চারদিক-হাসি ফুটুক তাদের মুখেও by ইমাম হাসান
রাস্তার পাশেই কলবেল। শব্দ করতেই দৌড়ে এসে দরজা খুলে দিল একটি মেয়ে। ভেতরে ঢোকার আগেই একটি শিশু এসে জড়িয়ে ধরল। হালকা বাদামি চোখ। তেল করা চুলে বাম সিঁথি। কোলে তুলে নিলাম। ছোট্ট হাত দুটি বড়ই কোমল ঠেকল পিঠের ওপর। কোলে বসেই প্রশ্ন। ‘তুমি দলপো (গল্প) বলতে পালো? আমি না একতা দলপো পালি।’
ভাঙা ভাঙা উচ্চারণ। বেশ মজাই লাগল। জানতে চাইলাম, ‘নাম কী তোমার?’ ‘আমাল নাম সাদোল।’ বুঝলাম ‘সাগর’ বলতে চাইছে। বাড়ির ভেতরে ঢোকার আগেই আরেকটি কচি মুখ। বয়স বড়জোর বছর চার। জড়োসড়ো হয়ে তাকিয়ে আছে। কাছে এগিয়ে গেলাম। ‘কী হয়েছে তোমার?’ কোনো উত্তর নেই। আবার সাগরের কথার ঝুলি, ‘ওল বাবা-মা নাই তো, তাই মন খালাপ। জানো, আমালও কেউ নাই।’
থমকে গেলাম সাগরের কথা শুনে। ভেতরে তখন আরও কতক শিশুর কিচিরমিচির। কারও প্রাণখোলা হাসি। কেউবা সুর করে কবিতা পড়ছে। সুর উঠছে হারমোনিয়ামে। আনন্দ আর লেখাপড়ায় এখন এভাবেই কেটে যাচ্ছে এসব শিশুর দিন-রাত। অথচ এদের কেউ মা-বাবা হারা। কারও মা থাকলেও নেই বাসস্থান। দুই বেলা খেতে পায়নি অনেকে। এখন তারা স্বপ্ন দেখছে লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার। আর তাদের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে পাশে রয়েছে ‘উৎস বাংলাদেশ’।
১৯৯৩ সালে যাত্রা শুরু করে উৎস বাংলাদেশ। তখন তাদের শিক্ষার্থী ছিল মাত্র তিনজন। সময় গড়িয়েছে আর উৎস আপন করে নিয়েছে এমন সব পথশিশুকে, যারা লেখাপড়ার সুবিধা থেকে ছিল অনেক দূরে। উচ্ছ্বাসের কথাই ধরা যাক। ছোট্ট উচ্ছ্বাসের (ছদ্মনাম) বাবা ছিল না। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। উৎস বিদ্যানিকেতনে লেখাপড়া করতে থাকে উচ্ছ্বাস। এখন সে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে। গুনে গুনে শিশু বয়স থেকে উৎস বাংলাদেশ এখন ১৮ বছরের টগবগে যুবক। আর এরই মধ্যে বাড্ডার নূরেরচালা ছাড়াও রায়েরবাজার এবং গাজীপুরের নয়নপুরে উৎস বাংলাদেশের আরও দুটি বিদ্যানিকেতন গড়ে উঠেছে। পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছে আরও বেশি শিশু। আবাসিক ও অনাবাসিক—দুই ধরনের সুবিধাই আছে উৎস বিদ্যানিকেতনে। তিনটি বিদ্যালয়ে বর্তমানে ২৩০ জনের মতো পথশিশু শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। শুধুই একাডেমিক জ্ঞান নয়, এর পাশাপাশি নিজেকে একজন সঠিক মানুষে রূপান্তরের শিক্ষাও তারা পাচ্ছে। খেলাধুলা, ছবি আঁকা, নাচ-গান সবকিছুতেই পারদর্শী তারা। উৎসের শিক্ষার্থী লিজা জানাল, ‘রান্নাবান্না, কাপড় ধোয়াসহ প্রায় সব কাজ নিজেরা করতে পারি। এ ছাড়া ছোটদের কাজে বড় শিশুরা এগিয়ে আসে। আমরা সবাই এখানে একটি পরিবার হয়ে আছি।’ প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং বর্তমান নিবার্হী পরিচালক মাহবুবা মাহমুদ। শুরুর দিকের কথা বলতে গিয়ে জানালেন, ‘বেশ কয়েকটি এনজিও প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুবাদে পথশিশু এবং তাদের পরিবার সম্পর্কে জানতাম। বেশ কষ্ট হতো পরিবারগুলোর কথা ভেবে। এরপর আমরা কয়েকজন মিলে আলাপ করে দাঁড় করাই উৎস বাংলাদেশ।’ এরপর জানাতে থাকেন উৎস বাংলাদেশের বেড়ে ওঠার কথা।
‘তিনজন শিক্ষার্থীর খরচ তখন আমরা দিতে থাকলেও বাড়তে শুরু করল শিক্ষার্থী। আমরা এখানে মূলত শ্রমজীবী দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের পড়ানোর কথা ভাবলাম, যাদের মায়েরা কাজে গেলে সন্তান বেড়ে উঠতে থাকে রাস্তায়। সেসব মায়েরা নামমাত্র টাকায় এখানে তাদের সন্তানকে শিক্ষিত করার সুযোগ পেলেন। আর বাকি টাকার জন্য আমরা শুরু করলাম নানা ধরনের উদ্যোগ। বেশ কিছু সক্ষম পরিবার কিছু বাচ্চার পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীতে ক্যাফে মুক্তি নামে তিনটি ক্যানটিন পরিচালনা করা হচ্ছে উৎস বাংলাদেশের মাধ্যমে, যেখানে বেশ কয়েকজন দুস্থ মহিলার কর্মসংস্থানও করেছি আমরা। জাকাতের কিছু অর্থ আমরা পাই বাচ্চাদের পেছনে ব্যয়ের জন্যে।’ বাড়ি বাড়ি থেকে পুরোনো কাপড় সংগ্রহ করে সেগুলো থেকে কিছু অর্থ উঠে আসে বলে জানান মাহমুদা মাহবুব। তবে এ ছাড়াও প্রতিবছর উৎস বাংলাদেশ আয়োজন করে ‘উৎস সংগীতসন্ধ্যা’র, যেখানে গান করেন তারকাশিল্পীরা। আর এখানের অনুদান-কার্ডের বিনিময়ে প্রাপ্ত অর্থ জমা পড়ে বিদ্যালয় পরিচালনার তহবিলে।
প্রতিবছর দুটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ বছরের প্রথম অনুষ্ঠানটি হচ্ছে ৬ এপ্রিল, শুক্রবার সন্ধ্যায়। সেখানে গান করবেন জনপ্রিয় দুই কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী ও কৃষ্ণকলি। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের অডিটরিয়ামে সন্ধ্যা সাতটায় শুরু হবে উৎস সংগীতসন্ধ্যা ২০১২। ৫০০ এবং এক হাজার টাকার বিনিময়ে অনুদান-কার্ড নিতে চাইলে ফোন করতে পারেন ০২৯৮৮০৭০৮ অথবা ০১৭১১৬২২৩৭৮ নম্বরে। সরাসরি যোগাযোগ করতে: উৎস বাংলাদেশ, বাড়ি-৪৪, রোড-২, ব্লক-বি, নিকেতন আবাসিক এলাকা, গুলশান-১— এই ঠিকানায় চলে আসতে পারেন। আপনার অর্থের এই সামান্য উপকারে হয়তো আরও দুটি পথশিশু খুঁজে পাবে তাদের পথের ঠিকানা। হাসি ফুটবে দিশাহীন কিছু নিষ্পাপ মুখে। গড়ে উঠবে শিক্ষিত একটি বাংলাদেশ।
ইমাম হাসান
থমকে গেলাম সাগরের কথা শুনে। ভেতরে তখন আরও কতক শিশুর কিচিরমিচির। কারও প্রাণখোলা হাসি। কেউবা সুর করে কবিতা পড়ছে। সুর উঠছে হারমোনিয়ামে। আনন্দ আর লেখাপড়ায় এখন এভাবেই কেটে যাচ্ছে এসব শিশুর দিন-রাত। অথচ এদের কেউ মা-বাবা হারা। কারও মা থাকলেও নেই বাসস্থান। দুই বেলা খেতে পায়নি অনেকে। এখন তারা স্বপ্ন দেখছে লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার। আর তাদের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে পাশে রয়েছে ‘উৎস বাংলাদেশ’।
১৯৯৩ সালে যাত্রা শুরু করে উৎস বাংলাদেশ। তখন তাদের শিক্ষার্থী ছিল মাত্র তিনজন। সময় গড়িয়েছে আর উৎস আপন করে নিয়েছে এমন সব পথশিশুকে, যারা লেখাপড়ার সুবিধা থেকে ছিল অনেক দূরে। উচ্ছ্বাসের কথাই ধরা যাক। ছোট্ট উচ্ছ্বাসের (ছদ্মনাম) বাবা ছিল না। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। উৎস বিদ্যানিকেতনে লেখাপড়া করতে থাকে উচ্ছ্বাস। এখন সে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে। গুনে গুনে শিশু বয়স থেকে উৎস বাংলাদেশ এখন ১৮ বছরের টগবগে যুবক। আর এরই মধ্যে বাড্ডার নূরেরচালা ছাড়াও রায়েরবাজার এবং গাজীপুরের নয়নপুরে উৎস বাংলাদেশের আরও দুটি বিদ্যানিকেতন গড়ে উঠেছে। পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছে আরও বেশি শিশু। আবাসিক ও অনাবাসিক—দুই ধরনের সুবিধাই আছে উৎস বিদ্যানিকেতনে। তিনটি বিদ্যালয়ে বর্তমানে ২৩০ জনের মতো পথশিশু শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। শুধুই একাডেমিক জ্ঞান নয়, এর পাশাপাশি নিজেকে একজন সঠিক মানুষে রূপান্তরের শিক্ষাও তারা পাচ্ছে। খেলাধুলা, ছবি আঁকা, নাচ-গান সবকিছুতেই পারদর্শী তারা। উৎসের শিক্ষার্থী লিজা জানাল, ‘রান্নাবান্না, কাপড় ধোয়াসহ প্রায় সব কাজ নিজেরা করতে পারি। এ ছাড়া ছোটদের কাজে বড় শিশুরা এগিয়ে আসে। আমরা সবাই এখানে একটি পরিবার হয়ে আছি।’ প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং বর্তমান নিবার্হী পরিচালক মাহবুবা মাহমুদ। শুরুর দিকের কথা বলতে গিয়ে জানালেন, ‘বেশ কয়েকটি এনজিও প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুবাদে পথশিশু এবং তাদের পরিবার সম্পর্কে জানতাম। বেশ কষ্ট হতো পরিবারগুলোর কথা ভেবে। এরপর আমরা কয়েকজন মিলে আলাপ করে দাঁড় করাই উৎস বাংলাদেশ।’ এরপর জানাতে থাকেন উৎস বাংলাদেশের বেড়ে ওঠার কথা।
‘তিনজন শিক্ষার্থীর খরচ তখন আমরা দিতে থাকলেও বাড়তে শুরু করল শিক্ষার্থী। আমরা এখানে মূলত শ্রমজীবী দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের পড়ানোর কথা ভাবলাম, যাদের মায়েরা কাজে গেলে সন্তান বেড়ে উঠতে থাকে রাস্তায়। সেসব মায়েরা নামমাত্র টাকায় এখানে তাদের সন্তানকে শিক্ষিত করার সুযোগ পেলেন। আর বাকি টাকার জন্য আমরা শুরু করলাম নানা ধরনের উদ্যোগ। বেশ কিছু সক্ষম পরিবার কিছু বাচ্চার পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীতে ক্যাফে মুক্তি নামে তিনটি ক্যানটিন পরিচালনা করা হচ্ছে উৎস বাংলাদেশের মাধ্যমে, যেখানে বেশ কয়েকজন দুস্থ মহিলার কর্মসংস্থানও করেছি আমরা। জাকাতের কিছু অর্থ আমরা পাই বাচ্চাদের পেছনে ব্যয়ের জন্যে।’ বাড়ি বাড়ি থেকে পুরোনো কাপড় সংগ্রহ করে সেগুলো থেকে কিছু অর্থ উঠে আসে বলে জানান মাহমুদা মাহবুব। তবে এ ছাড়াও প্রতিবছর উৎস বাংলাদেশ আয়োজন করে ‘উৎস সংগীতসন্ধ্যা’র, যেখানে গান করেন তারকাশিল্পীরা। আর এখানের অনুদান-কার্ডের বিনিময়ে প্রাপ্ত অর্থ জমা পড়ে বিদ্যালয় পরিচালনার তহবিলে।
প্রতিবছর দুটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ বছরের প্রথম অনুষ্ঠানটি হচ্ছে ৬ এপ্রিল, শুক্রবার সন্ধ্যায়। সেখানে গান করবেন জনপ্রিয় দুই কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী ও কৃষ্ণকলি। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের অডিটরিয়ামে সন্ধ্যা সাতটায় শুরু হবে উৎস সংগীতসন্ধ্যা ২০১২। ৫০০ এবং এক হাজার টাকার বিনিময়ে অনুদান-কার্ড নিতে চাইলে ফোন করতে পারেন ০২৯৮৮০৭০৮ অথবা ০১৭১১৬২২৩৭৮ নম্বরে। সরাসরি যোগাযোগ করতে: উৎস বাংলাদেশ, বাড়ি-৪৪, রোড-২, ব্লক-বি, নিকেতন আবাসিক এলাকা, গুলশান-১— এই ঠিকানায় চলে আসতে পারেন। আপনার অর্থের এই সামান্য উপকারে হয়তো আরও দুটি পথশিশু খুঁজে পাবে তাদের পথের ঠিকানা। হাসি ফুটবে দিশাহীন কিছু নিষ্পাপ মুখে। গড়ে উঠবে শিক্ষিত একটি বাংলাদেশ।
ইমাম হাসান
No comments