিয়েছে, কতজন নারীকে নির্যাতন করেছে, নিরাপত্তা চাইতে আসা কতজন শিষ্টের দমন করে দুষ্টের পালন করেছে, ঘুষ গ্রহণের পরিমাণ কত ছিল, বিচারবহির্ভূত কয়টি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল পুলিশ, দলীয় বিবেচনায় কয়জন সন্ত্রাসী ক্যাডার পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল, চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা হিসেবে বিশেষ জেলা (লক্ষ্মীপুর বা বগুড়া) কতটা গুরুত্ব পেয়েছিল এবং এই সরকারের চলতি সময় পর্যন্ত এসব বিষয়ের আমলনামা কী, তাহলে 'ভালো' বলাটাকে প্রামাণ্য করা যেত। বিপন্ন অসহায় মানুষ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরবর্তী প্রজ্ঞাপনে এই পরিসংখ্যান জেনে কিছুটা আশ্বস্ত হতে চায়।
সাংবাদিকদের ওপর পুলিশি নির্যাতনের কথা স্বরাস্ট্রমন্ত্রীর কাছে তুলতেই তাঁর আচরণে ছন্দপতন দেখা গেল। মনে হলো, অনেকটা পালিয়ে বাঁচতে চাইলেন তিনি। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যটিও আমি মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করেছি। আমার তখন প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের জন্য মায়া হচ্ছিল। কারণ তাঁর বক্তব্যে সরলতা ও অসহায়ত্ব দুটোই দেখতে পেয়েছিলাম। এই ঘটনার পরদিনই পুলিশ কিছুমাত্র সংযত না হয়ে খোদ রাজধানীতে কোর্ট চত্বরে বিচারপ্রার্থী মা-বাবাকে অন্যায়ভাবে পেটাল আর তরুণী মেয়ের শ্লীলতাহানি করল। এতেও লজ্জিত না হয়ে প্রতিবাদকারী সাংবাদিক ও আইনজীবীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করল পুলিশ। এরও একদিন পর গাজীপুরে পুলিশ আসামি ধরে তাকে সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে দিয়ে নিষ্ঠুর হত্যালীলা প্রত্যক্ষ করল।
এসব দেখে এখন দেশবাসীর মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় পুলিশের ওপর সব রকম নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। আর কী অদ্ভুত চামড়ার পুরুত্বের কারণে অন্য সব ঘটনা বাদ দিলাম, কোর্ট এলাকায় তরুণী নির্যাতনের পর সেই সাগর-রুনি হত্যার সূত্রে 'প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি' বলা পুলিশ প্রধানসহ ঊর্ধ্বতন কোনো পুলিশ কর্মকর্তা একবার দুঃখ প্রকাশও করলেন না। এঁদের কথা বাদ দিলাম এ জন্য যে প্রচলিত অবকাঠামো থেকেই তাঁরা পুলিশ হয়েছেন। কিন্তু সরকারদলীয় রাজনীতিক আর মন্ত্রীদের প্রতিক্রিয়া কোথায়? আওয়ামী লীগ নেতা হানিফ বা প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামদের নিত্যকার কথাবার্তায় না হয় মানুষ কম গুরুত্ব দেয়, কিন্তু মহাজোটের শরিক ইনু, মেনন- তাঁরা বিবেক বন্ধক রাখবেন, তা তো মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না। মতিয়া চৌধুরীর মতো সৎ ইমেজের মন্ত্রী নৈতিক সততার জোরে সরকারে থেকে সরকারকে সতর্ক করবেন এবং অসহায়দের পক্ষ নিয়ে কথা কলবেন- এ ছিল প্রত্যাশিত। তাহলে কি ধরে নেব, সবাই হতাশ হয়ে পর্দায় মুখ লুকাচ্ছেন?
ছাত্রদলের ক্যাডার নেতাদের বলতে শুনেছি, হাওয়া ভবনের সঙ্গে কথা পাকা হয়েছে, বিএনপির শাসনামলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোনোর পর পুলিশে চাকরি নিশ্চিত। একইভাবে এ আমলে ছাত্রলীগের ক্যাডাররাও পুলিশে চাকরি পাওয়ার গ্রিন সিগন্যাল পাচ্ছে বলে দাবি করছে। তাই ক্ষমতাপ্রিয় বিএনপি আর ক্ষমতাপ্রিয় আওয়ামী লীগের মধ্যে এ ক্ষেত্রে দর্শনগত দিক থেকে কোনো ফারাক নেই।
একথা মানছি, পুলিশ বাহিনী রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধ। সরকারের প্রতি বিশ্বস্ততা প্রকাশ পুলিশের কর্তব্য। আমরাও প্রত্যাশা করব, সেই বিশ্বস্ততা থেকে কিছুমাত্র বিচ্যুত হবে না পুলিশ। পাশাপাশি এ সত্যটি সমান গুরুত্বপূর্ণ পুলিশের কাছে যে তাঁরা জনগণের সেবক। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তাঁরা প্রতিপালিত হন, বিভাগটি সজ্জিত হয়। কোনো পক্ষের হীনরাজনৈতিক উদ্দেশ্য সফল করানোর জন্য তাঁদের নিশ্চয়ই লাঠিয়াল বানানো হয়নি। লাঠিয়াল নয়, অনেক সম্মানিত জায়গায় তাঁদের অবস্থান। এ দৃষ্টিতে পুলিশ যদি ঘুরে দাঁড়ায়, সততার সঙ্গে নিজ আদর্শ প্রতিপালন করতে চায়; তবে সর্বংসহা এ দেশের মানুষের নৈতিক সমর্থন ও আশ্রয় নিশ্চয়ই পুলিশ পাবে। এই পরিপ্রেক্ষিত পুলিশকে অনেক বেশি মনস্তাত্তি্বক শক্তি জোগাবে। আর অমন পরিবর্তিত অবস্থা দেখে সুবিধাবাদী সেয়ানা রাজনীতিকরা সুপথ খুঁজে নিতে বাধ্য হবেন।
লেখক : অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments