কালের আয়নায়-সরকার হার্ডলাইনে গিয়ে লাভবান হবে কি? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
বিরোধী দলের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে গিয়ে সরকার নিজেদের জনবিচ্ছিন্নতা বাড়ানো ছাড়া আর কোনো লাভেরই অধিকারী হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, কোনো গণতান্ত্রিক সরকার যখন রাজনৈতিক শক্তি দ্বারা বিরোধী পক্ষকে মোকাবেলা করার বদলে ক্ষমতার লাঠি দ্বারা তাদের দমন করতে চায়, তখনই বুঝতে হবে তারা দুর্বল হয়ে পড়েছেন।
তারা এখন একটি উইক গভর্নমেন্ট, মোটেই স্ট্রং গভর্নমেন্ট নয়। অতীতে বিএনপি সরকার এ ধরনের হার্ডলাইন ও দমননীতি দ্বারা ক্ষমতায়
থাকতে পারেনি
বাংলাদেশের রাজনীতি আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সরকার ও বিরোধী দল আবার রাজপথে মুখোমুখি। হরতালের প্রতি জনসমর্থন নেই, তবু সেই হরতালকে হাতিয়ার করে বিএনপি জোট আবার মাঠে নেমেছে। সরকারও হার্ডলাইনে গেছে। বিএনপি জোটের বিশালসংখ্যক নেতা রাজপথে অরাজকতা সৃষ্টি, ভাংচুরের দায়ে পুলিশি মামলায় জেলে বন্দি। তাতে বিরোধী দলের মিটিং, মিছিল, হরতাল করার জোর কমেছে। কিন্তু জনজীবনে দুর্ভোগ কিছুমাত্র কমেনি, বরং বেড়েছে। ১৭ মে বৃহস্পতিবারের হরতালেও তা প্রমাণ হয়েছে। দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক তেমন সফল হয়নি; কিন্তু ভাংচুর, গাড়িতে অগি্নসংযোগ হয়েছে সমানভাবেই।
বিরোধী দল আরও কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে। অন্যদিকে সরকারও যে হার্ডলাইনে গেছে, ব্যাপক ধরপাকড় থেকে তা বোঝা যাচ্ছে। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হচ্ছে, প্রাণ যাচ্ছে উলুখড়ের। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি এবং জাপানের উপ-প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ঢাকা সফর তাদের নিজ নিজ দেশের স্বার্থপ্রণোদিত হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রধান দু'দলকে তারা সংলাপে বসার পরামর্শ দিয়ে যাওয়ায় এবং দু'দলই সংলাপে আগ্রহ প্রকাশ করায় ঢাকায় মিডিয়াগুলো আশা প্রকাশ করছিল যে, দেশের রাজনীতিতে সংলাপ ও সমঝোতার হাওয়া বইছে। এ আশা যে কত ঠুনকো তা দু'দিন না যেতেই দেখা যাচ্ছে।
বিরোধী দল বিএনপি এবং তার জোটভুক্ত দলগুলো, বিশেষ করে জামায়াত সরকারের সঙ্গে ফলপ্রসূ কোনো সংলাপে আগ্রহী তা দেশের কাউকে সম্ভবত বিশ্বাস করানো যাবে না। তাদের এজেন্ডা আলাদা। এই এজেন্ডা হলো, দেশময় অরাজকতা সৃষ্টি দ্বারা '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করা। জামায়াত লোক দেখানোভাবে এবং বহির্বিশ্বকে বোকা বানানোর জন্য সংলাপে বসার কথা বলছে বটে, কিন্তু তাদের আসল উদ্দেশ্য বিএনপিকে আওয়ামী লীগ ও সরকারের সঙ্গে বিপজ্জনক সংঘাতে জড়িয়ে রেখে দেশময় সন্ত্রাস সৃষ্টি এবং '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নস্যাৎ করে দেওয়া। বিএনপি ও তার জোটভুক্ত অন্য দলগুলো জামায়াতের দ্বারা তাদের চক্রান্তে ব্যবহৃত হচ্ছে।
সরকারের এ কথা জানা থাকায় তাদের উচিত ছিল, দেশের অপশক্তির চক্রান্ত থেকে দেশকে মুক্ত করার চেষ্টার অংশ হিসেবে সংলাপে বসার ব্যবস্থা সম্পন্ন করা এবং তার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য তিন দেশের নেতার ঢাকা সফরের পর হার্ডলাইন থেকে আপাতত সরে আসা। ইলিয়াস আলী অপহরণ ইস্যুতে কিছুদিন আগের হরতালগুলোতে দাঙ্গা-হাঙ্গামার জন্য অভিযুক্ত বিএনপি নেতাদের পুলিশি মামলায় একেবারে জেলে না পাঠিয়ে জামিনে মুক্ত থাকায় এবং সংলাপে বসার সুযোগ দেওয়া।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনার জন্য সরকার বলছে, বিরোধী দল পার্লামেন্টে আসুক। বিরোধী দল বলছে, সংসদে সরকারের বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা। সেখানে গিয়ে আলোচনায় বসে লাভ নেই। সংসদের বাইরে সংলাপ অনুষ্ঠিত হোক। আমার ধারণা, দেশকে সংঘাত থেকে বাঁচানোর বৃহত্তর স্বার্থে সরকার এ দাবি মেনে নিলে সুবিবেচনার পরিচয় দিত। সংসদের বাইরের আলোচনায় একটা ঐকমত্য তৈরি হলে মীমাংসায় প্রস্তাবগুলো যুক্তভাবে সংসদে উত্থাপন করা যেত।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতার সঙ্গে আলাপ করে জেনেছি, দু'দলের সংলাপ দ্বারা বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে সমঝোতা হোক বিএনপি তা চায় এটা তারা বিশ্বাস করেন না। তারা মনে করেন, বিএনপি দাতা দেশগুলোর নেতাদের এবং দেশের মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য সংলাপে বসার বাহ্যিক আগ্রহ দেখাচ্ছে। কিন্তু '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, তারেক রহমান ও অন্যান্য বিরোধীদলীয় নেতার বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতি, সন্ত্রাসের মামলা এবং অন্যান্য কিছু জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তারা সরকারকে ছাড় দিয়ে সংলাপ সফল করবে আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড তা বিশ্বাস করছে না।
তাদের বিশ্বাস, কোনো না কোনো ছুতো তুলে তারা সংলাপ ব্যর্থ করবে এবং আওয়ামী লীগের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেশময় অরাজকতা সৃষ্টি করে অগণতান্ত্রিকভাবে সরকারের পতন ঘটানোর জন্য ইস্যুর পর ইস্যু তৈরি করবে। যেমন ব্রিটিশ আমলে অবিভক্ত ভারতের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য কংগ্রেম-লীগ তথা গান্ধী-জিন্নাহ বারবার বৈঠক হয়েছে। কিন্তু কোনোটাই সফল হয়নি। কংগ্রেস দোষ চাপিয়েছে মুসলিম লীগের ওপর। মুসলিম লীগ সেই দোষ কংগ্রেসের ওপর চাপিয়েছে। শেষ পর্যন্ত তৃতীয় পক্ষ র্যাডক্লিফের ছুরিতে ভারত ভাগ করে লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের মাধ্যমে দুই দলের ও দুই নেতার ওপর যে মীমাংসা চাপিয়ে দেয়, তারা তা মেনে নিতে বাধ্য হন।
এ কথা সত্য, আমরা তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ ছাড়া নিজেরা নিজেদের কোনো সমস্যারই সমাধান করতে পারি না। তাতে অনেক সময় আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হয়। বিদেশিরা এসে আমাদের ওপর মাতব্বরি করে। উপদেশ দেয়। এ কথা আমাদের জাতীয় নেতারা হয়তো উপলব্ধি করেন না। দ্বিপক্ষীয় সংলাপে না বসার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের নেতাদের যুক্তি সঠিক নয়, তা আমি মনে করি না। তথাপি আমার কথা, এখনই হার্ডলাইনে না গিয়ে সরকার বিএনপির শর্ত মেনে সংলাপে বসার আয়োজন করলে ভালো করত। গান্ধী-জিন্নাহ বৈঠকের মতো হাসিনা-খালেদা বৈঠকও সম্ভবত ব্যর্থ হতো। কিন্তু দেশের মানুষ জানতে পারত এই সংলাপ ব্যর্থ হওয়ার জন্য কাদের জেদ এবং অবাস্তব দাবি দায়ী। তারা কী উদ্দেশ্যে দেশে অরাজকতা জিইয়ে রাখতে চায়।
সরকার বলছে, বিরোধী দল অশুভ উদ্দেশ্যে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করতে চায়। বিরোধী দল বলছে, সরকারি দলের জোর-জুলুম, ইলিয়াস আলীর মতো তাদের নেতাদের গুম, খুন ইত্যাদি করার জন্যই দেশের মানুষ হরতাল চায় না জেনেও তারা হরতালে নামতে বাধ্য হচ্ছেন। তাতে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি হচ্ছে। বিএনপির সকল নেতা না চাইলেও জামায়াত যে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করতে চায় এ কথা সত্য। কিন্তু বিএনপির কাঁধে চেপে দেশময় অরাজকতা সৃষ্টিতে জামায়াতগোষ্ঠীর এই সুযোগ লাভের পেছনে আওয়ামী লীগ সরকারের দেশ শাসনে ব্যর্থতাও কি দায়ী নয়?
বিএনপির প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতা ইলিয়াস আলী (তিনি নিজে যাই হোন) রাজধানী ঢাকা থেকে অপহৃত হওয়ার পর মাসাধিককাল ধরে নিখোজ; পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কেউ কোনো খোঁজ করতে পারছে না; এটা কি কাজের কথা? সাগর-রুনি সাংবাদিক দম্পতির হত্যাকাণ্ড আজ পর্যন্ত রহস্যের জালে ঢাকা। এটা কি কোনো সরকারের জন্য গৌরবের কথা? তার ওপর আবার প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেন, 'কারও বেডরুমে গিয়ে পাহারা দেওয়া আমাদের দায়িত্ব নয়।' এই উক্তি শুনে দেশের মানুষ হতবাক হয়েছে। বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি তার সুযোগ নেবে না?
কোনো কোনো আওয়ামী মন্ত্রী যুক্তি দেখান, বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতাসহ অসংখ্য সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত তদন্ত পর্যন্ত বিএনপি সরকার করেনি। দোষীদের শাস্তি দেওয়া দূরের কথা আওয়ামী নেতাদের এই যুক্তি কি ধোপে টেকে? বিএনপি সরকার দেশ শাসনে অযোগ্য, অক্ষম এবং ব্যর্থ প্রমাণিত হওয়াতেই ২০০৮ সালের নির্বাচনে জনগণ এত বিরাট নির্বাচন-সাফল্য উপহার দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। তারা এই সরকার বিএনপির মতো ব্যর্থ হবে, দেশকে অপশাসন উপহার দেবে এটা দেখতে চায় না। এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসে যদি সাবেক বিএনপি সরকারের মতো দেশ শাসনে অযোগ্যতা ও ব্যর্থতাকেই অনুসরণ করে, তাহলে কোন মুখে তারা অতীতের সরকারের নিন্দা করবেন? কতদিন আর পুরনো গাজির গীত গেয়ে দেশবাসীর মন ভোলানো যাবে?
সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এক এপিএসের গাড়িতে কয়েক লাখ টাকা পেতেই এবং সুরঞ্জিত বাবু তার সঙ্গে জড়িত তা প্রমাণ হওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রী ধমক দিয়ে বলেছেন, মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে। মন্ত্রী আজ্ঞা পালন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী এটা যদি করতে পারেন, তাহলে এই কথিত দুর্নীতির চেয়েও গুরুতর বিরোধী দলের এক নেতার গুম হওয়া, সাংবাদিক দম্পতির নৃশংস হত্যা, দেশময় অপহরণ, হত্যার সংখ্যা বিপজ্জনকভাবে বেড়ে চলা সত্ত্বেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অবিলম্বে পদত্যাগ করা উচিত কথাটা কেন বলতে পারছেন না? অথবা তাকে আবুল হোসেনের মতো অন্য মন্ত্রকে সরিয়ে দিয়ে এই পদে একজন যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে পারছেন না? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন একজন অত্যন্ত ভালো মানুষ। আওয়ামী লীগের একজন নিবেদিত নেত্রী। অন্য কোনো মন্ত্রকের দায়িত্ব পেলে তিনি হয়তো দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিচয় দেবেন। কিন্তু একজন টাফ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার ব্যাপারে তার মধ্যে যে দক্ষতা ও ব্যক্তিত্বের অভাব রয়েছে, প্রধানমন্ত্রী কি গত তিন বছরেও তা বুঝতে পারেননি?
সরকার যদি অনেক ভালো কাজের মধ্যে দুটি মন্দ কাজও করে, জনজীবনের প্রাত্যহিক দুর্ভোগ কমাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সমুদ্র জয় করেও জনগণের মন জয় করা যাবে না। সরকারের ছোট-বড় সকল ব্যর্থতারই সুযোগ নেবে বিরোধী দল। ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া, সাগর-রুনির শয়নকক্ষে বসে নির্মম খুনের শিকার হওয়া ইত্যাদি ঘটনার ব্যাপারে সরকার যদি সামান্য সাফল্যেরও প্রমাণ দিতে পারত, তাহলে বিএনপি এগুলোকে ইস্যু করার এবং এ ইস্যু নিয়ে হরতালে নামার সুযোগ পেত না। দেশের মানুষ হরতাল পছন্দ করে না। কিন্তু বিএনপির ডাকা সাম্প্রতিক হরতালগুলো পছন্দ না করলেও তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়নি। দাতা দেশগুলোর সরকারি নেতারা, দেশের ব্যবসায়ীরা হরতালের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, দুই নেত্রীর মধ্যে সংলাপ-সমঝোতার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে 'পায়াস উইশ' ব্যক্ত করা ছাড়া আর কিছু করেননি। হিলারি ও প্রণব দু'জনেই ঢাকা এসেছিলেন বাংলাদেশের ওপর চাপ দিয়ে তাদের কিছু স্বার্থ আদায়ের জন্য। এ দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা তাদের স্বার্থ পূরণের সহায়ক। এ কথা তারা জানেন। এই রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করার ব্যাপারে তাই তারা কোনো সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন না।
যদি তারা তা করেন, তাহলে তাকে আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ বলে কেউ কেউ অভিযোগ করতে পারতেন। কিন্তু এই হস্তক্ষেপ শুভ ফলপ্রসূ হতো। ১৯৪৭ সালে কংগ্রেস-মুসলিম লীগের বিরোধ মেটানোর ব্যাপারেও ব্রিটিশ সালিশি ও হস্তক্ষেপ কি মেনে নেওয়া হয়নি? বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এমন কোনো পর্যায় নেই, যেখানে বিদেশি হস্তক্ষেপ ও ডমিনেন্স দেখা যাবে না। তাতে আমাদের আপত্তি নেই। যত আপত্তি, দেশের বিপজ্জনক রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করার ব্যাপারে আন্তরিকভাবে ইচ্ছুক কোনো মিত্র বিদেশি রাষ্ট্র মধ্যস্থতা করতে এলে।
১৯৬৫ সালে যখন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হয়, তখন যুদ্ধ থামানোর জন্য হস্তক্ষেপ করেছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। দু'দেশের নেতাদের তাসখন্দে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে বৈঠকের ব্যবস্থা করা হয়েছিল এবং তাসখন্দ শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এই চুক্তি উপমহাদেশে শান্তি ফিরিয়ে এনেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের এই উদ্যোগকে তখন কেউ উপমহাদেশে সোভিয়েত ইউনিয়নের হস্তক্ষেপ আখ্যা দেয়নি। এমনকি পাকিস্তানের মুরবি্ব দেশ এবং বিভিন্ন সামরিক চুক্তির পার্টনার আমেরিকাও মস্কোর এই উদ্যোগে বাধা দেয়নি, বরং স্বাগত জানিয়েছে।
বাংলাদেশে এখন শক্তিশালী এলিট ক্লাস আছে। তাদের একটি সুশীল সমাজ আছে, পশ্চিমা দাতা দেশগুলোর সঙ্গে যাদের সম্পর্ক প্রকাশ্য পিরিতির। তাদের শক্তিশালী ইংরেজি, বাংলা মিডিয়া আছে। তারা কেন নিরপেক্ষতার ভান করে আওয়ামী লীগ-বিরোধিতায় তাদের সকল ভূমিকা সীমাবদ্ধ করে না রেখে প্রকৃত নিরপেক্ষ ভূমিকা গ্রহণ এবং জনমত সংগঠিত করে দুই দলের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি দ্বারা তাদের সংলাপে ও সমঝোতায় বসতে বাধ্য করেন না তা আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধির অগম্য।
আমাদের নোবেল লরিয়েট ড. ইউনূস, ব্রিটিশ নাইট খেতাবধারী আবেদ সাহেবের আর্থ-সামাজিক স্ট্যান্ডিংও দেশে বিরাট। তারা কেন তাদের এই প্রভাব ও প্রতিপত্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে দুই নেত্রীকে সংলাপে বসতে চাপ না দিয়ে বিদেশিদের কাছে গিয়ে আত্মসম্মান বিকিয়ে ধর্ণা দেন? বিএনপি যাতে আর হরতাল, ধর্মঘট দ্বারা দেশময় অরাজকতা সৃষ্টিতে না এগোয় এবং আওয়ামী লীগ সরকারও তাদের জনসমর্থন ও রাজনৈতিক শক্তির অনুপস্থিতিতে প্রশাসনের দমননীতির সাহায্যে বিরোধী দলকে মোকাবেলার জন্য হার্ডলাইনে না যায়, সে জন্য অন্যান্য গণতান্ত্রিক দল, বিভিন্ন পেশার নেতৃস্থানীয় মানুষ, মিডিয়া, পেশাজীবী সমিতি, প্রভাবশালী সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দুটি প্রধান দলের ওপরই এমন চাপ সৃষ্টি করুন, যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ সকল অমীমাংসিত সমস্যা মীমাংসার জন্য দুই নেত্রী, দুই দল অবিলম্বে সংলাপে বসতে বাধ্য হয়। শুধু সংলাপে নয়, একটি সমঝোতায় পেঁৗছতে বাধ্য হয়। এই সংলাপকে একটি সর্বদলীয় রূপ দেওয়ার জন্য একটি শক্তিশালী নাগরিক কমিটি দ্বারা অনতিবিলম্বে দেশে একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করলে কেমন হয়?
বিএনপিকে বুঝতে হবে, বর্তমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে আন্দোলনের আরও কঠোর কর্মসূচি দিয়ে কোনো লাভ হবে না। এসব কর্মসূচি দ্বারা জনগণের জীবনে দুর্ভোগ বাড়ানো যাবে, সরকারের পতন ঘটানো যাবে না। তাদের আন্দোলনের পেছনে জনসমর্থনও আদৌ শক্তিশালী নয়। সাধারণ মানুষ বর্তমান সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত। কিন্তু বিএনপির সদ্য অতীতের দুঃশাসনের তিক্ত অভিজ্ঞতা এখনও তারা ভোলেনি। সরকার হটাও আন্দোলনে তাদের সায় নেই।
অন্যদিকে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে গিয়ে সরকার নিজেদের জনবিচ্ছিন্নতা বাড়ানো ছাড়া আর কোনো লাভেরই অধিকারী হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, কোনো গণতান্ত্রিক সরকার যখন রাজনৈতিক শক্তি দ্বারা বিরোধী পক্ষকে মোকাবেলা করার বদলে ক্ষমতার লাঠি দ্বারা তাদের দমন করতে চায়, তখনই বুঝতে হবে তারা দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তারা এখন একটি উইক গভর্নমেন্ট, মোটেই স্ট্রং গভর্নমেন্ট নয়। অতীতে বিএনপি সরকার এ ধরনের হার্ডলাইন ও দমননীতি দ্বারা ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। বরং তাদের পতন ত্বরান্বিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার যেন তাদের নীতি অনুসরণ করে একই পরিণতির দিকে দ্রুত ধাবমান না হয়।
লন্ডন, শুক্রবার ১৮ মে, ২০১২
থাকতে পারেনি
বাংলাদেশের রাজনীতি আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সরকার ও বিরোধী দল আবার রাজপথে মুখোমুখি। হরতালের প্রতি জনসমর্থন নেই, তবু সেই হরতালকে হাতিয়ার করে বিএনপি জোট আবার মাঠে নেমেছে। সরকারও হার্ডলাইনে গেছে। বিএনপি জোটের বিশালসংখ্যক নেতা রাজপথে অরাজকতা সৃষ্টি, ভাংচুরের দায়ে পুলিশি মামলায় জেলে বন্দি। তাতে বিরোধী দলের মিটিং, মিছিল, হরতাল করার জোর কমেছে। কিন্তু জনজীবনে দুর্ভোগ কিছুমাত্র কমেনি, বরং বেড়েছে। ১৭ মে বৃহস্পতিবারের হরতালেও তা প্রমাণ হয়েছে। দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক তেমন সফল হয়নি; কিন্তু ভাংচুর, গাড়িতে অগি্নসংযোগ হয়েছে সমানভাবেই।
বিরোধী দল আরও কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে। অন্যদিকে সরকারও যে হার্ডলাইনে গেছে, ব্যাপক ধরপাকড় থেকে তা বোঝা যাচ্ছে। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হচ্ছে, প্রাণ যাচ্ছে উলুখড়ের। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি এবং জাপানের উপ-প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ঢাকা সফর তাদের নিজ নিজ দেশের স্বার্থপ্রণোদিত হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রধান দু'দলকে তারা সংলাপে বসার পরামর্শ দিয়ে যাওয়ায় এবং দু'দলই সংলাপে আগ্রহ প্রকাশ করায় ঢাকায় মিডিয়াগুলো আশা প্রকাশ করছিল যে, দেশের রাজনীতিতে সংলাপ ও সমঝোতার হাওয়া বইছে। এ আশা যে কত ঠুনকো তা দু'দিন না যেতেই দেখা যাচ্ছে।
বিরোধী দল বিএনপি এবং তার জোটভুক্ত দলগুলো, বিশেষ করে জামায়াত সরকারের সঙ্গে ফলপ্রসূ কোনো সংলাপে আগ্রহী তা দেশের কাউকে সম্ভবত বিশ্বাস করানো যাবে না। তাদের এজেন্ডা আলাদা। এই এজেন্ডা হলো, দেশময় অরাজকতা সৃষ্টি দ্বারা '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করা। জামায়াত লোক দেখানোভাবে এবং বহির্বিশ্বকে বোকা বানানোর জন্য সংলাপে বসার কথা বলছে বটে, কিন্তু তাদের আসল উদ্দেশ্য বিএনপিকে আওয়ামী লীগ ও সরকারের সঙ্গে বিপজ্জনক সংঘাতে জড়িয়ে রেখে দেশময় সন্ত্রাস সৃষ্টি এবং '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নস্যাৎ করে দেওয়া। বিএনপি ও তার জোটভুক্ত অন্য দলগুলো জামায়াতের দ্বারা তাদের চক্রান্তে ব্যবহৃত হচ্ছে।
সরকারের এ কথা জানা থাকায় তাদের উচিত ছিল, দেশের অপশক্তির চক্রান্ত থেকে দেশকে মুক্ত করার চেষ্টার অংশ হিসেবে সংলাপে বসার ব্যবস্থা সম্পন্ন করা এবং তার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য তিন দেশের নেতার ঢাকা সফরের পর হার্ডলাইন থেকে আপাতত সরে আসা। ইলিয়াস আলী অপহরণ ইস্যুতে কিছুদিন আগের হরতালগুলোতে দাঙ্গা-হাঙ্গামার জন্য অভিযুক্ত বিএনপি নেতাদের পুলিশি মামলায় একেবারে জেলে না পাঠিয়ে জামিনে মুক্ত থাকায় এবং সংলাপে বসার সুযোগ দেওয়া।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনার জন্য সরকার বলছে, বিরোধী দল পার্লামেন্টে আসুক। বিরোধী দল বলছে, সংসদে সরকারের বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা। সেখানে গিয়ে আলোচনায় বসে লাভ নেই। সংসদের বাইরে সংলাপ অনুষ্ঠিত হোক। আমার ধারণা, দেশকে সংঘাত থেকে বাঁচানোর বৃহত্তর স্বার্থে সরকার এ দাবি মেনে নিলে সুবিবেচনার পরিচয় দিত। সংসদের বাইরের আলোচনায় একটা ঐকমত্য তৈরি হলে মীমাংসায় প্রস্তাবগুলো যুক্তভাবে সংসদে উত্থাপন করা যেত।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতার সঙ্গে আলাপ করে জেনেছি, দু'দলের সংলাপ দ্বারা বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে সমঝোতা হোক বিএনপি তা চায় এটা তারা বিশ্বাস করেন না। তারা মনে করেন, বিএনপি দাতা দেশগুলোর নেতাদের এবং দেশের মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য সংলাপে বসার বাহ্যিক আগ্রহ দেখাচ্ছে। কিন্তু '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, তারেক রহমান ও অন্যান্য বিরোধীদলীয় নেতার বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতি, সন্ত্রাসের মামলা এবং অন্যান্য কিছু জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তারা সরকারকে ছাড় দিয়ে সংলাপ সফল করবে আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড তা বিশ্বাস করছে না।
তাদের বিশ্বাস, কোনো না কোনো ছুতো তুলে তারা সংলাপ ব্যর্থ করবে এবং আওয়ামী লীগের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেশময় অরাজকতা সৃষ্টি করে অগণতান্ত্রিকভাবে সরকারের পতন ঘটানোর জন্য ইস্যুর পর ইস্যু তৈরি করবে। যেমন ব্রিটিশ আমলে অবিভক্ত ভারতের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য কংগ্রেম-লীগ তথা গান্ধী-জিন্নাহ বারবার বৈঠক হয়েছে। কিন্তু কোনোটাই সফল হয়নি। কংগ্রেস দোষ চাপিয়েছে মুসলিম লীগের ওপর। মুসলিম লীগ সেই দোষ কংগ্রেসের ওপর চাপিয়েছে। শেষ পর্যন্ত তৃতীয় পক্ষ র্যাডক্লিফের ছুরিতে ভারত ভাগ করে লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের মাধ্যমে দুই দলের ও দুই নেতার ওপর যে মীমাংসা চাপিয়ে দেয়, তারা তা মেনে নিতে বাধ্য হন।
এ কথা সত্য, আমরা তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ ছাড়া নিজেরা নিজেদের কোনো সমস্যারই সমাধান করতে পারি না। তাতে অনেক সময় আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হয়। বিদেশিরা এসে আমাদের ওপর মাতব্বরি করে। উপদেশ দেয়। এ কথা আমাদের জাতীয় নেতারা হয়তো উপলব্ধি করেন না। দ্বিপক্ষীয় সংলাপে না বসার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের নেতাদের যুক্তি সঠিক নয়, তা আমি মনে করি না। তথাপি আমার কথা, এখনই হার্ডলাইনে না গিয়ে সরকার বিএনপির শর্ত মেনে সংলাপে বসার আয়োজন করলে ভালো করত। গান্ধী-জিন্নাহ বৈঠকের মতো হাসিনা-খালেদা বৈঠকও সম্ভবত ব্যর্থ হতো। কিন্তু দেশের মানুষ জানতে পারত এই সংলাপ ব্যর্থ হওয়ার জন্য কাদের জেদ এবং অবাস্তব দাবি দায়ী। তারা কী উদ্দেশ্যে দেশে অরাজকতা জিইয়ে রাখতে চায়।
সরকার বলছে, বিরোধী দল অশুভ উদ্দেশ্যে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করতে চায়। বিরোধী দল বলছে, সরকারি দলের জোর-জুলুম, ইলিয়াস আলীর মতো তাদের নেতাদের গুম, খুন ইত্যাদি করার জন্যই দেশের মানুষ হরতাল চায় না জেনেও তারা হরতালে নামতে বাধ্য হচ্ছেন। তাতে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি হচ্ছে। বিএনপির সকল নেতা না চাইলেও জামায়াত যে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করতে চায় এ কথা সত্য। কিন্তু বিএনপির কাঁধে চেপে দেশময় অরাজকতা সৃষ্টিতে জামায়াতগোষ্ঠীর এই সুযোগ লাভের পেছনে আওয়ামী লীগ সরকারের দেশ শাসনে ব্যর্থতাও কি দায়ী নয়?
বিএনপির প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতা ইলিয়াস আলী (তিনি নিজে যাই হোন) রাজধানী ঢাকা থেকে অপহৃত হওয়ার পর মাসাধিককাল ধরে নিখোজ; পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কেউ কোনো খোঁজ করতে পারছে না; এটা কি কাজের কথা? সাগর-রুনি সাংবাদিক দম্পতির হত্যাকাণ্ড আজ পর্যন্ত রহস্যের জালে ঢাকা। এটা কি কোনো সরকারের জন্য গৌরবের কথা? তার ওপর আবার প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেন, 'কারও বেডরুমে গিয়ে পাহারা দেওয়া আমাদের দায়িত্ব নয়।' এই উক্তি শুনে দেশের মানুষ হতবাক হয়েছে। বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি তার সুযোগ নেবে না?
কোনো কোনো আওয়ামী মন্ত্রী যুক্তি দেখান, বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতাসহ অসংখ্য সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত তদন্ত পর্যন্ত বিএনপি সরকার করেনি। দোষীদের শাস্তি দেওয়া দূরের কথা আওয়ামী নেতাদের এই যুক্তি কি ধোপে টেকে? বিএনপি সরকার দেশ শাসনে অযোগ্য, অক্ষম এবং ব্যর্থ প্রমাণিত হওয়াতেই ২০০৮ সালের নির্বাচনে জনগণ এত বিরাট নির্বাচন-সাফল্য উপহার দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। তারা এই সরকার বিএনপির মতো ব্যর্থ হবে, দেশকে অপশাসন উপহার দেবে এটা দেখতে চায় না। এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসে যদি সাবেক বিএনপি সরকারের মতো দেশ শাসনে অযোগ্যতা ও ব্যর্থতাকেই অনুসরণ করে, তাহলে কোন মুখে তারা অতীতের সরকারের নিন্দা করবেন? কতদিন আর পুরনো গাজির গীত গেয়ে দেশবাসীর মন ভোলানো যাবে?
সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এক এপিএসের গাড়িতে কয়েক লাখ টাকা পেতেই এবং সুরঞ্জিত বাবু তার সঙ্গে জড়িত তা প্রমাণ হওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রী ধমক দিয়ে বলেছেন, মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে। মন্ত্রী আজ্ঞা পালন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী এটা যদি করতে পারেন, তাহলে এই কথিত দুর্নীতির চেয়েও গুরুতর বিরোধী দলের এক নেতার গুম হওয়া, সাংবাদিক দম্পতির নৃশংস হত্যা, দেশময় অপহরণ, হত্যার সংখ্যা বিপজ্জনকভাবে বেড়ে চলা সত্ত্বেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অবিলম্বে পদত্যাগ করা উচিত কথাটা কেন বলতে পারছেন না? অথবা তাকে আবুল হোসেনের মতো অন্য মন্ত্রকে সরিয়ে দিয়ে এই পদে একজন যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে পারছেন না? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন একজন অত্যন্ত ভালো মানুষ। আওয়ামী লীগের একজন নিবেদিত নেত্রী। অন্য কোনো মন্ত্রকের দায়িত্ব পেলে তিনি হয়তো দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিচয় দেবেন। কিন্তু একজন টাফ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার ব্যাপারে তার মধ্যে যে দক্ষতা ও ব্যক্তিত্বের অভাব রয়েছে, প্রধানমন্ত্রী কি গত তিন বছরেও তা বুঝতে পারেননি?
সরকার যদি অনেক ভালো কাজের মধ্যে দুটি মন্দ কাজও করে, জনজীবনের প্রাত্যহিক দুর্ভোগ কমাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সমুদ্র জয় করেও জনগণের মন জয় করা যাবে না। সরকারের ছোট-বড় সকল ব্যর্থতারই সুযোগ নেবে বিরোধী দল। ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া, সাগর-রুনির শয়নকক্ষে বসে নির্মম খুনের শিকার হওয়া ইত্যাদি ঘটনার ব্যাপারে সরকার যদি সামান্য সাফল্যেরও প্রমাণ দিতে পারত, তাহলে বিএনপি এগুলোকে ইস্যু করার এবং এ ইস্যু নিয়ে হরতালে নামার সুযোগ পেত না। দেশের মানুষ হরতাল পছন্দ করে না। কিন্তু বিএনপির ডাকা সাম্প্রতিক হরতালগুলো পছন্দ না করলেও তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়নি। দাতা দেশগুলোর সরকারি নেতারা, দেশের ব্যবসায়ীরা হরতালের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, দুই নেত্রীর মধ্যে সংলাপ-সমঝোতার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে 'পায়াস উইশ' ব্যক্ত করা ছাড়া আর কিছু করেননি। হিলারি ও প্রণব দু'জনেই ঢাকা এসেছিলেন বাংলাদেশের ওপর চাপ দিয়ে তাদের কিছু স্বার্থ আদায়ের জন্য। এ দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা তাদের স্বার্থ পূরণের সহায়ক। এ কথা তারা জানেন। এই রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করার ব্যাপারে তাই তারা কোনো সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন না।
যদি তারা তা করেন, তাহলে তাকে আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ বলে কেউ কেউ অভিযোগ করতে পারতেন। কিন্তু এই হস্তক্ষেপ শুভ ফলপ্রসূ হতো। ১৯৪৭ সালে কংগ্রেস-মুসলিম লীগের বিরোধ মেটানোর ব্যাপারেও ব্রিটিশ সালিশি ও হস্তক্ষেপ কি মেনে নেওয়া হয়নি? বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এমন কোনো পর্যায় নেই, যেখানে বিদেশি হস্তক্ষেপ ও ডমিনেন্স দেখা যাবে না। তাতে আমাদের আপত্তি নেই। যত আপত্তি, দেশের বিপজ্জনক রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করার ব্যাপারে আন্তরিকভাবে ইচ্ছুক কোনো মিত্র বিদেশি রাষ্ট্র মধ্যস্থতা করতে এলে।
১৯৬৫ সালে যখন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হয়, তখন যুদ্ধ থামানোর জন্য হস্তক্ষেপ করেছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। দু'দেশের নেতাদের তাসখন্দে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে বৈঠকের ব্যবস্থা করা হয়েছিল এবং তাসখন্দ শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এই চুক্তি উপমহাদেশে শান্তি ফিরিয়ে এনেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের এই উদ্যোগকে তখন কেউ উপমহাদেশে সোভিয়েত ইউনিয়নের হস্তক্ষেপ আখ্যা দেয়নি। এমনকি পাকিস্তানের মুরবি্ব দেশ এবং বিভিন্ন সামরিক চুক্তির পার্টনার আমেরিকাও মস্কোর এই উদ্যোগে বাধা দেয়নি, বরং স্বাগত জানিয়েছে।
বাংলাদেশে এখন শক্তিশালী এলিট ক্লাস আছে। তাদের একটি সুশীল সমাজ আছে, পশ্চিমা দাতা দেশগুলোর সঙ্গে যাদের সম্পর্ক প্রকাশ্য পিরিতির। তাদের শক্তিশালী ইংরেজি, বাংলা মিডিয়া আছে। তারা কেন নিরপেক্ষতার ভান করে আওয়ামী লীগ-বিরোধিতায় তাদের সকল ভূমিকা সীমাবদ্ধ করে না রেখে প্রকৃত নিরপেক্ষ ভূমিকা গ্রহণ এবং জনমত সংগঠিত করে দুই দলের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি দ্বারা তাদের সংলাপে ও সমঝোতায় বসতে বাধ্য করেন না তা আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধির অগম্য।
আমাদের নোবেল লরিয়েট ড. ইউনূস, ব্রিটিশ নাইট খেতাবধারী আবেদ সাহেবের আর্থ-সামাজিক স্ট্যান্ডিংও দেশে বিরাট। তারা কেন তাদের এই প্রভাব ও প্রতিপত্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে দুই নেত্রীকে সংলাপে বসতে চাপ না দিয়ে বিদেশিদের কাছে গিয়ে আত্মসম্মান বিকিয়ে ধর্ণা দেন? বিএনপি যাতে আর হরতাল, ধর্মঘট দ্বারা দেশময় অরাজকতা সৃষ্টিতে না এগোয় এবং আওয়ামী লীগ সরকারও তাদের জনসমর্থন ও রাজনৈতিক শক্তির অনুপস্থিতিতে প্রশাসনের দমননীতির সাহায্যে বিরোধী দলকে মোকাবেলার জন্য হার্ডলাইনে না যায়, সে জন্য অন্যান্য গণতান্ত্রিক দল, বিভিন্ন পেশার নেতৃস্থানীয় মানুষ, মিডিয়া, পেশাজীবী সমিতি, প্রভাবশালী সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দুটি প্রধান দলের ওপরই এমন চাপ সৃষ্টি করুন, যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ সকল অমীমাংসিত সমস্যা মীমাংসার জন্য দুই নেত্রী, দুই দল অবিলম্বে সংলাপে বসতে বাধ্য হয়। শুধু সংলাপে নয়, একটি সমঝোতায় পেঁৗছতে বাধ্য হয়। এই সংলাপকে একটি সর্বদলীয় রূপ দেওয়ার জন্য একটি শক্তিশালী নাগরিক কমিটি দ্বারা অনতিবিলম্বে দেশে একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করলে কেমন হয়?
বিএনপিকে বুঝতে হবে, বর্তমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে আন্দোলনের আরও কঠোর কর্মসূচি দিয়ে কোনো লাভ হবে না। এসব কর্মসূচি দ্বারা জনগণের জীবনে দুর্ভোগ বাড়ানো যাবে, সরকারের পতন ঘটানো যাবে না। তাদের আন্দোলনের পেছনে জনসমর্থনও আদৌ শক্তিশালী নয়। সাধারণ মানুষ বর্তমান সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত। কিন্তু বিএনপির সদ্য অতীতের দুঃশাসনের তিক্ত অভিজ্ঞতা এখনও তারা ভোলেনি। সরকার হটাও আন্দোলনে তাদের সায় নেই।
অন্যদিকে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে গিয়ে সরকার নিজেদের জনবিচ্ছিন্নতা বাড়ানো ছাড়া আর কোনো লাভেরই অধিকারী হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, কোনো গণতান্ত্রিক সরকার যখন রাজনৈতিক শক্তি দ্বারা বিরোধী পক্ষকে মোকাবেলা করার বদলে ক্ষমতার লাঠি দ্বারা তাদের দমন করতে চায়, তখনই বুঝতে হবে তারা দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তারা এখন একটি উইক গভর্নমেন্ট, মোটেই স্ট্রং গভর্নমেন্ট নয়। অতীতে বিএনপি সরকার এ ধরনের হার্ডলাইন ও দমননীতি দ্বারা ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। বরং তাদের পতন ত্বরান্বিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার যেন তাদের নীতি অনুসরণ করে একই পরিণতির দিকে দ্রুত ধাবমান না হয়।
লন্ডন, শুক্রবার ১৮ মে, ২০১২
No comments