বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধ স্টাডিজ by মোঃ আবু সালেহ সেকেন্দার

স্বাধীনতার ৪১ বছর অতিক্রান্ত হলেও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস রচিত হয়নি। প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চতর গবেষণা কেন্দ্র পর্যন্ত বারবার বদল ঘটানো হচ্ছে এ গৌরবের অধ্যায়ের। বলা হয়, 'যে সরকার ক্ষমতায় থাকে সেই সরকার তাদের মতো করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা করে থাকে।'


প্রকৃত ইতিহাস রচনা সম্ভব? এ প্রশ্নের সহজ উত্তর, 'হ্যাঁ' সম্ভব। একাডেমিক পঠন-পাঠনের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস রচনা করা সম্ভব। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধ স্টাডিজ চালু করা যায়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কিত উপকরণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বাংলাদেশের পথে-ঘাটে। এখনও যারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তারা জীবিত রয়েছেন, তাদের মুখে ছাত্রছাত্রীরা তাদের সংগ্রামের ধারাবাহিক ইতিহাস শোনার মাধ্যমে নিয়মিত মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানবে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ের ইতিহাস নিয়ে ভালো মানের অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এসব পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। উপরন্তু ঢাকা, জগন্নাথ, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ প্রভৃতি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেন, সেসব নিবেদিতপ্রাণ গবেষক ও শিক্ষকদের এই বিষয়টি পাঠদানের জন্য নিযুক্ত করা যেতে পারে। 'মুক্তিযুদ্ধ স্টাডিজ' বিভাগ বা কোর্সে বাংলাদেশ সৃষ্টি পর্বের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনা নারী, মুক্তিযুদ্ধে পেশাজীবীদের ভূমিকা, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল, রাজাকার সমাচার, মুক্তিযুদ্ধে বহির্শক্তির ভূমিকা, মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা, মুক্তিযুদ্ধের ৪১ বছর ও বাংলাদেশের অর্জন, মুক্তিযুদ্ধে মিডিয়ার ভূমিকা, মুজিবনগর সরকার, মুক্তিযুদ্ধকালীন হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক প্রভৃতি শিরোনামে কোর্স চালু করে এই বিভাগের কার্যক্রম শুরু করা যেতে পারে।
অনেকে হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, কেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়টি চালু করলেই প্রকৃত ইতিহাসের চর্চা হবে? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে। সেহেতু সরকার চাইলেই এখানে গবেষণারত নিবেদিতপ্রাণ গবেষকদের প্রতি খড়্গহস্ত হতে পারবেন না। আর যদি সেখানে প্রভাব বিস্তার করতে চায় এর পরিণতি কী হতে পারে তা গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল। আশা করি, ভবিষ্যতে কোনো সরকার এ ধরনের ভুল করবে না।
এ জন্যই আমাদের দাবি, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে 'মুক্তিযুদ্ধ স্টাডিজ' নামে নতুন একটি বিভাগ চালু করা হোক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের হৃৎপিণ্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' থেকে শুরু করে 'জয় বাংলা'র স্রষ্টা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্ররাই দেশব্যাপী স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। তারাই মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল। সেই সময়ের আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ছাত্রদের মধ্যে অনেকে আজ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় নামকরা অধ্যাপক। তারা চাইলেই এটি সম্ভব। বাংলাদেশের মুক্তবুদ্ধি চর্চার সূতিকাগার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের উদ্যোগে 'মুক্তিযুদ্ধ স্টাডিজ' নামে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ চালু করার মাধ্যমে সেই সূচনা হতে পারে। অন্ততপক্ষে যদি একটি বিভাগ চালু না করা যায় তবে এই নামেই একটি কোর্স চালু করা যেতে পারে। এ রকম একটি কোর্স অথবা বিভাগ চালু হলে নতুন গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি হবে। আর এর মাধ্যমেই প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বের হয়ে আসবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেহেতু স্বায়ত্তশাসিত তাই সরকার চাইলেও প্রকৃত ইতিহাস রচনার ওপর বাধা দিতে পারবে না। অথবা এক সরকারের সময় শুরু হওয়া গবেষণা অন্য সরকার বন্ধ করে দিতে পারবে না। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অথবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষরাই এখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, ইউজিসির চেয়ারম্যান ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দয়া করে আপনারা উদ্যোগী হোন।

স মোঃ আবু সালেহ সেকেন্দার :শিক্ষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
salah.sakender@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.