স্মরণ-শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এ কে শামসুদ্দিন by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ

তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা, অথচ মহকুমার রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং পাক বাহিনী সিরাজগঞ্জ দখল করা অবধি তিনি ছিলেন মহকুমার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় প্রধান সংগঠক বিলম্ব হলেও শহীদ এ কে শামসুদ্দিনকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হলো।


এ কথা অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলা যায় যে, তৎকালীন সিরাজগঞ্জ মহকুমার মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তিনি একক সংগঠক ছিলেন। এ শহর পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে চলে যাওয়ার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি তার সঙ্গে ছিলাম। ১৯৭০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জ মহকুমার রায়গঞ্জ থানায় থানা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগদান করি। এ বছরেই তিনি সিরাজগঞ্জ মহকুমা প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দেখা হলে তাকে রায়গঞ্জ আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাই। উত্তরে তিনি বললেন, আপনি ম্যাজিস্ট্রেট। আপনার দায়িত্ব অনেক। আমি এই থানার প্রশাসন নিয়ে আর চিন্তা করব না। এ কথায় আমি তার উদার মানসিকতার পরিচয় পেলাম।
এলো সেই ২৬ মার্চ '৭১। খুব ভোরে সিরাজগঞ্জের এসডিও এ কে শামসুদ্দিন ফোন করলেন। সমগ্র থানায় একটি মাত্র ফোন ছিল পোস্ট অফিসে। বাসা থেকে বেশ দূরে। ফোন ধরতেই এসডিও সাহেব জানালেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ট্যাংক এবং সর্বাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঢাকায় নিরস্ত্র জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। চালাচ্ছে গণহত্যা। পুলিশ ও ইপিআর (বর্তমানে বিজিবি) হেডকোয়ার্টার আক্রান্ত। আরও বললেন, পাবনার ডিসি প্রতিরোধ যুদ্ধে নামবেন। তার নিজের সিদ্ধান্তও তাই। আমি কী করব সেটা আমাকে ঠিক করতে হবে। তৎক্ষণাৎ জানিয়ে দিলাম যে, আমিও প্রতিরোধ যুদ্ধে অবতীর্ণ হবো। ২৬ মার্চ ধানগড়া ক্লাবে সভা করার পর রাজনৈতিক এবং ছাত্রনেতাদের সঙ্গে থানায় গিয়ে অস্ত্র বিতরণ করা হলো। অস্ত্র বলতে অবশ্য ৩০৩ (থ্রি নট থ্রি) রাইফেল। একটি রাইফেল নিজের কাছে রেখেছিলাম। স্থির হলো, পর্যায়ক্রমে এই অস্ত্র দিয়ে যুবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। আমার তৎপরতা সীমাবদ্ধ ছিল রায়গঞ্জ থানার ভেতর। এ কে শামসুদ্দিন পুরো মহকুমা ছুটে বেড়াতে লাগলেন। তিনি সবসময় কমব্যাট পোশাকে থাকতেন। ইতিমধ্যে সেনাবাহিনী এবং রাইফেলসের কয়েক সদস্য তার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। যতদূর মনে পড়ে, একটি এলএমজি এবং এসএলআর ওদের সঙ্গে ছিল। আমি জীবনে প্রথম এই অস্ত্র দুটি দেখলাম। এ কে শামসুদ্দিন বাঘাবাড়ী ঘাটে পাক বাহিনীর অগ্রগতিতে বাধা দিয়েছিলেন; সফল হননি। কেননা অস্ত্রবলে পার্থক্য ছিল আকাশ-পাতাল। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত সিরাজগঞ্জ মুক্ত ছিল। এর মাঝে তিনি একদিন ধানগড়ায় দুই জিপ মুক্তিবাহিনীর সদস্যসহ এসেছিলেন। আরেক দুপুরে তিনি কিছু লোক নিয়ে ধানগড়ায় আমার বাসায় আসেন। দুপুরে খাওয়ার পর বিশ্রাম নিয়ে ঠিক সন্ধ্যার কিছু আগে আমরা দুই গাড়িসহ চান্দায়কোনা বাজারে যাই। এটি ঢাকা-বগুড়া হাইওয়েতে অবস্থিত এবং তৎকালীন পাবনা জেলার শেষ সীমানা। সন্ধ্যা পার হয়েছে। আঁধার নেমেছে। এমন সময় দূর থেকে গাড়ির হেডলাইটের আলো দেখা যাচ্ছে। আমাদের ধারণা হলো, আমাদের অবস্থান সম্পর্কে পাকবাহিনীকে জানানো হয়েছে। ইতিমধ্যে পাকবাহিনী বগুড়া জেলার শেরপুরে চলে এসেছে। চান্দাইকোনা থেকে শেরপুর প্রায় ১৫ কিলোমিটার। এই শক্তি নিয়ে মোকাবেলা করা যাবে না মনে করে আমরা উল্লাপাড়া রওনা হলাম। পথিমধ্যে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় পতিত হলো। মারাত্মকভাবে কেউ আহত হয়নি। দুই গাড়ির লোক এক গাড়িতে নিয়ে সোজা উল্লাপাড়া থানায়। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা মীর্জা আবদুল লতিফ (প্রয়াত সাংসদ) তার বাহিনী নিয়ে অবস্থান করছিলেন। আমরা দুই বাহিনী এক হয়ে প্রস্তুত থাকলাম, যদি পাকবাহিনী আসে যুদ্ধ হবে। পরদিন সকালে উল্লাপাড়া থেকে আমি এবং এসডিও সাহেব সিরাজগঞ্জ শহরমুখে রওনা হলাম। ইতিমধ্যে পাকবাহিনী বাঘাবাড়ী ঘাট থেকে কামান দাগাতে দাগাতে চান্দাইকোনার দিকে অগ্রসর হলো। দুই ধারে সব গ্রামে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিল। সন্ধ্যার দিকে সিরাজগঞ্জ শহর থেকে আমরা সরে গেলাম। শহরবাসীকে এই অসহায় অবস্থার কথা জানানো হলো। পরে সিরাজগঞ্জ থানার ওসি কিছু দিন পালিয়ে থাকার পর কাজে যোগদান করেন এবং বেড়া থানাতে তাকে পোস্টিং দেওয়া হয়েছিল। সেখানে তাকে হত্যা করা হয়। বিদায়ের প্রাক্কালে শামসুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে কথা হলো যে, তিনি প্রথমে তার বাড়ি টাঙ্গাইলে যাবেন। সেখান থেকে মুজিবনগর সরকারে যোগ দেবেন। আমাকেও সেখানে যেতে বললেন। তিনি আরও সতর্ক করলেন যে, কোনো অবস্থাতেই যেন পাকিস্তানিদের অধীনে চাকরিতে যোগ দেওয়ার কথা না ভাবি। কেননা তাদের চোখে আমরা দেশদ্রোহী। আমরা পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছি। সে সময়ে আমার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। তিনি বলেন, আমার উচিত হবে বাসায় গিয়ে স্ত্রীর খোঁজখবর নেওয়া। তিনি আরও জানালেন, তার স্ত্রীও সন্তানসম্ভবা। তবে তিনি সম্ভবত তার মার কাছে আছেন। শামসুদ্দিন সাহেব আমাকে আরও বললেন, আমি তার চেয়েও বেশি বিপদে রয়েছি। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রায় ১ মাস সিরাজগঞ্জ মহকুমা মুক্ত ছিল। হিলি বর্ডারও এপ্রিলের মাঝামাঝি একেবারে উন্মুক্ত ছিল। এই সময়ে বহু নেতা/ভিআইপি এই রাস্তা দিয়ে সীমান্ত পার হয়েছেন। অতএব এ কে শামসুদ্দিনও গাড়ি নিয়ে টাকা ভর্তি করে হিলি দিয়ে সীমান্ত পার হতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মহকুমার মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা, অথচ মহকুমার রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং পাকবাহিনী সিরাজগঞ্জ দখল করা অবধি তিনি ছিলেন মহকুমার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় প্রধান সংগঠক। পরে শুনেছি, তিনি তার ভায়রা তৎকালীন চিফ সেক্রেটারি শফিউল আজমের আশ্বাসে কাজে যোগ দিয়েছিলেন। সম্ভবত শফিউল আজম অন্ধ পাকিস্তানভক্ত ছিলেন এবং বাংলাদেশবিদ্বেষী বললেও ভুল হবে না। প্রায় ১ মাস মুক্ত সময়ে তিনি অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন এবং প্রতিটি থানায় গিয়ে সবাইকে প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। থাকা-খাওয়ার কোনো ঠিক-ঠিকানা ছিল না। তিনি পূর্ণ আন্তরিকতা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ করেছেন। তিনি একজন অতি উচ্চমাপের দেশপ্রেমিক ছিলেন। তার অবদানের কথা শুধু সিরাজগঞ্জবাসী নয়, সমগ্র দেশের মানুষের স্মরণ রাখা উচিত।
আশা করব, এ কে শামসুদ্দিনের একাত্তরের রণক্ষেত্র সিরাজগঞ্জে তার স্বাধীনতা পদক অর্জন উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে এবং সে সময়ের সহযোদ্ধাদের তাতে অংশগ্রহণের সুযোগ হবে।

সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ :সাবেক ইপিসিএস ও সহকারী সচিব, মুজিবনগর সরকার
 

No comments

Powered by Blogger.