কাইয়ুম চৌধুরী বড় মাপের শিল্পী by বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর
কাইয়ুম চৌধুরীর চোখ বিষণ্ন। বিষণ্নতা চোখে নিয়ে কাইয়ুম প্রকৃতির দিকে, নিসর্গের দিকে, জগৎ-সংসারের দিকে এবং মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এই তাকিয়ে থাকা তাঁর চোখে বিষণ্নতা তৈরি করে। বিষণ্নতাকে যদি তোরণ বলে ভাবি, তোরণের ভেতর দিয়ে তিনি শিল্পের ভুবনে প্রবেশ করেন। প্রথম তোরণ বাস্তবতার, দ্বিতীয় তোরণ পোস্ট-ইমপ্রেসিজম।
বাস্তবতার শক্তি তিনি শিখেছেন জয়নুল আবেদিন থেকে, যিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ৩০ লাখ লোককে দুর্ভিক্ষে না খেয়ে মরে যেতে দেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় কাইয়ুম ৩০ লাখ লোককে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে মরতে দেখেছেন। এ শুধু দেখা নয়, অভিজ্ঞতা এবং এই অভিজ্ঞতা তাঁকে বাস্তবের দিকে টেনে নিয়ে গেছে। হৃদয়ের ভেতরে চেয়ে তিনি ছবি আঁকেন। হৃদয়ের ভেতর গভীর, সেই সঙ্গে শক্ত এবং স্পষ্ট জাগতিক ঘটনায় তিনি নির্লিপ্ত ও নিরাশক্ত, সেখান থেকে তিনি তুলে আনেন ছবি আঁকার নিয়মকানুন। যদি বলি তিনি পোস্ট-ইমপ্রেসিজম রীতিতে রিয়ালিস্টিক ছবি আঁকেন, তাহলে ভুল বলা হবে না।
কাইয়ুম তাঁর জীবনকে কাঁচামাল হিসেবে দেখেন, যে কাঁচামাল তাঁর ছবিতে প্রবেশ করার জন্য দাঁড়িয়ে। যে ছবি ক্রমাগত তাঁর অভিজ্ঞতা প্রসেস করে চলেছে, তিনি দেখেছেন তাঁর শিল্প এক ধরনের বিনিময়। বিনিময় হচ্ছে তাঁর অভিজ্ঞতার সঙ্গে লোকজশিল্পের অভিজ্ঞতার। ৩০ লাখ লোককে পাকিস্তানি সৈন্যরা মেরে ফেলেছে, আর ৩০ লাখ লোকের লাশের ওপর বাঙালি বুর্জোয়ারা শিল্পবোধ গড়ে তুলেছে, যে শিল্পবোধ ইউরোপের, যে শিল্পবোধ জয়নুল আবেদিনদের অস্বীকার করেছে। এই যুদ্ধক্ষেত্রে কাইয়ুম চৌধুরীদের (এবং হাশেম খানদের) লোকজ-শিল্পের কাছে ফিরে যাওয়ার লিবারেশন বলে মনে হয়েছে। এই লোকজ-শিল্প নিজের শক্তিকে আবিষ্কার। কোন অর্থে আবিষ্কার? কোন অর্থে লিবারেশন? পশ্চিমা শিল্পের কাছে ধার করা নয় কিংবা ভারতীয় শিল্পের পৌরাণিকতা (অথবা বাঙালি মুসলমানদের পৌরাণিকতা) ব্যবহার করা নয়। তিনি নিসর্গের মটিফ এঁকেছেন, দেখেছেন সরাসরি, দৃশ্যমানতার ভুবনে আলোকের হেজিমনি ছড়িয়ে দিয়েছেন, ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে আলোকের দ্যুতি চোখে মেলেছেন, এই হচ্ছে তাঁর লোকজ-শিল্প ব্যবহার, যেন নদী ফুটে উঠেছে, পাখি উড়াল দিচ্ছে, মেয়েদের চোখে অনন্ত একটা সুখের সরলতা শিল্পের গোপন মেলে ধরেছে, কোথাও গোপন নেই, কোথাও রহস্য নেই, কোনো কিছু লুকানোর নেই, সে জন্য তাঁর কাজ লিবারেশন। ধুলো পড়া লিজেন্ড এবং মতাদর্শ তিনি ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন, তিনি নিজেকে প্রত্যক্ষ করেছেন প্রত্যক্ষতার মধ্যে। প্রাত্যহিকতার অভিজ্ঞতা তাঁকে অভিজ্ঞ করেছে। এই অভিজ্ঞতাই তাঁর কাছে লোকজ-শিল্প। এখানে তিনি বারবার যান। এই যাওয়াটাই লিবারেশন।
তাঁর কাজে তরলতা নেই, আছে গভীরতা। সে জন্য তিনি রঙের গভীরে, নিসর্গের গভীরে, প্রত্যক্ষতার গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। একটা ক্যানভাসে তিনি বিভিন্ন প্রত্যক্ষতা ছড়িয়ে দেন, বিভিন্ন প্রত্যক্ষতা মিলে একটা অন্য উদ্ভাস তৈরি হয়, সব চেনা মহল ভিন্ন হয়ে ওঠে, তাঁর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আমরা দর্শকরা বলে উঠি, সব চেনা কিন্তু ভিন্ন বলে মনে হচ্ছে। এভাবে তিনি কল্পনাকে বিশ্রাম দেন (কথাটা ভ্যানগঘের)। পরস্পরবিরোধী প্রত্যক্ষ বা একসঙ্গে বেঁধে দেওয়ার দরুন তাঁর কাজ পরিবর্তিত হয়ে কল্পনার সৃষ্টি করে, আমাদের অনুভূতি পুনর্জন্ম পায়। জীবনযাপনের বৈচিত্র্য একদিকে তিনি সরল করে আনেন, অন্যদিকে করে তোলেন জটিল। তাঁর লোকজ আমাদের চোখের ব্যাপ্তি বাড়িয়ে দেয়, আমরা নিসর্গ, প্রকৃতি, জগৎ-সংসার ভিন্নভাবে দেখতে বাধ্য হই। তিনি প্রত্যক্ষ ভেঙে দেন এবং কল্পনাকে বিশাল করে তোলেন। তাঁর বাস্তবতা এভাবে, আমাদের অজানা, অচেনার দিকে যাত্রা করায়। তিনি যা আঁকেন সব চেনা, পুরোটা মিলিয়ে ভিন্ন একটা জগতের রেশ, আমরা বাধ্য হই কল্পনাকে বিশ্রাম দিতে, তাঁর কাজের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমি কাইয়ুমের চোখের বিষণ্নতার কথা উল্লেখ করেছি। যদিও আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ শিল্পভাষা সম্বন্ধে অশিক্ষিত, ছবি আঁকার ভাষা শোসক শ্রেণীর রুচি ও স্বার্থ প্রকাশ করে চলেছে। সাধারণ মানুষ যেভাবে ছবি আঁকার ভাষা বোঝে, ব্যবহার করে, উঠতি বুর্জোয়ারা সে ভাষা থেকে সরে গেছে। কাইয়ুম এই ফারাকের বিরোধী, তিনি ইনহেরিট করতে চেয়েছেন লোকজ-রীতি, লোকজ-বিষয় এবং প্রত্যক্ষতা। তিনি একটা জীবন্ত ভাষা ইনহেট্টরি করেছেন, ব্যবহার করে চলেছেন, বিষয়ের মধ্যে খুঁজে ফিরেছেন অনিঃশেষ বৈচিত্র্য। তাঁর বিষয় উদ্ভাবনের মধ্যে ছন্দ আছে এবং এই ছন্দ সজীবের মধ্যে (কাইয়ুমের সজীবের প্রতি আকর্ষণ তীব্র)। দেশে শিল্পভাষা শিক্ষিতের সংখ্যা বাড়ছে, একটি চোখওয়ালা পাবলিক তৈরি হচ্ছে। কাইয়ুম সে জন্য ভাবতে শুরু করেছেন, এই সংখ্যা যত বাড়বে তত শিল্প বোঝার ক্ষেত্র বৈপ্লবিক হবে। বিপ্লব দরকার, এ ক্ষেত্রে বিপ্লব দরকার। তিনি বিশ্বাস করা শুরু করেছেন ছবি দিয়ে, ছবি বোঝার ক্ষেত্রে একটা নতুন কনসেপ্ট উদ্ভাবন করেছেন (যেমন হাশেম খান করেছেন)। যত দ্রুত এই সংখ্যা বাড়া দরকার, তা বাড়ছে না বলে তিনি বিষণ্ন। বুর্জোয়ারা তাঁর ছবিকে ডেকোরেটিং আর্ট বলে ভাবে, যে ভাবনার সঙ্গে তাঁর যুদ্ধের শেষ নেই।
লোকজ শিল্পী পেশাদার নন, কিন্তু কাইয়ুম লোকজ-রীতি ব্যবহার করা সত্ত্বেও এক শ ভাগ পেশাদার। এই তফাত মনে রাখা দরকার। তিনি লোকজ-ঐতিহ্য ব্যবহার করে চলেছেন লোকজ-ঐতিহ্য ভেঙে ফেলে। এ জায়গাটাই তাঁর দেখার জোর। এই জোর তাঁকে পেশাদার করেছে এবং ছবি আঁকার বিভিন্ন কনভেনশন তাঁকে শিখিয়েছে দক্ষতা। যেমন_কম্পোজিশনের কনভেনশন, ড্রইং পারসপেকটিভ, অ্যানাটমি। এসব কনভেনশন তাঁর সামাজিক অভিজ্ঞতার সমান্তরাল। এই অভিজ্ঞতাই একদিকে তাঁকে লোকজ ঐতিহ্য থেকে ইমিগ্রেট করেছে, অন্য দিকে বুর্জোয়াদের থেকে রক্ষা করেছে। তিনি হয়ে উঠেছেন সাধারণ মানুষের পেইন্টার। তাঁর লক্ষ্য, সে জন্য ডেকোরেটিভ নয়, কিংবা নয় অপটিক্যাল। তিনি তাঁর কাজে রক্ষা করছেন বিষয়ের অন্তঃসার। বিষয়ের অন্তঃসার রক্ষা করার অর্থ অভিজ্ঞতার অন্তঃসার রক্ষা করা। তিনি সে জন্য একজন পেইন্টার হিসেবে এবং আমি একজন দর্শক হিসেবে, বাংলাদেশের ইতিহাস শেয়ার করতে থাকে। তিনি ব্রাশ হাতে নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এই তাকানো থেকে জন্ম নেয় তাঁর অহংকার; শিল্পী হওয়ার অহংকার। তিনি ঘুরে বেড়ান সাধারণ মানুষের সঙ্গে সর্বত্র, তিনি ফিরে পান শিল্পের জোর, তাঁর কবজিতে তাঁর চোখে তিনি ক্রমাগত হয়ে ওঠেন একজন বড় মাপের মানুষ, একজন বড় মাপের শিল্পী।
লেখক : শিক্ষাবিদ, কবি, কথাসাহিত্যিক ও শিল্পকলা বিশ্লেষক
কাইয়ুম তাঁর জীবনকে কাঁচামাল হিসেবে দেখেন, যে কাঁচামাল তাঁর ছবিতে প্রবেশ করার জন্য দাঁড়িয়ে। যে ছবি ক্রমাগত তাঁর অভিজ্ঞতা প্রসেস করে চলেছে, তিনি দেখেছেন তাঁর শিল্প এক ধরনের বিনিময়। বিনিময় হচ্ছে তাঁর অভিজ্ঞতার সঙ্গে লোকজশিল্পের অভিজ্ঞতার। ৩০ লাখ লোককে পাকিস্তানি সৈন্যরা মেরে ফেলেছে, আর ৩০ লাখ লোকের লাশের ওপর বাঙালি বুর্জোয়ারা শিল্পবোধ গড়ে তুলেছে, যে শিল্পবোধ ইউরোপের, যে শিল্পবোধ জয়নুল আবেদিনদের অস্বীকার করেছে। এই যুদ্ধক্ষেত্রে কাইয়ুম চৌধুরীদের (এবং হাশেম খানদের) লোকজ-শিল্পের কাছে ফিরে যাওয়ার লিবারেশন বলে মনে হয়েছে। এই লোকজ-শিল্প নিজের শক্তিকে আবিষ্কার। কোন অর্থে আবিষ্কার? কোন অর্থে লিবারেশন? পশ্চিমা শিল্পের কাছে ধার করা নয় কিংবা ভারতীয় শিল্পের পৌরাণিকতা (অথবা বাঙালি মুসলমানদের পৌরাণিকতা) ব্যবহার করা নয়। তিনি নিসর্গের মটিফ এঁকেছেন, দেখেছেন সরাসরি, দৃশ্যমানতার ভুবনে আলোকের হেজিমনি ছড়িয়ে দিয়েছেন, ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে আলোকের দ্যুতি চোখে মেলেছেন, এই হচ্ছে তাঁর লোকজ-শিল্প ব্যবহার, যেন নদী ফুটে উঠেছে, পাখি উড়াল দিচ্ছে, মেয়েদের চোখে অনন্ত একটা সুখের সরলতা শিল্পের গোপন মেলে ধরেছে, কোথাও গোপন নেই, কোথাও রহস্য নেই, কোনো কিছু লুকানোর নেই, সে জন্য তাঁর কাজ লিবারেশন। ধুলো পড়া লিজেন্ড এবং মতাদর্শ তিনি ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন, তিনি নিজেকে প্রত্যক্ষ করেছেন প্রত্যক্ষতার মধ্যে। প্রাত্যহিকতার অভিজ্ঞতা তাঁকে অভিজ্ঞ করেছে। এই অভিজ্ঞতাই তাঁর কাছে লোকজ-শিল্প। এখানে তিনি বারবার যান। এই যাওয়াটাই লিবারেশন।
তাঁর কাজে তরলতা নেই, আছে গভীরতা। সে জন্য তিনি রঙের গভীরে, নিসর্গের গভীরে, প্রত্যক্ষতার গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। একটা ক্যানভাসে তিনি বিভিন্ন প্রত্যক্ষতা ছড়িয়ে দেন, বিভিন্ন প্রত্যক্ষতা মিলে একটা অন্য উদ্ভাস তৈরি হয়, সব চেনা মহল ভিন্ন হয়ে ওঠে, তাঁর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আমরা দর্শকরা বলে উঠি, সব চেনা কিন্তু ভিন্ন বলে মনে হচ্ছে। এভাবে তিনি কল্পনাকে বিশ্রাম দেন (কথাটা ভ্যানগঘের)। পরস্পরবিরোধী প্রত্যক্ষ বা একসঙ্গে বেঁধে দেওয়ার দরুন তাঁর কাজ পরিবর্তিত হয়ে কল্পনার সৃষ্টি করে, আমাদের অনুভূতি পুনর্জন্ম পায়। জীবনযাপনের বৈচিত্র্য একদিকে তিনি সরল করে আনেন, অন্যদিকে করে তোলেন জটিল। তাঁর লোকজ আমাদের চোখের ব্যাপ্তি বাড়িয়ে দেয়, আমরা নিসর্গ, প্রকৃতি, জগৎ-সংসার ভিন্নভাবে দেখতে বাধ্য হই। তিনি প্রত্যক্ষ ভেঙে দেন এবং কল্পনাকে বিশাল করে তোলেন। তাঁর বাস্তবতা এভাবে, আমাদের অজানা, অচেনার দিকে যাত্রা করায়। তিনি যা আঁকেন সব চেনা, পুরোটা মিলিয়ে ভিন্ন একটা জগতের রেশ, আমরা বাধ্য হই কল্পনাকে বিশ্রাম দিতে, তাঁর কাজের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমি কাইয়ুমের চোখের বিষণ্নতার কথা উল্লেখ করেছি। যদিও আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ শিল্পভাষা সম্বন্ধে অশিক্ষিত, ছবি আঁকার ভাষা শোসক শ্রেণীর রুচি ও স্বার্থ প্রকাশ করে চলেছে। সাধারণ মানুষ যেভাবে ছবি আঁকার ভাষা বোঝে, ব্যবহার করে, উঠতি বুর্জোয়ারা সে ভাষা থেকে সরে গেছে। কাইয়ুম এই ফারাকের বিরোধী, তিনি ইনহেরিট করতে চেয়েছেন লোকজ-রীতি, লোকজ-বিষয় এবং প্রত্যক্ষতা। তিনি একটা জীবন্ত ভাষা ইনহেট্টরি করেছেন, ব্যবহার করে চলেছেন, বিষয়ের মধ্যে খুঁজে ফিরেছেন অনিঃশেষ বৈচিত্র্য। তাঁর বিষয় উদ্ভাবনের মধ্যে ছন্দ আছে এবং এই ছন্দ সজীবের মধ্যে (কাইয়ুমের সজীবের প্রতি আকর্ষণ তীব্র)। দেশে শিল্পভাষা শিক্ষিতের সংখ্যা বাড়ছে, একটি চোখওয়ালা পাবলিক তৈরি হচ্ছে। কাইয়ুম সে জন্য ভাবতে শুরু করেছেন, এই সংখ্যা যত বাড়বে তত শিল্প বোঝার ক্ষেত্র বৈপ্লবিক হবে। বিপ্লব দরকার, এ ক্ষেত্রে বিপ্লব দরকার। তিনি বিশ্বাস করা শুরু করেছেন ছবি দিয়ে, ছবি বোঝার ক্ষেত্রে একটা নতুন কনসেপ্ট উদ্ভাবন করেছেন (যেমন হাশেম খান করেছেন)। যত দ্রুত এই সংখ্যা বাড়া দরকার, তা বাড়ছে না বলে তিনি বিষণ্ন। বুর্জোয়ারা তাঁর ছবিকে ডেকোরেটিং আর্ট বলে ভাবে, যে ভাবনার সঙ্গে তাঁর যুদ্ধের শেষ নেই।
লোকজ শিল্পী পেশাদার নন, কিন্তু কাইয়ুম লোকজ-রীতি ব্যবহার করা সত্ত্বেও এক শ ভাগ পেশাদার। এই তফাত মনে রাখা দরকার। তিনি লোকজ-ঐতিহ্য ব্যবহার করে চলেছেন লোকজ-ঐতিহ্য ভেঙে ফেলে। এ জায়গাটাই তাঁর দেখার জোর। এই জোর তাঁকে পেশাদার করেছে এবং ছবি আঁকার বিভিন্ন কনভেনশন তাঁকে শিখিয়েছে দক্ষতা। যেমন_কম্পোজিশনের কনভেনশন, ড্রইং পারসপেকটিভ, অ্যানাটমি। এসব কনভেনশন তাঁর সামাজিক অভিজ্ঞতার সমান্তরাল। এই অভিজ্ঞতাই একদিকে তাঁকে লোকজ ঐতিহ্য থেকে ইমিগ্রেট করেছে, অন্য দিকে বুর্জোয়াদের থেকে রক্ষা করেছে। তিনি হয়ে উঠেছেন সাধারণ মানুষের পেইন্টার। তাঁর লক্ষ্য, সে জন্য ডেকোরেটিভ নয়, কিংবা নয় অপটিক্যাল। তিনি তাঁর কাজে রক্ষা করছেন বিষয়ের অন্তঃসার। বিষয়ের অন্তঃসার রক্ষা করার অর্থ অভিজ্ঞতার অন্তঃসার রক্ষা করা। তিনি সে জন্য একজন পেইন্টার হিসেবে এবং আমি একজন দর্শক হিসেবে, বাংলাদেশের ইতিহাস শেয়ার করতে থাকে। তিনি ব্রাশ হাতে নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এই তাকানো থেকে জন্ম নেয় তাঁর অহংকার; শিল্পী হওয়ার অহংকার। তিনি ঘুরে বেড়ান সাধারণ মানুষের সঙ্গে সর্বত্র, তিনি ফিরে পান শিল্পের জোর, তাঁর কবজিতে তাঁর চোখে তিনি ক্রমাগত হয়ে ওঠেন একজন বড় মাপের মানুষ, একজন বড় মাপের শিল্পী।
লেখক : শিক্ষাবিদ, কবি, কথাসাহিত্যিক ও শিল্পকলা বিশ্লেষক
No comments