মৃদুকণ্ঠ-দায়মুক্ত হয়ে বিদায় নিলেন by খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক দায়িত্ব শেষে বিদায় নিয়েছেন। চিরন্তন নিয়মে। আগমন হলে নির্গমন ঘটবেই। দায়িত্ব গ্রহণ করলে সমাপন করতেই হবে। সমাপন শেষে বিদায়ও নিতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটে না। তাঁর ক্ষেত্রেও ঘটেনি। বিচারপতি খায়রুল হক তাঁর ১৩ বছরের বিচারিক জীবনে অসীম সাহসিকতা, দেশপ্রেম ও নিষ্ঠার যে পরিচয় রেখেছেন, তা
সমসাময়িক ইতিহাসে বিরল। তিনি ইতিহাসের জঞ্জাল সাফ করেছেন মেধা ও প্রজ্ঞার দ্বারা। তিনি ইতিহাসের কালিমা মুছে দিয়েছেন বিবেক ও সাহসিকতার ছোঁয়া দিয়ে। এ কারণেই ইতিহাস তাঁকে বিদায় দেবে না, যদিও পেশা থেকে বিদায় নিয়েছেন তিনি। নিজের অজান্তেই ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস সবার জানা। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের দুর্বার আন্দোলন ও ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন স্বাধিকারের। স্বাধীনতার। বাষট্টি, ছেষট্টি, ঊনসত্তরের তীব্র গণ-আন্দোলন, সত্তরের ঐতিহাসিক গণরায় অর্জনের পর একাত্তরের মার্চে গণঐক্য পূর্ণতা পেয়েছিল। মার্চের প্রথম থেকে অতুলনীয় 'অসহযোগ আন্দোলন'-এর মাধ্যমে পূর্ব বাংলা ডি-ফ্যাক্টো স্বাধিকার অর্জন করেছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ও নির্দেশনায়। ৭ মার্চ স্বাধীনতার ডাক দিলেন মুক্তির মহানায়ক। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে আক্রান্ত হওয়ার পর স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন, যাতে আক্রমণকারী বা বিচ্ছিন্নতাবাদীর বদনাম না জোটে। জনগণকে আহ্বান জানালেন প্রতিরোধের মাধ্যমে দেশকে দখলদার মুক্ত করার জন্য। জনগণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল। জনযুদ্ধ শুরু হলো। ১০ এপ্রিল জনপ্রতিনিধিরা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাকে সমর্থন ও গ্রহণ করে স্বাধীনতার সনদ প্রণয়ন করলেন এবং তদনুযায়ী অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলো। ৯ মাস জনযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদারদের হটিয়ে মাতৃভূমিকে মুক্ত করা হলো। আমরা আক্রমণ করে জয়লাভ করিনি। আক্রান্ত হয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধের মাধ্যমে অধিকার অর্জন করেছি। বিশ্বের ইতিহাসে এ এক অপূর্ব ঘটনা।
রক্তমূল্যে কেনা এই স্বাধীনতার ওপর আঘাত এল পঁচাত্তর সালে। চীন-মার্কিন ছত্রচ্ছায়ায় দেশীয় রাজাকারদের সহায়তায় পরাজিত পাকিস্তান প্রতিশোধ গ্রহণ করল। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী অস্থায়ী সরকারপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ চার নেতাকে হত্যা করে তারা বাংলাদেশ দখল করল_এক ধরনের অর্ধপাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করল। ইতিহাসে কালিমা লেপন করা হলো। ইতিহাসকে বিকৃত করা হলো। নব্য মীরজাফর মোশতাককে সামনে রেখে মূল খলনায়কের ভূমিকায় ছিলেন জেনারেল জিয়া। মুক্তিযুদ্ধের সংবিধান সঙ্গিনের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হলো। মূলনীতি ছেঁটে ফেলা হলো। শহীদের রক্তে লেখা আইন পাল্টে দেওয়া হলো সন্ত্রাসের কালিমা দিয়ে। ইতিহাসের পাতায় জাতির পিতার নাম ঢেকে রাখা হলো, বসানো হলো সঙ্গিনওয়ালাদের প্রতিনিধিকে। কালি লেপটে দেওয়া হলো মূল্যবোধের ওপর। ইতিহাসে বাংলাদেশের পৃষ্ঠাগুলো কালিতে কালিতে কলঙ্কিত হয়ে উঠল।
ইতিহাস হতবাক হয় কখনো। কিন্তু মিথ্যাকে মেনে নেয় না। প্রকৃতির নিয়মে ইতিহাসের সন্তানরাই পরম যত্নে কালিমা মুছে দেয়। ইতিহাসকে পরিচ্ছন্ন করে। ইতিহাসের সন্তানরাও ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়। তাদের জীবন নশ্বর। ইতিহাসে তারা অবিনশ্বর। নিজের অজান্তেই খায়রুল হক ইতিহাসের তেমনই এক সন্তান হয়ে রইলেন, ইতিহাসের একজন জঞ্জাল সাফকারী হিসেবে। বিবেকের আয়নায় অস্বচ্ছতা মোচনকারী হিসেবে। আইনের পরিষ্কারক দিয়ে ইতিহাসের কালিমাখা পাতাগুলোকে আবার কালিমামুক্ত করে তুলতে অবদান রেখেছিলেন তিনি।
ইতিহাসের দায় থেকে মুক্ত হওয়ার একটি মোড় পরিবর্তনকারী কাজ ছিল বিচারপতি খায়রুল হকের মুন সিনেমা হল বিষয়ক মামলার রায়, যা সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায় হিসেবে পরিচিত। পঁচাত্তরের পর অনেক বিজ্ঞ ও স্বনামধন্য বিচারপতি উচ্চতর আদালতকে অলংকৃত করেছেন। তাঁদের জ্ঞানের প্রশংসা আমরা শুনেছি। কিন্তু সাহসী বিবেকের পরিচিতি তাঁরা রাখেননি। তাঁরা পরগাছা কর্তনের সাহস দেখাননি। বরং পরগাছাতে পানি সিঞ্চন করে মূল গাছটিকেই দুর্বল করে ফেলেছিলেন। তাঁরা কোর্টের বাইরে বলতেন, 'সামরিক আইন হলো জংলি আইন', 'আইনের অনুপস্থিতিই হলো সামরিক আইন' অথবা 'সেনাপ্রধানের নির্দেশই হলো সামরিক আইন'। অথচ কোর্টে বসে সেই সামরিক আইনকেই তাঁরা বৈধতা দিয়েছেন। সামরিক ফরমানগুলো বৈধ মনে করেছেন। বাংলাদেশবিরোধী গোলাম আযমের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের শত শত রাজনৈতিক কর্মী ও সেনাসদস্য হত্যার মতো মানবতাবিরোধী কর্মকেও মুক্ত করেনি বিচারের জন্য। এমনকি বেআইনি ও অনৈতিক কুখ্যাত 'ইনডেমনিটি' আইনকেও বৈধ করে রেখেছেন।
আগমন-নির্গমনের ধারাবাহিকতায় বিচারপতি খায়রুল হক নিয়োগ পেলেন উচ্চ আদালতে। মুন সিনেমার মালিকানা নিয়ে মামলা এল। মালিকানার বৈধতা নির্ভর করছিল সামরিক আইনের বৈধতার পর। পূর্বসূরিদের মতো তিনিও মার্শাল লকে ভিত্তি করে রায় দিয়ে দিতে পারতেন। তিনি তা করেননি। কারণ তিনি তো চাকরিজীবী নন। তিনি বিচারক। তিনি সময়ের সাহসী সন্তান। তিনি ইতিহাসের সন্তান। বিবেকের তাড়নায়, সুবিচারের প্রেরণায়, সর্বশক্তিমানের ওপর গভীর বিশ্বাস রেখে অদম্য সাহসের সঙ্গে এক যুগান্তকারী রায় দিলেন। দিনটি ছিল ২৯ আগস্ট ২০০৫। রায় দিলেন, আইনের দৃষ্টিতে মোশতাক, সায়েম, জিয়ার ক্ষমতারোহণ ছিল অবৈধ। তাঁরা ছিলেন 'হিউজারপর' বা 'জবরদখলকারী'। অতএব, তাঁদের প্রণীত 'আইন', 'বিধিবিধান' সব অবৈধ। তখন বিএনপি সরকার ক্ষমতাসীন। ক্ষমতার রক্তচক্ষু তাঁকে ভীতবিহ্বল করে তোলেনি। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তিনি বলেছিলেন, 'আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখি। আল্লাহ সত্য। তাই বান্দাও সত্য থেকে বিচ্যুত হতে পারে না।' তাঁর এই সত্যনিষ্ঠা তাঁকে ইতিহাসের পাদপীঠে দাঁড় করিয়েছিল। পঁচাত্তরে অসত্য, কলঙ্ক, সন্ত্রাস ও অবৈধতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল হিংসার মাধ্যমে, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে, হত্যার মাধ্যমে। ২০০৫ সালে এসে সাহস ও বিবেকের ওপর ভর করে আইনের মাধ্যমে উপড়ে ফেলেছিলেন মিথ্যার পরগাছা। সযত্নে মুছে দিয়েছিলেন ইতিহাসের পাতায় জমে ওঠা ময়লা, ধুলোবালি। ইতিহাসের সত্যগুলো আবার পরিস্ফুট হয়ে উঠল। ইতিহাসের সন্তান ইতিহাসকে সন্ত্রাসীদের কবল থেকে ছিনিয়ে আনলেন।
এর পর থেকে একের পর এক জঞ্জাল সাফ করে গেছেন এই নিরস্ত্র বিবেক। একুশে ফেব্রুয়ারি এলে ভাষার জন্য মায়াকান্না আমরা অনেক দেখি। কিন্তু মাতৃভাষাকে মায়ের আসনে সমাসীন করেছেন কজন? হাতেগোনা কয়েকজনের মধ্যে খায়রুল হক অনন্য একজন। উচ্চতর আদালতে বাংলা ভাষায় রায় লিখে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার।
যে মুক্তিযুদ্ধ একটি নেশন স্টেট বা জাতিরাষ্ট্র স্থাপন করেছিল, তার ডাক এসেছিল ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে। হানাদার বাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করেছিল এই ঐতিহাসিক ময়দানে। জাতির জনক ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে জনতার সঙ্গে কথা বলেছিলেন এই রেসকোর্স ময়দানে। মুক্তিযুদ্ধের সহযোদ্ধা ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের জনগণকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন এই একই ময়দানে। এভাবেই রেসকোর্স বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, স্বাধীনতার প্রতীক। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণের রায় দিয়েছিলেন বিচারপতি খায়রুল হক ২০০৯ সালে। সবশেষে সপ্তম সংশোধনী এবং ফতোয়া বিষয়ক রায় দিয়ে ২০১১ সালে তিনি বিদায় নিলেন। স্বাধীনতার ঘোষক বিষয়েও তথ্যসমৃদ্ধ অকাট্য প্রমাণাদি দিয়ে রায় দিয়েছেন তিনি।
বিএনপির কিছু নেতা খায়রুল হককে আওয়ামী দলীয় বলে উল্লেখ করেছেন। বিচারপতি হওয়ার আগে দীর্ঘদিন তিনি উচ্চতর আদালতে আইনজীবী ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ছিল না এক দিনের জন্যও। তিনি ছিলেন নিতান্তই সৎ পেশাজীবী। রাজনীতি করার সুযোগ থাকাকালে যিনি রাজনীতি করলেন না, তিনি কেন বিচারক হয়ে রাজনীতি করবেন! তিনি যে আইনের বিষয়ে প্রবল শক্তিমানকেও ছাড় দেন না, তার একটি প্রমাণ উল্লেখ করছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েক মাস আগে চট্টগ্রামে প্রকাশ্য ভাষণে বলেছিলেন, চট্টগ্রামে উচ্চতর আদালত স্থাপিত হবে। প্রধান বিচারপতি পরদিনই ফুলকোর্টে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন যে ঢাকার বাইরে উচ্চতর আদালত স্থাপনের আইনানুগ কোনো সুযোগ নেই। বেঞ্চ চট্টগ্রামে স্থাপন না করে তিনি চুপ করেও থাকতে পারতেন। চুপ করেও থাকেননি। তাঁর এই বলিষ্ঠতাই প্রমাণ করে, তিনি রাজনীতি করেননি, তাঁবেদারি করেননি। দায়িত্বে নিষ্ঠাবান থেকেছেন।
বিদায়ক্ষণে তাঁর কুশপুত্তলিকা দাহ করেছে বিএনপিপন্থী কিছু মানুষ। বিএনপি ও জামায়াত তাঁকে গালমন্দ করেছে। এটাই স্বাভাবিক। পঁচাত্তরের অবৈধ সরকারের রাজনৈতিক সন্তান হলো বিএনপি। জামায়াত সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। অসত্যের কলঙ্কের গর্ভে যার জন্ম, সে তো সত্যদর্শনে ভীত হবে। উন্মাদের মতো আচরণ করবে। কিন্তু সত্য অবিচল। ইতিহাস নিজ গতিতে চলতেই থাকবে।
ইতিহাসে আমরা অনেক জারজ সন্তানের পরিচয় পাই, যারা নিজগুণে মহিমান্বিত হয়েছিল। জারজ হওয়ার দায় তো সন্তানের নয়। জন্মদাতার। তাই কলঙ্ক জন্মদাতার। সন্তানের নয়। এমনটা তো বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির ক্ষেত্রেও হতে পারে। দোষ তাদের জন্মদাতার। তাদের তো দোষ নেই। মুক্তিযুদ্ধবিরোধিতা তথা পাকিস্তানপ্রীতি পরিত্যাগ করে তারাও তো দেশপ্রেমিক দলে রূপান্তরিত হতে পারে। জামায়াতের পক্ষে এমনটা সম্ভব না হলেও বিএনপি-জাতীয় পার্টির পক্ষে সম্ভব। আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করুন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে যাবেন কেন? দেশকে ভালোবাসলে মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়ে লালন করতে হবে। জাতির পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে মানতে হবে। সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীনকে জাতীয় বীরের আসনে বসাতে হবে। মূল সংবিধানের মৌলিকত্ব ফিরিয়ে এনে তা সুরক্ষা করতে হবে। এটি দলীয় বিষয় নয়। বিষয়টি জাতীয়তাবোধের, দেশপ্রেমের।
নিজ আঙিনায় বিচারপতি খায়রুল হক নীরবে, নিঃশঙ্কচিত্তে এ কাজগুলোই করে গেছেন। ভ্রষ্ট রাষ্ট্রশক্তিকে মুক্তিযুদ্ধের কক্ষপথে পুনঃপ্রতিষ্ঠায় অনন্য অবদান রেখেছেন। আজ যারা তাঁর কুশপুত্তলিকা দাহ করছে, শতবর্ষ পরে তারা যখন পচে গলে বিলীন হয়ে যাবে, খায়রুল হক তখন ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বল করবেন। পথহারাকে পথ দেখাবেন। নবপ্রজন্মের পথপ্রদর্শক হয়ে উঠবেন। ইতিহাসের নতুন সন্তানদের আদর্শস্থানীয় হয়ে থাকবেন।
লেখক : সাবেক ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস সবার জানা। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের দুর্বার আন্দোলন ও ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন স্বাধিকারের। স্বাধীনতার। বাষট্টি, ছেষট্টি, ঊনসত্তরের তীব্র গণ-আন্দোলন, সত্তরের ঐতিহাসিক গণরায় অর্জনের পর একাত্তরের মার্চে গণঐক্য পূর্ণতা পেয়েছিল। মার্চের প্রথম থেকে অতুলনীয় 'অসহযোগ আন্দোলন'-এর মাধ্যমে পূর্ব বাংলা ডি-ফ্যাক্টো স্বাধিকার অর্জন করেছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ও নির্দেশনায়। ৭ মার্চ স্বাধীনতার ডাক দিলেন মুক্তির মহানায়ক। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে আক্রান্ত হওয়ার পর স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন, যাতে আক্রমণকারী বা বিচ্ছিন্নতাবাদীর বদনাম না জোটে। জনগণকে আহ্বান জানালেন প্রতিরোধের মাধ্যমে দেশকে দখলদার মুক্ত করার জন্য। জনগণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল। জনযুদ্ধ শুরু হলো। ১০ এপ্রিল জনপ্রতিনিধিরা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাকে সমর্থন ও গ্রহণ করে স্বাধীনতার সনদ প্রণয়ন করলেন এবং তদনুযায়ী অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলো। ৯ মাস জনযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদারদের হটিয়ে মাতৃভূমিকে মুক্ত করা হলো। আমরা আক্রমণ করে জয়লাভ করিনি। আক্রান্ত হয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধের মাধ্যমে অধিকার অর্জন করেছি। বিশ্বের ইতিহাসে এ এক অপূর্ব ঘটনা।
রক্তমূল্যে কেনা এই স্বাধীনতার ওপর আঘাত এল পঁচাত্তর সালে। চীন-মার্কিন ছত্রচ্ছায়ায় দেশীয় রাজাকারদের সহায়তায় পরাজিত পাকিস্তান প্রতিশোধ গ্রহণ করল। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী অস্থায়ী সরকারপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ চার নেতাকে হত্যা করে তারা বাংলাদেশ দখল করল_এক ধরনের অর্ধপাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করল। ইতিহাসে কালিমা লেপন করা হলো। ইতিহাসকে বিকৃত করা হলো। নব্য মীরজাফর মোশতাককে সামনে রেখে মূল খলনায়কের ভূমিকায় ছিলেন জেনারেল জিয়া। মুক্তিযুদ্ধের সংবিধান সঙ্গিনের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হলো। মূলনীতি ছেঁটে ফেলা হলো। শহীদের রক্তে লেখা আইন পাল্টে দেওয়া হলো সন্ত্রাসের কালিমা দিয়ে। ইতিহাসের পাতায় জাতির পিতার নাম ঢেকে রাখা হলো, বসানো হলো সঙ্গিনওয়ালাদের প্রতিনিধিকে। কালি লেপটে দেওয়া হলো মূল্যবোধের ওপর। ইতিহাসে বাংলাদেশের পৃষ্ঠাগুলো কালিতে কালিতে কলঙ্কিত হয়ে উঠল।
ইতিহাস হতবাক হয় কখনো। কিন্তু মিথ্যাকে মেনে নেয় না। প্রকৃতির নিয়মে ইতিহাসের সন্তানরাই পরম যত্নে কালিমা মুছে দেয়। ইতিহাসকে পরিচ্ছন্ন করে। ইতিহাসের সন্তানরাও ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়। তাদের জীবন নশ্বর। ইতিহাসে তারা অবিনশ্বর। নিজের অজান্তেই খায়রুল হক ইতিহাসের তেমনই এক সন্তান হয়ে রইলেন, ইতিহাসের একজন জঞ্জাল সাফকারী হিসেবে। বিবেকের আয়নায় অস্বচ্ছতা মোচনকারী হিসেবে। আইনের পরিষ্কারক দিয়ে ইতিহাসের কালিমাখা পাতাগুলোকে আবার কালিমামুক্ত করে তুলতে অবদান রেখেছিলেন তিনি।
ইতিহাসের দায় থেকে মুক্ত হওয়ার একটি মোড় পরিবর্তনকারী কাজ ছিল বিচারপতি খায়রুল হকের মুন সিনেমা হল বিষয়ক মামলার রায়, যা সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায় হিসেবে পরিচিত। পঁচাত্তরের পর অনেক বিজ্ঞ ও স্বনামধন্য বিচারপতি উচ্চতর আদালতকে অলংকৃত করেছেন। তাঁদের জ্ঞানের প্রশংসা আমরা শুনেছি। কিন্তু সাহসী বিবেকের পরিচিতি তাঁরা রাখেননি। তাঁরা পরগাছা কর্তনের সাহস দেখাননি। বরং পরগাছাতে পানি সিঞ্চন করে মূল গাছটিকেই দুর্বল করে ফেলেছিলেন। তাঁরা কোর্টের বাইরে বলতেন, 'সামরিক আইন হলো জংলি আইন', 'আইনের অনুপস্থিতিই হলো সামরিক আইন' অথবা 'সেনাপ্রধানের নির্দেশই হলো সামরিক আইন'। অথচ কোর্টে বসে সেই সামরিক আইনকেই তাঁরা বৈধতা দিয়েছেন। সামরিক ফরমানগুলো বৈধ মনে করেছেন। বাংলাদেশবিরোধী গোলাম আযমের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের শত শত রাজনৈতিক কর্মী ও সেনাসদস্য হত্যার মতো মানবতাবিরোধী কর্মকেও মুক্ত করেনি বিচারের জন্য। এমনকি বেআইনি ও অনৈতিক কুখ্যাত 'ইনডেমনিটি' আইনকেও বৈধ করে রেখেছেন।
আগমন-নির্গমনের ধারাবাহিকতায় বিচারপতি খায়রুল হক নিয়োগ পেলেন উচ্চ আদালতে। মুন সিনেমার মালিকানা নিয়ে মামলা এল। মালিকানার বৈধতা নির্ভর করছিল সামরিক আইনের বৈধতার পর। পূর্বসূরিদের মতো তিনিও মার্শাল লকে ভিত্তি করে রায় দিয়ে দিতে পারতেন। তিনি তা করেননি। কারণ তিনি তো চাকরিজীবী নন। তিনি বিচারক। তিনি সময়ের সাহসী সন্তান। তিনি ইতিহাসের সন্তান। বিবেকের তাড়নায়, সুবিচারের প্রেরণায়, সর্বশক্তিমানের ওপর গভীর বিশ্বাস রেখে অদম্য সাহসের সঙ্গে এক যুগান্তকারী রায় দিলেন। দিনটি ছিল ২৯ আগস্ট ২০০৫। রায় দিলেন, আইনের দৃষ্টিতে মোশতাক, সায়েম, জিয়ার ক্ষমতারোহণ ছিল অবৈধ। তাঁরা ছিলেন 'হিউজারপর' বা 'জবরদখলকারী'। অতএব, তাঁদের প্রণীত 'আইন', 'বিধিবিধান' সব অবৈধ। তখন বিএনপি সরকার ক্ষমতাসীন। ক্ষমতার রক্তচক্ষু তাঁকে ভীতবিহ্বল করে তোলেনি। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তিনি বলেছিলেন, 'আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখি। আল্লাহ সত্য। তাই বান্দাও সত্য থেকে বিচ্যুত হতে পারে না।' তাঁর এই সত্যনিষ্ঠা তাঁকে ইতিহাসের পাদপীঠে দাঁড় করিয়েছিল। পঁচাত্তরে অসত্য, কলঙ্ক, সন্ত্রাস ও অবৈধতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল হিংসার মাধ্যমে, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে, হত্যার মাধ্যমে। ২০০৫ সালে এসে সাহস ও বিবেকের ওপর ভর করে আইনের মাধ্যমে উপড়ে ফেলেছিলেন মিথ্যার পরগাছা। সযত্নে মুছে দিয়েছিলেন ইতিহাসের পাতায় জমে ওঠা ময়লা, ধুলোবালি। ইতিহাসের সত্যগুলো আবার পরিস্ফুট হয়ে উঠল। ইতিহাসের সন্তান ইতিহাসকে সন্ত্রাসীদের কবল থেকে ছিনিয়ে আনলেন।
এর পর থেকে একের পর এক জঞ্জাল সাফ করে গেছেন এই নিরস্ত্র বিবেক। একুশে ফেব্রুয়ারি এলে ভাষার জন্য মায়াকান্না আমরা অনেক দেখি। কিন্তু মাতৃভাষাকে মায়ের আসনে সমাসীন করেছেন কজন? হাতেগোনা কয়েকজনের মধ্যে খায়রুল হক অনন্য একজন। উচ্চতর আদালতে বাংলা ভাষায় রায় লিখে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার।
যে মুক্তিযুদ্ধ একটি নেশন স্টেট বা জাতিরাষ্ট্র স্থাপন করেছিল, তার ডাক এসেছিল ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে। হানাদার বাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করেছিল এই ঐতিহাসিক ময়দানে। জাতির জনক ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে জনতার সঙ্গে কথা বলেছিলেন এই রেসকোর্স ময়দানে। মুক্তিযুদ্ধের সহযোদ্ধা ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের জনগণকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন এই একই ময়দানে। এভাবেই রেসকোর্স বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, স্বাধীনতার প্রতীক। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণের রায় দিয়েছিলেন বিচারপতি খায়রুল হক ২০০৯ সালে। সবশেষে সপ্তম সংশোধনী এবং ফতোয়া বিষয়ক রায় দিয়ে ২০১১ সালে তিনি বিদায় নিলেন। স্বাধীনতার ঘোষক বিষয়েও তথ্যসমৃদ্ধ অকাট্য প্রমাণাদি দিয়ে রায় দিয়েছেন তিনি।
বিএনপির কিছু নেতা খায়রুল হককে আওয়ামী দলীয় বলে উল্লেখ করেছেন। বিচারপতি হওয়ার আগে দীর্ঘদিন তিনি উচ্চতর আদালতে আইনজীবী ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ছিল না এক দিনের জন্যও। তিনি ছিলেন নিতান্তই সৎ পেশাজীবী। রাজনীতি করার সুযোগ থাকাকালে যিনি রাজনীতি করলেন না, তিনি কেন বিচারক হয়ে রাজনীতি করবেন! তিনি যে আইনের বিষয়ে প্রবল শক্তিমানকেও ছাড় দেন না, তার একটি প্রমাণ উল্লেখ করছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েক মাস আগে চট্টগ্রামে প্রকাশ্য ভাষণে বলেছিলেন, চট্টগ্রামে উচ্চতর আদালত স্থাপিত হবে। প্রধান বিচারপতি পরদিনই ফুলকোর্টে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন যে ঢাকার বাইরে উচ্চতর আদালত স্থাপনের আইনানুগ কোনো সুযোগ নেই। বেঞ্চ চট্টগ্রামে স্থাপন না করে তিনি চুপ করেও থাকতে পারতেন। চুপ করেও থাকেননি। তাঁর এই বলিষ্ঠতাই প্রমাণ করে, তিনি রাজনীতি করেননি, তাঁবেদারি করেননি। দায়িত্বে নিষ্ঠাবান থেকেছেন।
বিদায়ক্ষণে তাঁর কুশপুত্তলিকা দাহ করেছে বিএনপিপন্থী কিছু মানুষ। বিএনপি ও জামায়াত তাঁকে গালমন্দ করেছে। এটাই স্বাভাবিক। পঁচাত্তরের অবৈধ সরকারের রাজনৈতিক সন্তান হলো বিএনপি। জামায়াত সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। অসত্যের কলঙ্কের গর্ভে যার জন্ম, সে তো সত্যদর্শনে ভীত হবে। উন্মাদের মতো আচরণ করবে। কিন্তু সত্য অবিচল। ইতিহাস নিজ গতিতে চলতেই থাকবে।
ইতিহাসে আমরা অনেক জারজ সন্তানের পরিচয় পাই, যারা নিজগুণে মহিমান্বিত হয়েছিল। জারজ হওয়ার দায় তো সন্তানের নয়। জন্মদাতার। তাই কলঙ্ক জন্মদাতার। সন্তানের নয়। এমনটা তো বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির ক্ষেত্রেও হতে পারে। দোষ তাদের জন্মদাতার। তাদের তো দোষ নেই। মুক্তিযুদ্ধবিরোধিতা তথা পাকিস্তানপ্রীতি পরিত্যাগ করে তারাও তো দেশপ্রেমিক দলে রূপান্তরিত হতে পারে। জামায়াতের পক্ষে এমনটা সম্ভব না হলেও বিএনপি-জাতীয় পার্টির পক্ষে সম্ভব। আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করুন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে যাবেন কেন? দেশকে ভালোবাসলে মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়ে লালন করতে হবে। জাতির পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে মানতে হবে। সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীনকে জাতীয় বীরের আসনে বসাতে হবে। মূল সংবিধানের মৌলিকত্ব ফিরিয়ে এনে তা সুরক্ষা করতে হবে। এটি দলীয় বিষয় নয়। বিষয়টি জাতীয়তাবোধের, দেশপ্রেমের।
নিজ আঙিনায় বিচারপতি খায়রুল হক নীরবে, নিঃশঙ্কচিত্তে এ কাজগুলোই করে গেছেন। ভ্রষ্ট রাষ্ট্রশক্তিকে মুক্তিযুদ্ধের কক্ষপথে পুনঃপ্রতিষ্ঠায় অনন্য অবদান রেখেছেন। আজ যারা তাঁর কুশপুত্তলিকা দাহ করছে, শতবর্ষ পরে তারা যখন পচে গলে বিলীন হয়ে যাবে, খায়রুল হক তখন ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বল করবেন। পথহারাকে পথ দেখাবেন। নবপ্রজন্মের পথপ্রদর্শক হয়ে উঠবেন। ইতিহাসের নতুন সন্তানদের আদর্শস্থানীয় হয়ে থাকবেন।
লেখক : সাবেক ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
No comments