জার্নি বাই ট্রেন by অর্চি দাশগুপ্ত

ট্রেনে চলেছি দিলি্লর পথে। গত নভেম্বরের প্রথম দিনে আমরা কয়েকজন বুয়েটের ছাত্রছাত্রী বের হয়েছি শিক্ষা ভ্রমণে। বাইরে দারুণ ঠাণ্ডা বাতাস। এভাবে ট্রেন ভ্রমণ একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা। ট্রেনটি চলছে ১০ ঘণ্টা লেটে। ছোট-বড় ভাঙাচোরা সব রকম স্টেশনে থামার জন্য কে তাকে দিব্যি দিয়েছে, কে জানে।


আমাদেরই একজন জুবায়েরের মন্তব্য_ আকাশ, পাখি, গরু যা দেখছে সব কিছুকে থেমে থেমে সালাম দিচ্ছে ট্রেনটি। কেবল তার পেটের ভেতর যে বিপুলসংখ্যক যাত্রী, তাদের কথা ভাবছে না।
এই ট্রেনেই দেখা মিলল অনেক ভিখারির। তাদের প্রত্যেকের পদ্ধতি ও কৌশল আলাদা। এক হিন্দুস্তানি নারী ভিক্ষা করতে আমাদের কামরায় এলেন, সঙ্গে দুটি শিশু। একটি ছেলে, একটি মেয়ে। তার সন্তান কি? নাকি ধার করে আনা হয়েছে কমিশনের বিনিময়ে? মহিলাটি একাগ্র মনে ঢোল বাজিয়ে চলেছেন। আর শিশু দুটি কামরায় ঘুরে ঘুরে অ্যাক্রোবেটিক সব কসরত দেখিয়ে চলেছে। মোটা করে কাজল দু'জনের চোখে। ছেলেটার গোঁফের স্থানে তাসের রাজার মতো আঁকা হয়েছে গোঁফ। কপালে কালো ফোটা। মাথায় টুপি। চেহারায় নিষ্পাপ ভাব। দারুণ মায়াবী দেখতে। হাতের ভিক্ষাপাত্রে টুপটাপ পয়সা-নোট পড়ছে। বাংলাদেশের ভিখারিরা এখন পয়সা তো নয়ই, এক বা দুই টাকাও চায় না। দশটা টাকা দেন_ এমন কথা অনেকবার শুনেছি। কিন্তু দিলি্লর পথে ট্রেনে যেতে দেখলাম, পয়সার কদর রয়েছে। ছেলেমেয়ে দুটির শরীরের নানা কসরত এবং তাদের সঙ্গের নারীর সুরের আবেশ ছড়ানো ঢোলের বাদ্যের কারণে ভিখারি হিসেবে তাদের বিবেচনা করতে মন সায় দেয়নি। তাদের বরং বলতে পারি বিনোদনের বিনিময়ে উপার্জনে ব্যস্ত। আমাদের মতো আরও অনেকের ক্লান্তিকর যাত্রায় তারা বরং আনন্দের খোরাক জোগাচ্ছে।
ট্রেনে একটি স্টেশন থেকে কয়েকজন হিজড়া উঠে পড়ল। একজন তো খুব মারমুখী। যারা টাকা দিতে চাইছিল না, তাদের পাশে বসে যাচ্ছে, গায়ে হাত দিয়ে অপমান করছে।
শিক্ষা সফরে আরেক ট্রেন জার্নির অভিজ্ঞতা ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। গন্তব্য ভুবনেশ্বর। তবে গীতাঞ্জলি নামের ট্রেনটি সেখানে থামে না। কাছাকাছি কোনো স্টেশনে নামতে হবে। আমরা সুপার ফাস্ট ট্রেনে দাঁড়িয়ে থাকার শর্তে টিকিট কাটলাম। আমাদের কয়েকজনের লাগেজ রাখা হলো টয়লেটের সামনে। সামনের বগিটা এসি, পেছনে ক্যান্টিন। আমাদের কামরায় তিল ধারণের ঠাঁই নেই। স্ট্যান্ডিং টিকিট মানে কী, সেটা আমাদের ধারণাতেই ছিল না। আমাদের দু'জন একটি আসন খালি পেয়ে কোনো রকমে কষ্ট করে বসল। এ সময় এলেন টিটি বাহাদুর এবং প্রত্যেককে ৩৭৭ রুপি করে জরিমানা করে দিলেন। চলতে চলতে আমরা দুলছি আর দুলছি। এর মধ্যেই একজন আমাদের বিস্মিত করে দিয়ে তার বার্থ ছেড়ে দিল। আমরা পালা করে শুয়ে সময় কাটিয়ে দিলাম। ট্রেনটা আসলেই ছিল সুপার ফাস্ট। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই আমাদের নামিয়ে দিল রাউরকেল্লা স্টেশনে। আর সাঙ্গ হলো আমাদের দুঃস্বপ্নের কয়েকটি ঘণ্টা।
স্কুলের পরীক্ষায় রচনা থাকে জার্নি বাই ট্রেন। কতই মুখস্থ করতে হয়েছে তখন। এখন মনে হয়, পুরো খাতা ভরে ফেললেও অনেক কিছু থেকে যাবে বলার। কোনো কিছুই মুখস্থ করে উগড়ে ফেলার দরকার নেই। যা দেখেছি, অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ করে দিয়েছে। সবকিছু গেঁথে আছে মনের মধ্যে। যেসব চরিত্রের মুখোমুখি হয়েছি, সবাইকে যেন আপন মনে হয়। এ লেখার সঙ্গের যে ছবিটা, তাকে আবার দেখতে ইচ্ছা করে। জীবন-সংগ্রাম তার মতো আরও অনেকের সোনালি শৈশব কেড়ে নিয়েছে। মানুষের দয়ায় তাকে বেঁচে থাকতে হয়। নিত্যনতুন সাজে সাজতে হয়। তাকে যদি জার্নি বাই ট্রেন রচনা লেখার সুযোগ করে দেওয়া যেত, কী চমৎকার অভিজ্ঞতাই না ফুটিয়ে তুলতে পারত।
ভারতে শিক্ষা সফরে জীবনকে আমরা নতুনভাবে দেখতে পেরেছি। আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল স্থাপত্য বিষয়ে সম্যক ধারণা লাভ করা। কিন্তু পেয়েছি যে আরও অনেক কিছু।
এই না হলে শিক্ষা সফর!

স অর্চি দাশগুপ্ত :স্থাপত্যকলা বিভাগ, বুয়েট

No comments

Powered by Blogger.