সংবিধান সংশোধনী-বিবেচনার জন্য কিছু প্রস্তাব by আলী রীয়াজ

জাতীয় সংসদের সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত বিশেষ কমিটির সাম্প্রতিক বৈঠকগুলো, আগামী সংসদ অধিবেশনে সংবিধান সংশোধনীর সম্ভাবনা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে অ্যামিকাস কিউরিদের বক্তব্য দান এবং প্রধান বিরোধী দল বিএনপির বক্তব্যের কারণে সংবিধান নিয়ে এখন জোরদার


আলোচনা চলছে। গত বছরের আগস্ট মাসে সংসদীয় কমিটি গঠনের পর এটা সবারই জানা ছিল যে, এ নিয়ে কোনো না কোনো পর্যায়ে বিতর্কের সুযোগ তৈরি হবে। আদালতের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায় যখন সুপ্রিম কোর্টে বহাল থাকল এবং পরে সুপ্রিম কোর্টের পুরো মতামত জানা গেল, অনেকেই আশা করেছিলেন যে এতে করে সংবিধান নিয়ে ব্যাপক আকারে আলোচনার সূত্রপাত হবে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায় বেরোনোর এক বছরের বেশি সময় পার হওয়া সত্ত্বেও এ ধরনের বড় উদ্যোগ আমার নজরে আসেনি। দেশের সিভিল সোসাইটির সংগঠনগুলো এ ব্যাপারে খুব আশাপ্রদ ভূমিকা রাখেনি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আইন বিভাগ সম্মিলিত বা আলাদাভাবে উদ্যোগ নিতে পারত। বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত আলোচনায় সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদেরা মন্তব্য করলেও তার সারাৎসার সরকার ও জনসাধারণের বোধগম্য হয়েছে বলে মনে হয় না। আইনজীবীদের সংগঠনগুলো; বিশেষ করে, সাংবিধানিক আইন নিয়ে যাঁরা চিন্তাভাবনা করেন, তাঁরা দলীয়ভাবে বিভক্তির কারণেই সম্ভবত একত্রে বসে বিভিন্ন দিক নিয়ে মতবিনিময় করেননি। এসব সুযোগ যে এখন আর নেই, আমার তা মনে হয় না।
সংবিধানের যে ভাষ্য ইতিমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে মুদ্রণ করা হয়েছে, তা ত্রুটিপূর্ণ এবং তার পক্ষে কথা বলতে গিয়ে অনেক রকম বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। সেগুলো সমাধানের চেষ্টা অব্যাহত রাখা দরকার, কিন্তু তার চেয়ে বেশি দরকার, এটা আলোচনা করা যে কী করে সংবিধানকে আরও বেশি ত্রুটিমুক্ত করে স্বচ্ছ, সবার অংশগ্রহণমূলক, প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যায়। বাংলাদেশের ৪০ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে এটা স্পষ্ট যে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করা এবং অগণতান্ত্রিক আচার-আচরণ রোধ করার ক্ষেত্রে সংবিধান খুব বেশি সাহায্য করেনি। সংবিধানের খুঁটিনাটি বিধিবিধান পরিবর্তন, সংশোধন, পরিবর্ধনের আগে এই বাস্তবতাকে উপলব্ধি করা এবং তার ভিত্তিতে একটি বৃহত্তর কাঠামো তৈরি করা। দেশের রাজনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ, বিশ্লেষক কমবেশি এদিকে মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন, কিন্তু তার ফল আমরা এখনো দেখতে পাইনি।
এই পটভূমিকায়ই তত্ত্বাবধায়ক সরকার, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, সংসদ সদস্যদের অনুপস্থিতি এবং সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে কিছু কিছু কথাবার্তা হচ্ছে। সেসব বিষয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি সুনির্দিষ্টভাবে বোঝার সুযোগ তৈরি হয়নি। সংসদীয় কমিটির অন্যতম শীর্ষ ব্যক্তি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কিছু মন্তব্য করেছেন। এগুলো ওই কমিটির সিদ্ধান্ত নয় বলেই ধরে নেওয়া যায়, কেননা কমিটির সুপারিশ হিসেবে এগুলো উপস্থাপিত হয়নি।
কোনো কোনো মহলে এ রকম আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল যে ক্ষমতাসীন দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দিতে উৎসাহী। বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে সরকার ব্যবস্থাটি বাতিল করবে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে যে তারা ব্যবস্থাটি বাতিল না করে এতে সংশোধনী আনতে চায়। ব্যক্তিগতভাবে আমি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার সমালোচক। ১৯৯৬ সালে এই ব্যবস্থা যেভাবে সংবিধানে জুড়ে দেওয়া হয়, আমি তা সমর্থনযোগ্য মনে করিনি এবং পরবর্তী ১৫ বছর ধরে এর ত্রুটিগুলোর ব্যাপারে আমি মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছি। (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০০৬ সালের আগস্ট মাসে প্রকাশিত আমার একটি রচনার শিরোনাম ছিল ‘ক্রিপলড কেয়ারটেকার’। হিমাল, সাউথ এশিয়া ম্যাগাজিনের আগস্ট ২০০৬ সংখ্যা দ্রষ্টব্য।) অনেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার সমালোচনা করছেন ২০০৭-০৮ সালের সরকারের কার্যক্রম দেখে। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী ওই সরকার সংবিধানের ফাঁক-ফোকর ব্যবহার করে ৯০ দিনের বদলে দুই বছর থেকেছে এবং সংবিধানে সুনির্দিষ্ট নয় এমন সব কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। সমালোচকেরা এও বলেন, ২০০৬ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ প্রথমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করে এই ব্যবস্থার মর্মবাণী বা স্পিরিটের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। রাষ্ট্রপতির হাতে জরুরি অবস্থা জারির ক্ষমতা থাকায় ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তাঁর অপপ্রয়োগের সুযোগ পেয়েছেন বলে বলা হয়। এসব অভিযোগের পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। তবে এই অভিজ্ঞতাগুলো যে ব্যবস্থাটি নিয়ে ভাববার কাজে দিচ্ছে, সেটা ইতিবাচক; পাশাপাশি কেন এই ব্যবস্থার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল বা দেয়, সেটা মনে রাখা দরকার। কী পরিস্থিতিতে ২০০৭ সালের ১২ জানুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ঢেলে সাজাতে হয়েছিল; কেন তার প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন দিয়েছিল সাধারণ জনগণ, আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনা এবং এই সরকার ৯০ দিনের অতিরিক্ত থাকার সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য কতটা সহায়ক হয়েছিল, সেগুলোও ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর আস্থার অভাব, অবাধ নির্বাচনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুপস্থিতি বা দুর্বলতা এবং প্রশাসনের দলীয়করণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এড়িয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদকাল বা রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নিয়ে আলোচনা করলে বা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করলে তার ফল আশানুরূপ হবে না। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ৯০ দিনে বেঁধে দেওয়া হবে। কেবল জরুরি অবস্থায়ই তা আরও ৩০ দিন বাড়ানো যাবে। আশা করি, এই সংশোধনীর মধ্যে সুস্পষ্ট থাকবে যে ‘জরুরি অবস্থা’ কে নির্ধারণ করবেন এবং ৯০ দিনের বেঁধে দেওয়া সময়ে রাজনৈতিক অচলাবস্থা দূর না করা গেলে কী বিকল্প থাকবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেবল দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করবে, এর বেশি করার কোনো ক্ষমতা তার থাকবে না। এটা নিশ্চিত করতে হলে এও নিশ্চিত করতে হবে—অবাধ, সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যা কিছু করা দরকার, তা করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের হাতে হস্তান্তর করা হবে। তদুপরি কমিশন যেন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, তবে তাকে দলীয় প্রভাবমুক্তভাবে গড়তে হবে কমপক্ষে এক বছর আগে।
বলা হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। এখনকার চালু ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি আলংকারিক পদ থেকে নির্বাহী পদে রূপান্তরিত হয়। যুক্তিটি নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্য। তার প্রয়োগ আমরা কমপক্ষে দুই দফা প্রত্যক্ষ করেছি। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমকে তাঁর পদ থেকে অপসারণ করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা এর প্রধান এ বিষয়ে অবহিত ছিলেন না বলেই অভিযোগ আছে। রাষ্ট্রপতির বাধ্যবাধকতা ছিল না তাকে অবহিত করার। ২০০৭ সালে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন ১১ জানুয়ারি। কোনো অভিজ্ঞতাই সুখকর নয়। দুই অভিজ্ঞতা তুলনীয় কি না, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। কিন্তু রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতা প্রয়োগের প্রয়োজন যদি দেখা দেয়, যদি দেশে এ ধরনের পরিস্থিতি দেখা দেয়, তবে জরুরি অবস্থা জারি কিংবা দৈনন্দিন কার্যকলাপের অতিরিক্ত দায়িত্ব কে কীভাবে পালন করবেন, তা সুস্পষ্ট না থাকলে বিভ্রান্তি, এমনকি অচলাবস্থা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে আমার ব্যক্তিগত অনুৎসাহ ও বিরোধিতার পেছনে যেসব কারণ, তার অন্যতম হলো, এ ধরনের সরকারের দায়বদ্ধতার অভাব। সংবিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাষ্ট্রপতির কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন। রাষ্ট্রপতি যে দলীয় বিবেচনায় নির্বাচিত হন এবং যেভাবে তাঁকে কার্যত প্রধানমন্ত্রীর অনুগত থাকতে হয়, সে ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে তার কাছে দায়বদ্ধ করার বিধান সংবিধানের অন্যান্য অংশের সঙ্গে কতটা সংগতিপূর্ণ, তা আমার কাছেই প্রশ্নসাপেক্ষ বলেই মনে হয়। তদুপরি, যত দিন এ ধরনের ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা হবে, তত দিন পর্যন্ত শক্তিশালী স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠনের কাজ থেকে রাজনীতিবিদেরা বিরত থাকবেন। ১৯৯৬ থেকে ২০১১—এই ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমি এই উপসংহারে পৌঁছাতে বাধ্য হয়েছি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা নিয়ে যতটা আলোচনা হচ্ছে, তার গঠন ও সম্ভাব্য সদস্যদের যোগ্যতা নিয়ে ততটা আলোচনা লক্ষ করছি না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের পদটির সঙ্গে বিচার বিভাগকে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে দেওয়া মতামতে রোকনউদ্দিন মাহমুদ মন্তব্য করেছেন, যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব পালন করেন এবং যেহেতু তিনি আর বিচার বিভাগে প্রত্যাবর্তন করেন না, সেহেতু বিচার বিভাগের স্বাধীনতা তাতে ক্ষুণ্ন হয় না। আইনগত দিক থেকে বিবেচনা করলে তাঁর সঙ্গে দ্বিমত করা কষ্টকর। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সম্ভাব্য প্রধানের বিবেচনা যে বিচার বিভাগের নিয়োগ, পদোন্নতি ইত্যাদিতে প্রভাব ফেলেনি, এসব কথা নিশ্চয় রোকনউদ্দিন মাহমুদ বলবেন না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংশোধনের সময় তার প্রধান হওয়ার যে বিকল্পগুলো রাখা হয়েছে, সেগুলোও সংশোধনের কথা ভাবা খুবই জরুরি। অন্যথায় গত বছরগুলোর অভিজ্ঞতার কোনো লাভ হলো বলে মনে হবে না।
সংবিধান সংশোধন নিয়ে সরকারি উদ্যোগ কেবল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা পরিবর্তনে সীমিত থাকবে না বলে আশা করি। নির্বাচিত সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে, সেই পাঁচ বছর রাষ্ট্রপতির যে ক্ষমতা আছে এবং যেসব ক্ষমতা নেই, সেগুলো বিবেচনা করা দরকার বিভিন্ন কারণে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করা। ১৯৯১ সালে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের সময় তাড়াহুড়ো করে রাষ্ট্রপতির সব ক্ষমতা যেভাবে প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, তাতে ‘নির্বাচিত একনায়কতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত হয়েছে। সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী যথেষ্ট ক্ষমতাশালী প্রতিষ্ঠান; কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে সব ক্ষমতা এক হাতে সোপর্দ করাটি গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক। কাগজ-কলমে তার পক্ষে যুক্তি দেখানো সম্ভব হলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিবেচনা করে দেশের নীতিনির্ধারকেরা সৃষ্টিশীলভাবে এই সমস্যাটি বিবেচনা করুন—এটাই আবেদন।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান এবং তার ক্ষমতার প্রশ্নটি গণতন্ত্র সংহত করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থেও বিবেচনা করা দরকার। কয়েকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান যেমন—নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশনের নিয়োগের ভার রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত। কার্যত, এগুলো ক্ষমতাসীন দলের হাতে আটকা পড়ে গেছে, কেননা রাষ্ট্রপতি পদটি ক্ষমতাহীন এবং প্রধানমন্ত্রীর ওপর তার নির্ভরশীলতা অতিমাত্রায়। বিরাজমান ব্যবস্থায় সামান্যতম ভিন্নমত পোষণ করলে রাষ্ট্রপতির ভাগ্যে কী ঘটে, তা আমরা কে না জানি। এই সমস্যা মোকাবিলার জন্য সংসদের মেয়াদকালের ঠিক মধ্যবর্তী সময়ে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রস্তাব তোলার সময় এসেছে বলে আমার ধারণা। এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল জনগণের মধ্যে তাদের জনপ্রিয়তা পরীক্ষার সুযোগ পাবেন, রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতাসীন দলের মুখাপেক্ষী হতে হবে না, সর্বোপরি একজন রাষ্ট্রপতিকে কাজ করতে হবে দুটি নির্বাচিত সংসদের সঙ্গে। একটি ছোট সমস্যার কথা এখানে অনেকে তুলতে পারেন। রাষ্ট্রপতি ও সংসদ যদি দুই ভিন্ন দলের হয়, তবে সংসদের উদ্বোধনী ভাষণের বক্তব্য কী হবে? ব্রিটেনে পার্লামেন্টে রানি যে বক্তৃতা দেন, তা ক্ষমতাসীন দলেরই কর্মসূচি। বাংলাদেশের পার্লামেন্টে রাষ্ট্রপতির ভাষণ দেওয়ার ব্যবস্থা ওই ধারারই অনুসরণ। ব্রিটেনে শত শত বছর তা কাজ করেছে বলে সর্বত্রই সব সময় তা কাজ করবে—এমন মনে করা অসংগত। সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করলে এই ঔপনিবেশিক ধারা থেকে বাংলাদেশ নিজেকে মুক্ত করতে পারবে। রাষ্ট্রপতি বছরে একবার সংসদে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ পাবেন, অথবা তিনি স্পিকারের মাধ্যমে সংসদে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য যেকোনো সময় অনুরোধ করবেন। তাঁকে সে জন্য ধন্যবাদ দেওয়ার প্রয়োজন নেই—এটা তাঁর দায়িত্ব বলেই বিবেচনা করা যেতে পারে।
সাংবিধানিকভাবে নির্ধারিত যেসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির কাছে অর্পিত আছে এবং থাকবে বলে আমার প্রস্তাব, সেগুলো যাতে এক ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছা, পছন্দ-অপছন্দের বিষয়ে পরিণত না হয়, তার জন্য এই বিধান করা যেতে পারে যে রাষ্ট্রপতি কাউকে নিয়োগ দেওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী, সংসদনেতা, বিরোধীদলীয় নেতা ও স্পিকারের সঙ্গে এ বিষয়ে মতবিনিময় করবেন। এরপর মনোনীত ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের নাম ঘোষণা করবেন, যাতে করে তাঁদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও ভূমিকা নিয়ে সাধারণ মানুষ তাঁদের মতামত প্রকাশ করতে পারেন। রাষ্ট্রপতি চাইলে তাঁর মনোনয়ন প্রত্যাহারও করতে পারবেন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একাধারে তিন ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তিনি প্রধানমন্ত্রী, সংসদীয় দলের প্রধান এবং তাঁর দলের প্রধান। এই তিনটি দায়িত্ব তিন ব্যক্তির হাতে তুলে দিলে দল, সরকার ও সংসদ—সবই উপকৃত হবে। লক্ষণীয়, সংসদের অন্যান্য অনেক বিষয়ে ব্রিটেনকে মডেল হিসেবে ব্যবহার করলেও এ বিষয়ে ব্রিটেনের অনুসারী হওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদেরা মোটেই উৎসাহী নন।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে এযাবৎ বিস্তর আলোচনা হয়েছে গত কয়েক বছরে। এসব আলোচনায় এই মতৈক্য সুস্পষ্ট যে এই ধারাটি গণতন্ত্রের জন্য মোটেই অনুকূল নয়; সম্ভবত একে অগণতান্ত্রিক বলেও চিহ্নিত করা যেতে পারে। সংবিধানে এই বিধান রাখার পক্ষে জোরালো কোনো যুক্তি কেউ এখনো হাজির করতে পারেননি। সংসদ সদস্যদের দলীয় নিয়ন্ত্রণে না রাখলে সরকারের স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ন হয়। পাকিস্তানের পঞ্চাশের দশকের অভিজ্ঞতা থেকে এই ধারা যুক্ত করা হয়েছিল, পরে তা আরও কঠোর করা হয়েছে। সংসদীয় কমিটি এবং অন্যরা এর পরিবর্তনে আগ্রহ দেখিয়েছে, কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, সংসদে অনাস্থা ভোটের ক্ষেত্রে দলীয় নিয়ন্ত্রণ রাখা দরকার কি না। ক্ষমতাসীন দলকে যদি সংবিধানের বিধানের জোরে দলীয় সদস্যের সমর্থন নিশ্চিত করতে হয়, তবে তা কি প্রমাণ করে না যে দলীয় নেতৃত্ব দল ও সরকার পরিচালনার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে? জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন ছাড়া অন্য সব বিষয়ে সংসদ সদস্যরা তাঁদের বিবেক-বিবেচনাপ্রসূত ভোটাধিকার নিশ্চিত করার ব্যবস্থাসংবলিত বিধান করা অত্যন্ত জরুরি।
২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে বিএনপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারা ক্ষমতায় গেলে ৩০ দিনের বেশি অনুপস্থিত থাকলে সংসদ সদস্যদের সদস্যপদ বাতিল হওয়ার বিধান করবে। সংসদকে কার্যকর করার জন্য এই প্রস্তাবটি সত্যি সত্যিই একটি আশাব্যঞ্জক প্রস্তাব ছিল। বিএনপি কেবল নির্বাচনে পরাজিতই হয়েছে তা নয়, তারা কার্যকরভাবে নিজেরাই এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে আসছে। নবম সংসদের ২৪ মার্চ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ২০৭টি কার্যদিবসে মাত্র ৫১ দিন বিএনপির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। অষ্টম সংসদের বৈঠক হয়েছে ৩৭৩ কার্যদিবস; তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ মোট ১৫০ দিন যোগ দিয়েছে। একটি জাতীয় দৈনিকের হিসাব অনুযায়ী গত ২০ বছরে বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যরা মোট কার্যদিবসের অর্ধেক দিনই সংসদে অনুপস্থিত ছিলেন। এসব অভিজ্ঞতার আলোকে বর্তমান ৯০ কার্যদিবসের বদলে ৯০ দিনে পরিবর্তনের প্রস্তাব নিঃসন্দেহে ইতিবাচক; কিন্তু এটা বিএনপির প্রস্তাবিত ৩০ দিনে নির্ধারণ করতে বাধা কোথায়? অন্তত বিএনপি নিশ্চয় তাতে আপত্তি করতে পারবে না। কিন্তু সংসদ কার্যকর করতে এটাই যথেষ্ট পদক্ষেপ নয়; কোরামের অভাবে সংসদ মুলতবি করার মতো ঘটনা যখন ঘটছে, তখন নিশ্চয়ই তার জন্যও একটা বিধান রাখার কথা সংসদীয় কমিটি বিবেচনা করে দেখবে।
সংবিধানের প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো কীভাবে উপস্থাপিত হবে—আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই তা জানার সুযোগ হবে বলে আশা করি। সংসদে বিল আকারে সেসব সংশোধনী উপস্থাপনের আগে আলাপ-আলোচনার সুযোগ থাকবে, এটাও আমার প্রত্যাশা। সেসব আলোচনা সংসদীয় কমিটি ও নীতিনির্ধারকেরা বিবেচনায় নেবেন কি না, এখন সেটাই বড় প্রশ্ন।
ইলিনয়, ৪ এপ্রিল ২০১১
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.