ভোজ্যতেলের বাজার এখনো অস্থির by আবুল হাসনাত

ভোজ্যতেলের বাজারের অস্থিরতা কাটছেই না। নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটির দাম অব্যাহতভাবেই বেড়ে চলেছে। ভোজ্যতেলের ওপরে কার্যত এখন সরকারেরও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ট্যারিফ কমিশন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি।


পরে অবশ্য আগের নির্ধারিত মূল্যই বহাল রাখা হয়। কিন্তু কোনো তেল পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠান তা মানছে না।
সরকারি বিপণনপ্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে খোলা সয়াবিন তেলের দাম এখন ১২৫ থেকে ১২৮ টাকা লিটার। তবে বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১২৮ থেকে ১৩০ টাকার ওপরে। পাম তেল ১০৪ থেকে ১০৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলা হলেও এর বাজারদর ১০৯ থেকে ১১০ টাকা। অথচ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে যৌথভাবে সরকার-নির্ধারিত দর অনুযায়ী ভোক্তা পর্যায়ে খোলা সয়াবিন তেল ১০৯ টাকা ও পাম তেল ৯৯ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা।
এই অবস্থায় সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী কারখানার মালিকদের নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার বৈঠক ডেকেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বর্তমানে কী পরিমাণ ভোজ্যতেল মজুদ আছে এবং আমদানির ঋণপত্র খোলা আছে তা জানতে চেয়ে গত সোমবার তেল পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। বৈঠকে চিনি নিয়েও আলোচনা হবে।
পরিবেশকেরা জানান, রাজধানীর বাজারে এখন অন্যান্য কারখানার তুলনায় বেশি সয়াবিন তেল সরবরাহ করছে সিটি গ্রুপ। তাদের কারখানা গেট থেকে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ১১৫ টাকা এবং সুপার পাম তেল ১০১ টাকায় দেওয়া হচ্ছে। মেঘনা গ্রুপও একই দামে তেল সরবরাহ করছে, তবে তাদের সরবরাহ খুব কম।
পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে জানান, গত ১৫ দিনে পাইকারিতে খোলা সয়াবিন তেলের দাম মণপ্রতি ৩০০ টাকা বেড়েছে। তবে পাম তেল খুব একটা বাড়েনি। বাজারে এখন সয়াবিন তেলের চাহিদা কম, তাই সরবরাহও কম। আর পাম তেলের চাহিদা বেশি, সরবরাহও বেশি। কিন্তু মিলগুলো পরিবেশকদের কাছ থেকে বেশি দাম রাখছে।
নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ায় আমাদেরও বাড়াতে হয়েছে। যে সয়াবিন তেল আমরা কিনেছিলাম এক হাজার ১৭৫ ডলারে, এখন কিনতে হচ্ছে এক হাজার ২৯৫ ডলারে। চলতি মাসের শেষের দিকে এই তেল চলে আসবে। তখন হয়তো আবারও দাম বাড়াতে হতে পারে।’
ট্যারিফ কমিশনের পর্যবেক্ষণ: গত ২৮ মার্চ ১০টি পণ্যের আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজারদরের একটি পর্যালোচনা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দিয়েছে ট্যারিফ কমিশন। তাতে বলা হয়, গত ২৭ মার্চ প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের আন্তর্জাতিক দর ছিল এক হাজার ২৭৪ দশমিক ৭৩ ডলার। ৮২ টাকা ৪৫ পয়সায় এক ডলার ধরলে টাকার অঙ্কে তা হয় এক লাখ পাঁচ হাজার ১০১ টাকা। এর সঙ্গে প্রতি টনের পরিশোধন ব্যয় ২২ হাজার ৩৭৩ টাকা যোগ করা হলে প্রতি টন সয়াবিনের দাম পড়ে এক লাখ ২৭ হাজার ৪৭৫ টাকা। সে হিসাবে এক লিটার সয়াবিন তেলের উৎপাদন ব্যয়ই হয় ১১৮ টাকা। ট্যারিফ কমিশনের হিসাবে বর্তমান বাজারে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১২২ থেকে ১২৫ টাকায়। যদিও বাস্তবে সয়াবিন তেলের বাজারদর এর চেয়েও বেশি।
একইভাবে পাম তেলেরও হিসাব দিয়েছে ট্যারিফ কমিশন। তাতে বলা হয়, প্রতি টন পাম তেলের আন্তর্জাতিক মূল্য এক হাজার ১৯০ দশমিক ৩৮ ডলার (৯৮ হাজার ১৪৬ টাকা)। পরিশোধন ব্যয় ২১ হাজার ১৯৫ টাকা যোগ করলে উৎপাদন ব্যয় এক লাখ ১৯ হাজার ৩৫৯ টাকা। অর্থাৎ প্রতি লিটারের দাম পড়ে ১১০ টাকা ৬৩ পয়সা। কমিশনের হিসাবে বাজারে এই তেল বিক্রি হচ্ছে ১০৪ থেকে ১০৬ টাকায়।
ট্যারিফ কমিশনের ওই পর্যালোচনায় বলা হয়, গত এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে চার দশমিক ৮৩ শতাংশ। অন্যদিকে, অপরিশোধিত পাম তেলের দাম এক বছরে বেড়েছে ১৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ। তবে টিসিবির হিসাবে দেশে গত এক বছরে লিটারপ্রতি খোলা সয়াবিন তেল ১৮ দশমিক ১৮ শতাংশ এবং পাম তেল ১৪ দশমিক ১৩ শতাংশ দাম বেড়েছে।
ভোজ্যতেলের আমদানি: চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) ভোজ্যতেল আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলার পরিমাণ কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ে সাত লাখ ১৬ হাজার টন ভোজ্যতেলের ঋণপত্র খোলা হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে খোলা হয়েছিল আট লাখ ২৫ হাজার টনের ঋণপত্র। তবে একই সময়ে ঋণপত্র নিষ্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে। আগের অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছিল চার লাখ ৮৫ হাজার টন, চলতি বছরে হয়েছে সাত লাখ ২৪ হাজার টন।
ট্যারিফ কমিশনের তদারকি সেলের ৩০ মার্চের তথ্য অনুযায়ী, ৭৫ হাজার ৩৬৩ টন ভোজ্যতেল চট্টগ্রাম কাস্টমস থেকে বিভিন্ন কারখানায় চলে গেছে। এর মধ্যে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ২২ শতাংশ, ৬১ শতাংশ অপরিশোধিত পাম এবং ১৭ শতাংশ হচ্ছে পরিশোধিত পাম তেল। আর নতুন করে কাস্টমসে ঢুকেছে ৫৩ হাজার ৩০৮ টন তেল। এর মধ্যে কোনো সয়াবিন তেল নেই। ৮৫ শতাংশ অপরিশোধিত পাম এবং বাকিটা পরিশোধিত পাম তেল।
না জানিয়েই বাড়ানো হচ্ছে দাম: অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ অনুযায়ী, ভোজ্যতেলের মূল্য বাড়ানোর অন্তত ১৫ দিন আগে তদারকি সেলকে জানাতে হবে। কিন্তু দু-একটি তেল পরিশোধন ছাড়া কেউই এই আইন মানছেন না।
সেল সূত্র জানায়, সিটি গ্রুপ গত ১২ মার্চ ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর জন্য ট্যারিফ কমিশনে আবেদন করে। তাদের আবেদনে বলা হয়, লিটারপ্রতি খোলা সয়াবিন তেল ১১৫ টাকা ৮৮ পয়সা এবং পাম তেল ১০৭ টাকা ৯৩ পয়সা ভোক্তাদের কাছ থেকে নিতে চায় প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া ২২ ফেব্রুয়ারি বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর জন্য কমিশনে আবেদন করে বাংলাদেশ এডিবল অয়েল (রূপচাঁদা ব্র্যান্ড)। তারা এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৩৮ টাকা নিতে চায় বলে জানানো হয়। আর কেউ দাম বাড়ানোর জন্য আবেদন করেনি।

No comments

Powered by Blogger.