'ব্যর্থতা'র মধ্যে সরকারের সুচারু সাফল্য by লুৎফর রহমান রনো
সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে কথার অন্ত নেই। রাজনৈতিক মঞ্চের ব্যক্তিবর্গের কথা হিসাবে নেয় না সচেতন মানুষ। কারণ সরকারের উজ্জ্বল কোনো সাফল্যকেও বিরোধী দলগুলো স্বীকার করে না। সরকারের ব্যর্থতাকেও তারা সঠিক দৃষ্টিতে দেখে গঠনমূলক ব্যাখ্যা না করে বিকৃত করে ব্যাখ্যা করে।
যেমন ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি কিংবা ফারাক্কার পানি বণ্টনের অন্যায্যতা নিয়ে ন্যায্য কথা বলতে শোনা যায়নি। তাঁরা বলেছেন, এ সরকারের উপদেষ্টারা সবাই ভারতের স্বার্থ দেখে কিংবা কখনো বলেছেন, ভারতের হাতে দেশটাকেই সরকার তুলে দিচ্ছে, ইত্যাদি। সরকারি লোকজনেরও বিরোধী দল সম্পর্কে বেমক্কা কথা বলার উদাহরণ রয়েছে। দেশবাসীও এই দুই দলের 'রাজনীতি'র ভাষাভঙ্গি-বিতর্ক সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। এমনকি দল দুটি বা জোট দুটির রাজনৈতিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্যও পরিষ্কার খোলা চোখের মানুষের কাছে। তাই আমরা সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে দেখব। রাজনৈতিক ঢঙ্গে নয়। দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়, সরকার পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করতে পারেনি, তা তাদের ব্যর্থতা। সঠিকভাবে বললে বলা উচিত আপাত ব্যর্থতা। সরকার তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়েছে, কিন্তু সাধারণ নাগরিক হিসেবে বলা যায়, বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ। গত বছর বা তার আগের বছরের লোডশেডিংয়ের চেয়ে এবারের লোডশেডিং আরো বেশি যন্ত্রণাদায়ক। পানি সমস্যাও তথৈবচ। গ্রামে সেচ-সংকট সৃষ্টি হয়েছে বিদ্যুতের অভাবে। পত্রিকার খবর অনুযায়ী বহুসংখ্যক কলকারখানাও বন্ধ হয়ে গেছে বিদ্যুতের সংকটে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ এবার সংকট থেকে মহাসংকট রূপ নিয়েছে। সরকার বলছে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে তিন হাজার মেগাওয়াট। তাও সত্য, সাফল্যও সত্য।
গতকাল আমার এক সহকর্মীকে দুঃখ করে বলছিলাম, সরকার কথা দিয়ে নয় শুধু, অনেকটা তারিখ দিয়ে ফেলেছিল সাংবাদিকদের অষ্টম বেতন স্কেল ঘোষণা করার। অথচ এখন পাথরের মতো নির্বিকার। আমাদের কথা কানেও নিচ্ছে না। সহকর্মী বলল, 'সরকার তার সঠিক অবস্থানে রয়েছে। জানেন না সরকারগুলো তাদের শ্রেণীস্বার্থ রক্ষা করার নিমিত্তে সবই করে। আমাদের কিছু আদায় করতে হলে রাস্তায় নামতে হয়, পুলিশের পিটুনি খেতে হয়, তারপর যদি সরকার সদয় হয় গরিবের প্রতি...' মনে হলো এ কথা তো আমিও জানি, কিন্তু কেন যেন মনে করে আসছিলাম, অন্তত সাংবাদিকদের প্রতি এ সরকার সদয় থাকবে। সত্য যে, ক্ষমতাসীন এই দল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী। কিন্তু তাঁদের ভ্রান্ত নীতি ও ভুল ব্যক্তিদের হাতে ক্ষমতার অদূরদর্শী ব্যবহার, আত্মস্বার্থপরতা এসবের কারণে সরকারে অর্জনের সুফল ভোগ করছে ব্যবসায়ী ও উচ্চবিত্ত শ্রেণী।
আসলে ব্যাপারটা সব ক্ষেত্রেই এরূপ। বাড়তি বিদ্যুৎ সবই খরচ হচ্ছে এই দুতিন বছরে যারা নতুন করে ধনী হয়েছে তাঁদের এয়ারকুলার চালাতে। পুরনো ধনীরা বিদ্যুৎ ব্যবহার আগের চেয়ে তিন-চারগুণ বৃদ্ধি করেছেন। খুব কাছের শিল্পপতিদের কারখানা নিরবচ্ছিন্নভাবে উৎপাদন যাতে অব্যাহত রাখে, সে ব্যবস্থা হয়েছে। এ কথাগুলো যদি মিথ্যা হয় বিদ্যুতের বাড়তি উৎপাদন কি সত্য নয়?
সাংবাদিকদের বেতন স্কেল বৃদ্ধি করলে যে কয়েক কোটি টাকা মাসে ব্যয় হবে মালিকদের, সে ব্যয় রোধ করে মালিকদের সহায়তা করছে সরকার। যেমন গার্মেন্ট শ্রমিকের বেতন নূ্যনতম পাঁচ হাজার না করে তিন হাজার টাকায় বেঁধে দিয়ে মালিকের পক্ষাবলম্বন করেছিল। একজন শ্রমিকের ঢাকায় থাকা-খাওয়া-বাঁচার জন্য কত প্রয়োজন হতে পারে, তা যদি রাষ্ট্র পরিচালকের ধারণায় না থাকে, তাহলে প্রত্যেক ক্ষেত্রেই বিড়ম্বনা অবধারিত। সরকার হয়তো এমন দুচারজন সাংবাদিককে চেনে, যাদের বেতন-ভাতা প্রায় মন্ত্রী-এমপিদের সমতুল্য। সেই সৌভাগ্যবান দুচারজন সাংবাদিকের জীবন হিসাব করে কিংবা তাঁদের পরোক্ষ পরামর্শ পেয়ে হাজার হাজার গরিব সাংবাদিকের প্রত্যাশাকে গুঁড়িয়ে চলেছে নীরবে নির্দ্বিধায়!
অনেকে বলেন, সরকারের সাফল্যকে যথোচিতভাবে প্রচার করা হচ্ছে না। সাফল্য প্রচারের অপেক্ষা রাখে না। একজন মানুষ আগের চেয়ে যদি কিঞ্চিৎ পরিমাণ ভালো থাকতে পারে, তাতেই সরকারের সাফল্যের ঢোল আপনিই বাজবে।
বহু আগে থেকে গণমাধ্যমে প্রচার হচ্ছিল পোলট্রি খামারগুলো সংকটের মধ্যে আছে। কে কান দেয় গরিবের ঘ্যানঘ্যানানিতে? খামার করে সাধারণত গরিব উদ্যোক্তারা। কোনোমতে কয়েক লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছিল। দেশের মানুষও সস্তায় ডিম ও মাংস খেতে পারছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে খামারিদের মাংস খেতে জেঁকে বসল ধনিক শ্রেণী। মুরগির বাচ্চার মূল্য বেড়েছে প্রায় ৩০০ শতাংশ। মুরগির খাবারের মূল্য বৃদ্ধি হয় প্রায় ২০০ শতাংশ। পরিণামে খামারিরা বেশি টাকা লগি্ন করে মুনাফা করতে ব্যর্থ হওয়ায় ধীরে ধীরে পোলট্রি খাত সঙ্কুচিত হয়ে আসে। এখন হাতেগোনা ধনীরাই খামার করে। বাজারেও দাম বেশি। মুনাফা তাদের হচ্ছে বটে। কিন্তু এখন অধিকাংশ গরিব দেশবাসী বঞ্চিত হচ্ছে পুষ্টি থেকে। এ ক্ষেত্রেও সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি দরিদ্র খামারিদের জন্য। ব্যবসা এখন শতভাগ চলে গেছে কেন্দ্রীয় ধনীদের বৃত্তে। বলাই যায় তাই ধনীস্বার্থ রক্ষার্থে সরকার এখন শতভাগ সফল। এভাবে আমরা ভোজ্য তেলের কথা বলতে গিয়ে তাবৎ খাদ্যপণ্যের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধির কারণ যে ব্যবসায়ী স্বার্থ রক্ষা, তার পুনরুল্লেখের কোনো প্রয়োজন আর নেই।
লেখক : সাংবাদিক
গতকাল আমার এক সহকর্মীকে দুঃখ করে বলছিলাম, সরকার কথা দিয়ে নয় শুধু, অনেকটা তারিখ দিয়ে ফেলেছিল সাংবাদিকদের অষ্টম বেতন স্কেল ঘোষণা করার। অথচ এখন পাথরের মতো নির্বিকার। আমাদের কথা কানেও নিচ্ছে না। সহকর্মী বলল, 'সরকার তার সঠিক অবস্থানে রয়েছে। জানেন না সরকারগুলো তাদের শ্রেণীস্বার্থ রক্ষা করার নিমিত্তে সবই করে। আমাদের কিছু আদায় করতে হলে রাস্তায় নামতে হয়, পুলিশের পিটুনি খেতে হয়, তারপর যদি সরকার সদয় হয় গরিবের প্রতি...' মনে হলো এ কথা তো আমিও জানি, কিন্তু কেন যেন মনে করে আসছিলাম, অন্তত সাংবাদিকদের প্রতি এ সরকার সদয় থাকবে। সত্য যে, ক্ষমতাসীন এই দল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী। কিন্তু তাঁদের ভ্রান্ত নীতি ও ভুল ব্যক্তিদের হাতে ক্ষমতার অদূরদর্শী ব্যবহার, আত্মস্বার্থপরতা এসবের কারণে সরকারে অর্জনের সুফল ভোগ করছে ব্যবসায়ী ও উচ্চবিত্ত শ্রেণী।
আসলে ব্যাপারটা সব ক্ষেত্রেই এরূপ। বাড়তি বিদ্যুৎ সবই খরচ হচ্ছে এই দুতিন বছরে যারা নতুন করে ধনী হয়েছে তাঁদের এয়ারকুলার চালাতে। পুরনো ধনীরা বিদ্যুৎ ব্যবহার আগের চেয়ে তিন-চারগুণ বৃদ্ধি করেছেন। খুব কাছের শিল্পপতিদের কারখানা নিরবচ্ছিন্নভাবে উৎপাদন যাতে অব্যাহত রাখে, সে ব্যবস্থা হয়েছে। এ কথাগুলো যদি মিথ্যা হয় বিদ্যুতের বাড়তি উৎপাদন কি সত্য নয়?
সাংবাদিকদের বেতন স্কেল বৃদ্ধি করলে যে কয়েক কোটি টাকা মাসে ব্যয় হবে মালিকদের, সে ব্যয় রোধ করে মালিকদের সহায়তা করছে সরকার। যেমন গার্মেন্ট শ্রমিকের বেতন নূ্যনতম পাঁচ হাজার না করে তিন হাজার টাকায় বেঁধে দিয়ে মালিকের পক্ষাবলম্বন করেছিল। একজন শ্রমিকের ঢাকায় থাকা-খাওয়া-বাঁচার জন্য কত প্রয়োজন হতে পারে, তা যদি রাষ্ট্র পরিচালকের ধারণায় না থাকে, তাহলে প্রত্যেক ক্ষেত্রেই বিড়ম্বনা অবধারিত। সরকার হয়তো এমন দুচারজন সাংবাদিককে চেনে, যাদের বেতন-ভাতা প্রায় মন্ত্রী-এমপিদের সমতুল্য। সেই সৌভাগ্যবান দুচারজন সাংবাদিকের জীবন হিসাব করে কিংবা তাঁদের পরোক্ষ পরামর্শ পেয়ে হাজার হাজার গরিব সাংবাদিকের প্রত্যাশাকে গুঁড়িয়ে চলেছে নীরবে নির্দ্বিধায়!
অনেকে বলেন, সরকারের সাফল্যকে যথোচিতভাবে প্রচার করা হচ্ছে না। সাফল্য প্রচারের অপেক্ষা রাখে না। একজন মানুষ আগের চেয়ে যদি কিঞ্চিৎ পরিমাণ ভালো থাকতে পারে, তাতেই সরকারের সাফল্যের ঢোল আপনিই বাজবে।
বহু আগে থেকে গণমাধ্যমে প্রচার হচ্ছিল পোলট্রি খামারগুলো সংকটের মধ্যে আছে। কে কান দেয় গরিবের ঘ্যানঘ্যানানিতে? খামার করে সাধারণত গরিব উদ্যোক্তারা। কোনোমতে কয়েক লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছিল। দেশের মানুষও সস্তায় ডিম ও মাংস খেতে পারছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে খামারিদের মাংস খেতে জেঁকে বসল ধনিক শ্রেণী। মুরগির বাচ্চার মূল্য বেড়েছে প্রায় ৩০০ শতাংশ। মুরগির খাবারের মূল্য বৃদ্ধি হয় প্রায় ২০০ শতাংশ। পরিণামে খামারিরা বেশি টাকা লগি্ন করে মুনাফা করতে ব্যর্থ হওয়ায় ধীরে ধীরে পোলট্রি খাত সঙ্কুচিত হয়ে আসে। এখন হাতেগোনা ধনীরাই খামার করে। বাজারেও দাম বেশি। মুনাফা তাদের হচ্ছে বটে। কিন্তু এখন অধিকাংশ গরিব দেশবাসী বঞ্চিত হচ্ছে পুষ্টি থেকে। এ ক্ষেত্রেও সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি দরিদ্র খামারিদের জন্য। ব্যবসা এখন শতভাগ চলে গেছে কেন্দ্রীয় ধনীদের বৃত্তে। বলাই যায় তাই ধনীস্বার্থ রক্ষার্থে সরকার এখন শতভাগ সফল। এভাবে আমরা ভোজ্য তেলের কথা বলতে গিয়ে তাবৎ খাদ্যপণ্যের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধির কারণ যে ব্যবসায়ী স্বার্থ রক্ষা, তার পুনরুল্লেখের কোনো প্রয়োজন আর নেই।
লেখক : সাংবাদিক
No comments