কালের পুরাণ-রাজনীতির বিষ ছাড়াবেন কে? by সোহরাব হাসান
বাংলাদেশের রাজনীতিকেরা আর কিছু না পারুন, লম্বা-চওড়া কথা বলতে তাঁদের মোটেই বাধে না। তাঁরা কখন কী বলেন, তা নিজেরাও জানেন না। আমাদের জনদরদি রাজনীতিকেরা নির্বাচনের আগে জাতির কাছে বড় বড় ওয়াদা করেন, নম্র ও বিনয় সম্ভাষণে ভোটারদের মন জয় করতে সচেষ্ট থাকেন। কিন্তু নির্বাচনের পরই তাঁদের আসল চেহারা বেরিয়ে আসে।
ক্ষমতাসীনেরা মনে করেন, মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতার জোরেই তাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন। বিরোধী দল মনে করে, জনগণ যেহেতু ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেহেতু পাঁচ বছর তাদের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। তারা কেবল সরকারের সঙ্গে অসহযোগ করে না, অসহযোগ করে জনগণের সঙ্গেও। হরতাল-অবরোধ ও সংসদ বর্জনই তার প্রমাণ।
আরেকটি মজার ব্যাপার হলো, রাজনীতিকেরা নিজেদের ব্যর্থতার দায় বরাবর প্রতিপক্ষের ওপর চাপিয়ে নিজেদের মহাপবিত্র প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লাগেন। বিরোধী দল সংসদে যায় না, সেটি তাদের ব্যর্থতা। কিন্তু তারা বলবে, সরকার সংসদে তাদের কথা বলতে দেয় না, তাই তারা সংসদে গরহাজির থাকে। তবে এবার তিন দিনের জন্য সংসদে গিয়ে বিরোধী দলের সাংসদেরা যেসব কথা বলেছেন, তা অশালীন, অশ্রাব্য ও অভদ্রজনিত। এসব কথা শুনে অনেক ভদ্রমহিলা ও ভদ্রলোক কানে আঙুল দিতে বাধ্য হয়েছেন।
সরকারের দায়িত্ব কাজ করা, জনগণকে দেওয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালন করা। কিন্তু সরকারের মন্ত্রীরা মনে করেন, কাজ করার দরকার নেই। মুখের জোরেই তাঁরা পাঁচ বছরের জন্য জনগণের মুখ বন্ধ করে রাখবেন।
সরকার ওয়াদা করেছিল জনগণকে চাহিদামাফিক বিদ্যুৎ দেবে, জনজীবনের কষ্ট লাঘব করবে, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন করবে, ঢাকা শহরকে যানজটমুক্ত রাখবে, পদ্মা সেতু নির্মাণ করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়ন ঘটাবে। তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন বলেছিলেন, সরকারের মেয়াদ থাকতেই পদ্মা সেতু জনগণের জন্য খুলে দেওয়া হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, এখনো সেতুর কাজই শুরু হয়নি। কবে হবে, তাও অনিশ্চিত।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে যখন বলল, তিন বছরের মধ্যে বিদ্যুতের সমস্যার সমাধান করবে, এ জন্য তারা স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও ঘোষণা করেছিল, মানুষ তখন তাদের কথায় আশ্বস্ত হয়েছিল। এমনকি তারা বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগের জন্য যখন সংসদে দায়মুক্তি আইন পাস করল, তখনো মানুষ চুপচাপ ছিল। কেননা, তাদের একটাই চাওয়া, বিদ্যুতের সমস্যার সমাধান হোক।
এখন সোয়া তিন বছর পর প্রধানমন্ত্রী আমাদের সেই পুরোনো গল্প শোনাচ্ছেন, বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিদ্যুৎ খাতে কিছুই করেনি। করেনি বলেই তো জনগণ আপনাদের ক্ষমতায় এনেছে। এখন বলবেন, এবারে হলো না, বিদ্যুতের সমস্যার সমাধান করতে হলে আরও একবার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে হবে। তাহলে এত যে রোড শো, লং শো, শর্ট শো করলেন, তার ফলটা কী হলো? এখন জনগণ যদি রোড শোর খরচের হিসাব চায়, সরকার দিতে পারবে? কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে এত হইচই হলো, তা এখন সরকারের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বলতে পারেন, দ্রুত বিদ্যুৎ দেওয়ার ক্ষেত্রে এর বিকল্প ছিল। সে কথা আমরাও স্বীকার করি। কিন্তু ১৬ কোটি মানুষের দেশ তো রেন্টাল বিদ্যুৎ দিয়ে চলতে পারে না। সে জন্য চাই টেকসই পরিকল্পনা ও এর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন। গ্যাসের মজুদ কমে আসছে। সেখানে একমাত্র বিকল্প হলো কয়লা। দেশে ৩০-৪০ বছরের চাহিদা মেটাতে পারে—এ রকম কয়লা থাকলেও প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়ে বসেছেন, তিনি এই কয়লা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে দেবেন। বর্তমান প্রজন্ম কি হাওয়া খেয়ে চলবে?
পদ্মা সেতু প্রকল্পের দায়িত্ব মন্ত্রী কাম ব্যবসায়ী সৈয়দ আবুল হোসেনকে দিয়ে যে সরকার মহাফাঁপড়ে পড়েছে, তাও কেউ স্বীকার করতে চাইছেন না। প্রধানমন্ত্রী এত দিন বলেছেন, বিশ্বব্যাংককে দুর্নীতি প্রমাণ করতে হবে। তারা প্রাথমিক প্রমাণ দিয়েছে। কানাডীয় কোম্পানি এসএনসি-লাভালিনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এখন কী হবে? সরকার মালয়েশিয়ার সঙ্গে নতুন চুক্তি করতে চাইছে। কী শর্তে? সেই শর্ত যদি বিশ্বব্যাংকের চেয়ে কঠিন হয়, অনেক বেশি সুদ দিতে হয়, সেই ভার জনগণ বইবে কেন? একজন মন্ত্রী বলেছেন, পদ্মা সেতু নিয়ে দেশের ভেতরে-বাইরে ষড়যন্ত্র চলছে, কারা ষড়যন্ত্র করছে, কাদের কারণে সেতুর কাজ আটকে গেল, সেই প্রশ্নের জবাব সরকারকেই দিতে হবে।
যাঁরা বিদ্যুতের সমস্যার কথা বলছেন, পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করছেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁদের লোডশেডিংয়ের হুমকি দিচ্ছেন। তিনি বলেছেন, গত তিন বছরে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছেন, তা প্রত্যাহার করে নিলেই তাঁরা বুঝবেন বিদ্যুৎ কোন অবস্থায় ছিল। প্রধানমন্ত্রীর দাবি, বিদ্যুৎ বৃদ্ধির পাশাপাশি চাহিদাও অনেক বেড়েছে। এ কথা কেউ অস্বীকার করছেন না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী জনসংখ্যা সমস্যাকে যখন সমস্যাই মনে করেন না, তখন চাহিদার বিষয়টিও তাঁর মাথায় থাকা উচিত ছিল। গত তিন বছরে তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে বলে সরকার যে হিসেব দিয়েছে, সে সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ আর এম দেবনাথ। আরও অনেকের মতো তিনিও প্রশ্ন করেছেন, সরকারের এই হিসাবে শুভংকরের ফাঁকি আছে কি না? এর আগে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, লোডশেডিং মাঝে মাঝে থাকা ভালো, না হলে মানুষ লোডশেডিং কাকে বলে ভুলে যেতে পারে।
আপনি আচরি ধর্ম বলে একটি কথা আছে। অতএব লোডশেডিং থাকার কথাটি আমজনতাকে মনে করিয়ে দেওয়ার আগে সরকারের মন্ত্রী ও সাংসদদেরও মনে রাখা প্রয়োজন। অর্থাৎ লোডশেডিংয়ের কাজটি চলুক বঙ্গভবন ও গণভবন থেকেই। আশা করি, সাধারণ বাসিন্দাদের এলাকায় যে কয় ঘণ্টা লোডশেডিং চলে, প্রধানমন্ত্রী তাঁর কার্যালয় ও মন্ত্রীদের বাড়িতেও যাতে সমপরিমাণ সময় লোডশেডিং থাকে সেই ব্যবস্থা করবেন।
২.
যোগাযোগমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আমাদের পানিতে বিষ। বাতাসে বিষ। পলিটিশিয়ানদের মুখেও বিষ। দিন যতই যাচ্ছে, ততই আমাদের মুখের বিষ তীব্র হচ্ছে।’ (সমকাল, ৪ এপ্রিল ২০১২)। এখানেই তিনি থেমে থাকেননি। প্রখ্যাত কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করে তিনি বলেছেন, ‘শরীরের শক্তি কমতে থাকলে মুখের বিষ বাড়ে।’
বাংলাদেশের হালফিল রাজনীতি নিয়ে এ রকম মোক্ষম ও শতভাগ সত্য কথা নিকট-অতীতে কেউ বলেননি। এ জন্য মন্ত্রী মহোদয়কে আন্তরিক মোবারকবাদ জানাই। এই আত্মোপলব্ধি যদি মন্ত্রী ও নেতাদের কাজে পেতাম, তাহলে দেশটা সত্যি সত্যি বদলে যেত। কেবল ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় নেতা-কর্মী নন, জনগণের দিনও বদল হতো।
এখন পাঠকের কাছেই ওবায়দুল কাদেরের ধাঁধার উত্তর চাই। তাঁরাই ঠিক করুন, সরকারের শক্তি কমেছে না বেড়েছে? তিন বছর আগে মন্ত্রীরা এভাবে গলার রগ ফুলিয়ে কথা বলতেন না, সংবাদপত্রে কিছু লেখা হলে, টেলিভিশনে ছবি দেখানো হলে এতটা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও দেখাতেন না। তখন সাংসদ আবদুর রহমান বদির মতো লোকের সংখ্যা ছিল গুটিকয়েক। এখন বদিদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। অপরাজনীতি কী রকম সংক্রমিত হয়, তার একটি ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে রূপগঞ্জে গত মঙ্গলবারের আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত পর্যালোচনা বৈঠকে। পর্যালোচনা বৈঠককে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষ হাতাহাতিতে লিপ্ত হয়েছে; তারা গাড়ি, অফিস ও সরকারি কর্মকর্তাদের বাসভবনে হামলা চালিয়েছে, ভাঙচুর করেছে। উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও উপজেলা চেয়ারম্যান শাহজাহান ভূঁইয়া স্থানীয় সাংসদ গোলাম দস্তগীর গাজীকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করেন। এভাবেই জাতীয় সংসদের বাইরে ও ভেতরে কথাকথিত রাজনীতির বিষ ছড়ানো হচ্ছে। এই বিষের ভয়াবহ ক্ষতিকর দিকটি যখন মন্ত্রী মহোদয় উপলব্ধি করেছেন, তখন তাঁরই কি উচিত নয় এই বিষ ঝেরে ফেলতে কিছু একটা করার?
৩.
বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের মুখের জোর সর্বজনবিদিত। শুনেছি, এককালে তিনি আওয়ামী লীগ-সমর্থিত ছাত্রলীগ করতেন। তারপর জাসদ হয়ে বিএনপিতে। দল বদলালেও জয়নুল আবদিন ফারুক গলার স্বর বদলাতে পারেননি। তিনি মাঠে-ময়দানে কিংবা জাতীয় সংসদে বক্তৃতা দেওয়ার সময় মাইকের প্রয়োজন হয় না। আওয়ামী লীগের অনেক নেতার সঙ্গে এই একটি ব্যাপারে তাঁর মিল রয়েছে।
সম্প্রতি পত্রিকায় দেখলাম, তিনি স্পিকার আবদুল হামিদের কঠোর সমালোচনা করে তাঁর বক্তব্য সংসদের কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। পৃথিবীর কোনো দেশের সাংসদ স্পিকারের বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করার দাবি করেছেন, এমন তথ্য আমাদের জানা নেই। সেদিক থেকে জয়নুল আবদিন ফারুকের নাম গিনেজ বুকে স্থান পেতে পারে।
এখন দেখা যাক, তিনি কী বলেছেন। একটি পত্রিকা শিরোনাম লিখেছে, স্পিকার শরিফ বদমাইশ—বললেন বিরোধী দলের চিফ হুইপ (জনকণ্ঠ ১ এপ্রিল ২০১২)। অন্য একটি পত্রিকার খবর অনুযায়ী, ফারুক সাহেব বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সম্পর্কে স্পিকারের দেওয়া বক্তব্য প্রত্যাহার করতে বলেছেন। তাঁর মতে, স্পিকার বিরোধীদলীয় নেতাকে পরামর্শ বা উপদেশ দিতে পারেন না। একই সঙ্গে তিনি বিরোধী দলের নেতার সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর সংসদে দেওয়া বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করতে বলেছেন। কিন্তু তাঁর দলের নারী সাংসদেরা যেসব অশালীন বক্তব্য দিয়েছেন, সে সম্পর্কে একটি কথাও বলেননি জয়নুল আবদিন ফারুক।
গত রোববারের কালের পুরাণ পড়ে একজন বিদগ্ধ পাঠক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছিলেন, আপনি যখনই সরকারের সমালোচনা করেন, তখনই বিরোধী দলের দোষত্রুটিও তুলে ধরেন। তাঁকে সবিনয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, যা লিখেছি তা অসত্য কি না। তিনি সেই প্রশ্নের উত্তর দেননি। এবারের লেখায় বিরোধী দলের প্রসঙ্গ আনব না বলেই মনে মনে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু বিরোধী দলের চিফ হুইপের কণ্ঠে ‘শরিফ বদমাইশ’ শব্দটি শোনার পর সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারলাম না বলে দুঃখিত।
রাজনীতির বিষ কেবল দল বিশেষে বা নেতা বিশেষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি এখন সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। এ ভয়ংকর বিষ ছাড়ানোর ওঝা কি এই বাংলাদেশে আছেন?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
আরেকটি মজার ব্যাপার হলো, রাজনীতিকেরা নিজেদের ব্যর্থতার দায় বরাবর প্রতিপক্ষের ওপর চাপিয়ে নিজেদের মহাপবিত্র প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লাগেন। বিরোধী দল সংসদে যায় না, সেটি তাদের ব্যর্থতা। কিন্তু তারা বলবে, সরকার সংসদে তাদের কথা বলতে দেয় না, তাই তারা সংসদে গরহাজির থাকে। তবে এবার তিন দিনের জন্য সংসদে গিয়ে বিরোধী দলের সাংসদেরা যেসব কথা বলেছেন, তা অশালীন, অশ্রাব্য ও অভদ্রজনিত। এসব কথা শুনে অনেক ভদ্রমহিলা ও ভদ্রলোক কানে আঙুল দিতে বাধ্য হয়েছেন।
সরকারের দায়িত্ব কাজ করা, জনগণকে দেওয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালন করা। কিন্তু সরকারের মন্ত্রীরা মনে করেন, কাজ করার দরকার নেই। মুখের জোরেই তাঁরা পাঁচ বছরের জন্য জনগণের মুখ বন্ধ করে রাখবেন।
সরকার ওয়াদা করেছিল জনগণকে চাহিদামাফিক বিদ্যুৎ দেবে, জনজীবনের কষ্ট লাঘব করবে, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন করবে, ঢাকা শহরকে যানজটমুক্ত রাখবে, পদ্মা সেতু নির্মাণ করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়ন ঘটাবে। তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন বলেছিলেন, সরকারের মেয়াদ থাকতেই পদ্মা সেতু জনগণের জন্য খুলে দেওয়া হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, এখনো সেতুর কাজই শুরু হয়নি। কবে হবে, তাও অনিশ্চিত।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে যখন বলল, তিন বছরের মধ্যে বিদ্যুতের সমস্যার সমাধান করবে, এ জন্য তারা স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও ঘোষণা করেছিল, মানুষ তখন তাদের কথায় আশ্বস্ত হয়েছিল। এমনকি তারা বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগের জন্য যখন সংসদে দায়মুক্তি আইন পাস করল, তখনো মানুষ চুপচাপ ছিল। কেননা, তাদের একটাই চাওয়া, বিদ্যুতের সমস্যার সমাধান হোক।
এখন সোয়া তিন বছর পর প্রধানমন্ত্রী আমাদের সেই পুরোনো গল্প শোনাচ্ছেন, বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিদ্যুৎ খাতে কিছুই করেনি। করেনি বলেই তো জনগণ আপনাদের ক্ষমতায় এনেছে। এখন বলবেন, এবারে হলো না, বিদ্যুতের সমস্যার সমাধান করতে হলে আরও একবার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে হবে। তাহলে এত যে রোড শো, লং শো, শর্ট শো করলেন, তার ফলটা কী হলো? এখন জনগণ যদি রোড শোর খরচের হিসাব চায়, সরকার দিতে পারবে? কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে এত হইচই হলো, তা এখন সরকারের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বলতে পারেন, দ্রুত বিদ্যুৎ দেওয়ার ক্ষেত্রে এর বিকল্প ছিল। সে কথা আমরাও স্বীকার করি। কিন্তু ১৬ কোটি মানুষের দেশ তো রেন্টাল বিদ্যুৎ দিয়ে চলতে পারে না। সে জন্য চাই টেকসই পরিকল্পনা ও এর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন। গ্যাসের মজুদ কমে আসছে। সেখানে একমাত্র বিকল্প হলো কয়লা। দেশে ৩০-৪০ বছরের চাহিদা মেটাতে পারে—এ রকম কয়লা থাকলেও প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়ে বসেছেন, তিনি এই কয়লা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে দেবেন। বর্তমান প্রজন্ম কি হাওয়া খেয়ে চলবে?
পদ্মা সেতু প্রকল্পের দায়িত্ব মন্ত্রী কাম ব্যবসায়ী সৈয়দ আবুল হোসেনকে দিয়ে যে সরকার মহাফাঁপড়ে পড়েছে, তাও কেউ স্বীকার করতে চাইছেন না। প্রধানমন্ত্রী এত দিন বলেছেন, বিশ্বব্যাংককে দুর্নীতি প্রমাণ করতে হবে। তারা প্রাথমিক প্রমাণ দিয়েছে। কানাডীয় কোম্পানি এসএনসি-লাভালিনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এখন কী হবে? সরকার মালয়েশিয়ার সঙ্গে নতুন চুক্তি করতে চাইছে। কী শর্তে? সেই শর্ত যদি বিশ্বব্যাংকের চেয়ে কঠিন হয়, অনেক বেশি সুদ দিতে হয়, সেই ভার জনগণ বইবে কেন? একজন মন্ত্রী বলেছেন, পদ্মা সেতু নিয়ে দেশের ভেতরে-বাইরে ষড়যন্ত্র চলছে, কারা ষড়যন্ত্র করছে, কাদের কারণে সেতুর কাজ আটকে গেল, সেই প্রশ্নের জবাব সরকারকেই দিতে হবে।
যাঁরা বিদ্যুতের সমস্যার কথা বলছেন, পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করছেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁদের লোডশেডিংয়ের হুমকি দিচ্ছেন। তিনি বলেছেন, গত তিন বছরে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছেন, তা প্রত্যাহার করে নিলেই তাঁরা বুঝবেন বিদ্যুৎ কোন অবস্থায় ছিল। প্রধানমন্ত্রীর দাবি, বিদ্যুৎ বৃদ্ধির পাশাপাশি চাহিদাও অনেক বেড়েছে। এ কথা কেউ অস্বীকার করছেন না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী জনসংখ্যা সমস্যাকে যখন সমস্যাই মনে করেন না, তখন চাহিদার বিষয়টিও তাঁর মাথায় থাকা উচিত ছিল। গত তিন বছরে তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে বলে সরকার যে হিসেব দিয়েছে, সে সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ আর এম দেবনাথ। আরও অনেকের মতো তিনিও প্রশ্ন করেছেন, সরকারের এই হিসাবে শুভংকরের ফাঁকি আছে কি না? এর আগে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, লোডশেডিং মাঝে মাঝে থাকা ভালো, না হলে মানুষ লোডশেডিং কাকে বলে ভুলে যেতে পারে।
আপনি আচরি ধর্ম বলে একটি কথা আছে। অতএব লোডশেডিং থাকার কথাটি আমজনতাকে মনে করিয়ে দেওয়ার আগে সরকারের মন্ত্রী ও সাংসদদেরও মনে রাখা প্রয়োজন। অর্থাৎ লোডশেডিংয়ের কাজটি চলুক বঙ্গভবন ও গণভবন থেকেই। আশা করি, সাধারণ বাসিন্দাদের এলাকায় যে কয় ঘণ্টা লোডশেডিং চলে, প্রধানমন্ত্রী তাঁর কার্যালয় ও মন্ত্রীদের বাড়িতেও যাতে সমপরিমাণ সময় লোডশেডিং থাকে সেই ব্যবস্থা করবেন।
২.
যোগাযোগমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আমাদের পানিতে বিষ। বাতাসে বিষ। পলিটিশিয়ানদের মুখেও বিষ। দিন যতই যাচ্ছে, ততই আমাদের মুখের বিষ তীব্র হচ্ছে।’ (সমকাল, ৪ এপ্রিল ২০১২)। এখানেই তিনি থেমে থাকেননি। প্রখ্যাত কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করে তিনি বলেছেন, ‘শরীরের শক্তি কমতে থাকলে মুখের বিষ বাড়ে।’
বাংলাদেশের হালফিল রাজনীতি নিয়ে এ রকম মোক্ষম ও শতভাগ সত্য কথা নিকট-অতীতে কেউ বলেননি। এ জন্য মন্ত্রী মহোদয়কে আন্তরিক মোবারকবাদ জানাই। এই আত্মোপলব্ধি যদি মন্ত্রী ও নেতাদের কাজে পেতাম, তাহলে দেশটা সত্যি সত্যি বদলে যেত। কেবল ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় নেতা-কর্মী নন, জনগণের দিনও বদল হতো।
এখন পাঠকের কাছেই ওবায়দুল কাদেরের ধাঁধার উত্তর চাই। তাঁরাই ঠিক করুন, সরকারের শক্তি কমেছে না বেড়েছে? তিন বছর আগে মন্ত্রীরা এভাবে গলার রগ ফুলিয়ে কথা বলতেন না, সংবাদপত্রে কিছু লেখা হলে, টেলিভিশনে ছবি দেখানো হলে এতটা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও দেখাতেন না। তখন সাংসদ আবদুর রহমান বদির মতো লোকের সংখ্যা ছিল গুটিকয়েক। এখন বদিদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। অপরাজনীতি কী রকম সংক্রমিত হয়, তার একটি ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে রূপগঞ্জে গত মঙ্গলবারের আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত পর্যালোচনা বৈঠকে। পর্যালোচনা বৈঠককে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষ হাতাহাতিতে লিপ্ত হয়েছে; তারা গাড়ি, অফিস ও সরকারি কর্মকর্তাদের বাসভবনে হামলা চালিয়েছে, ভাঙচুর করেছে। উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও উপজেলা চেয়ারম্যান শাহজাহান ভূঁইয়া স্থানীয় সাংসদ গোলাম দস্তগীর গাজীকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করেন। এভাবেই জাতীয় সংসদের বাইরে ও ভেতরে কথাকথিত রাজনীতির বিষ ছড়ানো হচ্ছে। এই বিষের ভয়াবহ ক্ষতিকর দিকটি যখন মন্ত্রী মহোদয় উপলব্ধি করেছেন, তখন তাঁরই কি উচিত নয় এই বিষ ঝেরে ফেলতে কিছু একটা করার?
৩.
বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের মুখের জোর সর্বজনবিদিত। শুনেছি, এককালে তিনি আওয়ামী লীগ-সমর্থিত ছাত্রলীগ করতেন। তারপর জাসদ হয়ে বিএনপিতে। দল বদলালেও জয়নুল আবদিন ফারুক গলার স্বর বদলাতে পারেননি। তিনি মাঠে-ময়দানে কিংবা জাতীয় সংসদে বক্তৃতা দেওয়ার সময় মাইকের প্রয়োজন হয় না। আওয়ামী লীগের অনেক নেতার সঙ্গে এই একটি ব্যাপারে তাঁর মিল রয়েছে।
সম্প্রতি পত্রিকায় দেখলাম, তিনি স্পিকার আবদুল হামিদের কঠোর সমালোচনা করে তাঁর বক্তব্য সংসদের কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। পৃথিবীর কোনো দেশের সাংসদ স্পিকারের বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করার দাবি করেছেন, এমন তথ্য আমাদের জানা নেই। সেদিক থেকে জয়নুল আবদিন ফারুকের নাম গিনেজ বুকে স্থান পেতে পারে।
এখন দেখা যাক, তিনি কী বলেছেন। একটি পত্রিকা শিরোনাম লিখেছে, স্পিকার শরিফ বদমাইশ—বললেন বিরোধী দলের চিফ হুইপ (জনকণ্ঠ ১ এপ্রিল ২০১২)। অন্য একটি পত্রিকার খবর অনুযায়ী, ফারুক সাহেব বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সম্পর্কে স্পিকারের দেওয়া বক্তব্য প্রত্যাহার করতে বলেছেন। তাঁর মতে, স্পিকার বিরোধীদলীয় নেতাকে পরামর্শ বা উপদেশ দিতে পারেন না। একই সঙ্গে তিনি বিরোধী দলের নেতার সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর সংসদে দেওয়া বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করতে বলেছেন। কিন্তু তাঁর দলের নারী সাংসদেরা যেসব অশালীন বক্তব্য দিয়েছেন, সে সম্পর্কে একটি কথাও বলেননি জয়নুল আবদিন ফারুক।
গত রোববারের কালের পুরাণ পড়ে একজন বিদগ্ধ পাঠক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছিলেন, আপনি যখনই সরকারের সমালোচনা করেন, তখনই বিরোধী দলের দোষত্রুটিও তুলে ধরেন। তাঁকে সবিনয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, যা লিখেছি তা অসত্য কি না। তিনি সেই প্রশ্নের উত্তর দেননি। এবারের লেখায় বিরোধী দলের প্রসঙ্গ আনব না বলেই মনে মনে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু বিরোধী দলের চিফ হুইপের কণ্ঠে ‘শরিফ বদমাইশ’ শব্দটি শোনার পর সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারলাম না বলে দুঃখিত।
রাজনীতির বিষ কেবল দল বিশেষে বা নেতা বিশেষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি এখন সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। এ ভয়ংকর বিষ ছাড়ানোর ওঝা কি এই বাংলাদেশে আছেন?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments